ভানুসিংহের পত্রাবলী/৩৩
৩৩
তোমার চিঠিতে যে-রকম ঠাণ্ডা এবং মেঘ্লা দিনের বর্ণনা ক’রেচো তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্চে, তুমি তোমার ভানুদাদার এলাকার অনেক তফাতে চ’লে গেচো। বেশি না হোক, অন্তত দু-তিন ডিগ্রির মতোও ঠাণ্ডা যদি ডাকযোগে এখানে পাঠাতে পারে তা হ’লে তোমাদেরও আরাম, আমাদেরও আরাম। বেয়ারিং পোষ্টে পাঠালেও আপত্তি ক’র্বো না,এমন কি ভ্যালু- পেবলেও রাজি আছি। আসল কথা, ক-দিন থেকে এখানে রীতিমতো খোট্টাই ফেশানের গরম প’ড়েচে। সমস্ত আকাশটা যেন তৃষ্ণার্ত্ত কুকুরের মত জিব বের ক’রে হাঃ-হাঃ ক’রে হাঁপাচ্চে। আর এই-যে দুপুরবেলাকার হাওয়া, এ-যে কী রকম—সে তোমাকে বেশি বোঝাতে হবে না—এই ব’ল্লেই বুঝবে-যে, এ প্রায় বেনারসি হাওয়া, আগুনের লক্লকে জরির সূতো দিয়ে আগাগোড়া ঠাস বুনোনি;—দিক-লক্ষ্মীরা প’রেচেন, তাঁরা দেবতার মেয়ে ব’লেই সইতে পারেন, কিন্তু ওর আঁচ্লা যখন মাঝে মাঝে উড়ে আমাদের গায়ে এসে পড়ে তখন নিজেকে মর্ত্ত্যের ছেলে ব’লেই খুব বুঝ্তে পারি। আমি কিন্তু আমার ঐ আকাশের ভানুদাদার দূতগুলিকে ভয় করিনে; এই দুপুরে দেখ্বে, ঘরে ঘরে দুয়ার বন্ধ কিন্তু আমার ঘরের সব দরজা-জান্লা খোলা। তপ্ত হাওয়া হু-হু ক’রে ঘরে ঢুকে আমাকে আগাগোড়া ঘ্রাণ ক’রে যাচ্চে,—এমনি তা’র ঘ্রাণ-যে, ঘ্রাণেন অর্দ্ধভোজনং। গরমের ঝাঁজে আকাশ ঝাপ্সা হয়ে আছে—কেমন যেন ঘোলা নীল—ঠিক যেন মূর্চ্ছিত মানুষের ঘোলা চোখ্টার মতো। সকলেই থেকে থেকে ব’লে ব’লে উঠ্চে, “উঃ, আঃ,—কী গরম!” আমি তাতে আপত্তি ক’রে ব’ল্চি, গরম তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু তা’র সঙ্গে আবার ওই তোমার উঃ আঃ জুড়ে দিলে কেন? যাই হোক্, আকাশের এই প্রতাপ আমি এক-রকম ক’রে সইতে পারি কিন্তু মর্ত্ত্যের প্রতাপ আর সহ্য হয় না। তোমরা তো পাঞ্জাবে আছো, পাঞ্জাবের দুঃখের খবর বোধ হয় পাও। এই দুঃখের তাপ আমার বুকের পাঁজর পুড়িয়ে দিলে। ভারতবর্ষে অনেক পাপ জমেছিলো তাই অনেক মার খেতে হ’চ্চে। মানুষের অপমান ভারতবর্ষে অভ্রভেদী হ’য়ে উঠেচে। তাই কতশত বৎসর ধ’রে মানুষের কাছ থেকে ভারতবর্ষ এত অপমান সইচে কিন্তু আজও শিক্ষা শেষ হয়নি। ইতি, ৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৬।