ভারতের নবজন্ম

 ভারতের নবজন্ম হইতেছে—এই ধরণের কথা আজকাল আমাদের মধ্যে খুবই শুনা যায়। ফলতঃ, দেশে যে একটা নূতন জীবনের, নূতন চিন্তার বহুবঙ্কিম ধারা ক্রমেই ফুটিয়া উঠিতেছে, ক্রমেই বাড়িয়া চলিয়াছে, তাহা দেখিয়া মনে হয় ভারতের সত্য সত্যই নবজন্ম হইতেছে। যদি তাই হয়, যদি বাস্তবিকই ভারত একটা নূতন জন্ম গ্রহণ করিতে চলিয়া থাকে, তরে ব্যাপারটি কেবল তাহার নিজের পক্ষে নয়, জগতের পক্ষেও যে কত বড় অমূল্য জিনিষ হইয়া পড়ে, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। নিজের দিক্ দিয়া দেখিতে গেলে, এই নবজন্মের অর্থ, ভারতের যে চিরন্তন ধর্ম্ম, যে সমষ্টিগত শিক্ষাদীক্ষা তাহার পুনঃপ্রতিষ্ঠা বা পরিবর্ত্তন—এবং এ কথা বলিতে মুখ্যতঃ ও গৌণতঃ যাহা কিছু বুঝায় তাহা সবই সেই নবজন্মের অন্তর্ভূক্ত। আর জগতের দিক্ দিয়া দেখিতে গেলে দেখি, একটা অভিনব শক্তির অভ্যুত্থান, আর সেই শক্তির সম্মুখে কত অভিনব সম্ভাবনা। মনের যে ভঙ্গী, অন্তরাত্মার যে ভাব আধুনিক মানুষের চিন্তাধারাকে এতদিন অবধি নিয়ন্ত্রিত করিয়া আসিয়াছে, তাহা হইতে কত পৃথক্‌ ঐ উদীয়মান্ শক্তির ছন্দ—ইহার অনুরূপ কিছু পাইতে হইলে আমাদিগকে যাইতে হইবে ভবিষ্যতে, ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রিত করিবে যে ভাব, যে ভঙ্গী একমাত্র তাহারই সহিত ইহার তুলনা হইতে পারে। সে যাহা হউক, ভারতের পক্ষে ভারতের নবজন্ম যে কি বস্তু শুধু সেই কথাটাই আপাততঃ আমি আলোচনা করিতে চাই। কারণ, ভারতের নবজীবন সমস্ত মানবজাতিকে লইয়া কি করিবে বা না করিবে, এই বড় সমস্যার আগে হইতেছে, ভারত নিজে তাহার নিজের জীবন লইয়া কি করিবে, এই ছোট সমস্যাটি। বিশেষতঃ, অনতিবিলম্বে এই সমস্যাটি পূরণ করাই আমাদের পক্ষে বোধ হয় একান্ত প্রয়োজনীয় হইয়া পড়িবে।

 সকলের আগে গোড়ার প্রশ্ন হইতেছে, বাস্তবিকই ভারতের একটা নবজন্ম আসিয়াছে কি না। প্রশ্নটির উত্তর নির্ভর করিবে ‘নবজন্ম’ বলিতে কি বুঝি আমরা তাহার উপরে। তা ছাড়া ভবিষ্যতে কি ঘটে বা না ঘটে তাহার উপরেও অনেক নির্ভর করিবে—কারণ, জিনিষটি বর্ত্তমানে রহিয়াছে অতি অপূর্ণ অবস্থায় পরে তাহা কি রূপ লইবে বা না লইবে তাহা এখন পর্যন্ত কিছু জোর করিয়া বলা যায় না। ‘নবজন্ম’ কথাটা ইউরোপীয় রেনাসেন্স (Renaissance) কথাটির প্রতিধ্বনি—নবজন্ম বলিতেই ইউরোপ তাহার শিক্ষাদীক্ষার যে সন্ধিমুহূর্ত্তকে প্রথম এই নাম দিয়াছিল, তাহারই চিত্র আমাদের মনে পড়িয়া যায়। কিন্তু ইউরোপের এই নবজন্মকে ঠিক নবজাগরণ বলা যায় না, তাহা একটা আমূল পরিবর্ত্তন, একটা বিপর্য্যয়। ইউরোপ আগে ছিল খৃষ্টীয়-ধর্ম্মের, টিউটন-জাতির, ফিউডতন্ত্রের হাবে ভাবে অভিভূত; তাহার উপর আসিয়া পড়িল প্রাচীন গ্রীস ও রোমের শিক্ষাদীক্ষার বন্যা, তাহাতে পুরাতন ধারা ধুইয়া মুছিয়া গেল; সেখানে স্থাপিত হইল নূতন ভাব নূতন রূপ, আর তাহার আনুসঙ্গিক বিপুল জটিল অভিনব বিধি ব্যবস্থা সব। এই ধরণের নবজন্ম ভারতে কখনও সম্ভব নয়। ভারতের নবজন্মের তুলনা ইউরোপে কতক পাওয়া যাইতে পারে আধুনিক আয়র্লণ্ডের নবীন সাধনায়। আয়র্লণ্ডের যে জাতীয় জাগরণ আজ দেখা দিয়াছে, তাহা চাহিতেছে আপনাকে প্রকাশ করিয়া ধরিবার নূতন একটা অনুপ্রেরণা,—এমন একটা অনুপ্রেরণা যাহা তাহাকে লইয়। চলিবে অন্তরাত্মার দিকে এবং এই অন্তরাত্মার শক্তিতেই সে নূতন করিয়া গড়িবে সৃজিবে বৃহৎ ভাবে। আয়র্লণ্ড এই অনুপ্রেরণা পাইয়াছে আবার তাহার প্রাচীন কেল‍্টিক্ শিক্ষাদীক্ষার মধ্যে ফিরিয়া গিয়া—তাহার যে শিক্ষাদীক্ষা ইংরাজী শিক্ষাদীক্ষার তলে এতদিন চাপা পড়িয়া ছিল। ভারতবর্ষেও এই রকমেরই একটা পুনরভ্যুত্থান ঘটিতেছে। ১৯০৫ সালের রাষ্ট্রনীতিক আন্দোলনে এই জিনিষটিই বিশেষভাবে মুখ লইয়া উঠিয়াছে। তবুও আয়র্লণ্ডের সহিত তুলনা করিলেও ভারত যে সত্য লইয়া জাগিতেছে, তাহার সবখানি হৃদয়ঙ্গম হইবে না।  