বেল্লিক রামায়ণ/নালিশী হাঙ্গামা (কলেজে নলেজ)

তৃতীয় কাণ্ড।

নালিশী হাঙ্গামা—কলেজে নলেজ।

না দেয় আতর টাকা আর ত এখন।
এখন দিতেছে ঋণ অন্য কোন জন॥
টেকচাঁদ শেঠের সে হয় ত বান্ধব।
টেকচাঁদ ব্যাপার যা বলিয়াছে সব॥
তাহাতেই বুঝেছে সে, অভারাম তারে।
কিছুতে টাকা ত নাহি দিবে পুনঃ ফিরে॥
সুতরাং নালিশ সে করে নামে তার।
ঋণদায়ে অভা তবে যায় কারাগার॥
সেথায় থাকিয়ে অভা মরে যে জেলেতে।
দুঃখিনী অভার পত্নী ভাসে অকূলেতে॥
সংবাদ পৌঁছিল গিয়ে বৈবাহিক স্থানে।
“বৈবাহিক বন্দোবস্ত করুন্ এক্ষণে॥
নিতান্ত অভদ্র নহে সেই বৈবাহিক।
ত্বরায় উপায় তিনি করিলেন ঠিক॥
যাহা কিছু সাংসারিক খরচ তাঁদের।
সকলি দিবেন তিনি সহ আনন্দের॥

অধিকন্তু দিতেছেন তিনি বরাবর।
অবগত সকলি সে হবে অতঃপর॥
বেল্লিক এণ্ট্রান্স পাশ দিল এইবার।
শ্বশুরের মনে জন্মে আনন্দ অপার॥
মনের আনন্দে তিনি পাঠান যে টাকা।
কিছুতে মনেতে তার নাহি জন্মে ধোঁকা॥
আশাই এ দুনিয়ার একমাত্র বল।
আশাতেই বাঁচে যত মানুষ সকল॥
আশাতেই বৃহচ্চক্ষু দেয় যত টাকা।
আশাতেই তাহারে বানাইল বোকা॥
কলেজে নলেজ্ ক্রমে পায় সে জামাতা।
দ্বিগুণ উৎসাহে টাকা পাঠান্ ত হেথা॥
কপালে আগুন কিন্তু লাগিল যে তার।
শুকাতে আরম্ভে তার তরু যে আশার॥
দিন দিন বেল্লিকের হয় নীচ মতি
লুকায়ে লুকায়ে বেশ্যালয়ে করে গতি॥
মায়েরে পীড়ন করি টাকা কাড়ি লয়।
মা যদি বলেন কিছু প্রহার করয়॥
জননীরে কহে “আরে, পাপিষ্ঠা জননী।
নাহি জান কার টাকা খাইতেছ তুমি॥
এই যে পাঠায় টাকা শ্বশুর আমার।
বল দেখি পাঠান্ এ নিমিত্তে কাহার?

তােমাদের শাের-পেটে খাবার যােগাতে।
নিশ্চিত দেন না তিনি জানিহ মনেতে॥
আমারে রাখিতে সুখে বাসনা সদাই।
পাঠাইয়ে টাকা মোরে দেন তিনি তাই॥
আমার টাকায় আমি করিব যা খুসী।
কি সাধ্য বকিস মােরে তুই বেটী দাসী॥
লজ্জা নাহি হয় মনে একটুও তাের।
হেন ভাবে ফাঁকি দিয়ে খেতে টাকা মাের॥
মাের বিদ্যে শিখিবার খরচ যা আসে।
সেই টাকা তুই কি না দিস্ নিজ গ্রাসে॥
আগুন লাগে না তাের অমন পেটে কি।
গলাতে লাগাতে ফাঁসি দড়ি জোটে না কি॥
না হয় দিতেছি আমি কিনিয়ে আপনি।
মর গিয়ে গলে দড়ি দিইয়ে এখনি॥
সকল আপদ শান্তি হইবে আমার।
তােমারো ঘুচিবে জ্বালা দুঃখে পাবে পার॥
বড়ই পাপিনী তুমি জানিয়াছি আমি।
এত কষ্ট কেনই বা নাহি পাবে তুমি॥
তােমারে বিবাহ করি বাবা সর্ব্বস্বান্ত।
অবশেষে জেলে গিয়ে হয়েন প্রাণান্ত॥
চার পাঁচ ছেলে আরাে রয়েছে ত তাের।
তাহাদের নে না টাকা কেন নিস্ মাের॥

