বেল্লিক রামায়ণ/গূঢ় রহস্য ভেদ

মােহিনী কর্ত্তৃক গূঢ়রহস্য ভেদ।

কহিতে মােহিনী তবে করে আরম্ভণ।
শুন শুন অপরূপ এক বিবরণ॥

একটী বনেতে এক শিবা ও হরিণ।
বন্ধুভাবে দুইটীতে ছিল কিছুদিন॥
দুজনেই দুজনেরে ছাড়ি নাহি থাকে।
কত যেন ভালবাসা বাসে এ উহাকে॥
হরিণের বাস্তবিক নাহি গােল মনে।
চূড়ান্ত পিরীতি স্থান পায় তার প্রাণে॥
কোন রূপ ছল কল নাহি জানে সেই।
শৃগালের মনে কিন্তু ছল বই নেই॥
ভালবাসা অভিপ্রায় তাহার না হয়।
কিরূপে খায় যে তারে এই চিন্তা রয়॥
একদিন বলিল সে হরিণেরে ডাকি।
শুন ভাই এক যুক্তি চিত্তে যাহা রাখি॥
বৃথায় সময় কেন করি হে যাপন।
তার চেয়ে করি এস ক্ষেত্রের কর্ষণ॥
বপন করিলে তায় বীজ সময়েতে।
অবশ্য মনের বাঞ্ছা পূরিবে তাহাতে॥
রীতিমত পুরস্কার পাব যথাকালে।
অন্নের চিন্তা ত আর না রবে কপালে॥
আবার অন্নের চিন্তা যদ্যপি না রয়।
কারি বা দ্বারস্থ আর হতে তবে হয়॥
কহিল হরিণ তবে, মহা আনন্দেতে।
বল কোন্ চাষ তবে, হবে আরম্ভিতে॥

এখনি প্রস্তুত আমি আছি ত ইহায়।
বল কোন্ কার্য্য হবে করিতে আমায়॥
সাধ্য যদি হয় তাহা সাধিব এখনি।
তার জন্যে চিন্তা নাহি কর গুণমণি॥
তােমার যা ভাল জ্ঞান সেই মাের ভাল।
তুমি ভাল বলিলেই মাের ভাল হ’ল॥
আমার দোসরা ভাল নাহি ত কিছুতে।
বল একে বল ভাই কি হবে সাধিতে॥”
শৃগাল কহিল, “তব শৃঙ্গ মজ্‌বুত।
মৃত্তিকা চষিতে তব ক্ষমতা অদ্ভুত॥
মনে যদি কর এক দণ্ডের মধ্যেতে।
পার এক বিঘা জমি তুমি হে চষিতে॥
অতএব কর তুমি ক্ষেত্রের কর্ষণ।
যথাকালে বীজ আমি করিব বপন॥
তার পর সেই শস্য পাকিবে যখন।
দুজনে পড়িয়ে তাহা করিব কর্ত্তন॥
তার আর কাজ যাহা তাহাও সাধিব।
তার পর দুই ভাগ সমান করিব॥
দেখিয়ে সকল লােক হবে বড় খুসী।
সেই খুসী দেখিতেই ভাল আমি বাসি॥”
হরিণ বলিল, “এ ত মন্দ কথা নয়।
এই দণ্ডেতেই আমি লাগিব নিশ্চয়॥

যত জমি পাও তুমি লও খাজনা করি।
এ কার্য্যে সন্তুষ্ট আমি আছি ওহে ভারী॥
চষিবার ভার যাহা দিলে তুমি মোরে।
অপারগ কদাচ না হব সেই ভারে॥
অতীব আনন্দে আমি করিব কর্ষণ।
চল ভাই কোথা হবে করিতে গমন॥”
শৃগাল বলিল, “চল, করি তবে চাষ।
চাষের কাজেতে লাভ আছে বারমাস॥
আপাতত ইক্ষুচাষ করি চল গিয়ে।
দেখি পাই কি না লাভ এ চাষ করিয়ে॥”
হরিণ বলিল “ভাল, তাই তবে করো।
প্রথমে আকেরি চাষ ভাল তাই ধরো॥
কত রস কত গুড় পাবো তবে খেতে।
বড়ই আনন্দ মোর আকের চাষেতে॥”
এত বলি জমি-চাষে চলিল হরিণ।
রীতিমত পরিশ্রম কৈল কিছু দিন॥
তার পর শৃগালে বুনিল তাহে আক।
যথাকালে সেই আকে ধরিলও পাক॥
কাটিল সেই সে আক পড়ি দুইজনে।
আধাআধি ভাগ করি লইল এক্ষণে॥
বেবাক গোড়ার দিক রৈল একদিকে।
বেবাক্ ডগের দিক্ রয় আর দিকে॥

