বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বৈরাগ্যসঞ্চার

তৃতীয় অধ্যায়
বৈরাগ্যসঞ্চার

 সমগ্র মানবজাতিকে দুঃখ হইতে মুক্ত করিবার কল্যাণকর সুমহৎ ব্রত যাঁহাকে গ্রহণ করিতে হইবে, সংসারের ক্ষণস্থায়ী সুখভোগ তাঁহাকে কেমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিবে? রাজ-অন্তঃপুরের প্রচুর ভোগবিলাসের আড়ম্বরের মধ্যে অবস্থিত হইলেও সিদ্ধার্থ আপনার চিত্তে কখন কখন বাহির হইতে করুণ আহ্বান শুনিতে পাইতেন। জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু নিরন্তর সমস্ত প্রাণীর জীবন দুঃখময় করিয়া রাখিয়াছে; ইহাদের আক্রমণহইতে কি উপায়ে জীবকুল নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে, এই চিন্তা বিদ্যুৎ-স্ফুরণের ন্যায় সময়ে সময়ে তাঁহার মনে উদিত হইত। জীবনের উচ্চ লক্ষ্য ক্ষীণভাবে তাঁহার নিকটে প্রকাশ পাইত। মনের এইরূপ অবস্থায় সিদ্ধার্থকে ভোগবিলাস শান্তিদান করিতে পারিত না। গভীর দুঃখে তাঁহার হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিত।

 একদা বসন্তকালে সিদ্ধার্থের নগরভ্রমণের বাসনা হইল। তিনি পিতার নিকটে নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন। রাজার আদেশে নগর, পত্রে পুষ্পে পতাকায় ও মঙ্গলকলসীতে সুসজ্জিত হইল। সারথি ছন্দককে লইয়া রথারোহণে সিদ্ধার্থ ভ্রমণে চলিলেন। এই সময়ে তিনি প্রথমদিনে পলিতকেশ শিথিলচর্ম্ম কম্পিতপদ জরাজীর্ণ বৃদ্ধ, দ্বিতীয় দিনে শুষ্ক শীর্ণ বিবর্ণ চলৎশক্তিহীন রোগী, এবং তৃতীয়দিনে এক মৃতদেহ দেখিতে পাইলেন।

 চরিত-আখ্যায়কগণ ঐ তিনদিনেব মনোহর বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। উক্ত বর্ণনা পাঠ করিলে ইহা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম হয় যে, জরা ব্যাধি ও মৃত্যুর অপরিহার্য্য দুঃখ এই সময়ে সিদ্ধার্থকে ব্যাকুল করিয়া তুলিয়াছিল; কিন্তু এই সকল অতিরঞ্জিত আখ্যানগুলিকে সর্ব্বাংশে সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না। সিদ্ধার্থ ঊনত্রিশ বৎসর বয়সে গৃহত্যাগ করেন, ঐ সময়পর্য্যন্ত তিনি জরা ব্যাধি ও মৃত্যু সম্বন্ধে শিশুতুল্য অজ্ঞ ছিলেন একথা শ্রদ্ধেয় নহে। তীক্ষ্ণধী ও স্বভাববিরাগী সিদ্ধার্থকে তাঁহার পিতা ভোগসুখে আসক্ত করিবার জন্য এত দীর্ঘকাল জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুহীন প্রমোদলোকে আবদ্ধ করিয়া রাখিতে পারিয়াছিলেন, একথা বিশ্বাসযোগ্য নহে। তবে এই সময়ে এই তিনের রহস্য তাঁহার চিত্তকে গভীরভাবে নাড়া দিয়াছিল, জীবকুলের অপরিহার্য্য অনন্তদুঃখে তাঁহার অন্তর্দ্দৃষ্টির সম্মুখে উদ্ঘাটিত হইয়াছিল, এতদিন কেবল মাঝে মাঝে যে তত্ত্ব তাঁহার মনে আসিত, এক্ষণে উহা চির দিনের জন্য গভীরভাবে তাঁহার হৃদয় অধিকার করিল। গৃহজীবনের সুখভোগ হইতে তাঁহার মন চিরদিনের জন্য ফিরিয়া আসিল। আপনাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করিয়া তিনি জীবের দুঃখমুক্তির উপায় আবিষ্কার করিতে প্রস্তুত হইলেন। এই মঙ্গল ব্রত সাধনের নিমিত্ত তাঁহাকে কি করিতে হইবে, কোন্‌ পথ অবলম্বন করিতে হইবে, এই মহতী চিন্তা তাঁহাকে আবিষ্ট করিল। যখন মনের এইরূপ অনিশ্চিত অবস্থা, সেই সময়ে চতুর্থ দিনে নগরে ভ্রমণকালে প্রশান্তমূর্ত্তি গৈরিকধারী এক সন্ন্যাসী তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাধুর শান্ত সংযত নির্ব্বিকারভাব সিদ্ধার্থকে মুগ্ধ করিল। তিনি স্থির করিলেন, মুক্তির পথ আবিষ্কার করিবার জন্য সংসারের ভোগবিলাস ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসব্রতই গ্রহণ করিতে হইবে। তিনি বুঝিলেন, মহাত্যাগ ভিন্ন মহাকল্যাণ লাভের দ্বিতীয় কোন উপায় নাই।

 সিদ্ধার্থের মনে তুমুল সংগ্রাম চলিতে লাগিল। একদিকে বাহির হইতে ত্যাগের গভীর আহ্বান, অপরদিকে স্নেহময় জনক, স্নেহময়ী বিমাতা ও পতিপ্রাণা গোপার মমতার বন্ধন। তাঁহার আহারে রুচি নাই, নয়নে নিদ্রা নাই, নৃত্যগীতে আসক্তি নাই।

 সিদ্ধার্থের মনে যখন এইরূপ চিন্তার ঘাতপ্রতিঘাত চলিতেছিল, এমন সময়ে একদিন তিনি সংবাদ পাইলেন গোপা একটি পুত্র প্রসব করিয়াছেন। এই সংবাদশ্রবণে তিনি বিন্দুমাত্র আনন্দলাভ করিতে পারিলেন না, পরন্তু গৃহত্যাগের বাসনা তাঁহার মনে বলবতী হইয়া উঠিল।