বুদ্ধের জীবন ও বাণী/শাক্যবংশ ও শাক্যদেশ
কুশীনগর হইতে কুমায়ুনপর্য্যন্ত ভূভাগ এককালে শাক্যবংশীয় ক্ষত্রিয়দের নিবাসভূমি ছিল; এই প্রদেশের উত্তরে হিমগিরিশ্রেণী তরঙ্গাকারে বিরাজিত, পূর্ব্বে প্রতাপশালী মগধ ও লিচ্ছবিদের রাজ্য, এবং পশ্চিমে কোশল রাজ্য অবস্থিত ছিল। বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত হইয়াছে যে, মগধরাজ নন্দ এক সময়ে ধরা নিঃক্ষত্রিয় করিয়াছিলেন; তাঁহার অভ্যুদয়ের বহুপূর্ব্ব হইতেই ক্ষত্রিয়েরা হীনবীর্য্য হইয়াছিল; দেশের এই দুৰ্গতির দিনে শাক্যের দেশরক্ষার ভার গ্রহণ করেন।
শাক্যরাজ্যের রাজধানী কপিলবাস্তু নগর রোহিণীনামক একটি পার্ব্বতীয় স্রোতস্বিনীর তীরে অবস্থিত ছিল। এই নগরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে। চীন দেশীয় পরিব্রাজকেরা যখন ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন, তাহার পূর্ব্বেই এই নগর বিনষ্ট হইয়াছিল। সুপণ্ডিত কার্লাইল সাহেব ১৮৭৫ খৃস্টাব্দে কপিলবাস্তুর অবস্থান নির্ণয় করিয়াছেন। এই প্রাচীন নগরটি যেস্থানে বিদ্যমান ছিল, উক্তস্থান এখন ভুইলাগ্রাম নামে পরিচিত। গ্রামের সমীপে একটি হ্রদ আছে এবং অনতিদূরে একটি নদী প্রবাহিত। বুদ্ধের জন্মভূমি কপিলবাস্তু বারাণসীধাম হইতে শতাধিক মাইল উত্তরে এবং অযোধ্যা হইতে ২৫ মাইল উত্তরপূর্ব্বে অবস্থিত।
বুদ্ধচরিত-প্রণেতা অশ্বঘোষ বলেন যে, এই স্বভাবসুন্দর নগর এককালে কপিল ঋষির সাধনক্ষেত্র ছিল এবং সেইজন্যই নগরটির নাম কপিলবাস্তু হইয়াছে। অশ্বঘোষের অপর কাব্য সৌন্দরানন্দে কথিত আছে যে, সূর্য্যবংশীয় একব্যক্তি পিতৃশাপগ্রস্ত হইয়া কপিল মুনির আশ্রমে আশ্রয় লাভ করিয়াছিলেন; কালক্রমে তাঁহার বংশধরেরা এখানে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়া রাজত্ব করিতে থাকেন। ইহার শাকবন-বেষ্টিত ঋষির আশ্রমে বাস করিতেন বলিয়া “শাক্য” আখ্যা পাইয়াছিলেন।
শাক্যবংশীয়েরা যে এককালে ভুজবলে ও সমৃদ্ধিতে প্রাধান্য লাভ করিয়াছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ করিবার কোন হেতু নাই। ইঁহারা যে প্রদেশ অধিকার করিয়া বাস করিতেন, তাহার মধ্যে কপিলবাস্তু, শিলাবতী, সক্কর, দেবদহ প্রভৃতি অনেকগুলি সমৃদ্ধ নগরীর উৎপত্তি হইয়াছিল। হলচালন ও পশুপালনই যে রাজ্যের অধিবাসীদের প্রধান উপজীবিকা, সেখানে খুব পাশাপাশি বহু নগর গঠিত হইতে পারে না। সুতরাং সমৃদ্ধিশালী শাক্যরাজ্য যে বহুদূরব্যাপী ছিল, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই।
পুণ্যবান শুদ্ধোদন এই সুবিস্তৃত রাজ্যের রাজা ছিলেন। সাধারণতঃ রাজা বলিতে আমরা যাহা বুঝি তিনি তেমন সর্ব্বশক্তিমান্ ভূপতি ছিলেন না। সগোত্রদের মধ্যে প্রধান ছিলেন বলিয়া, তিনি তাহাদের নায়ক নির্ব্বাচিত হইয়াছিলেন। রাজপদ তখন বংশগত ছিল না; শাক্যেরা তাহাদের নির্ব্বাচিত নায়ককে “রাজা” বলিয়া সম্বোধন করিত।
রাজ্যসংক্রান্ত যাবতীয় কার্য্যের সহিত দেশের যুবা বৃদ্ধ সকলেরই যোগ ছিল। রাজকার্য্যপরিচালনার জন্য কপিলবাস্তু নগরে “সন্থাগার”নামক একটি বিচারশালা ছিল; তথায় সর্ব্বজন সমক্ষে রাজা বা নির্ব্বাচিত দেশনায়ক সাধারণ প্রশ্নসমূহের মীমাংসা করিতেন। একমাত্র রাজধানীতে নহে, প্রধান প্রধান নগরেও “সন্থাগার” থাকিত। পল্লীবাসীরাও নিজদের ছোটবড় প্রশ্নগুলি প্রকাশ্য সভায় মীমাংসা করিত। আম, কাঁটাল, গুবাক, নারিকেলের বাগানে খোলা জায়গায় পল্লীবাসীদের বৈঠক বসিত।