পরেতে শৃগাল এই করিল বিচার।
হরিণ খেটেছে বেশী ডগা হবে তার॥
শৃগাল খেটেছে কম অতএব গােড়া।
গােড়ায় কি আছে ছাই খালি ধূলো ঝাড়া॥
সহজে সরল মন হরিণ জাতের।
সহজে বুঝে না অত শত ফারফের॥
হাসি-মুখে সেই সে ডগেরি ভাগ লয়ে।
যায় ঘরে স্ত্রীরে তার দেখায় যে গিয়ে॥
দেখিয়ে স্ত্রী তার রেগে হয় ত আগুন।
“এতখানি দেহ তব বিন্দু নাহি গুণ॥
আকের গােড়ারে ফেলি আন কিনা ডগা
তােমার অদৃষ্টে দেখি আছে ভিক্ষে মাগা॥
সামান্য এটুকু যার নাহিক গেয়ান।
কি কোরে করিতে হয় ভাগ সে সমান॥
তেমন লােকের হয় মরণ মঙ্গল।
নতুবা কাজেতে তার আছেই গরল॥”
“যা হবার হয়ে গেছে” হরিণ কহিছে।
“আর নাহি অকারণ বােকে মর মিছে॥
এবার পুনশ্চ চাষ হইবে যখন।
নিশ্চয় গোড়ারি ভাগ করিব গ্রহণ॥
গোড়ার তরেতে কেন এত কিচিকিচি।
ভুল করিয়েই নয় ডগা লইয়াছি॥

পুনরায় চাষ যদি করিব এবার।
নিশ্চয় ডগাটী নাহি লইব ত আর॥
এবার লইব গোড়া অন্যথা না হবে।
এমন ভুল ত তুমি আর না দেখিবে॥
দেখহ যদ্যপি হেন ভুল পুনর্ব্বার।
কখন মুখ না তুমি দেখিবে আমার॥”
এত বলি শৃগালের কাছে সে হরিণ।
যায় চলি দুঃখমনে পুনঃ সেই দিন॥
বলে, যা ঘটেছে হেথা, বাড়ীতে তাহার।
যেরূপে রমণী তার করে তিরস্কার॥
শৃগাল শুনিয়ে বলে “তার জন্যে কিবা।
আগামী বৎসরে আর না বলিবে হাবা॥
আগামী বৎসরে ধান রোপিব এবারে।
ভাবিতে হবে না আর গোড়া পাইবারে॥
নিশ্চয় এবারে গোড়া দিব ত তোমায়।
যদ্যপি তাহার এত বাসনা গোড়ায়॥”
এই বলি আপাততঃ সবে চুপ চাপ্।
হরিণী হরিণে এবার করিল ত মাপ॥
অতঃপর দ্বিগুণ উৎসাহে পুনর্ব্বার।
ধান্যের চাষেতে মন পড়িল দোঁহার॥
যথাকালে সেই ধান্য সুপক্ক হইল।
আবার কাটিয়ে দোঁহা ভাগ করি নিল॥

