বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বুদ্ধের বাল্য ও গার্হস্থ্য জীবন

দ্বিতীয় অধ্যায়

——:+:——

বুদ্ধের বাল্য ও গার্হস্থ্য জীবন

 যাঁহার সাধনা পৃথিবীকে নূতন আলোকে উদ্ভাসিত করিয়াছে এবং এককালে ভারতবর্ষের ধর্ম্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-কলা ও স্থাপত্য, সকল বিভাগকে সজীব করিয়া দিয়াছিল, আমরা সেই মহাপুরুষ বুদ্ধের জীবন সংক্ষেপে আলোচনা করিব।

 আমাদের আলোচ্য বুদ্ধদেব—ঐতিহাসিক মহাপুরুষ; সুতরাং সর্ব্বপ্রকার অলৌকিকত্ব ও আতিশয্য বর্জ্জন করিয়া তাঁহার চরিত্রঅঙ্কনের চেষ্টা করিব।

 বুদ্ধদেবের পিতার নাম শুদ্ধোদন, মাতার নাম মহামায়া। অনুমান খৃঃ পূ: ৬২৩ অব্দে কপিলবাস্তুর অদূরবর্ত্তী লুম্বিনীনামক প্রমোদকাননে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তাঁহার জন্ম হয়; কথিত আছে, উদ্যানে বেড়াইতে বেড়াইতে জননী মহামায়া যখন শালতরুর একটি পুষ্পিত পল্লব ছিন্ন করিবার জন্য হস্ত উত্তোলন করিয়াছিলেন, তখন তাঁহার পুত্র প্রসূত হয়। কুমারের জন্মে রাজ্যে সকলেরই অর্থসিদ্ধি হইয়াছিল বলিয়া, শুদ্ধোদন তাঁহার নাম “সর্ব্বার্থসিদ্ধ” (বা “সিদ্ধার্থ”) রাখিলেন। পুত্রপ্রসবের সপ্তমদিনে জননী মহামায়ার মৃত্যু ঘটে।

 পুরবাসীদের কল্যাণকারিণী এবং নৃপতি শুদ্ধোদনের প্রাণতুল্যা মহামায়ার অকাল মৃত্যুতে সকলেই বিষণ্ণ হইলেন; শুদ্ধোদন নবকুমারের মুখ চাহিয়া কোনরূপে পত্নীশোক সংবরণ করিলেন। শিশু সিদ্ধার্থ বিমাতা ও মাতৃষ্বসা গৌতমীর অঙ্কে দিন দিন বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিলেন।

 ভোগ ও সম্পদের মধ্যে প্রতিপালিত হইয়াও সিদ্ধার্থ বাল্যকাল হইতেই গম্ভীর ও সংযত ছিলেন। বালসুলভ চাপল্য তাঁহার ছিল না; বিবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া তিনি সুপণ্ডিত হইলেন। ক্ষত্রিয়োচিত যুদ্ধবিদ্যাতেও তিনি পারিদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন। শাক্যকুলে অশ্বারোহণ ও রথচালনে কেহই তাঁহার সমকক্ষ ছিল না বলিয়া প্রকাশ। উত্তরকালে যে করুণার দ্বারা তিনি সকল মানব ও প্রাণীকে আপনার করিয়া ফেলিয়াছিলেন, বাল্যে ও কিশোরকালেই তিনি তাহার প্রথম আভাস প্রদান করেন। দলের সঙ্গে মিশিয়া তিনি শিকার করিতে যাইতেন বটে, কিন্তু কখনও কোন প্রাণীর প্রাণসংহার করিতেন না।

 এই সময়কার একটি প্রসিদ্ধ আখ্যায়িকা সিদ্ধার্থের জীবপ্রীতির প্রকৃষ্ট পরিচয় প্রদান করে। কথিত আছে, একদা নির্ম্মল বসন্তপ্রভাতে তিনি রাজবাটীর উদ্যানে ভ্রমণ করিতেছিলেন, এমন সময়ে একঝাঁক কলহংস মধুর কলরবে আকাশ মুখরিত করিয়া তাঁহার মাথার উপর দিয়া উড়িয়া যাইতেছিল। সহসা তীরবিদ্ধ হইয়া একটি হংস সিদ্ধার্থের সম্মুখে ভুতলে পতিত হইল। হংসটির শুভ্র বক্ষঃস্থল রক্তে রঞ্জিত হইয়া গিয়াছিল। সিদ্ধার্থ ক্ষণবিলম্ব না করিয়া আহত হংসটিকে কোলে লইয়া তীরটি তুলিয়া ফেলিলেন এবং স্নেহশীতল হস্তে তাহার সেবা করিতে লাগিলেন। পক্ষীটি কেমন বেদনা পাইয়াছে পরীক্ষা করিবার জন্য সিদ্ধার্থ তীরের অগ্রভাগ নিজ হস্তে বিঁধাইয়া দিলেন এবং তদনন্তর সজলনয়নে আবার তাহার সেবায় রত হইলেন। তাঁহার করুণ শুশ্রূষায় পাখী বাচিয়া উঠিল।