তারপর আর একটি জিনিষ আমাদিগকে দেখিতে হইবে। ভারতে যে নবজীবনের চাঞ্চল্য দেখা দিয়াছে, তাহা এখনও একটা বিপুল অথচ অস্পষ্ট কুয়াসার মত— তাহার মধ্যে খেলিতেছে নানা বিরোধী ধারা; শুধু এখানে ওখানে দুই একটা কেন্দ্রে স্পষ্টতর, স্ফুটতর রূপায়নের চেষ্ট। চলিয়াছে, এই দুই একটা স্থানেই নূতন চেতনা নিজের সম্বন্ধে সজাগ হইয়া বাহিরে দেখা দিয়াছে। কিন্তু এই সব নব রূপায়ন সাধারণের মনের মধ্যে যে সম্যক্ প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে, তাহা এখনও বলা চলে না। এগুলি ভবিষ্যতের প্রথম পরিকল্পনা,—বৈতালিকের কণ্ঠে আবাহন, অগ্রণীর হাতে মশাল। মোটের উপর আমরা দেখিতেছি, বিরাট কি এক শক্তি নূতন জগতে ভিন্নপ্রকার ক্ষেত্রে জাগিয়া উঠিতেছে। কিন্তু ছোট বড় অসংখ্য বন্ধনে তাহার প্রতি অঙ্গ এখনও আবদ্ধ——এই সব বন্ধন কতক সে অতীতে নিজেই নিজের চারিদিকে আঁটিয়া দিয়াছে, কতক বা ইদানীন্তন কালে বাহির হইতে তাহার উপর আরোপিত হইয়াছে। এই সকল কাটিয়া ছিঁড়িয়া সে চাহিতেছে মুক্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইতে, স্বকীয় মূর্ত্তি প্রকাশ করিয়া ধরিতে, চতুর্দ্দিকে নিজের প্রতিভা ছড়াইয়া দিতে, জগতের উপর আপনার নাম আকিয়া দিতে। বাঁধন যে আস্তে আস্তে কাটিয়া চলিয়াছে তাহার শব্দ সকল দিকেই আমরা শুনিতেছি, এখানে ওখানে একেবারে হঠাৎ ছিঁড়িয়া পড়িবার ধ্বনিও শ্রবণে আসিতেছে। তবুও মুক্তগতির স্বাচ্ছন্দ্য এখনও আসে নাই। চোখে দৃষ্টি এখনও আবছায়া, অন্তরাত্মার কোরক এই এখনও অর্দ্ধবিকশিত, মহাশক্তি এখনও উঠিয়া দাঁড়ান নাই।

 নবজন্ম বা জাগরণ কথাটা ভারতের পক্ষে আদৌ প্রযোজ্য কিনা, তাহা আর একটু বিচার করিয়া দেখা দরকার। কারণ, অনেকে বলিতে পারেন যে ভারত চিরদিনই জাগ্রত, নূতন করিয়া সে আবার জাগিবে কি? কথাটার মধ্যে যে কিছু সত্য নাই, এমন নয়। বিশেষতঃ, ভারতের পূজারী বিদেশী যাঁহারা বাহির হইতে এখানে আসেন, তাঁহাদের মনে কোন পুরাতন সংস্কারের আবর্জনা না থাকায়, প্রথমেই যে জিনিষটি তাঁহাদের চোখে লাগে, তাহা হইতেছে অতীতের ও বর্তমানের ভারতের মধ্যে একটা সজীব সংযোগ-ধারা। এ জিনিষটি এত স্পষ্ট যে, অন্য সব জিনিষ হঠাৎ নজরে না-ও পড়িতে পারে। কিন্তু আমরা যাহারা দেশের সন্তান, আমরা ত’ ঠিক সে ভাবে দেখিতে পারি না। ভারতে যে বিপুল অধঃপতন অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে একেবারে চরমে পৌঁছিয়াছিল, তাহার বিষময় ফল হইতে আমরা এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি পাইতেছি না। এ কথা কখনও অস্বীকার করা যাইবে না যে, ভারতের সত্য সত্যই এমন একটা সঙ্কটের কাল আসিয়াছিল—তাহা খুব বেশী দিন স্থায়ী হয় নাই সত্য বটে; কিন্তু সেই অল্প সময়ের মধ্যেই কি দারুণ ক্ষতি করিয়া দিয়াছে!—যখন জীবনের সে দীপ্ত বহ্নি নির্ব্বাপিতপ্রায় হইয়া গিয়াছিল, এমন কি, একটা মুহূর্ত্ত আসিয়াছিল, যখন বোধ হইতেছিল এই বুঝি ভারতের শেষ, এইখানেই বুঝি ভারতের ইতি। তখনই রাষ্ট্রে তাহার দেখা দিয়াছিল সেই বিশৃঙ্খলতা, অরাজকতা, যাহার কল্যাণে ইউরোপের ভবঘুরে সকলে এখানে আস্তানা খুঁজিয়া পাইল। তখনই অন্তরে তাহার আসিয়া পড়িতে লাগিল ঘোর তামসিকতা, যাহার কবলে কবলিত অস্তমিত হইয়া চলিল ধর্ম্মে, শিল্প-কলায়, তাহার সকল স্জন-প্রতিভা। দর্শন, বিজ্ঞান, বুদ্ধির সৃষ্টি বহু পূর্ব্বেই লোপ পাইয়াছিল—যাহা কিছু বা ছিল, তাহা পাইয়া বসিয়াছিল বাক্‌সর্ব্বস্ব পাণ্ডিত্যের জড় স্থাবরত্ব। অধঃপতনের চরম সীমার লক্ষণ সব সর্ব্বত্র তখন ফুটিয়া উঠিয়াছিল। ইহাকেই ভারত বুঝি নাম দিয়াছে সেই যুগসন্ধি বা প্রলয়—যেখানে একটা সৃষ্টির শেষ, যাহার পরে আবার নূতন সৃষ্টির আরম্ভ। এই যে কালধর্ম্ম এবং ইহার সাথে সাথে যে আসিয়া পড়িল বাহির হইতে আগত ইউরোপীয় শিক্ষাদীক্ষার চাপ, তাহাই ডাকিয়া আনিল ভারতের নব অভ্যুত্থান।

 এই অভ্যুত্থান বুঝিতে হইলে তবে মোটামুটি তিনটি ধাপের উপর আমাদের নজর দিতে হইবে। প্রথম হইতেছে, অতীতে ভারতের সেই সমুন্নত শিক্ষাদীক্ষা ও জীবনের মাধ্যন্দিন যুগ, আর তার পরে আসিয়া পড়িল যে জড়তা ও তামসিকতার সন্ধ্যা। দ্বিতীয় হইতেছে, পাশ্চাত্যের সহিত ভারতের প্রথম সংস্পর্শ,— যখন ভারত মরিয়া পচিয়া গলিয়া প্রায় লোপ পাইতে বসিয়াছিল। তৃতীয় হইতেছে, কিছুদিন হইতে একটা স্পষ্ট মূর্ত্তি লইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে যে নবজীবনের স্পন্দন, যে উর্দ্ধমুখী গতি। একটি কথা এখানে স্মরণে রাখিতে হইবে এবং অনেকেই ন্যায্যতঃ এ কথাটির উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন মনে করিয়াছেন। তাহা এই যে, ভারত চিরদিনই—এমন কি জাতীয় জীবনের ঘোর অবসাদের মধ্যেও, অক্ষত রাখিয়াছে তাহার অধ্যাত্মপ্রতিভা। এই বস্তুটিই ভারতকে রক্ষা করিয়াছে ভারতের প্রত্যেক সন্ধিমুহূর্ত্তে—আর আজকার যে নবজন্ম দেখা দিয়াছে, তাঁহারও গোড়ার অনুপ্রেরণা ঐ বস্তুটিরই মধ্যে। ভারতকে যে চাপের ভার সহ্য করিতে হইয়াছে, অন্য কোন জাতি তাহাতে বহু পূর্ব্বেই দেহ-প্রাণ সমেত লুপ্ত হইয়া যাইত। এ কথা সত্য। কিন্তু তবুও স্বীকার করিতে হইবে