ডগা হেতু গতবারে হরিণী বকেছে।
এবার হরিণ ডগা নাহি ত নিতেছে॥
এবার নিশ্চয় গােড়া লইবারে মন।
কাজেই হরিণ করে তাহাই গ্রহণ॥
নিয়ে গােড়া মহানন্দে বাড়ীপানে যায়।
“হরিণী, হরিণী” বলি, ডাকে ঘন তায়॥
হরিণী ছুটিয়ে আসে,—বলে, “কি ব্যাপার।”
হরিণ ধান্যের গােড়া রাখে সাম্নে তার॥
দেখিয়া হরিণী তবে রাগিয়ে আগুন।
বলে, “মিন্স আজি তােরে করিবই খুন॥
এত বােকা তুই যদি কিবা তবে সুখ।
লুকোক্ অচিরে তাের ঐ কালামুখ॥
এমন নির্ব্বোধ যেই বাঁচা বিড়ম্বনা।
সে যেন তিলেক আর বাঁচিয়ে থাকে না॥
বাঁচিলেই দুঃখ তার আছে কপালেতে।
আমিও আর ত জ্বালা পারি না সহিতে॥”
মনোদুঃখে ম্রিয়মাণ হরিণ আবার।
আবার সখেদে যায় কাছেতে সখার॥
সখা বলে “এত যদি তার বাড়াবাড়ি।
কেমনে দুজনে আর তবে বল মিলি॥
আমারে ছাড়িয়ে তুমি থাক তারে লয়ে।
কেমনে বাঁচিবে বল নিত্য হেন সয়ে॥

কিসের বা বন্ধু আমি তা হতে ত নই।
সে যা বলে কর তাই সুখ জান অই॥”
এত বলি বিমুখ শৃগাল তার প্রতি।
হরিণ কাঁদিয়ে পুনঃ করিল মিনতি॥
না ভাই তােমারে আমি ছেড়ে ত দিব না।
থাকিব তােমারি সাথে ঘরে যাইব না॥
তােমার মতন বন্ধু কেবা মাের আছে।
কত ঋণী চিরদিন আমি তব কাছে॥
তােমারে ছাড়িব যদি বাঁচিব কি সুখে।
চল ভাই পালাই আমরা হেথা থেকে॥
কোন এক দূরদেশে চলে চল যাই।
দেখিব তথায় সুখ পাই কি না পাই॥”
শৃগাল বলিল “ভাল, তাতে আমি রাজী।
যেতে বল—যাই নয় এখনি সে আজি॥
আমারো মনেতে এই হয় ত ধারণা।
তা হলে রবে না আর কোন বিড়ম্বনা॥
সেই ভাল যাই চল ওহে বন্ধুবর।
অনতিবিলম্বে কোন দূরদূরান্তর॥
স্ত্রীর কথা শুনিতে না হবে ত তা হলে।
ভাসিব না আর তাহা হলে অশ্রুজলে॥”
এই বলি, দুই বন্ধু না করিয়ে দেরি।
ছাড়িয়ে সে দেশ তবে যায় ত্বরা করি॥

কোথা পাবে ঠিকানা না আছে ঠিক তার।
কেবল ছুটিয়ে পথ হয় আগুসার॥
সারাদিন ছুটে ছুটে সন্ধ্যা ক্রমে হয়।
দেখে সম্মুখেতে এক সরু নালা রয়॥
অতি অল্প জল তাহে পাঁক কিন্তু খুব।
পাঁকেতে একটী প্রাণী হয় প্রায় ডুব॥
লাফাইতে সেই নালা হরিণ তখন।
দেহভারে সেই পাঁকে হইল পতন॥
কিছুতে হরিণ নাহি পারয়ে উঠিতে।
কাতরে বন্ধুরে ডাকে উদ্ধার করিতে॥
বন্ধু বলে “একা আমি কি করিতে পারি।
ডেকে আনি কাহারেও কর কিছু দেরি॥”
এত বলি দূরে এক চাষা যেতেছিল।
তাহারে অচিরে এই সংবাদ দানিল॥
বলিল “হে চাষা ভাই হরিণ ছট্ ফট্।
পাইবে শীকার যদি এস ঝট্ পট্॥”
চাষা বলে “আরে আরে কি বলিস্ বাণী।
হরিণ ছট্ ফট্ করে কোথায় এমনি॥
সত্য কি অসত্য মােরে ত্বরা করি বল।”
“সত্য অতি, নহে মিথ্যা” শৃগাল কহিল॥
অতঃপর সে চাষারে সঙ্গেতে লইয়ে।
উপস্থিত হয় সেই নালাধারে গিয়ে॥

