৩৬

শান্তিনিকেতন

 তোমার আজকের চিঠি পেয়ে বড়ো লজ্জা পেলুম। কেন ব’ল্‌বো? এর আগে তোমার একখানি চিঠি পেয়েছিলুম—তা’র জবাব দেবো-দেবো ক’র্‌চি, এমন সময় তোমার এই চিঠি, আজ তোমার কাছে আমার হার মান্‌তে হ’লো। আমি এত বড়ো লেখক, বড়ো বড়ো পাঁচ ভলুম কাব্যগ্রন্থ লিখেচি,—এহেন-যে আমি —যার উপাধিসমেত নাম হওয়া উচিত শ্রীরবীন্দ্রনাথ শর্ম্মা রচনা-লবণাম্বুধি কিম্বা সাহিত্য-অজগর কিম্বা বাগক্ষৌহিণীনায়ক কিম্বা রচনা-মহামহোপদ্রব কিম্বা কাব্যকলাকল্পদ্রুম কিম্বা—ফস্ ক’রে এখন মনে প’ড়্‌চে না, পরে ভেবে ব’ল্‌বো—একরত্তি মেয়ে, “সাতাশ” বছর বয়স লাভ ক’র্‌তে যাকে অন্ততঃ পঁয়ত্রিশ বছর সাধনা ক’র্‌তে হবে, তা’রই কাছে পরাভব—Two goals to nil! তারপরে আবার তুমি যে-সব বিপজ্জনক ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখ্‌চো, আমার এই ডেস্কে ব’সে তা’র সঙ্গে পাল্লা দিই কী ক’রে? আজ সকালে তাই ভাব্‌ছিলুম, পারুলবনের সাম্‌নে দিয়ে যে-রেলের রাস্তা আছে সেখানে গিয়ে রাত্রে দাঁড়িয়ে থাক্‌বো—তা’রপরে বুকের উপর দিয়ে প্যাসেঞ্জার ট্রেন্‌টা চ’লে গেলে পর যদি তখনো হাত চলে তা হ’লে সেই মুহূর্ত্তে সেইখানে ব’সে তোমাকে যদি চিঠি লিখ্‌তে পারি তবে তোমাকে টেক্কা দিতে পার্‌বো। এ সম্বন্ধে এখনো বউমার সঙ্গে পরামর্শ করিনি, এণ্ড্‌রুজ্ সাহেবকেও জানাইনি। আমার কেমন মনে মনে সন্দেহ হ’চ্চে, ওঁরা হয়তো কেউ সম্মতি দেবেন না, তা ছাড়া আমার নিজের মনেও একটা কেমন ধোঁকা লাগ্‌চে; মনে হ’চ্চে যদি গাড়িটার চাপে বুড়ো আঙুলটা কিছু জখম করে তা হ’লে হয় তো লেখা ঘ’টেই উঠ্‌বে না। আর যদি না ঘটে তা হ’লে অনন্তকালের মতো ঐ দু-খানা চিঠির জিৎ তোমার র’য়েই যাবে, অতএব থাক্।

 অল্পদিনের মধ্যে আমাদের এখানে ভয়ঙ্কর ব্যাপার একটাও ঘটেনি। ঝড়-বৃষ্টি অল্প স্বল্প হ’য়েছে কিন্তু তাতে আমাদের বাড়ির ছাদ ভাঙেনি, আমাদের কারো মাথায়-যে সামান্য একটা বজ্র প’ড়্‌বে তাও প’ড়্‌লো না। বন্দুক নিয়ে, ছোরাছুরি নিয়ে দেশের নানা জায়গায় ডাকাতি হ’চ্চে; কিন্তু আমাদের অদৃষ্ট এমনি মন্দ-যে, আজ পর্য্যন্ত অবজ্ঞা ক’রে আমাদের আশ্রমে তা’রা কিম্বা তাদের দূর-সম্পর্কের কেউ পদার্পণ ক’র্‌লে না। না, না, ভুল ব’ল্‌চি। একটা রোমহর্ষণ ঘটনা অল্পদিন হ’লো ঘ’টেছে। সেটা বলি। আমাদের আশ্রমের সাম্‌নে দিয়ে নির্জ্জন প্রান্তরের প্রান্ত বেয়ে একটি দীর্ঘ পথ বোলপুর-ষ্টেশন পর্য্যন্ত চ’লে গেচে। সেই পথের পশ্চিমে একটি দোতলা ইমারত। সেই ইমারতের একতলায় একটি বঙ্গ-রমণী একাকিনী বাস করেন। সঙ্গে কেবল কয়েকটি দাসদাসী, বেহারা, গোয়ালা, পাচক-ব্রাহ্মণ এবং উপরের তলায় এণ্ড্‌রুজ্ সাহেব নামক একটি ইংরেজ থাকেন। সমস্ত বাড়িটাতে এ ছাড়া আর জন-প্রাণী নেই। সেদিন মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি, মেঘের আড়াল থেকে চন্দ্র ম্লান কিরণ বিকীর্ণ ক’র্‌চেন। এমন সময় রাত্রি যখন সাড়ে এগারোটা, যখন কেবলমাত্র দশবারো জন লোক নিয়ে একাকিনী রমণী বিশ্রাম ক’র্‌চেন, এমন সময়ে ঘরের মধ্যে কে ঐ পুরুষ প্রবেশ ক’র্‌লে? কোন্ অপরিচিত যুবক? কোথায় ওর বাড়ি, কী ওর অভিসন্ধি? হঠাৎ সেই নিস্তব্ধ নিদ্রিত ঘরের নিঃশব্দতা সচকিত করে তুলে সে জিজ্ঞাসা ক’র্‌লে, —“ইস্কুল কোথায়?” অকস্মাৎ জাগরণে উক্ত রমণীর ঘন ঘন হৃৎ-কম্প হ’তে লাগ্‌লো; রুদ্ধ প্রায় কণ্ঠে ব’ল্‌লেন, “ইস্কুল ঐ পশ্চিম দিকে।” তখন যুবক জিজ্ঞাসা ক’র্‌লে, “হেড্‌মাষ্টারের ঘর কোথায়?” রমণী ব’ল্‌লেন, “জানিনে।”

