৩২

শান্তিনিকেতন

 তোমার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত এইমাত্র পাওয়া গেল। আমি ভাব্‌চি, তোমার এমন চিঠির বেশ সমান ওজনের জবাবটি দিই কী ক’রে? তুমি চলিষ্ণু, আমি স্তব্ধ; তুমি আকাশের পাখী, আমি বনান্তের অশথগাছ; কাজেই তোমার গানে আর আমার মর্ম্মরে ঠিক সমকক্ষ হ’তে পারে না। একজায়গায় তোমার সঙ্গে আমার মিলেচে; তুমিও গেচো হাওয়া বদল ক’র্‌তে, আমিও এসেচি হাওয়া বদল ক’র্‌তে। তুমি গেচো কাশী থেকে সোলনে, আমি এসেচি আমার লেখ্‌বার ডেস্ক থেকে আমার জান্‌লার ধারের লম্বা কেদারায়। খুব বদল, —তোমাদের বিশ্বেশ্বরের মন্দির থেকে আর তাঁর শ্বশুরবাড়ি যত বদল তা’র চেয়ে অনেক বেশি। আমি যে-হাওয়ায় ছিলুম, এ হাওয়া তা’র থেকে সম্পূর্ণ তফাৎ। তবে কিনা, তোমার ভ্রমণে আমার ভ্রমণে একটি মূলগত প্রভেদ আাছে, তুমি নিজে চ’লে চ’লে ভ্রমণ ক’র্‌চো কিন্তু আমি নিজে থাকি স্থির আর আমার সাম্‌নে যা-কিছু চ’ল্‌চে, তাদের চলায় আমার চলা। এই হ’চ্চে রাজার উপযুক্ত ভ্রমণ—অর্থাৎ আমার হ’য়ে অন্যে ভ্রমণ ক’র্‌চে, চল্‌বার জন্যে আমার নিজেকে চ’ল্‌তে হ’চ্চে না। ঐ দেখো না, আজ রবিবার হাটবার, সাম্‌নে দিয়ে গোরুর গাড়ি চ’লেচে—আমার দুই চক্ষু সেই গোরুর গাড়িতে সওয়ার হ’য়ে ব’স্‌লো। ঐ চ’লেচে সাঁওতালের মেয়েরা মাথায় খড়ের আঁটি, ঐ চ’লেচে মোষের দল তাড়িয়ে সন্তোষ বাবুর গোষ্ঠের রাখাল। ঐ চ’লেচে ইষ্টেশনের দিক থেকে গোয়ালপাড়ার দিকে কা’রা এবং কিসের জন্যে—তা কিছুই জানিনে; একজনের হাতে ঝুল্‌চে এক থেলোহুঁকো, একজনের মাথায় ছেঁড়া ছাঁতি, একজনের কাঁধে চ’ড়ে ব’সেচে একটা উলঙ্গ ছেলে। ঐ আস্‌চে ভুবনডাঙ্গার গ্রাম থেকে কলসী-কাঁখে মেয়ের দল, তা’রা শান্তিনিকেতনের কুয়ো থেকে জল নিয়ে যাবে। ঐ সব চলার স্রোতের মধ্যে আমার মনটাকে ভাসিয়ে দিয়ে আমি চুপ ক’রে ব’সে আছি। আকাশ দিয়ে মেঘ চ’লেচে, কাল রাত্রিবেলাকার ঝড়-বৃষ্টির ভগ্ন-পাইকের দল—অত্যন্ত ছেঁড়া খোঁড়া রকমের চেহারা।

 এরাই দেখ্‌বো আজ সন্ধ্যেবেলায় নীল, লাল, সোনালি, বেগনি, উর্দ্দি প’রে কালবৈশাখীর নকিবের মতো গুরু গুরু দামামা বাজাতে বাজাতে উত্তর-পশ্চিম থেকে কুচ্-কাওয়াজ ক’রে আস্‌তে থাক্‌বে—তখন আর এমনতর ভালোমানুষি চেহারা থাক্‌বে না।

 আমাদের বিদ্যালয় বন্ধ, এখন আশ্রমে যা-কিছু আসর জমিয়ে রেখেচে শালিখ-পাখীর দল, আরো অনেক রকমের পাখী জুটেচে—বটের ফল পেকেচে তাই সব অনাহূতের দল জমেচে। বনলক্ষ্মী হাসিমুখে সবার জন্যেই পাত পেড়ে দিয়েচেন। ইতি ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৬।