ভানুসিংহের পত্রাবলী/৩০
৩০
তুমি ভাব্চো—মজা কেবল তোমাদেরই হ’য়েচে তাই তোমাদের ইস্কুলের প্রাইজের মজার ফর্দ্দ আমাকে লিখে পাঠিয়েচো, কিন্তু এত সহজে আমাকে হার মানাতে পার্চো না। মজা আমাদের এখানেও হয় এবং যথেষ্ট বেশি ক’রেই হয়। আচ্ছা, তোমাদের প্রাইজে কত লোক জ’মেছিলো?—পঞ্চাশ জন? কিন্তু আমাদের এখানে মেলায় অন্ততঃ দশ হাজার লোক তো হ’য়েইছিলো। তুমি লিখেচো, একটি ছোটো মেয়ে তা’র দিদির কাছে গিয়ে খুব চীৎকার ক’রে তোমাদের সভা খুব জমিয়ে তুলেছিলো—আমাদের এখানকার মাঠে যা-চীৎকার হ’য়েছিলো তাতে কত রকমেরই আওয়াজ মিলেছিলো, তা’র কি সংখ্যা ছিল? ছোটো ছেলের কান্না, বড়োদের হাঁক্ডাক, ডুগ্ডুগির বাদ্য, গোরুর গাড়ির ক্যাঁচ্কোঁচ্, যাত্রার দলের চীৎকার, তুবড়ীবাজির সোঁ সোঁ, পট্কার ফুট্ফাট্, পুলিশ-চৌকিদারের হৈ হৈ,—হাসি, কান্না, গান, চেঁচামেচি, ঝগ্ড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। ৭ই পৌষে মাঠে খুব বড়ো হাট ব’সেছিলো—তাতে গালার খেল্না, ফলের মোরব্বা, মাটির পুতুল, তেলে-ভাজা ফুলুরি, চিনেবাদাম ভাজা প্রভৃতি আশ্চর্য্য আশ্চর্য্য জিনিস বিক্রী হ’লো। এক-এক পয়সা দিয়ে ছেলেমেয়েরা সব নাগরদোলায় দুল্লো; চাঁদোয়ার নীচে নীলকণ্ঠ মুখুজ্যের কংসবধ যাত্রার পালা গান হ’চ্ছিলো—সেইখানে একেবারে ঠেলাঠেলি ভিড়। তা’রপরে ৯ই পৌষে আমাদের মেয়েরা আবার এক মেলা ক’রেছিলেন—তাতে সিঙারা, আলুর-দমের দোকান ব’সিয়েছিলেন—এক-একটা আলুর-দম এক-এক পয়সায় বিক্রী হ’লো। সুকেশী বউমা চিনে-বাদামের পুতুল গ’ড়েছিলেন, তা’র এক-একটা ছ-আনা দামে বিক্রী হ’য়ে গেল। কমল কাদা দিয়ে একটা ঘর বানিয়েছিলো—তা’র খড়ের চাল, চারিদিকে মাটির পাঁচিল, আঙিনায় শিব-স্থাপন করা আছে—সেটা কেউ কিন্তে চায় না, তাই কমল আমাকে সেটা জোর ক’রে তিন টাকায় বিক্রী ক’রেচে। ভেবে দেখো— কী রকম ভয়ানক মজা! ছোটো মেয়েরা একটুক্রো নেক্ড়া ছিঁড়ে তার চারিদিকে পাড় সেলাই ক’রে আমার কাছে এনে ব’ল্লে, “এটা রুমাল, এর দাম আটআনা, আপনাকে নিতেই হবে”—ব’লে সেটা আমার পকেটে পুরে দিলে—এমন ভয়ানক মজা! ওদের বাজারে এইরকম শ্রেণীর সব ভয়ানক মজা হ’য়ে গেছে—তোমরা যে-সব প্রাইজ পেয়েচো, সে এর কাছে কোথায় লাগে! তা’রপরে মজা,—মেলা যখন ভেঙে গেল, সমস্ত রাত ধ’রে চেঁচাতে চেঁচাতে বেসুরো গান গাইতে গাইতে দলে দলে লোক ঠিক আমার শোবার ঘরের সামনের রাস্তা দিয়েই যেতে লাগ্লো—মজায় একটুও ঘুম হ’লো না—নীচে যতগুলো কুকুর ছিল, সবাই মিলে ঊর্দ্ধশ্বাসে চেঁচাতে লাগ্লো, এমন মজা! তা’রপরে ক’ল্কাতার অনেক মেয়ে তাঁদের ছোটো ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছিলেন— তাঁদের কারো কাশী, কারো জ্বর। নিশ্চয়ই তোমাদের প্রাইজে এমন ধুমধাম, গোলমাল, কাশী-সর্দ্দি, অসুখবিসুখ আট আনায় রুমাল বেচা প্রভৃতি হয়নি— অতএব আমারই জিৎ রইলো।