যে, ভারত প্রাণে বাঁচিয়া থাকিলেও, দেহে তাহার ঘুণ ধরিয়া আসিতেছিল; জড়ত্বের আক্রমণে এক সময়ে মনে হইয়াছিল তাহার আত্ম-শোধনের সব শক্তি বুঝি পরাহত হইয়া যায়,—জড়ত্বই ত মৃত্যু! আবার যখন এই মুক্তির, নবজীবনের দিন আসিয়াছে তখন ভারতকে তাহার নিজস্ব প্রকৃতি, তাহার অন্তরাত্মার ধর্ম্মটি ধরিয়া রহিতেই হইবে। কিন্তু তাহার যে আকৃতি, যে দেহায়তন, সেখানে অনেক কিছুই পরিবর্তন ঘটিবে এমন সম্ভাবনা আছে। ভারতের সেই একই অন্তরাত্মা পুনর্জীবিত হইয়া নূতন একটা আধার গড়িয়া লইবে, তাহারই প্রেরণায় নূতন রূপ সব ফুটিয়া উঠিবে দর্শনে, শিল্পে, সাহিত্যে, শিক্ষায়, রাষ্ট্রে, সমাজে—ভারতের নবজন্মের ধরণ এই রকমেই হইবে বলিয়া মনে হয়। এই সব নূতন রূপ, অতীত ভারত যে সব সত্য প্রকাশিত করিয়াছে, তাহার বিরোধী হইবে না। কিন্তু প্রাচীন সত্যগুলিকে বিশুদ্ধ করিয়া পূর্ণতর করিয়া নূতন ভঙ্গীতে আবার প্রকাশিত করিবে।

 ভারতের এই যে পুরাণী প্রকৃতি, এই যে তাহার আপনকার অন্তরাত্মা, সেটি কি? সাধারণভাবে দেখিতে গেলে দেখা যায় যে, ভারতবাসীর চিন্তার ধরণে স্বভাবতঃই আছে কেমন তত্ত্বের দিকে, দার্শনিকতার দিকে ঝোঁক; প্রবল একটা ধর্ম্মপ্রাণতা, বৈরাগ্যময় ভাবুকতা তাহার যেন মজ্জাগত; তাহার দৃষ্টি সর্ব্বদাই আবদ্ধ; যেন একটা পারলৌকিক আদর্শে, এই জিনিষটিই ইউরোপীয়দের চোখে পড়িয়াছে এবং তাঁহারা এমনভাবে লিখিয়া ও বলিয়া থাকেন যেন ভারতের সমস্ত স্বভাব বা প্রকৃতি বা অন্তরাত্মা ইহারই মধ্যে। তাঁহাদের মতে ভারত কি? না, অসীমতার অনুভবে অভিভূত একটা তাত্ত্বিক, দার্শনিক, ধার্ম্মিক মন— জীবনের অনুপযোগী, স্বপ্নবিলাসী, অকর্ম্মা—‘মায়া’ নাম দিয়া কর্ম্ম হইতে, জীবন হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়াই সে চলিয়াছে। ভারতবাসীও কিছুকাল ধরিয়া অন্যান্য বিষয়ের মত এই বিষয়েও তাহার ইউরোপীয় শিক্ষকের ও গুরুর বাক্যে নির্ব্বিচারে সায় দিয়া আসিয়াছে। তাহার দর্শনের, তাহার সাহিত্যের, তাহার ধর্ম্মের কথা সে বুক ফুলাইয়া কহিতে শিখিয়াছে; কিন্তু আর সব বিষয়ে শুধু শিক্ষার্থী, অনুচিকীর্ষু হইতে পারিলেই নিজেকে কৃতার্থ মনে করিয়াছে। তার পরে ইউরোপই আবার একদিন আবিষ্কার করিল যে, সৌন্দর্য্যে, শক্তিতে, অপরূপ একটা শিল্পকলাও ভারতের ছিল। কিন্তু এই পর্য্যন্ত। এতদ্ব্যতীত ভারতের আরও যে কিছু আছে বা থাকিতে পারে, তাহা ইউরোপের জ্ঞানগোচরে আদৌ আসিয়াছে কি না সন্দেহ। সুখের বিষয়, ইতিমধ্যে ভারত পরমুখাপেক্ষী হইয়া থাকার অভ্যাস ছাড়িতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে, মুক্তির পথে অগ্রসর হইতে হইতে নিজের চোখ দিয়া নিজের অতীতকে সে দেখিতে আরম্ভ করিয়াছে। ফলে অনতিবিলম্বেই তাহার বোধগম্য হইয়াছে যে, এতদিন সে যে ভাবে দেখিয়াছে অর্থাৎ যে ভাবে তাহাকে দেখান হইয়াছে, সেটি সম্পূর্ণ ভুল পথ। বাস্তবিক, জিনিষকে একান্ত এক দিক দিয়াই দেখিলে ভুল হইতে বাধ্য, আর সে ভুল পরিশেষে ধরা পড়েই। জর্ম্মণী সম্বন্ধেও কি এক সময়ে মনে হয় এই রকমের একটা ভুল ধারণা সর্ব্বসাধারণের ছিল না? দর্শনে ও সঙ্গীতে জর্ম্মণী খুব বড় বটে, কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে সে পথ ভুলিয়া আসিয়া পড়িয়াছে, কর্ম্মজগতের স্কুল উপকরণরাজির পূর্ণ ব্যবহার সে জানে না—সুতরাং সে হইতেছে স্বপ্ন-বিলাসীর, ভাবুকের, পণ্ডিতের জাত—সে জিজ্ঞাসু, অধ্যবসায়ী, কর্ম্মঠ সন্দেহ নাই, কিন্তু রাজনীতিক দক্ষতা হিসাবে পঙ্গু—একদিকে কি মহান্, আর একদিকে আবার কি তুচ্ছ, এই জর্ন্মণী—admirable ridiculous Germany. কি নিদারুণ আঘাতে ইউরোপের এই যে ভুল ভাঙ্গিয়া গেল, তাহা আমরা জানি। ভারতের নবজীবন পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হইলে, ভারত-প্রতিভার সত্যকার প্রকৃতি ও সামর্থ্য দেখিয়াও ইউরোপের ভুল ভাঙ্গিবে— সেই একই রকম দারুণ আঘাতের ফলে নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু তবুও যথেষ্ট মাত্রায় আশ্চর্য্য হইয়া যাইবার মত জিনিষ সেখানে মিলিবে।

