৩৫

শান্তিনিকেতন

 কাল ছিলুম ক’ল্‌কাতায়, আজ বোলপুরে। এসে দেখি, তোমার একখানি চিঠি আমার জন্যে অপেক্ষা ক’রে আছে। আর দেখি, আকাশে ঘন ঘোর মেঘ,— বর্ষার আয়োজন সমস্তই র’য়েচে কেবল আমি আসিনি বলেই বৃষ্টি আরম্ভ হয়নি। বর্ষার মেঘের ইচ্ছা ছিল, আমাকে তা’র কাজরী গান শুনিয়ে দেবে—তা’রপরে আমিও তাকে আমার গানে জবাব দেবো। তাই এতক্ষণ পরে আমি দুপুরবেলায় যখন খেয়ে এসে ব’স্‌লুম তখন বৃষ্টি শুরু ক’রে দিয়েচে এক মাঠ থেকে আর-এক মাঠে। আর তা’র কল-সঙ্গীতে আকাশে কোথাও যেন ফাঁক রইলো না। নববর্ষার জল-স্থলের আনন্দ-উৎসব দেখ্‌তে চাও তা হ’লে এসো আমাদের মাঠের ধারে, বসো এই জানলাটিতে চুপ ক’রে। পাহাড়ে বর্ষার চেহারা স্পষ্ট দেখ্‌বার জো নেই, সেখানে পাহাড়েতে মেঘেতে ঘেষাঘেঁষি মেশামেশি একাকার কাণ্ড। সমস্ত আকাশটা বুজে যায়; সৃষ্টিটা যেন সর্দ্দিতে, কাশীতে জবুস্থবু হ’য়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে প’ড়ে থাকে। পাহাড় আমার কেন ভালো লাগে না বলি,—সেখানে গেলে মনে হয়, আকাশটাকে যেন আড়-কোলা ক’রে ধ’রে একদল পাহারাওয়ালার হাতে জিম্মা ক’রে দেওয়া হ’য়েচে, সে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। আমরা মর্ত্ত্যবাসী মানুষ—সীমাহীন আকাশে আমরা মুক্তির রূপটী দেখ্‌তে পাই—সেই আকাশটাকেই যদি তোমার হিমালয় পাহাড় একপাল মহিষের মতো শিং গুঁতিয়ে মার্‌তে চায় তা হ’লে সেটা আমি সইতে পারিনে। আমি খোলা আকাশের ভক্ত,—সেই জন্যে বাংলাদেশের বড়ো বড়ো দিল্-দরাজ্ নদীর ধারে অবারিত আকাশকে ওস্তাদ মেনে তা’র কাছে আমার গানের গলা সেধে এসেচি, এই কারণেই দূর হ’তে তোমাদের সোলন পর্ব্বতকে নমস্কার করি। যা হোক্, বর্ষা বিদায় হবার পূর্ব্বেই তোমরা আমার প্রান্তরে আতিথ্য নেবে শুনে আমি খুসি হ’য়েচি। তোমাদের জন্যে কিছু গান সংগ্রহ ক’রে রাখ্‌বো,—আর পাকা জাম, আর কেয়াফুল, আর পদ্মবন থেকে শ্বেতপদ্ম, আর যদি পারি গোটা কতক আষাঢ়ে গল্প। অতএব খুব বেশি দেরি ক’রো না, পর্ব্বত থেকে ঝর্‌ণা যেমন নেমে আসে তেমনি দ্রুতপদে নেমে এসো। ইতি—আষাঢ়স্য তৃতীয় দিবসে, ১৩২৬।