জেলে দর্প।

ভাবিতে লাগিল দর্প, কেমন করিয়া।
করি তায় জব্দ আমি,—পড়ে হাঁ করিয়া॥
যেমতি ব্রাহ্মণে ফাঁদ জব্দ করি দিল।
সেইমত জব্দ করা উচিত যে হৈল॥
উত্তম মধ্যম শিক্ষা দিতে আমি চাই।
নতুবা প্রাণের জ্বালা শান্ত হবে নাই॥
করিল চাতুরী এত সঙ্গেতে আমার।
আমি কি সহজে তারে দিইব নিস্তার॥
দেখিব কেমন সেই চালাক শিয়ান।
কেমনে আমার হাতে বাঁচায় পরাণ॥
এত বলি নীরবে চিন্তয়ে মনে মন।
কেমনেতে বেল্লিকের বধে সে জীবন॥
অথবা ফেলায় কোন মহা কার-ফেরে।
যাহে দফা রফা তার হয় শীঘ্র কোরে॥
পুলিস এদিকে তারে দিয়ে হাতকড়ি।
লয়ে যায় জেলে দিতে হিঁছড়ি পিছড়ি॥

বিচারেতে যথাকালে জেলে দর্প গেল।
জেলেতে বসিয়ে চিন্তা করিতে লাগিল॥
“কে সহায় এ সময় হইবে আমার।
এ বিষম জেলদায়ে যে করে নিস্তার॥”
অদৃষ্টে থাকিলে কিবা না পারে হইতে।
অচিরে সহায় এক মিলে আচম্বিতে॥
জাল-ছেঁড়া পোলো-ভাঙ্গা ছিল একজন।
সেই সে গারদ-মাঝে অমূল্য রতন॥
নামটি নীরেটরাম, বাড়ী সহরেতে।
ভয়ানক দাঙ্গাবাজ প্রসিদ্ধ দাঙ্গাতে॥
দাঙ্গার কারণে সেই জেলেতে আইল।
একটি বৎসর তরে গারদ হইল॥
জেলেতে আইল বটে, কিন্তু এক কথা।
এমনি সে রাশ ভারী—সদা উঁচু কথা॥
কার সাধ্য সাম্নে তার কথা দুটো কয়।
দৃষ্টিমাত্রে তারে করে সকলেতে ভয়॥
বিষম মানুষ সেই, বিষম আকৃতি।
বিষম আবার অতি সেই সে প্রকৃতি॥
জেলেতে এসেও হেন ভাব সে দেখায়।
বুঝি ক্রোধ হলে তার কে কোথায় যায়॥
সকল লোকেই হেথা ভয় তারে করে।
পাছে কোন ছলে সেই প্রাণে কারে মারে॥

যদি কটমট চক্ষে কোনদিন সেই।
চাহে কারাে পানে তরে রক্ষা আর নেই॥
অমনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে ভূমিতলে।
“রক্ষা কর” “রক্ষা কর” সঘনেতে বলে॥
কি দারােগা কিবা অন্য যে কেহ যেখানে।
সবাই তাহারে একটা মহাগুণী মানে॥
নামমাত্র জেলে সেই করিতেছে বাস।
রাজসেব্য আহারাদি পায় বার মাস॥
যখন ফাঁকায় যেতে মন তার হবে।
আছে আজ্ঞা দারােগার ফাঁকায় সে যাবে॥
এই সে ব্যক্তির সনে দর্প ভাব করে।
কত আশা দয়া করি সে দিল দর্পেরে॥
ছিল যথা বেল্লিকের রমণী এক্ষণে।
জানিত তা এই ব্যক্তি প্রকাশে বচনে॥
বলিল দর্পেরে, “শুন হে দর্পনারাণ।
আছে জানা আমার তা সেবা কোন্ স্থান॥
যে নাম বলিলে তুমি সে নামে রমণী।
এমনি গঠন বটে, আছে এক জানি॥
সেও এইমত হেথা আছে লুক্কায়িত।
তােমার বেল্লিকনারী গুপ্ত যেইমত॥
না হয় একদা বল আনি দেখাইয়ে।
বিশ্বাস করিও পরে স্বচক্ষে দেখিয়ে॥”

