বেল্লিক রামায়ণ/বেল্লিকের মাতার স্থানান্বেষণ

বেল্লিকের মাতার স্থান-অন্বেষণ।

কত দয়াবান্ রয় এই সহরেতে।
‘কি ভয়’ বেল্লিক-মাতা চিন্তিয়ে মনেতে॥
যায় ধীরে ধীরে তবে ছাড়ি সে ভবন।
দেখে কোথা পায় এক আশ্রয় তেমন॥
শুনিল যে পথিমধ্যে গিয়ে এক ঠাঁই।
যােগেন্দ্রমােহন রাজা সম দাতা নাই॥
সহরমধ্যেতে আছে যত দয়াবান্।
যোগেন্দ্রমােহন তার মধ্যেতে প্রধান॥
দেখেনি ত হেন দাতা কেহ কোন স্থানে
দ্বিতীয় সে বলিরাজা হন তিনি দানে॥
নাহি পাত্রাপাত্র তাঁর ছােট বড় জ্ঞান।
সকলেই সমভাবে তিনি দয়াবান্॥
যার যা কামনা, তাহা হলে সাধ্যমত।
অবশ্য তখনি তাহা করেন পূর্ণিত॥
আত্মবৎ সর্ব্বভূতে জ্ঞান যে তাঁহার।
সাধ্যমতে না রাখেন কষ্ট ত কাহার॥
যেরূপ পারেন দুঃখ দেন মুছাইয়ে।
রাখেন অন্যের প্রাণ নিজ অন্ন দিয়ে॥

হয় ত ভরসা সেই অন্ন তাঁর মােটে।
অথচ পরের দুঃখে প্রাণ বড় ফাটে॥
শুনি লােকমুখে এই দানের কাহিনী।
ছুটে ছুটে যায় তথা বেল্লিক-জননী॥
চারিটি সন্তান সঙ্গে দুঃখিনী রমণী।
চলে রাজ দরশনে হয়ে ব্যাকুলিনী॥
বলে, “কোথা মহারাজ, দেখ একবার।
ভদ্রকুলে জন্ম নিয়ে কি গতি আমার॥
সাধ্বী নারী, নাহি জানি কোন পাপ-কাজ।
অথচ দেখহ মনে পাই কত লাজ॥
সামান্য কুক্কুরী সম ফিরি পথে পথে।
না পাই খাইতে দুটি অন্ন দিনান্তেতে॥
গেছে পতি, কেবা আর খা(ও)য়াবে আমায়।
সন্তানের বড় যেটি সে না মুখ চায়॥
তাড়ায়ে দিয়েছে মােরে সেই কুসন্তান।
তুমি যদি কর দয়া তবে বাঁচে প্রাণ॥
প্রশংসা তােমারে করে সবে হে রাজন্।
করহ কিঞ্চিৎ দয়া মােরে বিতরণ॥”
বলিতে বলিতে এই বাণী বদনেতে।
উপস্থিত হয় গিয়া রাজার পাশেতে॥
দেখে দূরে হতে রাজা বসিয়া চেয়ারে।
পারিষদগণে ঘিরে রহে চারিধারে॥

কতমত কথা হয় কত রসালাপ।
ঠিক যেন গরীবের হয়েন মা বাপ্॥
মুখে খালি বুলি এই, “এই সংসারেতে।
একমাত্র দয়া শ্রেষ্ঠ বুঝিয়াছি চিতে॥
‘দয়া হতে ধর্ম্ম নাই’ বলে সাধুজন।
সত্য সত্য কথা এটি, মিথ্যা না কখন॥
যখনি কাহারাে প্রতি করি দয়া আমি।
মনে মনে কত সুখ জনমে তখনি॥
মর্ত্ত্যে বসি স্বর্গসুখ উপলব্ধি হয়।
হেন শান্তি বােধ প্রাণে কিছুতে ত নয়॥”
একবাক্যে পারিষদ সবে তবে বলে।
“অতি সত্য কথা, মিথ্যা নহে কোন কালে॥
বলেছেন মহারাজ যে কথা আপনি।
বেদবাক্য সুনিশ্চয় সে সব ত গণি॥
অসঙ্গত বলি কাল যাহা ভাবিয়াছি।
অতীব সঙ্গত পুন আজ দেখিতেছি॥
তােমার সমান জ্ঞানী কেহ বিশ্বে নাই।
জ্ঞানের সমুদ্র সম তুমি ত সদাই॥
সার্থক তুমি সে রাজা হয়েছ টাকায়।
পাথরে বাঁধায়ে ঘাট বসেছ তাহায়॥
আসন তােমার এই ঘাটে সদাকাল।
আছ বসি আলাে করি সকাল-বিকাল॥