যদি এ বলিস, টাকা কোথা তারা পাবে।
দে না কেন তাহাদের বিয়ে, টাকা হবে॥
সাফ্ কথা বলিতেছি তোমারে গো আমি।
আজ হতে নিজ পন্থা দেখ গিয়া তুমি॥
আমার ও টাকা হতে যদি তুমি খাবে।
নিশ্চিত একটি চড়ে প্রাণ তব যাকে॥
বেঘোরে যদ্যপি প্রাণ না হারাতে চাও।
এই বেলা যে যাহার পথ দেখে নাও॥
নতুবা বাধাব আমি কাণ্ড সে তুমুল।
কেন বল কেলেঙ্কারি হবে হুলস্থূল॥”
শুনিয়ে পুত্রের বাণী জননী অবাক্‌।
ভ্যাবাচ্যাকা লাগে যেন হয়ে যায় তাক্॥
বলে “হ্যাঁরে হতভাগা সন্তান আমার।
এই কি উচিত কথা হইল তোমার॥
ধিক্ ধিক্‌ শত ধিক্ আমার জীবনে।
নতুবা এমন পুত্র হবে কি কারণে॥
পুত্র কয় জননীরে হেন কুবচন।
মোর চেয়ে হতভাগী আছে কোন্ জন॥
ভাল, আর না খাইব টাকাতে তোমার।
ভাল শুধিলি রে ধার অভাগী মাতার॥
আমি যে পাপিষ্ঠা তার কিছু ভুল নাই।
নতুবা কি, হেতু বল্ এত কষ্ট পাই॥

অবধি কষ্টের নাহি রহিল আমার।
সমুদ্রপ্রমাণ কষ্ট চৌদিকে বিস্তার॥
নাহি জানি কেমনেতে পার পাব ইথে।
নাহি জানি কত আরো আছে কপালেতে॥
হয় ত তুই রে ক্রমে এত বদ্ হবি।
জুতায় ছিঁড়িয়ে মুখ তুই মাের দিবি॥
তা হলেই চূড়ান্ত সে হইবে দুঃখের।
অথবা তাতেও শেষ না হবে ক্লেশের॥
পথে পথে গালি খেয়ে বেড়াইতে হবে।
যাহার যা খুসীমােরে তাই বােলে যাবে॥
তুই সে পেটের ছেলে এমন যখন।
অন্য পরে বলিবে কি আশ্চর্য্য এমন॥
সকলি সম্ভবপর এ মাের কপালে।
যা আছে নিশ্চয় তাই হবে পােড়া ভালে॥
দশমাস দশদিন ধরিনু জঠরে।
এত কষ্ট সহি, হায় আমি যে তােমারে॥
কিবা ফল পাইলাম তাহার বা আমি।
এরূপেতে জ্বালা যদি নাহি দাও তুমি॥
সার্থক তােমারে বাবা ধরিয়াছি পেটে।
তেঁই সে শুনাও তুমি হেন মিঠে মিঠে॥
শীতল হইল অঙ্গ বাছা রে আমার।
পুত্র বিনা কে শুনায় এত সাধ্য কার্॥