বলা অবশ্য বাহুল্য, দর্প সব কথা।
যা যা তার অভিপ্রায়—তাবৎ বারতা॥
বলিয়াছে ইতিপূর্ব্বে নিরেটরামেরে।
তেঁই সে নিরেট তারে হেন উক্তি করে॥
বলে সে নিরেটরামে মিনতি করিয়ে।
“বড় দাগ বেল্লিক হে দিছে এ হৃদয়ে॥
অতএব তারে আমি দাগা দিতে চাই।
কিছু শান্তি তবে আমি হৃদে যদি পাই॥
তার স্ত্রীরে লুকাইয়ে রাখিব যে আমি।
পার না কি সহায়তা করিবারে তুমি॥”
এত বলি রূপ রঙ ধরণ ধারণ।
সেই সে নারীর সব করিল বর্ণন॥
বলিল, “কোথায় কিন্তু আছে যে এক্ষণে।
তাহা কিন্তু নাহি জানি, আছে গুপ্ত স্থানে॥”
শুনিয়ে নিরেট কহে, “শুন সমাচার।
কোথা আছে সে রমণী জানা তা আমার॥
যেথা মোর বাড়ী ঠিক তাহারি পাশেতে।
এইমত নারী এক রহে লুক্কায়িতে॥
চল দেখি মোর সাথে আজি নিশিযোগে।
দেখাইয়ে দিব আমি কোন যোগেযাগে॥
সেই যদি হয় এই যারে দেখাইব।
অবশ্য হরণ করি আনি তোমা দিব॥

কিন্তু এক কথা তোমা হইবে বলিতে।
সমানে সমান বিনা পারে না মিলিতে॥
আমি নিজে মাতৃভক্ত নহি কদাচন।
তব মাতৃভক্তি কথা করত বর্ণন॥
যদ্যপি সমান হয় দুয়ের ব্যাভার।
তবে ত মিলিতে পারি সঙ্গেতে তােমার॥
আমার ভক্তির কিছু দিই পরিচয়।
প্রথমত তুমি তাহা শুন সমুদয়॥
হাড়ে হাড়ে চটা আমি মাতার উপরে।
ইচ্ছা নখে ছিঁড়ে আমি ফেলি যে তাহারে॥
আমার ছিল যে নারী, তাহার সহিত।
করিত কলহ মাগী সদা বিপরীত॥
কিন্তু কি করিব আমি নামের প্রত্যাশী।
ছিলাম অত্যন্ত,—সদা নাম-অভিলাষী॥
পাছে দশজনে মন্দ বলয়ে আমায়।
তেঁই স্পষ্ট কিছু আমি না কহি তাহায়॥
অতঃপর একদিন করিনু এমন।
বুঝিতে পারিল মাগী এ কেমন ধন॥
একদা ঝগড়া করি, আসিয়ে কাছেতে।
যখন বাহির হতে আইনু বাড়ীতে॥
আস্তে ব্যস্তে এসে ধেয়ে আমারে কহিল।
‘ওরে ধন এ আমার কি ভাগ্য হইল॥

বউ মােরে করিতেছে বড় অপমান।
কিঞ্চিৎ নাহিক তার লঘু গুরু জ্ঞান॥
যাচ্ছে-তাই সদা সেই বলিতেছে মােরে।
বল দেখি প্রাণ আর ধরি বা কি কোরে॥
আমার ছেলের বউ না মানে আমায়।
এ হতে দুঃখের আর কিবা আছে হায়॥
তুই না চাহিলে মুখ, কোথা আমি যাব।
নিশ্চয় আজি রে প্রাণ আমি তেয়াগিব॥’
শুনেই অঙ্গ ত মাের জ্বলে যেন গেল।
কিন্তু স্পষ্ট কোন কথা বলা না হইল॥
কেন না সবাই জানে ‘মাতৃভক্ত’ বলি।
অকারণ কেন আর এ দুর্নাম তুলি॥
ভেবে চিন্তে সদুপায় করিলাম এই।
কৌশলে শিখাতে কিছু হবে অচিরেই॥
বলিলাম, ‘শুন গো মা, যেমন ও পাজী।
শিখাইয়ে দিব ওরে সমুচিত আজি॥
স্ত্রীলােকের গায়ে হাত দানিতে ত নাই।
হাতে না মারিয়ে ইচ্ছা ভাতে মারি তাই॥
দিও না উহারে আজি খাইতে কিঞ্চিত।
নিশ্চয় হইবে আজি ভাতেতে বঞ্চিত॥
ভাতের মারার চেয়ে নাহি মার আর।
ভাতেতে মারিব তাই শুন মা আমার॥’

তিথি সেইদিন ঠিক দশমী পড়িল।
পরদিন একাদশী অবশ্য আছিল॥
মাগী বলে, ‘“ওরে বাবা এ কেমন হবে।
বউ না খাইলে, তোর মা কেমনে খাবে॥
উপবাসী রাখিয়ে উহারে কেমনেতে।
অন্ন দিব বল দেখি আমি বা মুখেতে॥
এ ত পুত্রবধূ এর তুল্য কেহ নাই।
অন্য কেহ হইলেও খাইতে কি পাই॥
একজনে উপবাসী রাখি বাড়ী মাঝে।
কদাপি মুখেতে অন্ন দানিতে কি আছে॥
তাই বলি হেন পণ না করিস্ বাপ।
তার চেয়ে এ যাত্রায় কর ওরে মাপ॥
দুইদিন পিঠোপিঠি উপবাসী রব।
কেমনে আমি বা তবে জীবন ধরিব॥
এ বুড়ো বয়সে আর উপোস কি সয়।
সহজে উঠিলে মাথা ঘুরিয়ে পড়য়॥’
কহিলাম আমি, ‘মাগো কহেছি অটল।
এ কথা কি হতে পারে কভু চলাচল॥
কি রবে কথার দর তা হলে আমার।
যেই কথা সেই কাজ শুন মা আমার॥
করিয়ে প্রতিজ্ঞা যেই না পারে রাখিতে।
তাহার মতন পাপী নাহি ভুবনেতে॥