 ইহার মধ্যে সিদ্ধার্থের জ্ঞাতিভ্রাতা দেবদত্ত উদ্যানে উপস্থিত হইল। তাহার অব্যর্থ সন্ধানেই হংস ভূতলশায়ী হইয়াছিল বলিয়া সে পাখীটি দাবী করিল। সিদ্ধার্থ বিনীতভাবে কহিলেন “আমি এই পাখীটি কিছুতেই তোমাকে দিতে পারি না, ইহার যদি মৃত্যু ঘটিত, তাহা হইলে তুমিই পাইতে, আমার সেবায় এই পাখীটি বাঁচিয়া উঠিয়াছে, সুতরাং ইহাতে এখন আমারই অধিকার।” এই পাখীর অধিকার লইয়া দুইজনের মধ্যে তুমুল বাদানুবাদ হইল। অবশেষে প্রবীণ ব্যক্তিদের সভায় ইহার বিচার হইল। তাঁহারা বলিলেন “যিনি প্রাণরক্ষা করেন জীবিত প্রাণীর উপর তাঁহারই অধিকার, সুতরাং সিদ্ধার্থই এই পাখী পাইবেন।” সিদ্ধার্থের যে করুণরাগিণীতে একদিন সমগ্র মানবের হৃদয়তন্ত্রী ঝঙ্কৃত হইবে এই ঘটনায় কৈশোরেই তাহার পূর্ব্বাভাস লক্ষিত হইল।

 কপিলবাস্তু নগরে প্রতিবৎসর হলকর্ষণোৎসব হইত। এই দিন রাজা, অমাত্য পারিষদ ও পৌরজনসহ মহাসমারোহে হলচালনা করিতেন। একবার কিশোর সিদ্ধার্থ এই উৎসবে যোগদান করেন। উৎসবমত্ত পুরবাসীদের কলকোলাহলের মধ্যে তিনি একটি জম্বুবৃক্ষের মূলে আসন গ্রহণ করিলেন। তাঁহার গভীর দৃষ্টির সম্মুখে নিষ্ঠুরতার ও হিংসার বীভৎসভাব প্রকাশিত হইয় পড়িল। তিনি দেখিলেন উদরান্ন-সংগ্রহের জন্য প্রখর সূর্য্যকিরণে কৃষকগণ ঘর্ম্মাক্ত-কলেবরে কি কঠোর সংগ্রাম করিতেছে! ক্লিষ্ট বলীবর্দ্দদের সুকোমল অঙ্গে মূহুর্ম্মুহুঃ কি নির্ম্মম আঘাত পড়িতেছে! ইহাদের পদতলে পড়িয়া কত অসংখ্য ছোট ছোট প্রাণী নিহত হইতেছে! এই সকল মৃতদেহ লইয়া পক্ষীদের মধ্যে কি ভীষণ কড়াকড়ি পড়িয়া গিয়াছে!

 সিদ্ধার্থের করুণ আঁখি ধীরে ধীরে নিমীলিত হইয়া আসিল। অসংখ্য নরনারী জীবজন্তুর দুঃখ তাঁহার সুকুমার চিত্ত স্পর্শ করিল। জন্ম মৃত্যুর জ্ঞেয় রহস্য তাঁহার চিন্তার বিষয় হইল। জম্বুবৃক্ষতলে চিত্রার্পিতের ন্যায় তিনি ধ্যানস্থ হইয়া রহিলেন।

 উৎবসান্তে গৃহে ফিরিবার সময়ে কুমারের খোঁজ পড়িল। কিয়ৎকাল অনুসন্ধানের পরে পৌরজনেরা দেখিল তিনি নিম্পন্দদেহে নিমীলিতনেত্রে জম্বুতরুতলে ধ্যানমগ্ন হইয়া আছেন। বিশ্বপ্লাবনী করুণায় উদ্ভাসিত কুমারের দিব্য মুখকান্তি দেখিয়া শুদ্ধোদনের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। বহুক্ষণ পরে ধ্যান ভাঙ্গিলে পিতাকে প্রণাম করিয়া তিনি করুণকণ্ঠে কহিলেন—“পিতঃ, কৃষিকার্য্যে অসংখ্য জীবের প্রাণবিনাশ হয়, এই কার্য্য হইতে আপনি বিরত হউন।”

 পুত্রের গাম্ভীর্য্য ও বৈরাগ্য বিষয়াসক্ত পিতাকে চিন্তিত করিয়া তুলিল। সিদ্ধার্থের মন ভোগসুখের প্রতি আকৃষ্ট করিবার জন্য পিতা তাঁহাকে বিবাহপাশে বন্ধন করিবার ইচ্ছা করিলেন। দণ্ডপাণি-দুহিতা গোপার সহিত কুমারের বিবাহ হইল। তাঁহার উদাসীন চিত্তকে ভোগাসক্তির দিকে লইয়া যাইবার জন্য শুদ্ধোদন প্রত্যহ নৃত্য গীত আমোদ-প্রমোদের বিবিধ ব্যবস্থা করিলেন।

 রূপবতী ও গুণবতী গোপাকে জীবনসঙ্গিনীরূপে লাভ করিয়া সিদ্ধার্থ আপনাকে ভাগ্যবান মনে করিলেন। হিতৈষিণী সাধ্বী পত্নীর সাহচর্য্যে তাঁহার জীবন সুখময় হইল। গার্হস্থ-জীবনের সুখভোগে তাহার জীবনের কিয়ৎকাল কাটিয়া গেল।