লাঠি মারি হরিণেরে মারি ফেলে চাষ।
ফুরাইল হরিণীর যতেক ভরসা॥
শৃগাল চাষার সঙ্গে যায় তার বাড়ী।
অংশের কারণে সেই মাংসের উপরি॥
নহেক সামান্য কিন্তু সেই চাষ হয়।
কাটিয়ে বেবাক্ মাংস আপনি সে লয়॥
একটুকু হাড় মাস তারে নাহি দিল।
বন্ধুহত্যা-পাতকের ভাগী শুধু হলো॥
যে যেমন পাজী তার শাস্তিও তেমন।
মিথ্যা নহে এক বর্ণ জেনো মনে মন॥
বিশ্বাসঘাতক অই পাজী অতিশয়।
দু’তরফে বিশ্বাস ভেঙ্গেছে সমুদয়॥
বন্ধুর ঘরেতে চুরি আমার কারণ।
তার পর টেঁকে পুন তোমার মরণ॥
এমন জনেরে আমি নাহি ভালবাসি।
জানিও এজন কভু নহেক বিশ্বাসী॥
হাজার হলেও আমি পালিতা বেশ্যার।
কোন্ তুচ্ছ ওর বুদ্ধি কাছেতে আমার॥
যদি ওর নিতে মোরে না ছিল ভরসা।
কেন মোরে অনর্থক দিল তবে আশা॥
তোমার নিকট হতে অর্থ-কামনায়।
করিল এ কার্য্য তুমি বলেছ আমায়॥

নিশ্চয় আবার কিছু কল করিয়াছে।
তেঁই এ সংবাদ দুষ্ট তােমারে দিতেছে॥
পুলিস-ফুলিশ সব মিথ্যা সে জানিবে
পুলিস যদ্যপি সেই হেথা পাঠাইবে॥
উহারে জানাবে কেন কি গরজ তার।
বুঝ না ত শত্রু অই হয় যে তােমার॥
ঐ যে করেছে চুরি সেদিন আমারে।
এ ধারণা হয়েছেই রাজার অন্তরে॥
সুহৃদ্ কখন ওরে নাহি করে জ্ঞান।
সকলি ছলনা ওর সকলি সে ভান॥
এসেছে আবার কোন খেলা খেলাইতে।
কোনমতে কোন দিকে ফাঁকি কিছু দিতে॥
অতএব সাবধান রাখিয়ে উহারে।
গোপনেতে চল মােরা যাই অন্যস্তরে॥
পরে সেইমত দর্পে বসায়ে বেল্লিক
লইয়ে মােহিনী ধনে সরে যায় ঠিক॥
পার্শ্বের একটি গ্রামে লুকাইয়ে রয়।
দর্পের সন্ধান আর নাহি যাতে হয়॥
ধন যার আছে তার কিসের ভাবনা।
একটি দণ্ডেই সব ঘুচিল যন্ত্রণা॥
যেমন যাইল সেই পার্শ্বের গ্রামেতে।
অমনি একটি বাসা মিলে মুহূর্ত্তেতে॥

ধনে মুখ বন্ধ করি সে বাড়ীওয়ালার।
রহিলেক আপাততঃ নিকটে তাহার॥
আর এই সঙ্গে এক পত্র ত লিখিল।
সেই পত্র অবিলম্বে বাড়ী পৌঁছাইল॥
পত্রে লেখা, “ভেবো নাকো অয়ি অভাগিনী।
বেশী দিন আর নাহি রবে একাকিনী॥
অনতিবিলম্বে তোমা আনিব এখানে।
কিঞ্চিৎ ভাবনা নাহি করো সে কারণে॥
ঠিকানা আমার নাহি হইল লিখিত।
সে কারণে কদাপি না হইবে চিন্তিত॥
বিশেষ কারণে কোন না লিখি ঠিকানা।
সে কারণ মনে অভিমান করিও না॥
অচিরে তোমার সঙ্গে হইবে সাক্ষাৎ।
মান করি পরাণে না দিবে ত আঘাত॥”
পত্র সেই অবিলম্বে গিয়ে পঁহুছিল।
পত্র পেয়ে অভাগিনী অবাক্ হইল॥
বেল্লিকের রামায়ণে বেল্লিক সকলি।
পাঠেচ্ছায় জ্ঞানী মাত্রে হয় কুতূহলী॥
এমন রসাল গ্রন্থ বিশ্বে নাই আর।
সুধার সমুদ্র যেন-রস-পারাবার॥