ভাল, যাহা ইচ্ছা তুমি কর বাছাধন।
নিশ্চিত অন্যত্র আমি করিব গমন॥
ভিক্ষা করি তােমার পিতায় খা(ও)য়ায়েছি।
ভিক্ষাধনে তােমাদের মানুষ করেছি॥
এবে বড় হইয়াছ তুমি রে বাছনি।
অবশ্য করিয়ে ভিক্ষা খাইবে জননী॥
কিবা মান অপমান আমার আছয়।
যার মান সে রাখে নি, তবে কিসে ভয়॥
এখন তােদের মানে আমি সে মানিনী
তােরা যদি না মানিস্ কি তাহে কাঁদুনি॥
স্বচ্ছন্দে করিয়ে ভিক্ষা উদর পূরণ।
পারিব করিতে আমি চিন্তা কি এমন॥
থাক তুমি টাকা লয়ে, লইয়ে শ্বশুর।
তুমি রে পাপিষ্ঠ পুত্র, পুত্র না শত্তুর॥
এই চলিলাম আমি লয়ে এ সকলে।
যে দিবে আশ্রয় আমি যাব তারি স্থলে॥
এত বড় দুনিয়ার সব গরু নয়।
মানুষ কেহ না কেহ আছয়ে নিশ্চয়॥
তুই খেতে নাহি দিস, খেতে কি না পাব।
ঈশ্বরের রাজ্যে আমি কি হেতু ভাবিব॥
সুখে কেটে যাবে দিন তুই রে দেখিবি।
দেখিয়ে অবাক্ হয়ে গালে হাত দিবি॥

মনে যা ভাবিস্ তুই, নিশ্চয় তা নয়।
সবাকার অন্নদাতা সেই জন হয়॥
সে বিনে কেহই কারে না দেয় খাইতে।
মানুষ মাত্রেই খায় তাঁহার কৃপাতে॥
ছােট ছােট ভাইগুলি নাহি চাস্ মুখ।
তুই রে পাষণ্ড তাই দিতে চাস্ দুঃখ॥
লাগে না কিঞ্চিৎ ব্যথা ও কঠিন প্রাণে।
তুই কি ছিলি না হন বালক-জীবনে॥
কত কষ্টে করিয়াছি তােরেও মানুষ
পড়ে না মনে কি এবে, হয় না কি হুঁস॥
সামান্য কুকুর শ্যালে যাহা নাহি করে।
তুই রে করিস্ তাহা-নরদেহ ধোরে॥
কেমনে দেখাবি মুখ তুই অতঃপর।
ভাবিস্ এমনি কি রে যাবে বরাবর॥
যমদণ্ড কিছুতে ত নারিবি এড়াতে।
কি জবাব দিবি বল্ শেষের দিনেতে॥
ধরিবে শমন এসে কেশেতে যখন।
বল্ দেখি কি উপায় করিবি তখন॥
নাহি ভাব চিরদিন কাটিবে এমনি।
আমি অভাগিনী সত্য, তবু ত জননী॥
আমারে কাঁদালে হবে ভাল কি তােমার।
এখনো মনেতে তুমি কর রে বিচার॥”

এইরূপ বলি তিনি হয়েন নীরব।
ভাবেন “এক্ষণে পুত্র বুঝিয়াছে সব॥
নিশ্চয় তেমন আর দিবে না’ক ব্যথা।
শুনাতে হবে না আর কোন কড়া-কথা॥
না পেরে বুঝিতে বলিয়াছে একবার।
নিশ্চিত এরূপ নাহি বলিবে ত আর॥”
কিন্তু এ বেল্লিক রাম নহে সােজা ছেলে।
ঠাস করি এক চড়্ দিল মার গালে॥
ঘুরিয়ে পড়িল মাতা ভূতলে তখন।
দেখিয়ে কাঁদয় তার অন্য শিশুগণ॥
এক শিশু তাহাদের মধ্যে বড় কিছু।
রাগেতে বেল্লিকে সে শুনায় কথা উঁচু॥—
বলে, “কি বলিব তুমি হইয়াছ দাদা।
নতুবা এখনি কোরে দিতাম যে কাদা॥
তুমি ধর্ম্ম খেলে বোলে আমি ত খাব না।
নতুবা শিখতে পারি তাহা কি বােঝ না॥
যত দূর করিবার তুমি তা করিলে।
কহিনু মরিবে কিন্তু আর কাছে এলে॥”
এত বলি জননীরে লয়ে অন্য স্থানে।
শীঘ্র চলি যায় তারা ছাড়ি সে ভবনে॥