 এ কথায় কোন সন্দেহই নাই যে, ভারতীয় চিত্তের আসল কলকাঠি হইতেছে আধ্যাত্মিকতা। অসীমের অনুভব তাহার জন্মগত। ভারত গোড়া হইতেই দেখিয়া বুঝিয়া আসিয়াছে—এমন কি, তর্কবুদ্ধির শুষ্ক বাদ বিচারের যুগে, ক্রম-ঘনায়মান অজ্ঞানের যুগেও এই সূক্ষ্মবোধ তাহার লোপ পায় নাই—যে জীবনের যত বাহ্যিক রূপায়ন, কেবল মাত্র তাহারই আলোকে জীবনকে যথাযথ ধরা যায় না, কেবলমাত্র তাহারই শক্তিতে জীবন যথাযথ যাপন হয় না। স্কুলের নিয়ম, স্কুলের শক্তির মহত্ত্ব সম্বন্ধে সে খুবই সজাগ ছিল; জড়-বিজ্ঞানের যে কি প্রয়োজন তাহা তাহার দৃষ্টিকে কখনও এড়াইয়া যাইতে পারে নাই; দৈনন্দিন জীবনের জন্য যে সব শিল্পকলা দরকার তাহাতেও সে অকুশলী ছিল না। কিন্তু সে জানিত যে, স্থুল যতক্ষণ স্থুলের অতীত যাহা, তাহার সহিত সত্য সম্বন্ধে সম্মিলিত না হয়, ততক্ষণ স্থুল আপনার পূর্ণ ব্যঞ্জনা পায় না; সৃষ্টির যে জটিল বৈচিত্র্য তাহা পরিচিত মানুষী-সংজ্ঞার সহায়ে ব্যাখ্যাত হয় না, তাহা মানুষের স্থূল দৃষ্টির গোচরীভূত নহে; স্কুলের পিছনে, মানুষের নিজেরই ভিতরে আছে এমন আরও সব শক্তি, নৈমিত্তিক জীবনের সাধারণ জ্ঞানে, যাহা তাহার কাছে ধরা দেয় না; মানুষ নিজের সত্তার খুব সামান্য অংশেরই সম্বন্ধে সচেতন; দৃষ্টকে ঘিরিয়া রহিয়াছে অ-দৃষ্ট; ইন্দ্রিয়কে ঘিরিয়া রহিয়াছে অতীন্দ্রিয়—সসীমকে চিরদিনই ঘিরিয়া রহিয়াছে অসীম। ভারত আরও জানিত যে, আপনাকে ছাড়াইয়া উঠিবার শক্তি মানুষের আছে, বর্ত্তমানে সে যাহা, তাহা অপেক্ষা নিজেরই পূর্ণতর গভীরতর সত্ত্বা একটা লাভ করিতে সে পারে। ইউরোপ আজকাল মাত্র এই সব সত্য দেখিতে আরম্ভ করিয়াছে; তবুও এখনও এ সব সত্য তাহার কাছে এত বৃহৎ ষে, তাহার সাধারণ বুদ্ধির কাছে ইহা সহজ হইয়া পড়ে নাই। কিন্তু ভারতের দৃষ্টির সম্মুখে পূর্ণ ব্যক্ত ছিল মানুষকে ছাড়াইয়া রহিয়াছে যে সব অগণিত দেবতা, দেবতাকে ছাড়াইয়া রহিয়াছে যে ইশ্বর, ঈশ্বরকে ছাড়াইয়া রহিয়াছে যে মানুষের নিজেরই অনির্ব্বচনীয় অনস্ত সত্তা। ভারত দেখিয়াছে যে এই জীবনকে অতিক্রম করিয়া উঠিয়া চলিয়াছে আরও সব জীবনের পরিক্রম, বর্ত্তমান মানসকে অতিক্রম করিয়া উঠিয়া চলিয়াছে আরও সব মানসের পরিক্রম, সকলের উপরে উদ্ভাসিত আত্মার মহিমা। এই দৃষ্টি তার ছিল বলিয়াই ভারত পাইয়াছে একটা প্রশান্ত দুঃসাহস—সে দৃষ্টিতে নাই কোন সঙ্কোচ, নাই কোন ক্ষুদ্রতা। ইহারই কল্যাণে যে কাজে দরকার অন্তরাত্মার বল, বুদ্ধিবৃত্তির বল, মনের বল, প্রাণের বল, তেমন কাজে কখনও সে পশ্চাৎপদ হয় নাই। ভারত মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছে যে, এমন কোন বস্তু নাই, যাহা মানুষে আধিকার করিতে পারে না—প্রয়োজন শুধু ইচ্ছাশক্তিকে, জ্ঞানশক্তিকে শাণিত সমর্থ করিয়া তোলা। অন্তরের মধ্যে রহিয়াছে যে লোকপরম্পরা তাহা মানুষ জয় করিতে পারে, মানুষ হইতে পারে স্বরূপস্থ পুরুষ; মানুষ দেবতা হইতে পারে, ঈশ্বরের সহিতও একীভূত হইতে পারে, এমন কি, হইয়া যাইতে পারে অনির্ব্বচনীয় ব্রহ্ম। কিন্তু কেবল সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াই ভারত সন্তুষ্ট হয় নাই, সিদ্ধান্তের সহিত সাধনার পথও সে বাহির করিয়াছে। যুক্তিসিদ্ধ যাহা, তাহার অব্যর্থ প্রয়োগ কি করিয়া হইতে পারে, যাহা ভিতরে বোধ মাত্র, তাহাকে জাগ্রতে শৃঙ্খলার সহিত প্রকট, স্থিরপ্রতিষ্ঠ করা যায় কি রকমে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই বস্তুমুখী কর্ম্মকৌশল, এই ব্যবহারবুদ্ধিও ভারতের দার্শনিকতার ধাতুগত বিশেষত্ব। যুগের পর যুগ ভারত এই রকমে যে তাহার দিব্যদৃষ্টিকে ধরিয়া চলিয়াছে, উহাকে বাস্তবে পরিণত করিতে প্রয়াস করিয়া আসিয়াছে, এই অভ্যাসের ফলে তাহার আধ্যাত্মিকতার মধ্যে অব্যর্থ অঙ্গরূপে দেখা দিয়াছে, সূক্ষ্মের দিকে একটা প্রবল ঝোঁক, অসীমকে ধরিবার, অধিকার করিবার একটা দুর্দ্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা— ইহা হইতেই আসিয়াছে ভারতের সে সদা জাগ্রত পারত্রিকবুদ্ধি, তাহার ঊর্দ্ধমুখী ভাবুকতা, তাহার ‘যোগ’-বিদ্যা, তাহার দর্শনের, শিল্পকলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

 কিন্তু ভারতের অন্তরাত্মার ইহাই সবখানি ছিল না, হইবার কথাও নয়। পার্থিব লোকে যে আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ, তাহা শূন্যের উপর গজাইতে পারে না। আমাদের পর্ব্বতরাজির শিখর সব স্বপ্নের ভোজবাজীর মত কি মেঘের জঠর হইতে উঠিয়া পড়িয়াছে, মাটির উপর কি তাহাদের প্রতিষ্ঠা নাই? ভারতের অতীতের দিকে তাকাইয়া দেখ। আধ্যাত্মিকতার অব্যবহিত পরেই যে জিনিষটা চোখে পড়ে তাহা হইতেছে একটা বিরাট প্রাণশক্তি—জীবনে অফুরন্ত সামর্থ্যের আনন্দের খেলা, সৃজনকর্ম্মে একটা অসম্ভব রকম প্রাচুর্য্য। ন্যূনপক্ষে তিন হাজার বৎসর, বাস্তবিক কিন্তু আরও অনেক বেশী কাল, ধরিয়া ভারত-প্রতিভা অজস্র অনর্গল ভাবে দুই হাতে ফেলিয়া ছড়াইয়া নিত্যই নূতন নূতন পথে সৃষ্টি