অতএব বলেছি যা তাই ঠিক হবে।
কিছুতে আজিকে ভাত ওরে নাহি দিবে॥
একদা এরূপ যদি ঘটে কভু আর।
না করিবে ঝগড়াদি সঙ্গেতে তােমার॥
অত্যন্ত বেড়েছে বাড় কসা কিছু চাই।
আছিল শিখাতে কিছু বাসনা সদাই॥
এতদিন হয়নিকো সুবিধা তাহার।
যা হােক হইয়া গেল কিছু এইবার॥
অধিক আমারে আর না কিছু বলহ।
না হয় তুমিও কিছু সঙ্গে ওর সহ॥’
শুনিয়ে তখন মাতা কি করিবে আর।
উপবাসী রহিল করিয়ে হাহাকার॥
এদিকেও স্ত্রী আমার রহে অভিমানে
কতই না গালি সেই পাড়ে মনে মনে॥
সকালে প্রত্যহ সেই জল কিছু খেত।
অবশ্য এ সব কথা ছিল মাের জ্ঞাত॥
জানি কোনরূপে দিন সে পারে কাটাতে।
মাগী কিন্তু দুইদিন রবে উপােসেতে॥
একবিন্দু জল নাহি খেয়েছে এখন।
খাবেও যে একবিন্দু আশা নেই কোন॥
কাটিল সমস্ত দিন ঝাড়া উপবাসে।
ভাবে খালি ‘কহিনু কি কথা সর্ব্বনেশে॥

উপবাসী রহিতে হইল দশমীতে।
কালি পুনঃ একাদশী না পাবে খাইতে॥
হায় হায় ঝক্‌মারি কম কি হইল।
বধূরে শিখাতে গিয়ে নিজ শিক্ষা ভাল॥’
এইরূপে ভাবে আর কান্দে শুয়ে শুয়ে।
বিষম পেটের জ্বালা রহে মাগী সয়ে॥
আছিল কনিষ্ঠ এক বাড়ীতে আমার।
মাতারে খাইতে সেই কহে বারবার॥
মাতা কিন্তু বুড়ো মাগী খাইবে কেমনে।
কিঞ্চিৎ লজ্জা ত তার আছে মনে জ্ঞানে॥
কহিল, ‘বউ-মা উপবাসেতে রহিল।
আমার খাওয়া কিরে হয় ইথে ভাল?’
সে কহিল, ‘উপবাস বউ কি করিবে।
নিশ্চয় খাবার আনি দাদা তারে দিবে॥
তাহা ছাড়া খেয়েছে সে কিছু সকালেতে।
অনায়াসে সোমত্ত বৌ পারিবে রহিতে॥
নিশ্চয় মরিবি তুই বুড়ী গো মা প্রাণে।
বিশেষতঃ একাদশী কালিকার দিনে॥’
মাগী কহে, ‘হয় হোক যা আছে কপালে।
খাইতে কদাপি কিছু পারি না তা ব’লে॥
কি বলিবে দশজনে শুনিলে এ কথা।
কচি মেয়ে উপবাসী আমি খাব হেথা॥’

এত বলি সারাদিন উপবাসী রয়।
আমি না গৃহেতে আর হইনু উদয়॥
যতক্ষণ দিনমান রহিল গগনে।
ফাঁকে ফাঁকে ততক্ষণ ফিরিনু সে দিনে॥
অতঃপর সন্ধ্যা হলো—হলো অল্প রাত।
আসিনু বাড়ীতে দ্বারে করিনু আঘাত॥
আসিবার কালে পথ হতে নানাবিধ।
খাবার কিনিয়ে আমি এনেছি বিবিধ॥
কচুরি সিঙ্গেড়া লুচি পুরি নিম্‌কি গজা।
মতিচুর পানতুয়া রসগোল্লা খাজা॥
তরকারী ভাজিভাজা তার আলুর দম।
একটি চাঙ্গারী ঠাসা গরম গরম॥
দ্বারেতে আঘাত করি ‘ওগো ওগাে’ বলি।
কতক্ষণে দেয় দেখা প্রাণের পুতুলি॥
অভিমানে গর্‌গরে কথা নাহি কয়।
হায় তার সেই কষ্ট আমার কি সয়॥
চরণে ধরিয়ে তবে কহিলাম তারে।
‘ক্ষমা কর নিজ গুণে প্রেয়সি আমারে॥
এই দেখ কতবিধ এনেছি খাবার।
টপাটপ খও প্রিয়ে যা ইচ্ছা তােমার॥
দেখ ভেবে চিন্তে তুমি কিবা দোষী আমি।
কেন মম ’পরে রাগ কর মিছা তুমি॥

