পঞ্চদশ সর্গ।

কবি ও মুরলা।

মুরলা।—কবিগাে আমার, যদি আমি মােরে যাই 
তা হোলে কি বড় কষ্ট হয়গো তোমার?
কবি।—ওকি কথা মুরলা লো বলিতে যে নাই! 
তুই ছেলেবেলাকার সঙ্গিনী আমার!
কাদিস্ না, কাঁদিস্ না, মোছ অশ্রুধার।
আহা, সখি, বড় সুখী হই আমি মনে
যদি দেখি প্রেমে তুই পোড়েছিস্ কার,
সুখেতে আছিস্ তোরা মিলি দুইজনে!
নিরাশ্রয় মনে আসে কত কি ভাবনা,
কিছুতে অধীর হৃদি মানেনা সান্ত্বনা;
সজনি, অমন সব ভাবনা আঁধার
ভাবিস্‌নে কখনো লো ভাবিস্‌নে আর!
মুরলা।—কবিগো, রজনীগন্ধা ফুটেছিল গাছে, 
তুমি ভালবাস’ বোলে আপনি এনেছি তুলে,
নেবে কি এ ফুল গুলি, রাখিৰে কি কাছে?
কবি।—সখিলো, নলিনী কাল দুটি চাঁপা তুলে 
পরায়ে দেছিল মোর দুই কর্ণ মূলে;
পরশিতে দল গুলি পড়িছে ঝরিয়া

এখনো সুবাস তার যায় নি মরিয়া!
মুরলা।—দেখি সখা, একবার দেখি হাত খানি, 
এ হাত কাহারে কবি করিবে অৰ্পণ?
কত ভাল তোমারে সে বাসিবে না জানি।
না জানি, তোমারে কত করিবে যতন!
কিসে তুমি রবে সুখী সকলি সে জানিবে কি?
দেখিবে কি প্রতি ক্ষুদ্র অভাব তোমার?
তোমার ও মুখ দেখি, অমনি সে বুঝিবে কি
কখন পোড়েছে হৃদে একটু আঁধার!
অমনি কি কাছে গিয়ে কতনা সান্তনা দিয়ে
দূর করি দিবে সব বিষাদ তোমার?
তাই যেন হয় কবি আর কিবা চাই।
তা হোলেই সুখী হব রহি না যেথাই।
কবি।-মুরলা, সখিলাে, 
কেন আজ মন মোর উঠিছে কাঁদিয়া?
বিষাদ ভুজঙ্গ সম কেন রে হৃদয় মম
দলিতেছে, চারিদিকে বাঁধিয়া বাঁধিয়া?
ছেলেবেলা হোতে যেন কিছুই হোলনা,
যত দিন বেঁচে রব’ কিছুই হবে না,
এমনি কোরেই যেন কাটিবেক দিন,
কাঁদিয়া বেড়াতে হবে সুখ শান্তি হীন!
কেহ যেন নাই মোর, রবেনাকো কেহ,
ধরায় নাইক যেন বিশ্রামের গেহ।
কিছু হারাইনি তবু খুঁজিয়া বেড়াই,

কিছুই চাই না তবু কি যেন কি চাই!
কোন আশা না করিয়া নৈরাশ্যেতে দহি,
কোন কষ্ট না পাইয়া তবু কষ্ট সহি!
কেন রে এমন কেন হোল আজ মন?
দিয়েছিত, পেয়েছিত ভালবাসা ধন!
তুই কাছে আয় দেখি, আয় একবার,
মুখ তোর রাখ্ দেখি বুকেতে আমার!
দেখি তাহে এ হৃদয় শান্তি পায় যদি!
কে জানে উচ্ছ্বসি কেন উঠিতেছে হৃদি।
দেখি তোর মুখ খানি, সখি তোর মুখখানি,
বুকে তোর মুখ চাপি, কেন, সখি, কেন
সহসা উচ্ছ্বসি কাঁদি উঠিলিরে হেন?
যেন বহুক্ষণ হোতে যুঝিয়া যুঝিয়া
আর পারিল না, হৃদি গেল গো ভাঙ্গিয়া।
কি হোয়েছে বল্ মোরে, বল্ সখি বল্,
লুকাস্‌নে, লুকাস্‌নে দুখ অশ্রুজল!
পৃথিবীতে কেহ যদি নাহি থাকে তোর
এই হেথা এই আছে এই বক্ষ মোর!
এ আশ্রয় চিরকাল রহিবে তোমার
এ আশ্রয় কখনই হারাবিনে আর!
কাঁদিবি, যখন চাস্, হেথা মুখ ঢাকি,
তোর সাথে বরষিবে অশ্রু মোর আঁখি!
মুরলা।—তুমি সুখী হও কবি এই আমি চাই, 
তুমি সুখী হোলে মোর কোন দুঃখ নাই!