করিয়া গিয়াছে কত রকমারী রাষ্ট্র— গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, রাজচক্রবর্ত্তী-তন্ত্র—কত দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য—কত মন্দির, স্মৃতিস্তম্ভ, ইষ্টাপূর্ত্ত,—ধর্ম্মসম্প্রদায়, সাধনামার্গ, শাস্ত্র, অনুষ্ঠান, বিধান, রাজনীতি, সমাজনীতি—ব্যবসা, বাণিজ্য, চিকিৎসা, ঐহিক পারত্রিক সকল রকম বিদ্যা-নাম করিয়া তাহার আর শেষ করা যায় না। আর ইহাদের প্রত্যেকটিতে সে যে কি পরিমাণ কর্ম্মঠতা দেখাইয়াছে, তাহার লেখাজোখা নাই। সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে ত সে সৃষ্টি করিয়াই চলিয়াছে,—তৃপ্তি নাই, শ্রান্তি নাই! শেষ যেন সে কিছুতেই হইতে দিবে না—বিশ্রাম লইবার, হাঁপ ছাড়িবার, কিছুকালের জন্য শক্তি সংগ্রহের জন্য চুপ করিয়া নিস্তেজ হইয়া পড়িয়া থাকিবার প্রয়োজন যেন মোটেও সে অনুভব করে না। নিজের বাহিরেও সে আপনাকে ছড়াইয়া দিল। ভারতের নৌ-বহর সমুদ্র পার হইয়া চলিল। তাহার কাণায় কাণায় ভরা ঐশ্বর্য্য সম্পদ্ উপচিয়া গিয়া পড়িতে লাগিল জুডিয়ায়, মিশরদেশে, রোমরাজ্যে। সাগরের দ্বীপপুঞ্জ সব তাহার উপনিবেশ বক্ষে ধারণ করিল, দিকে দিকে ছড়াইয়া দিল তাহার শিল্প, তাহার কাব্য, তাহার ধর্ম্মমত। ভারতের পদচিহ্ন পাওয়া যায় মেসোপেটেমিয়ার বালুরাশির অন্তরে। তাহারই ধর্ম্ম গিয়া জয় করিল চীন, জাপান আর পশ্চিমে প্রসারিত হইয়া চলিল পালেস্তিন, আলেকসন্দ্রিয়া অবধি। উপনিষদের রূপকাবলী, বৌদ্ধদিগের মহাবাক্য প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল খৃষ্টের কণ্ঠে। ভারতের মাটিতে যেমন, তেমনি ভারতের কর্ম্মেও সর্ব্বত্রই আমরা দেখিতে পাই এই অপরিমেয় জীবনীশক্তির উচ্ছ্বসিত প্রাচুর্য্য। ইউরোপের পণ্ডিতেরাই ত অনুযোগ করিয়া থাকেন যে ভারতের স্থাপত্যে, ভাস্কর্য্যে, শিল্পে, অভাব পরিমাণের—ঐশ্বর্য্যকে রাখিয়া ঢাকিয়া দেখাইবার কোন ইচ্ছাই নাই সেখানে; শূন্যস্থান বা ফাঁক কোথাও নাই, প্রত্যেক ছিদ্রটি সে মণিমুক্তা দিয়া ভরিয়া দিয়াছে, প্রত্যেক অবকাশে ফুটাইয়া ধরিয়াছে অলঙ্কারের আতিশয্য। এই স্বভাব তাহার দোষের হউক কি গুণের হউক, সে বিচার আমরা করিতেছি না। আমরা বলিতেছি, ভারতের ছিল জীবনীশক্তির প্রাচুর্য্য, অন্তরে অনন্তের ভরাট আবেগ আর তাহারই অব্যর্থ পরিণাম হইতেছে ঐ স্বভাব। ভারত দুই হাতে তাহার ঐশ্বর্য্য বিতরণ করিয়া দিয়াছে, কারণ, না করিয়া তাহার উপায় ছিল না। নিখিল অনন্ত আপন আয়তনের এতটুকু ফাঁক পর্য্যন্ত জীবনীশক্তিতে, প্রাণের স্পন্দনে পরিপূর্ণ করিয়া ধরিয়াছে—কেন? কারণ, অনন্ত যে অনন্ত!

 কিন্তু এই যে চরম আধ্যাত্মিক-বোধ আর এই যে জীবনীশক্তির প্রাচুর্য্য, পার্থিব ভোগের সৃজনের আনন্দ —কেবল এই দুইটিই অতীত ভারতের ভাব-ধারার সবখানি নয়। উপরে ইন্দ্রনীল আকাশের প্রশান্ত অনন্ত বিস্তার আর নীচে গ্রীষ্মতাপে উত্তেজিত উর্ব্বর বনভূমির উচ্ছৃঙ্খল সম্পদ—ভারতের চিত্র এরূপ নহে। একযোগে এতখানি ঐশ্বর্য্য দেখিবার অভ্যাস যাহার নাই, তাহারই দৃষ্টিতে বোধ হয়, এই যে সব যায়গা জুড়িয়া অলঙ্কারে ভরিয়া রূপ ফলাইয়া তুলিবার প্রয়াস, ইহা কেবল উচ্ছৃঙ্খল আতিশয্যের বিলাস, এখানে তাল মানের, সুঠাম গঠনের, পরিষ্কার সামঞ্জস্যের নিতান্তই অভাব; এখানে আছে শুধু বিরাট হট্টগোল। ভারতের অন্তরের ছিল আর একটি ভাব-ধারা—সেটি হইতেছে সমর্থ বিচারবুদ্ধি। এই বৃত্তিটি তাহার একদিকে যেমন ছিল স্থির, আত্মস্থ, অন্যদিকে তেমনি ছিল বহুমুখী। একদিকে যেমন চলিত বৃহৎকে আলিঙ্গন করিতে, অন্যদিকে তেমনি চলিত ক্ষুদ্রের মধ্যে প্রবেশ করিতে; তাহা যেমন ছিল শক্তিমান, তেমনি ছিল নিপুণ—তত্ত্বকে যখন সে ধরিতে যায় তখন বিরাট বিশাল তাহার গতিচ্ছন্দ, আবার ক্ষুদ্র বস্তুকে লইয়া যখন তাহার কারবার, তখন সেখানে তেমনি পাই—পদে পদে পুঙ্খানুপুঙ্খ অতিসূক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসা। এই যে বিচারবুদ্ধি, তাহার প্রধান লক্ষ্যই ছিল শৃঙ্খলার দিকে—তবে সে-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত ছিল ভিতরের একটা নিয়মের, বস্তুর অন্তরের সত্যের উপরে। ভারত ভিতরের, অন্তরের দিকে তাকাইয়া চলিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে সর্ব্বদা পরম নিষ্ঠা সহকারে পরীক্ষা করিয়া চলিয়াছে সেই ভিতরের অন্তরের জিনিষকে কি করিয়া বাহিরে প্রয়োগের মধ্যে মূর্ত্ত করিয়া ধরা যায়। কারণ, ভারত হইতেছে ধর্ম্মের ও শাস্ত্রের পীঠস্থান। ব্যষ্টিগত