কিঞ্চিৎ দোষ ত আমি করিনিকো পায়।
যদ্যপি করিয়ে থাকি ক্ষমহ আমায়॥
খাও প্রিয়ে দয়া করি কিঞ্চিৎ খাবার।
দেখিয়ে শীতল প্রাণ হউক আমার॥
তুমি মাের ধ্যান জ্ঞান—তুমি মাের সব।
তােমা ছাড়া কিবা মাের আছে বা বিভব॥’
প্রেয়সী কহিল তবে, ‘যাও যাও যাও।
আর কেন মিছে অঙ্গ এরূপে জ্বালাও॥
তােমার যা ভালবাসা জেনেছি তা ভাল।
ভাতেতে মারিতে চাও এত রাগ হ’ল॥
তার চেয়ে প্রাণে মার ঘুচিবে আপদ।
কোনদিকে কোন আর রবে না বিপদ॥
বড়ই চক্ষের শূল হইয়াছি আমি।
আমি মরি পুনঃ বিয়া কর গিয়া তুমি॥
নূতন ছুক্‌রী মাগ হইবে আবার।
কতমতে মনােবাঞ্ছা পূরাবে তােমার॥
এনেছ খাবার খাও আপনি এক্ষণে।
করেছি আমিও পণ রব অনশনে॥
রব ততদিন, যতদিন নাহি মরি।
মরণ কামনা এবে হয়েছে আমারি॥
এত বড় কথা তব ভাতেতে মারিবে।
ভাল ভাল তব ভাত কেবা আর খাবে॥

দুটো পেটে খেতে দাও, তাই এত জারি।
কে কার খা(ও)য়ার কর্ত্তা বিনে সেই হরি॥
ভাল আর নাহি খাবো দেখি কিবা হয়।
খা(ও)য়ায় হরি কি তুমি, জানিব নিশ্চয়॥’
কহিলাম পুনঃ তার ধরিয়ে চরণ।
‘ক্ষমা কর নিজ গুণে ভাবি হীনজন॥
ভাতেতে মারিব সত্য বলিয়াছি বটে।
কিন্তু প্রিয়ে এ ত নহে ভাত কোনমতে॥
বাজারের খাবারে মারিব বলিনি ত।
বাজারের খাদ্য কেন না হবে ভক্ষিত?
লুচিতে মারিব হেন কভু কি বলেছি।
পুরিতে মারিব তাও বলিয়ে কি দিছি॥
কচুরি সিঙ্গেড়া কিবা করে অপরাধ।
সে ত পারে মিটাইতে উদরের সাধ॥
পানতুয়া সন্দেশে কি বলেছি মারিব।
এ সকল কেন নাহি খাইতে বলিব॥
মতিচুরে মারিব ত কভু বলি নাই।
রসগোল্লা কেন নাহি খাবে বল ভাই॥
গরম আলুর দম খেতে কিবা দোষ।
খাও প্রিয়ে দয়া করি, পরিহর রোষ॥’
বলিতে বলিতে এইরূপ ক্রমাগত।
পেলাম প্রিয়ার মন খেতে বসিল ত॥

মা মাগী দেখি না হেনকালে উপস্থিত।
বলে, ‘আহা কষ্ট বউ পায় যথোচিত॥
এনেছ খাবার দেখে হইলাম খুসী।
দুঃখী তাহে নহি আমি আছি উপবাসী॥’
কহিনু মাগীরে, ‘বোয়ে গেছে দিনমান।
দিনে খেতে নাহি দিব এই ছিল পণ॥
দিন গেছে, খেতে আর দিতে কিবা মানা।
তা ছাড়া নহেক ভাত—মিঠাই এ নানা॥
মিঠাই খাইতে কিছু দোষ ত মা নাই।
মিঠাই খাইতে আমি দিছি এবে তাই॥’
মাতৃভক্তি দেখে মাতা হইল অবাক।
তোমার কি কথা বল লেগে যাক্‌ তাক্॥”
বেল্লিকের রামায়ণ অতীব রসাল।
যে পড়ে ফুটিবে তার হাসি একগাল॥
এমন মজার গ্রন্থ না আছে দ্বিতীয়।
কিবা ধনী, কি নির্ধনী—সকলের প্রিয়॥