আমরাও ভাগ্যবান্ হই জনে জনে।
তেঁই সে পেয়েছি স্থান তব সন্নিধানে॥
দয়া যে একটা ধর্ম্ম এত বড় হয়।
কিঞ্চিৎ জ্ঞেয়ান নাহি ছিল সে বিষয়॥
ভাগ্যে বুঝাইয়া প্রভু দিলে সবাকারে।
তেঁই সে মিলিল জ্ঞান এত খপ্ কোরে॥
আরো এক অনুজ্ঞান অতি চমৎকার।
নূতন আসিলে কেহ নিকটে তােমার॥
কেমন চরিত্র তার, কিবা মনােভাবে।
দর্শন মাত্রেতে তুমি বুঝিতে পারিবে॥
অই যে রমণী এক আসে গুটি গুটি।
অবশ্যই মনােভাব আছয়ে একটি॥
আমরা অবশ্য তাহা জানিতে পারি না।
তুমি কিন্তু জান ইহা স্থির বিবেচনা॥
দয়া করি সপ্রমাণ করুন ইহার।
শুনিয়ে শ্রীমুখে বাণী হােক্ চমৎকার॥
পেরেছ বুঝিতে ঠিক তুমি মহাশয়।
দয়া করি মিটান্ যদ্যপি হে সংশয়॥
বড়ই আনন্দ মােরা পাই মনে মনে।
অতএব নিবেদন করি শ্রীচরণে॥
ঘুচাও মনের ভ্রান্তি ওহে দয়াময়।
সার্থক জীবন তবে চরিতার্থ হয়।”

শুনিয়ে এত্যেক বাণী সেই মহারাজ।
বলিতে লাগেন, “শুন ভক্তের সমাজ॥
ঐ নারী হয় নারী-কুলে অভাগিনী।
নাহিক পুরুষ ওর হন্ রাঁড়ী উনি॥
নাহি পান খেতে উনি দুটি দিনান্তেতে।
ভিক্ষা হেতু আসিছেন তাই এ স্থানেতে॥
সঙ্গেতে বালক কটি সন্তান নিশ্চয়।
জেনে দেখ মিথ্যে এর এক বিন্দু নয়॥
হয় বা না হয় ওরে করহ জিজ্ঞাসা।
এখনি ঘুচিবে ভ্রম দেখিবে তামাসা॥”
“বটে বটে, ভাল, তবে” বলিয়া সকলে।
জিজ্ঞাসা করিতে তারে চলে দলে দলে॥
করয়ে জিজ্ঞাসা, “কি গাে, বল দেখি শুনি।
সত্য কি না সত্য যাহা বলিলেন উনি॥
ভিক্ষা নিতে এসেছ কি আছে অন্য আশ।
মনােভাব কিবা, বাছা, করহ প্রকাশ॥
সত্য কি বিধবা তুমি, নাহি তব স্বামী।
সঙ্গে কেবা এইগুলি হয় অনুগামী॥”
বেল্লিক-জননী কহে তখন কাতরে।
“সত্য সব ওরে বাছা, মিথ্যা কিছু না রে॥
আমি অভাগিনী অতি, নাহি স্বামী মম।
আছে জ্যেষ্ঠ পুত্র এক সেও রে নির্ম্মম॥

এগুলিও ছেলে মোর অতি সত্য বাণী।
অন্ন বিনে ছন্নছাড়া ফিরি কাঙ্গালিনী॥
উপায় যা হোক্ প্রভু করহ তোমরা।
দেখ এতগুলি প্রাণ মারা যাই মোরা॥”
শুনিয়ে তখন রাজা যোগেন্দ্রমোহন।
বলে, “শুন বিবরণ, কহে কি কথন॥
দেখ অনুজ্ঞান মোর কিবা চমৎকার।
হয় কি না হয় সত্য বচন আমার॥”
পারিষদগণ সবে বলে সকলেতে।
“ঐক্যমত আমরাও তব এ কথাতে॥
চমৎকার তোমার যে হয় অনুজ্ঞান।
মিথ্যা এর নাহি এক কণা পরিমাণ॥
চিরদিন ধারণা এ আছে অন্তরেতে।
ভব সম অনুজ্ঞানী নাহি পৃথিবীতে॥”
এইরূপ বলি তারা করে জয়ধ্বনি।
সকলে মিলিয়া উচ্চ কণ্ঠেতে অমনি॥—
“জয় জয় জয় রাজা যোগেন্দ্র-মোহন।
কলিকালে বলি সম দানে মহাজন॥
জ্ঞান-বুদ্ধি-বলে হেন কেহ নাহি বলী।
সাক্ষাৎ সে ভূতনাথ শূলহারী শূলী॥
শত বর্ষ পরমায়ু হোক্ আপনার।
হইল আশ্রয়স্থান যত অভাগার।”

