১৬

শান্তিনিকেতন

 আজ সকালে তোমার চিঠি এইমাত্র পেলুম। আজ আমার চতুর্থ এবং পঞ্চম বর্গের পুরাতন পড়ার দিন, আজ সন্তোষের হাতে তাদের ভার; এইজন্যে আমার সকালের কাজের প্রথম দুই ভাগ আমার ছুটি, তাই এখনি তোমার চিঠির জবাব দিতে বস্‌বার সময় পেলুম। সেদিন যখন তোমাকে লিখ্‌ছিলুম, তখন আকাশ জুড়ে মেঘের হাঁক্‌ডাক্ এবং মাঠে-বনে পাগ্‌লা হাওয়ার দৌরাত্ম্য চ’ল্‌ছিলো; আজ সকালে তা’র আর কোনো চিহ্ন নেই, আজ শরৎকালের প্রসন্ন মূর্তি প্রকাশ পেয়েচে—শিবের জটা ছাপিয়ে যেন গঙ্গা ঝ’রে প’ড়্‌চে, —আকাশে তেমনি আজ আলোকের নির্ম্মল ধারা ঢেলে দিয়েছে, পৃথিবী আজ মাথা নত ক’রে তা’র অশ্রু-আর্দ্র হৃদয়খানি মেলে দিয়েচে, আর আকাশের কোন্ তরুণ দেবতা হাসিমুখে তা’র উপরে এসে দাঁড়িয়েচেন। জলস্থল শূন্যতল আজ একটি জ্যোতির্ম্ময় মহিমায় পূর্ণ হ’য়ে উঠেচে। সেই পরিপূর্ণতায় চারিদিক শান্ত স্তব্ধ, অথচ গোলমাল-যে কিছু নেই, তা নয়। জাগ্রত প্রভাতের কাজকর্ম্মের কলধ্বনি উঠেচে। আমার ঠিক সাম্‌নেই ‘দিনুবাবুর’ ঘরের দোতালায় রাজমিস্ত্রী ও মজুরের দল নানারকম ডাক্‌হাঁক্ এবং ঠুক্‌ঠাক্ লাগিয়ে দিয়েচে। দূরে থেকে ছেলেদের কণ্ঠস্বরও শোনা যাচ্চে, পূবদিকের সদর রাস্তা দিয়ে সার-বাঁধা গোরুর গাড়ি ইঁটের বোঝা নিয়ে আস্‌চে, তা’রই অনিচ্ছুক চাকার আর্ত্তনাদ এবং গাড়োয়ানের তর্জ্জন-ধ্বনির বিরাম নেই, তা’র উপরে ঠিক আমার পিছনের জানালার বাইরে সুধাকান্তর ঘরের চালের উপরে ব’সে একদল চড়ুইপাখী কিচিমিচি ক’রে কী-যে বিষম তর্ক বাধিয়ে দিয়েচে, তার একবর্ণ বোঝ্‌বার জো নেই,—প্রায় ন্যায়শাস্ত্রেরই তর্কের মতো। কিন্তু তবু আজ আলোকে অভিষিক্ত আকাশের এই অন্তরতর স্তব্ধতা কিছুতেই যেন ভাঙ্‌তে পারচে না। গায়ের উপর দিয়ে হাজার হাজার যে-সব ঝরণা ঝ’রে প’ড়্‌চে, তাতে যেমন হিমালয়ের অভ্রভেদী স্তব্ধতাকে বিচলিত করে না, এও ঠিক সেই রকম। একটি তপঃ-প্রদীপ্ত অপরিমেয় মৌনকে বেষ্টন করে এই সমস্ত ছোটো ছোটো শব্দের দল খেলা ক’রে চ’লেচে—তাতে তপস্যার গভীরতা আরো বড়ো হ’য়ে প্রকাশ পাচ্চে, নষ্ট হ’চ্চে না। শরতের বনতল যেমন নিঃশব্দে-ঝ’রে-পড়া শিউলিফুলে আকীর্ণ হ’য়ে ওঠে, তেম্‌নি ক’রেই আমার মনের মধ্যে আজ শরৎ-আকাশের এই আলো শুভ্র শান্তি বর্ষণ ক’র্‌চে। ইতি ২৪শে ভাদ্র, ১৩২৫।