 তা’রপরে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। ঐ যুবক সেই ম্লান জ্যোৎস্নালোকে সেই ঝিল্লি-মুখরিত মধ্যরাত্রে আবার আশ্রমের কঙ্কর-বিকীর্ণ পথে আশ্রম কুক্কুরবৃন্দের তারতিরস্কার শব্দ উপেক্ষা ক’রে দ্বিতীয় একটি নিঃসহায়া অবলার গৃহের মধ্যে প্রবেশ ক’র্‌লে। সেই ঘরে তৎকালে উক্ত রমণীর পূর্ণবয়স্ক একটি স্বামীমাত্র ছিল, আর জন-প্রাণীও না। সেখানেও পূর্ব্ববৎ সেই দুটি মাত্র প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের শব্দে স্তিমিত-দীপালোকিত সেই নির্জ্জন প্রায় কক্ষটি আতঙ্কে নিস্তব্ধ হ’য়ে রইলো। লোকটা বহুদূর দেশ থেকে হেড্‌ মাষ্টারকে খুঁজ্‌তে খুঁজ্‌তে কেন এখানে এলো? তা’র সঙ্গে কিসের শত্রুতা? সেই রাত্রে স্বামীসনাথা ঐ একটি রমণী এবং স্বামীদূরগতা অন্য অবলা না জানি তাদের সরল কোমল হৃদয়ে কী আশঙ্কা বহন ক’রে ঘুমিয়ে প’ড়্‌লো! পরদিন প্রভাতে হেড-মাষ্টারের মাষ্টার বাদ দিয়ে বাকি ছিন্ন অংশ কি, কোথাও পাওয়া যাবে—তাঁরা আশঙ্কা ক’রেছিলেন?

 তা’রপরে তৃতীয় পরিচ্ছেদ। পরদিন প্রথম নারীটি আমাকে ব’ল্‌লেন, “তাত, মধ্যরাত্রে একটি যুবক—ইত্যাদি।” শুনে আমার পাঠিকা বিস্মিত হবেন না-যে, আমি আশ্রম ছেড়ে পালাইনি; এমন কি, আমি তরবারিও কোষোম্মুক্ত ক’র্‌লুম না। কর্‌বার ইচ্ছে থাক্‌লেও তরবারি ছিল না, থাক্‌বার মধ্যে একটা কাগজ-কাটা ছুরি ছিল। সঙ্গে কোনো পদাতিক বা অশ্বারোহী না নিয়েই আমি সন্ধান ক’র্‌তে বেরোলুম, কোন্ অপরিচিত যুবা কাল নিশীথে “হেড্‌মাষ্টার কোথায়” ব’লে অবলা রমণীর নিদ্রা ভঙ্গ ক’রেচে?

 তা’রপরে উপসংহার। যুবককে দেখা গেল, তাকে প্রশ্ন করা গেল। উত্তরে জানা গেল—এখানে তা’র কোনো একটি আত্মীয়-বালককে সে ভর্ত্তি ক’রে দিতে চায়। ইতি সমাপ্ত। ২৬ আষাঢ়, ১৩২৬।