এইরূপ সকলেতে বলাবলি করে।
দুঃখিনীরে কেহ কিন্তু নাহি আর হেরে॥
দাঁড়ায়ে দুয়ারে সেই হইয়ে অবাক্।
বলে না কেহই কিছু “যা, কিম্বা থাক॥”
বড়ই কাতর হয়ে পুনশ্চ দুঃখিনী।
নিবেদিল রাজপদে যুড়ি দুই পাণি॥
“কিবা আজ্ঞা মহারাজ করেন দীনায়।
কেমনে মানুষ করি এ কটী বাছায়॥
দয়ার সাগর তুমি মাের জানা আছে।
আপনারে ছাড়ি আর যাব কার কাছে॥
পতিতপাবন যেই তাহারি কাছেতে।
যায় ত পতিত যত সাগ্রহ চিত্তেতে॥
অচিরে দিউন কোরে কিঞ্চিৎ কিনারা।
ভয়ে ভাবনায় নহে হই বড় সারা॥
প্রতিবেশীমধ্যে যারা ভাল জন ছিল।
কালবশে একে একে সকলেই গেল॥
দুই চারিজন যারা এখনো সে আছে।
প্রত্যাশী না হতে পারি তাহাদের কাছে॥
পতির ব্যভারদোষে সবে রুষ্ট তারা।
মনেতে পড়িলে সব, চক্ষে বহে ধারা॥
কাজ নাই কথাতে সে আর ত এক্ষণে।
বড়ই যন্ত্রণা তাহে পাই ক্ষুদ্র প্রাণে॥

এসেছি আপন পদে রাখুন আপনি।
পেলে আপন দয়া মরে এ দুঃখিনী॥”
কহে তবে মৃদু হেসে সে মহারাজন্।
“অবশ্যই দয়া আমি—শুন বিবরণ॥—
পারিতাম করিবারে, এ কি বড় কথা।
কিন্তু যে রহিছে মধ্যে একটি বারতা॥
বিশ্বে কেহ যারে দয়া না করিতে চায়।
কেমনে আমি বা দয়া করিব তাহায়॥
অবশ্যই মন্দ হয় সেই অভাগিনী।
পুত্রে যারে নাহি মানে বলিয়ে জননী॥
অতএব এখানে ত স্থান তব নাই
পারহ করিতে চেষ্টা অন্যত্রেতে যাই॥
আমার দয়ার পাত্র হইবে যাহারা।
শুনহ কেমন হয় মানুষ তাহারা॥
আছে যার তিন কুলে সব বর্ত্তমান।
কিবা স্বামী কি শ্বশুর আর সে সন্তান॥
খাওয়াইতে পরাইতে চাহে সকলেই।
তেজ করি নাহি খায় পরে নিজে সেই॥
এইরূপ যেই জন হয় এ বাজারে।
তারেই ত দিই আমি সবার ভিতরে॥
ঈশ্বরো রহেন রাজী এইরূপ হলে।
দীনতায় পড়ে সেও, দীনে দান দিলে॥

গরীবে রাখিলে পদে বিপদ তাহার।
অতএব তাহে শক্তি নাহি ত আমার॥
মার্জ্জনা করহ তুমি আমারে হে ধনী।”
বিমুখ হয়েন এত বলি নরমণি॥
সঙ্গে পাত্র মিত্র সবে লইয়া তখন।
দ্রুতবেগে স্থানান্তরে করেন গমন॥
তারা বলে “মহারাজ বলেছেন ঠিক।
গরিবেরে দান করা বড়ই অঠিক্॥
নিজ অমঙ্গল তাহে হয় ত বাড়ানো।
তার চেয়ে সুমঙ্গল ফেলিয়ে পালানো॥”
এত বলি মুহূর্ত্তেকে সবে অন্তর্দ্ধান।
বেল্লিকের রামায়ণ রামের প্রধান॥