ভানুসিংহের পত্রাবলী/২৮
২৮
আজ দুপুরবেলায় যখন খেতে ব’সেচি, এমন সময় —রোসো, আগে ব’লেনি কী খাচ্ছিলুম—খুব প্রকাণ্ড মোটা একটা রুটি—কিন্তু মনে ক’রো না তা’র সবটাই আমি খাচ্ছিলুম। রুটিটাকে যদি পূর্ণিমার চাঁদ বলে ধ’রে নেও তা হ’লে আমার টুক্রোটি দ্বিতীয়ার চাঁদের চেয়ে বড়ো হবে না। সেই রুটির সঙ্গে কিছু ডাল ছিল, আর ছিল চাট্নি আর একটা তরকারিও ছিল। যা হোক্, ব’সে ব’সে রুটি চিবোচ্চি, এমন সময়—রোসো, আগে ব’লে নিই রুটি, ডাল, চাট্নি এলো কোথা থেকে। —তুমি বোধ হয় জানো, আমার এখানে প্রায় পঁচিশজন গুজরাটি ছেলে আছে—আমাকে খাওয়াবে ব’লে তাদের হঠাৎ ইচ্ছা হ’য়েছিলো। তাই আজ সকালে আমার লেখা সেরে স্নানের ঘরের দিকে যখন চ’লেছি, এমন সময় দেখি, একটি গুজরাটি ছেলে থালা হাতে ক’রে আমার দ্বারে এসে হাজির। যা হোক্, নীচের ঘরে টেবিলে ব’সে ব’সে রুটির টুক্রো ভাঙ্চি আর খাচ্চি, আর তার সঙ্গে একটু একটু চাট্নিও মুখে দিচ্চি, এমন সময়—রোসো, আগে ব’লে নিই, খাবার কী রকম হ’য়েছিলো। রুটিটা বেশ শক্ত-গোছের ছিল; যদি আমাকে সম্পূর্ণ চিবিয়ে সবটা খেতে হ’তো তা হ’লে আমার এক্লার শক্তিতে কুলিয়ে উঠ্তো না, মজুর ডাক্তে হ’তো। কিন্তু ছিঁড়্তে যত শক্ত মুখের মধ্যে ততটা নয়। আবার রুটিটা মিষ্টি ছিল; ডাল তরকারি দিয়ে মিষ্টি রুটি খাওয়া আমাদের আইনে লেখে না, কিন্তু খেয়ে দেখা গেল-যে, খেলে-যে বিশেষ অপরাধ হয় তা নয়। সেই রুটি খাচ্চি, এমন সময়— রোসো, ওর মধ্যে একটা কথা ব’ল্তে একেবারেই ভুলে গেচি, দুটো পাঁপর-ভাজাও ছিল; সে-দুটো, আমি যাকে ব’লে থাকি সুশ্রাব্য—অর্থাৎ খেতে বেশ ভালো লাগে। শুনে তুমি হয় তো আশ্চর্য্য হবে এবং আমাকে হয়তো মনে মনে পেটুক ঠাউরে রেখে দেবে—এবং যখন আমি কাশীতে যাবো তখন হয় তো সকালে বিকালে আমাকে চাট্নি দিয়ে কেবলি পাঁপর-ভাজা খাওয়াবে। তবু সত্য গোপন ক’র্বো না, দুখানা পাঁপর-ভাজা সম্পূর্ণ ই খেয়েছিলুম। যা হোক্, সেই পাঁপর মচ্ মচ্ শব্দে খাচ্চি, এমন সময়—রোসো, মনে ক’রে দেখি সে-সময়ে কে উপস্থিত ছিল। তুমি ভাব্চো, তোমার বউমা তোমার ভানুদাদার পাঁপর-ভাজা খাওয়া দেখে অবাক্ হ’য়ে হতবুদ্ধি হ’য়ে টেবিলের এক কোণে ব’সে মনে মনে ঠাকুর-দেবতার নাম ক’র্ছিলেন, তা নয়— তিনি তখন কোথায় আমি জানিনে। আর কমল? সেও-যে তখন কোথায় ব’সে রোদ পোয়াচ্ছিলো তা আমি জানিনে। তা হ’লে দেখ্চি টেবিলে আমি এক্লা ছাড়া কেউই ছিল না। যাই হো’ক্, দুখানা পাঁপর-ভাজার পরে প্রায় সিকিটুক্রো রুটির পৌনে চার আনা যখন শেষ ক’রেচি, এমন সময়—হাঁ, হাঁ, একটা কথা ব’ল্তে ভুলে গেচি—আমি লিখেচি খাবার সময়ে কেউ ছিল না, কথাটা সত্য নয়। ভোঁদা কুকুরটা একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে লালায়িত জিহ্বায় চিন্তা ক’র্ছিলো-যে, আমি যদি মানুষ হতুম তা হ’লে সকাল থেকে রাত্তির পর্য্যন্ত ঐ রকম মুচ্মুচ্ মুচ্মুচ্ মুচ্মুচ্ ক’রে কেবলি পাঁপরভাজা খেতুম; ইতিহাসও প’ড়্তুম না, ভূগোলও প’ড়্তুম না—শিশু মহাভারত, চারুপাঠের কোনো ধার ধার্তুম না। যা হোক্, যখন দুখানা পাঁপর-ভাজা এবং কিছু রুটি ও চাট্নি খেয়েছি, এমন সময়—কিন্তু ডালটা খাইনি, সেটা নার্কোল দিয়ে এবং অনেকখানি কুয়োর জল দিয়ে তৈরি করেছিলো তাতে ডালের চেয়ে কুয়োর জলের স্বাদটাই বেশি ছিল, আর তরকারিটাও খাইনি —কেন না, আমি মোটের উপর তরকারি প্রভৃতি বড়ো বেশি খাইনে। যাই হোক্, যখন রুটি এবং পাঁপরভাজা খাওয়া প্রায় শেষ হ’য়েচে, এমন সময়ে ডাকহরকরা আমার হাতে কাশীর ছাপমারা একখানা চিঠি দিয়ে গেল।