হউক আর বিশ্বগত হউক, প্রত্যেক কর্ম্মচেষ্টার ভিতরের সত্য কি, ছন্দ কি অর্থাৎ ধর্ম্ম কি, ভারত তাহাই খুঁজিয়াছে। সেইটি যখন সে পাইয়াছে, তখন তাহাকে বাস্তব জীবনের ধারায় ঢালিবার চেষ্টা করিয়াছে, নানারূপের মধ্যে, খুঁটি নাটি জটিলতার মধ্যে, সাজাইয়া গুছাইয়া ফেলাইয়া ধরিতে চাহিয়াছে। ভারতের আদিযুগ উদ্ভাসিত অধ্যাত্মের আবিষ্কারে। ভারতের মধ্যযুগে শেষ হইল ধর্ম্মের আবিষ্কার। আর সর্বশেষ যুগে শাস্ত্র আনিয়া দিল প্রয়োগের পুঙ্খানুপুঙ্খ বহুল জটিল বিধি বিধান। এই তিনটি ধারা তাই বলিয়া আবার পরস্পর পরস্পর হইতে একান্ত পৃথক্ ও বিচ্ছিন্ন কখনও ছিল না, তাহারা একসঙ্গেই সর্ব্বদা চলিয়াছে।

 সমস্ত জীবনটি বিচিত্র রকমে নানা ভঙ্গীতে ফলাইয়া খেলাইয়া তুলিবার জন্যই ভারতে গড়িয়া উঠিল যত বিদ্যা, যত শাস্ত্র, তাহার চরম অভিব্যক্তি পাই এই শেষ যুগে। অশোকের সময় হইতে মুসলমানদের আগমনের অনেক পরে পর্য্যস্ত—এই সুদীর্ঘ কাল ব্যাপিয়া ভারতের সজাগ মস্তিষ্ক যাহা সৃষ্টি করিয়াছে, আর কিছু নয়, কেবল তাহার পরিমাণটি দেখিলেই চমৎকৃত হইতে হয়। একথার প্রমাণ সম্প্রতি গবেষকমণ্ডলীই দিতেছেন। তবুও আমাদের মনে রাখা উচিত যে, পণ্ডিতেরা এ পর্য্যন্ত যাহা উদ্ধার করিয়াছেন, তাহা এখনও যাহা পড়িয়া আছে, তাহার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, আর এখনও যাহা আছে, তাহা আবার এককালে যাহা ছিল তাহার অতি সামান্য ভগ্নাংশ। মুদ্রাযন্ত্রের যখন আবিষ্কার হয় নাই, আধুনিক বিজ্ঞান যখনও তাহার সুখ-সুবিধা লইয়া দেখা দেয় নাই, তখন এই যে বিপুল জ্ঞানের সৃষ্টি ও প্রসার চলিয়াছিল, তাহার তুলনা আর কোথাও মিলে না। আমরা আজ যে সব সহায় সুযোগের অধিকারী, তাহা কিছু না পাইয়াও এক স্মৃতিশক্তিকে আশ্রয় করিয়া আর ক্ষণভঙ্গুর তালপত্রকে যন্ত্র করিয়াই বিকাশ পাইয়াছে সেই সব পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা, সেই সব অজস্র রচনা। এই বিশাল অতিকায় সাহিত্য কেবল যে দর্শন ও ধর্ম্মতত্ত্ব, যোগ ও সাধনা, কাব্য নাটক, অলঙ্কার ব্যাকরণ, চিকিৎসা, জ্যোতিষ লইয়াই ব্যাপৃত ছিল, তাহা নয়। সমস্ত জীবনকে ইহা জুড়িয়াছিল—রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, চিত্রবিদ্য| হইতে নৃত্যবিদ্যা পর্য্যন্ত যাবতীয় চতুঃষষ্টিকলা, যাহা কিছু এই পৃথিবীতে মানুষের কাজে আসিতে পারে বা যাহাতে মানুষের মন আকৃষ্ট হইতে পারে, সমস্তই এখানে ছিল। এমন কি, অশ্ব ও হস্তী কিরূপে লালন পালন করিতে হয়, তাহার অতি পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যবস্থা পর্য্যন্ত পাওয়া যায়। আর এই সব প্রত্যেক বিষয় লইয়া এক একটি পৃথক্ শাস্ত্র গড়িয়া তোলা হইয়াছিল, প্রত্যেক বিদ্যারই ছিল নিজের নিজের একটা পরিভাষা, নিজের নিজের একটা বিশাল সাহিত্য। বিষয় খুব বৃহৎ খুব প্রয়োজনীয় হউক আর অতি ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিৎকর হউক, সে সকলের চর্চ্চায় সর্ব্বত্রই সমভাবে ভারত ঢালিয়া দিয়াছে সেই একই উদার ঋদ্ধ সূক্ষ্ম চরম বিচারবুদ্ধি। এক দিকে ছিল তাহার একটা অতর্পণীয় কৌতূহল, জীবনের প্রত্যেক খুঁটিনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানিবার আকাঙ্ক্ষা; আবার আর একদিকে ছিল তেমনি শৃঙ্খলার উপর পরিপাটি করিয়া সাজান-গোছানর উপর একটা সহজ টান; সকল জ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া, ঠিক ঠিক মাত্রাটি ছন্দটি ধরিয়া জীবনের পথে চলিবার একটা নিবিড় সঙ্কল্প। উপরে সমস্তকে ব্যাপিয়া ছিল ভারতের আপন মজ্জাগত সহজাত আধ্যাত্মিকতা, নীচে কর্ম্মজগতে তাহার ছড়াইয়া ছিল একটা অফুরন্ত প্রাণশক্তির সৃজন-প্রতিভা, সতেজ জীবন-ধারার উদাত্ত আবেগ আর এই দুইএর মাঝখানে, দুইটির মধ্যে আদান-প্রদানের সেতু তুলিয়া ধরিয়াছিল এমন একটি সমর্থ, তীক্ষ্ণ, সতর্ক বিচারবুদ্ধি, যাহা কেবল যুক্তির ক্ষেত্রে নয়, কিন্তু কর্ত্তব্যের ক্ষেত্রে, রসজ্ঞতার ক্ষেত্রেও—এই তিনটি ধারার প্রত্যেকটিতে চরম সৃষ্টিতৎপরতাকেই অনুপ্রাণিত করিয়াছিল। প্রাচীন ভারতের শিক্ষাদীক্ষায় পাই যে অপরূপ সামঞ্জস্য, তাহা এই রকমেই গড়িয়া উঠিয়াছিল।

