বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
বিজন পথ দিয়া বিদ্যুদ্বেগে যুবরাজ অশ্ব ছুটাইয়া চলিয়াছেন। অন্ধকার রাত্রি, কিন্তু পথ দীর্ঘ সরল প্রশস্ত বলিয়া কোন ভয়ের আশঙ্কা নাই। স্তব্ধ রাত্রে অশ্বের খুরের শব্দে চারিদিক প্রতিধ্বনিত হইতেছে, দুই একটি কুকুর ঘেউ-ঘেউ করিয়া ডাকিয়া উঠিতেছে, দুই একটা শৃগাল চকিত হইয়া পথ ছাড়িয়া বাঁশঝাড়ের মধ্যে লুকাইতেছে। আলােকের মধ্যে আকাশে তারা ও পথপ্রান্তস্থিত গাছে জোনাকি; শব্দের মধ্যে ঝিঁ ঝিঁ পােকার অবিশ্রাম শব্দ; মনুষ্যের মধ্যে কঙ্কাল-অবশেষ একটি ভিখারী বৃদ্ধা গাছের তলায় ঘুমাইয়া আছে! পাঁচ ক্রোশ পথ অতিক্রম করিয়া, যুবরাজ পথ ছাড়িয়া একটা মাঠে নামিলেন। অশ্বের বেগ অপেক্ষাকৃত সংযম করিতে হইল! দিনের বেলায় বৃষ্টি হইয়াছিল, মাটি ভিজা ছিল, পদে পদে অশ্বের পা বসিয়া যাইতেছে। যাইতে যাইতে সম্মুখের পায়ে ভর দিয়া অশ্ব তিনবার পড়িয়া গেল। শ্রান্ত অশ্বের নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত, মুখে ফেন, পশ্চাতের পদদ্বয়ের ঘর্ষণে ফেন জন্মিয়াছে, পঞ্জরের ভিতর হইতে একটা শব্দ বাহির হইতেছে, সর্ব্বাঙ্গ ঘর্ম্মে প্লাবিত। এদিকে দারুণ গ্রীষ্ম, বাতাসের লেশ মাত্র নাই, এখনাে অনেকটা পথ অবশিষ্ট রহিয়াছে। বহুতর জলা ও চষা মাঠ অতিক্রম করিয়া যুবরাজ অবশেষে একটা কাঁচা রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অশ্বকে আবার দ্রুতবেগে ছুটাইলেন। একবার তাহার স্কন্ধ চাপড়াইয়া উৎসাহ দিয়া ডাকিলেন, “সুগ্রীব!” সে চকিতে একবার কান খাড়া করিয়া বড় বড় চোখ, বঙ্কিম দৃষ্টিতে প্রভুর দিকে চাহিল, একবার গ্রীবা বাঁকাইয়া হ্রেষাধ্বনি করিল ও সবলে মুখ নামাইয়া রাশ শিথিল করিয়া লইল ও গ্রীবা নত করিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিতে লাগিল। দুই পার্শ্বের গাছপালা চোখে ভাল দেখা যাইতেছে না, আকাশে চাহিলে মনে হইতেছে যেন দলে দলে নক্ষত্রেরা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত সবেগে উড়িয়া যাইতেছে এবং সেই স্তব্ধবায়ু আকাশে তরঙ্গিত হইয়া কানের কাছে সাঁ সাঁ করিতে লাগিল। রাত্রি যখন তৃতীয় প্রহর, লােকালয়ের কাছে শৃগালেরা যখন ডাকিয়া গেল, তখন যুবরাজ, শিমুলতলীর চটির দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহার অশ্ব তৎক্ষণাৎ গতজীবন হইয়া ভূমিতে পড়িয়া গেল। নামিয়া তাহার পিঠ চাপড়াইলেন, তাহার মুখ তুলিয়া ধরিলেন, সুগ্রীব বলিয়া কতবার ডাকিলেন, সে আর নড়িল না। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া যুবরাজ দ্বারে গিয়া আঘাত করিলেন। বার বার আঘাতের পর চটির অধ্যক্ষ দ্বার না খুলিয়া জানালার মধ্য দিয়া কহিল—“এতরাত্রে তুমি কেগো?” দেখিল একজন সশস্ত্র যুবক দ্বারে দাঁড়াইয়া।
যুবরাজ কহিলেন “একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব দ্বার খােল।”
সে কহিল, “দ্বার খুলিবার আবশ্যক কি, যাহা জিজ্ঞাসা করিবার আছে, জিজ্ঞাসা কর না!”
যুবরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন—“রায়গড়ের রাজা বসন্তরায় এখানে আছেন?”
সে কহিল—“আজ্ঞা সন্ধ্যার পর তাঁহার আসিবার কথা ছিল বটে, কিন্তু এখনাে আসেন নাই। আজ বােধ করি, তাঁহার আসা হইল না।”
যুবরাজ দুইটি মুদ্রা লইয়া শব্দ করিয়া কহিলেন—“এই লও।”
সে তাড়াতাড়ি ছুটিয়া আসিয়া দ্বার খুলিয়া মুদ্রা দুইটি লইল। তখন যুবরাজ তাহাকে কহিলেন—“বাপু আমি একবারটি তােমার চটি অনুসন্ধান করিয়া দেখিব, কে কে আছে?”
চটি-রক্ষক সন্দিগ্ধ ভাবে কহিল—“না মহাশয় তাহা হইবেক না।”
উদয়াদিত্য কহিলেন—“আমাকে বাধা দিও না। আমি রাজবাটির কর্ম্মচারী। দুই জন অপরাধীর অনুসন্ধানে আসিয়াছি।”
এই কথা বলিয়াই তিনি প্রবেশ করিলেন। চটি-রক্ষক তাঁহাকে আর বাধা দিল না। তিনি সমস্ত অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেন। না বসন্ত রায়, না তাঁহার অনুচর, না কোন পাঠানকে দেখিতে পাইলেন। কেবল দুই জন সুপ্তোত্থিতা প্রৌঢ়া চেঁচাইয়া উঠিল “আ মরণ মিন্সে অমন করিয়া তাকাইতেছিস্ কেন?”
চটি হইতে বাহির হইয়া পথে দাঁড়াইয়া যুবরাজ ভাবিতে লাগিলেন। একবার মনে করিলেন যে, ভালই হইয়াছে, হয়ত আজ দৈবক্রমে তিনি আসিতে পারেন নাই। আবার মনে করিলেন যদি ইহার পূর্ব্ববর্তী কোন চটিতে থাকেন ও পাঠানেরা তাঁহার অনুসন্ধানে সেখানে গিয়া থাকে? এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সেই পথ বাহিয়া চলিতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর গিয়া দেখিলেন, বিপরীত দিক্ হইতে একজন অশ্বারােহী আসিতেছে। নিকটে আসিলে কহিলেন “কেও? রতন নাকি?” সে অশ্ব হইতে তৎক্ষণাৎ নামিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া কহিল “আজ্ঞা হাঁ। যুবরাজ আপনি এতরাত্রে এখানে যে?”
যুবরাজ কহিলেন “তাহার কারণ পরে বলিব। এখন বল ত দাদা মহাশয় কোথায় আছেন।”
“আজ্ঞা, তাঁহার ত চটিতেই থাকিবার কথা।”
“সে কি? সেখানে ত তাঁহাকে দেখিলাম না।”
সে অবাক্ হইয়া কহিল “ত্রিশ জন অনুচর সমেত মহারাজ যশাের উদ্দেশে যাত্রা করিয়াছেন। আমি কার্য্যবশত পিছাইয়া পড়িয়াছিলাম। এই চটিতে আজ সন্ধ্যাবেলা তাঁহার সহিত মিলিবার কথা।”
“পথে যেরূপ কাদা, তাহাতে পদচিহ্ন থাকিবার কথা, তাহাই অনুসরণ করিয়া আমি তাঁহার অনুসন্ধানে চলিলাম। তোমার ঘােটক লইলাম। তুমি পদব্রজে এস!”