শাক্যেরা ক্ষত্রিয় হইলেও কৃষি ও পশুপালনই তাহাদের প্রধান উপজীবিকা ছিল। হিমালয়ের অদূরবর্ত্তী সমতল ভূভাগে শস্যক্ষেত্রের পাশে পাশে শাক্যদের ঘরগুলি অবস্থিত ছিল। কুম্ভকার, স্বর্ণকার, সুত্রধর প্রভৃতি শিল্পীদের বাসের জন্য স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র গ্রাম নির্দ্দিষ্ট থাকিত। সুবিস্তৃত বনভাগের দ্বারা গ্রামগুলি ব্যবহিত ছিল। কেহ কেহ বলেন, এই সকল অরণ্যে দস্যুরা বাস করিত; কিন্তু তাহাদের উপদ্রবের কোনও বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় না। এই সময়কার গ্রামগুলিকে এক একটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য বলা যাইতে পারে।
গ্রামবাসীরা সরল সুন্দর জীবন যাপন করিত। কেহ ধনী কেহ দরিদ্র এইরূপ অর্থগত বৈষম্য তাহাদের মধ্যে দেখা যাইত না। তাহাদের গ্রাসাচ্ছাদন অল্পায়াসে চলিয়া যাইত—চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল না—আপনাদের পল্লী মধ্যে তাহারা পূর্ণ স্বাধীনতা সম্ভোগ করিত। পল্লীবাসীদের মধ্যে যেমন কেহ প্রবল ভূস্বামী ছিল না, তেমনি নিরন্ন পথের ভিখারীও দেখা যাইত না।
পল্লীবাসীদের সাধারণ সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কোন অভাব ছিল না। তাহাদের দিনগুলি একরূপ অনায়াসেই শান্তিতে কাটিয়া যাইত। কেবল যে বৎসর অনাবৃষ্টি হেতু শস্য নষ্ট হইয়া যাইত সেই বৎসর গৃহে গৃহে হাহাকার ধ্বনি শোনা যাইত। বৌদ্ধধর্ম্ম-গ্রন্থে এরূপ দুর্ভিক্ষের বিবরণ পাওয়া যায়।
পল্লীবাসীদের বাসগৃহগুলি কাছাকাছি সন্নিবিষ্ট ছিল। বিচ্ছিন্ন গৃহের উল্লেখ কোথায়ও দৃষ্ট হয় না। দুইখানি গৃহের মধ্যে একটি অপ্রশস্ত রাস্তামাত্রের ব্যবধান থাকিত।
প্রত্যেক গৃহস্থই কতগুলি গোমহিষাদি পশু রাখিত। এই সকল পশুর জন্য পল্লীবাসীদের সাধারণ একখানি চারণভূমি থাকিত। শস্যক্ষেত্রের ফসল যখন উঠিয়া যাইত, তখন পল্লীবাসীদের গৃহপালিত পশুগুলি ঐ ক্ষেত্রেই চরিয়া বেড়াইত; কিন্তু ক্ষেত্রে ফসল থাকিলে তাহাদের পক্ষ হইতে একব্যক্তি পশুগুলির তত্ত্বাবধানের জন্য নির্ব্বাচিত হইত। সাধারণতঃ বিশ্বাসী ও সুযোগ্য ব্যক্তি উপর এই কার্য্যের ভার অর্পিত। এইরূপ বর্ণিত আছে যে, পশুরক্ষক তাহার প্রতিপালিত পশুর আকৃতি গাত্রের বিশেষ বিশেষ চিহ্ন বলিয়া দিতে পারিত। পশুদের গাত্র হইতে মশক মক্ষিকা প্রভৃতি তাড়াইয়া দিবার কৌশল, ক্ষত আরোগ্য করিবার চিকিৎসাপ্রণালী প্রভৃতি বিষয়ে ইহার বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকিত।
কৃষিকার্য্য-পরিচালনারও মোটামুটি সুব্যবস্থা ছিল। নালী কাটিয়া ক্ষেত্রে জলপ্রদানের ভার পল্লীসম্প্রদায়কে গ্রহণ করিতে হইত। সম্প্রদায়ের নায়ক স্বয়ং ইহার তত্ত্বাবধান করিতেন। কোন ব্যক্তি আপন ক্ষেত্রের চারিদিকে বেড়া দিতে পারিত না; সমগ্র ক্ষেত্রের চতুর্দ্দিকে প্রাচীর দেওয়ার বিধান ছিল। ক্ষেত্রখণ্ডগুলিকে লইয়া সমগ্র ক্ষেত্রের যে আকৃতি হইত, উহা দেখিতে অনেকটা বৌদ্ধ ভিক্ষুর চীবরখণ্ড-তুল্য; উল্লিখিত প্রকার জনপদেই সেকালের ভারতবাসীদের অধিকাংশ বাস করিত; সমগ্র দেশের মধ্যে অতিঅল্পসংখ্যক লোকই নগরে ছিল।