 ফলতঃ, এতখানি জীবনীশক্তি, এতখানি বিচারবুদ্ধি যদি না থাকিত তবে ভারত তাহার আধ্যাত্মিক প্রবৃত্তি লইয়া যাহা করিয়াছে, তাহা কখনও করিতে পারিত না। প্রাণশক্তি যেখানে অর্দ্ধমৃত, বুদ্ধিবৃত্তি যেখানে অবজ্ঞাত, নিপীড়িত, সেই রিক্ত মাটিতেই যে আধ্যাত্মিক-প্রতিভা সব চেয়ে ভাল ফুটিয়া উঠে—ইহা মস্ত ভুল ধারণা। এই ভাবে যে আধ্যাত্মিকতা ফুটিয়া উঠে, তাহার মধ্যে থাকে একটা অস্বাস্থ্যের, দুঃস্থতার অস্বাভাবিক উগ্রতা, পরিণামে তাহার একটা দারুণ প্রতিক্রিয়া আসিতে বাধ্য। বরং যে জাতি যত সমৃদ্ধ জীবন যাপন করিয়া আসিয়াছে, যত নিবিড়ভাবে চিন্তা করিয়া আসিয়াছে, সেই জাতির আধ্যাত্মিকতাও হয় তত সমুন্নত, তত সুগভীর, তত বৈচিত্র্যময়, প্রতিপদে তত ফলপ্রসূ। ইউরোপ এই এতদিন ধরিয়া যে বিপুল জীবনীশক্তি, বিরাট চিন্তাশক্তির খেলাই থেলিয়া আসিয়াছে, তার ফলেই ত বর্ত্তমানে আজ দেখিতেছি, তাহার মধ্যে একটা সত্যকার আধ্যাত্মিক-জিজ্ঞাসা জাগিয়া উঠিবার উপক্রম হইয়াছে। ইউরোপের আধ্যাত্মিকতা একদিন ছিল জীবনরূপ মহাব্যাধির দীন ভিষক্, আজ শুধু সেই আধ্যাত্মিকতার মধ্যে ধীরে ধীরে ফুটিয়া উঠিতেছে একটা উদার গভীর প্রশান্ত দৃষ্টি। ভারতের অধ্যাত্মসাধনার ধারায় যে জিনিষটি ইউরোপের চোখে লাগে, তাহা হইতেছে বৌদ্ধেরা ও মায়াবাদীরা প্রচার করিয়াছেন যে বৈরাগ্য, জীবনের প্রত্যাখ্যান। কিন্তু স্মরণ রাখা উচিত যে, এটি হইতেছে ভারতের দার্শনিক চিন্তা-ধারার একটিমাত্র দিক্, আর এই দিক্‌টির উপর অত্যধিক জোর পড়িয়াছিল তখন, ভারত যখন অবনতির পথে। তা ছাড়া, আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ভারতের জিজ্ঞাসাবৃত্তির ধরণই ছিল এই রকম, কোন একটি তত্ত্বকে পাইলে—সে তত্ত্ব আধ্যাত্মিক হউক আর আধিভৌতিক হউক—কেবল সেইটিকে ধরিয়া কতদুর কোথায় চলিয়া যাওয়া যায়, তাহা সে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে চাহিত। প্রত্যেক বিষয়টিকে ভারত এই রকমে একান্ত করিয়া দেখিত, তাহার অন্তর্গত সকল খুঁটিনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণের জন্যও বটে, আবার তাহার মধ্যে আছে কোন্ অনন্ত, কোন্ চরম নিত্য-সত্য,—কোন্ অতলের, কোন্ সমুচ্চের শেষ সীমা, তাহাই আবিষ্কার করিতে। ভারত জানিত যে, সাধারণ সহজ মানুষের মন হইতেছে তামসিক স্থিতিশীল—জ্ঞানের চিন্তার উপলব্ধির পথে নৃতনের প্রতি, অবাধ অগ্রগতির প্রতি তাহা বাধা দিয়াই দাঁড়ায়; আর মনের গতির মধ্যে একটা আতিশয্য, অতিমাত্রা না থাকিলে সে বাধা ভাঙ্গিয়া ফেলা যায় না। তাই ভারত এই আতিশয্যের অতিমাত্রার পথে চলিয়াছিল অসীম সাহসে অথচ অটুট পদবিক্ষেপে। তাই দার্শনিক চিন্তার, আধ্যাত্মিক উপলব্ধির প্রত্যেক ধারা, প্রত্যেক উপধারার জের শেষ পর্যন্ত সে টানিয়া চলিয়াছিল, সেই শেষ প্রান্ত হইতে সমগ্র সৃষ্টিকে কি রকম দেখায়, সেইখানে দাঁড়াইয়া কোন্ সত্য, কোন্ শক্তিকে অধিকার করা যায়, তাহা পরীক্ষা করিতে চাহিয়াছিল। ভারত যখন জানিতে চাহিল অতিপ্রাকৃতকে, পরাপ্রকৃতিকে, তখন প্রকৃতি ছাড়াইয়া যত উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায় তাহার চেষ্টা সে করিল, দিব্যধর্ম্মের খোঁজে গিয়া দেবতাদের লোকও পার হইয়া চলিয়া গেল। ঈশ্বর পর্য্যন্ত তাহার চোখে ছোট হইয়া পড়িল—আধ্যাত্মিক নাস্তিকতার চরম সে দেখাইল ব্রহ্মবাদে, শূন্যবাদে। আবার যখন বিপরীত দিকে চলিল, তখনও দুরস্ত সাহসে সোজাসুজি খোলাখুলি প্রচার করিল একেবারে জড় নাস্তিকবাদ—ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ— তাহার মধ্যে কোন রকম ধর্ম্মবুদ্ধি বা সাধুগিরিকে এতটুকু আমল সে দেয় নাই। অবশ্য এই ভাবটা ভারতের ছিল খুব একটা অবান্তর দিকের কথা, ভারতের যে চিরপিপাসু জিজ্ঞাসা-বৃত্তি তজ্জনিত একটা খেয়াল মাত্র।

 সকল ক্ষেত্রেই দেখি এই একই ধারা। ভারতে যে আদর্শ ফুটিয়। উঠিয়াছে, তাহার মধ্যে এক দিকে পাই যেমন আত্ম-প্রতিষ্ঠার চরম-স্বাতন্ত্র্যের, প্রভুত্বের, ভোগাধিকারের জন্য অদম্য তৃষ্ণা; অন্যদিকে ঠিক তেমনি পাই আত্মত্যাগের চরম—নিজেকে সর্ব্বতোভাবে ঢালিয়া মুছিয়া দিবার জন্য ঐকান্তিক ব্যাকুলতা। জীবনযাত্রায় যখন সে ধনদৌলত চাহিয়াছে, তখন রাজার ঐশ্বর্য্যও তাহাকে তৃপ্ত করিতে পারে নাই; আবার দারিদ্র্যকে যখন সে বরণ করিয়া লইয়াছে, তখন একেবারে দিগম্বর হইয়া বসিতেও তাহার কোন কুণ্ঠা হয় নাই। বিশেষ ভাব বা আদর্শ তাহার যতই প্রিয় হউক, বিশেষ আচার রীতি তাহার যতই অভ্যস্ত হউক, ভারতের জ্ঞানের দৃষ্টি কোন দিন তাহার মধ্যেই একান্ত বদ্ধ অন্ধ হইয়া পড়ে নাই। সমাজ-শৃঙ্খলার জন্য একদিন তাহাকে জাতি-ভেদের স্থূল কাঠামটিকেই আঁকড়িয়া ধরিয়া পড়িতে হইয়াছিল, কিন্তু তখনও সে এ ভুলটি করে নাই যে, মানুষের অন্তরাত্মাকে, মানুষের মনকে কখন জাতির পাঁতিতে বাঁধা যাইতে পারে। তখনও নীচাদপি নীচের