ভানুসিংহের পত্রাবলী/২৯
২৯
দেরি ক’রে তোমার চিঠির উত্তর দিয়েচি—তুমি আমাকে এত বড়ো অপবাদ দেবে আর আমি তাই যে নীরবে সহ্য ক’রে যাবো, এতবড়ো কাপুরুষ আমাকে পাওনি। কখ্খনো দেরি করিনি,—এ আমি তোমার মুখের সাম্নে ব’ল্চি। এতে তুমি রাগই করো আর যাই করো। দেরি ক’রিনি, দেরি ক’রিনি, দেরি ক’রিনি,—এই তিনবার খুব চেঁচিয়েই ব’লে রাখ্লুম—দেখি, তুমি এর জবাব কী দাও। যত দোষ সব আমার, আর তোমার অগস্ত্যকুণ্ডের পোষ্টমাষ্টারটি বুঝি আটত্রিশটী গুণের আধার? ভালো কথা মনে প’ড়্লো, তোমাকে শেষবারে চিঠি লেখার পর আমি খোঁজ নিয়ে শুন্লুম—শ্রীমতী তুলসীমঞ্জরীকে বৌমা বিদায় করে দিয়েচেন। কী অন্যায় দেখো দেখি! তা’র অপরাধটা কী?—না, সে যতটা কাজ করে তা’র চেয়ে কথা কয় বেশি। তাই যদি হয়, তা হ’লে তোমার ভানুদাদার কী হবে বলো তো? আমি তো জন্মকাল থেকে কেবল কথাই ক’য়ে আস্চি, তুলসীমঞ্জরী যেটুকু কাজ ক’রেচে—আমি তাও ক’রিনি। বৌমা তাই রেগেমেগে হঠাৎ যদি আমার খোরাকি বন্ধ ক’রে দেন তা হলে আমার কী দশা হবে? যাই হোক্, এই কথাটা নিয়ে এখন থেকে ভাবনা ক’রে কোনোও লাভ নেই—সময় যখন উপস্থিত হবে তখন তোমাকে খবর দেওয়া যাবে, আমার যা কপালে থাকে তাই হবে। কিন্তু তোমার গুরুমা তোমাকে যে-ছাঁদে বাংলা-চিঠি লেখাতে চান, আমাকে সেই ছাঁদে লিখ্লে চ’ল্বে না—তা আমার নামের আগে শুধু না-হয় একটা মাত্র “শ্রী”-ই দেবে কিম্বা “শ্রী” নাই বা দিলে। আমার বিলেত যাবার একটা কথা উঠ্চে কিন্তু শুধু কথায় যদি বিলেত যাওয়া যেতো তা হ’লে আমার ভাবনা ছিল না; কথা এক্লা যদি না জোটাতে পার্তুম তা হলে তুলসীমঞ্জরীকে ডেকে পাঠাতুম। কিন্তু মুস্কিল হ’চ্চে এই-যে, বিলেত যেতে জাহাজের দরকার করে, যুদ্ধের উৎপাতে সেই জাহাজের সংখ্যা ক’মে গেচে অথচ যাবার লোকের সংখ্যা বেড়ে গেচে— তাই এখন—
“ঘাটে ব’সে আছি আনমনা,
যেতেচে বহিয়া সুসময়।”
এদিকে রোজ আমার একটা ক’রে নতুন গান বেড়েই চ’লেচে। গানের সুবিধা এই-যে তা’র জন্যে জাহাজের দরকার হয় না, কথাতেই অনেকটা কাজ হয়। প্রায় পনেরোটা গান শেষ হ’য়ে গেল। তুমি দেরি ক’রে যদি আসো তা হ’লে ততদিনে এত গান জ’মে উঠ্বে-যে, শুন্তে শুন্তে তোমার চারুপাঠ তৃতীয়ভাগ আর পড়া হবে না—তোমার শিশু-মহাভারত বৃদ্ধ-মহাভারত হ’য়ে উঠ্বে। তুমি হয় তো এম্ এ পাশ করার সময় পাবে না। ইতি ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৩২৫।