কবি।—আমি সুখী নই সখি, সুখী কেবা আর? 
বল্ দেখি মুরলালো কি দুঃখ আমার!
অমন নলিনী মোর হৃদয়ের ধন
সে আমার—সে আমার আছেগো যখন,
পেয়েছি যখন আমি তার ভালবাসা,
তখন আমার আর কিসের বা আশা?
পেয়েছি যখন আমি তোর মত সখী—
দুখে মোর দুখ পায় সুখে মোর সুখী,
তবে বল্ দেখি সখি কি দুঃখ আমার?
তবে যে উঠেছে মনে বিষাদ আঁধার
শরতের মেঘ সম দুদণ্ডে মিলাবে,
কোথা হোতে আসিয়াছে কোথায় বা যাবে।
এখনি নলিনী কাছে যাই একবার,
এখনি ঘুচিবে এই বিষাদের ভার!
মুরলা সখিলো তুই থাকিস্ হেথাই,
ফিরে এসে পুনঃ যেন দেখিবারে পাই! (কবির প্রস্থান)
মুরলা।—ফিরে এসে মুরলারে পাবেনা দেখিতে, 
কবি মোর, আরেকটু যদিগো থাকিতে!
নলিনীত চির জন্ম রহিবে তোমার,
আমি যে ও মুখ কভু হেরিব না আর!
ও মুখ কি আর কভু পাবনা দেখিতে
যত দিন হবে মোরে বাঁচিয়া থাকিতে?
পল যাবে, দণ্ড যাবে, দিন যাবে, মাস যাবে,
বর্ষ বর্ষ করি যাবে জীবন আমার,

ও মুখ দেখিতে তবু পাবনাকো আর?
মুরলা, পারিবি তুই? পারিবি থাকিতে?
দারুণ পাষাণে মন বাঁধিয়া রাখিতে?
না, না, না, মুরলা তুই যাইবি কোথায়?
অসীম সংসারে তোর কে আছে রে হায়
হবে যা অদৃষ্টে আছে, থাকিস্ কবির কাছে,
কবি তোর সুখ শান্তি হৃদয়ের ধন,
থাকিস্ জড়ায়ে ধরি কবির চরণ,
কবির চরণে শেষে ত্যজিস্ জীবন!
কিন্তু স্বার্থপর তুই কি করিয়া র’বি?
বিষণ্ন ও মুখ তোর নিরখিয়া কবি
এখনো কাঁদেন যদি, এখনো তাঁহার হৃদি
পুরানো বিষাদ যদি করেগো স্মরণ?
সেই ছেলেবেলাকার বিষাদ যন্ত্রণা ভার
আমি যদি তাঁর মনে জাগাইয়া রাখি—
তবেরে হতভাগিনী কি বলিয়া থাকি!
তবে আমি যাই, তবে যাই, তবে যাই,
কেহ মোর ছিলনাকো, কেহ মোর নাই।
মুরলা বলিয়া কেহ আছে কি ভুবনে?
মুরলা বলিয়া যারে ভাবিতেছি মনে
সে একটি নিশীথের স্বপ্ন মোহময়,
দেখিব স্বপন ভাঙ্গি মুরলা সে নয়!
নাই তার সুখ দুখ, নাই ভালবাসা,
নাই কবি—নাই কেহ—নাই কোন আশা,

কেহই সে নয়, আর কেহ তার নাই,
তবে কি ভাবনা আর যেথা ইচ্ছা যাই!
কিন্তু কবি মোর, আহা ভালবাসাময়,
আমারে না দেখে যদি তাঁর কষ্ট হয়?
থাম্ থাম্ মুরলারে—কেন মিছে বারে বারে
মনেরে প্রবোধ দিস্ ও কথা বলিয়া,
শুনিলে জগৎ যেরে উঠিবে হাসিয়া!
চল্ তুই চল্ তুই—যেথা ইচ্ছা চল্ তুই
কেহ নাই তোর লাগি কঁদিবার তরে।
তবে চলিলাম কবি দূর দেশান্তরে;
অন্তর্যামী দেবতা গো, শুন একবার,
যদি আমি ভালবাসি কবিরে আমার
কবি যেন সুখী হয়, নলিনী সে সুখে রয়,
সখারে আমার আমি ভালবাসি যত
নলিনী বালাও যেন ভালবাসে তত!
নলিনী বালার যত আছে দুখ জ্বালা
সব যেন মোর হয়, সুখে থাক্ বালা!
তবে চলিলাম কবি, আমি চলিলাম,
মুরলা করিছে এই বিদায় প্রণাম!