মধ্যে সে দেখিয়াছে নারায়ণকে। ভারত বৈষম্যের উপর জোর দিয়াছে যেন ফিরিয়া আবার সেই বৈষম্যকে অস্বীকার করিবার জন্যই। অবস্থা ও প্রয়োজনের বশে রাষ্ট্রক্ষেত্রে একদিন তাহাকে রাজ-তন্ত্রকেই অত্যধিক পরিমাণে বড় করিয়া ধরিতে হইয়াছিল, রাজাকে ‘নর-দেবতা’ বলিয়াই ঘোষণা করিতে হইয়াছিল। দেশের শক্তিকে এক কেন্দ্রে সংহত না করিয়া, চারিদিকে খণ্ড খণ্ড ভাবে বিক্ষিপ্ত করিয়া ফেলে বলিয়া আগে যে ছিল প্রতিনিধি-শাসিত পৌর-রাষ্ট্র সব সেগুলির ধ্বংস সাধনই তাহাকে করিতে হইয়াছিল। বিভিন্ন পৌর-রাষ্ট্রের পরস্পরের মধ্যে একটা স্বচ্ছন্দ সম্মিলনও দেশের একত্বের পক্ষে যথেষ্ট বলিয়া বিবেচিত হয় নাই। ভারতের মাটিতে তাই গণতন্ত্রের বিকাশ হইতে পারে নাই। কিন্তু তবুও গণতন্ত্রের যে মূল তত্ত্ব, তাহার প্রয়োগ আমরা যথেষ্ট পাই, গ্রাম্য-সংহতির মধ্যে, পৌর-জানপদ-সভাসমিতির মধ্যে, এমন কি, জাতিবন্ধনের মধ্যেও। জনসাধারণের মধ্যেও সকলের আগে ভারতই ভাগবতশক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল এবং রাজা যখন প্রভাবপ্রতিপত্তির চরম শিখরে দাঁড়াইয়া, তখনই তাঁহার মুখের উপরে সে বলিয়া উঠিয়াছে, ‘হে রাজ‍্ন! জনসাধারণের প্রধান দাস—গণদাস ছাড়া তুমি আর কি? ভারত সত্যযুগের যে কল্পনা করিয়াছে, তাহা হইতেছে আধ্যাত্মিক অরাজকতা। এই আধ্যাত্মিকতাকেও ভারত একেবারে চরম সীমায় ঠেলিয়া লইয়াছিল; তবুও ত একটা সুদীর্ঘ যুগ ধরিয়া ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জীবনের স্থূল ভোগের রহস্যও তলাইয়া দেখিতে সে বিরত হয় নাই —এখানেও অম্লময় আয়তনেও সে চাহিয়াছিল সকল রকম ‘অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্’ সিদ্ধির সম্পদ, সকল রকম তীব্র-গভীর অনুভব উপলব্ধি। তবে এই প্রসঙ্গে একটা বিষয় লক্ষ্য করিবার আছে। ভারত এই যে দুই সম্পূর্ণ বিপরীত, পরস্পর বিরোধী পথে যুগপৎ ছুটিয়া চলিয়াছে, তাহার মধ্যে কখন কোন বিশৃঙ্খলতা দেখা দেয় নাই। সুখবাদী হইয়া পড়িলেই ইউরোপকে আমরা একাধিকবার দেখিয়াছি যে রকম অবাধ অনাচারে ডুবিয়া যাইতে, ভারতে অতি ঘোর সুখবাদের যুগেও তাহার তুলনা কিছু পাই না। কারণ, ভারতের আছে যে একটা আধ্যাত্মিক, একটা নৈতিক প্রতিষ্ঠা, শুধু তাই নয়; ভারতের চিন্তাশীলতা ভারতের সৌন্দর্য্যবোধও এই বিষয়ে ভারতকে রক্ষা করিয়াছে। চিন্তাশীলতার মধ্যে আছে নিয়মানুবর্ত্তিতা, সৌন্দর্য্যবোধের মধ্যে আছে ছন্দের বোধ—উভয়েই বিশৃঙ্খলতার পরিপন্থী। ভারত সব বিষয়েই একেবারে অতিমাত্রায় গিয়া পৌছিয়াছে সন্দেহ নাই; কিন্তু সেই অতিমাত্রার মধ্যেই সে আবার মাত্রা প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, তাহার প্রয়োগে খুঁজিয়া বাহির করিয়াছে একটা নিয়ম, তাল মান, সুষ্ঠু রূপায়ন। তা ছাড়া, অতিমাত্রার দিকে এই তীব্র টানের সাথে সাথেই ভারতের সহজাত স্বভাবসিদ্ধ ছিল আর একটি বৃত্তি—সামঞ্জস্যের বৃত্তি, বহুকে, নানাকে, একের অখণ্ডের মধ্যে সাজাইবার কৌশল। ইহারই কল্যাণে, প্রত্যেক গতিধারার চূড়ান্ত জের টানিয়া আবার সে ফিরিয়া আসিয়াছে, এইভাবে যে সব জ্ঞান সে আহরণ করিয়াছে তাহাদিগকে আবার মিলাইয়া এক করিয়া লইয়াছে, কর্ম্মসাধনায় প্রতিষ্ঠানরচনায় স্থাপিত করিয়াছে একটা সঙ্গতি, সম্মেলন। গ্রীক-জাতি ছন্দ ও সঙ্গতি পাইয়াছিল নিজেকে সর্ব্বদা সীমার ভিতরে বাঁধিয়া রাখিয়া—সীমানা কাটিয়া কাটিয়া; কিন্তু ভারতের ছন্দ ও সঙ্গতির মূল তাহার বিচারবুদ্ধি, তাহার শ্রেয়োবোধ, তাহার রসানুভূতির সহজ-শৃঙ্খলা, তাহার মনের ও প্রাণের সুসমঞ্জস প্রেরণা।

 এই তথ্যগুলি এমন করিয়া বিশদভাবে বলিতে হইতেছে, কারণ, অনেকে এ সব কথা সহজেই ভুলিয়া যান—তাঁহাদের দৃষ্টি আবদ্ধ কেবল শেষ দিকের কয়েকটি যুগে ভারতের চিন্তা ও ভাবে যে সকল ধরণ-ধারণ অতিকায় হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছিল তাহারই মধ্যে। কিন্তু শুধু এই গুলির উপরেই জোর দিয়া চলিলে ভারতের অতীত সম্বন্ধে যে জ্ঞান তাহাতে অনেক ফাঁক, অনেক ভুল থাকিয়া যাইবে; ভারতের শিক্ষাদীক্ষার অর্থ কি, কোন্ নিবিড় অনুপ্রেরণায় সে চলিয়াছে, তাহার অখণ্ড রূপ আমরা কখনও ধরিতে পাইব না। অতীত চলিয়া যাইতে যাইতে ভাটার মুখে যে শেষ পলিমাটি রাখিয়া গিয়াছে তাহাই হইতেছে বর্ত্তমান। এই বর্ত্তমান হইতেই আবার ভবিষ্যতের আরম্ভ, সন্দেহ নাই। কিন্তু এই বর্ত্তমানের মধ্যে সুপ্ত রহিয়াছে ভারতের সমস্ত অতীত—তাহা নষ্ট হয় নাই, নবরূপ ধরিয়া আপনাকে আবার প্রকাশিত করিবার জন্যই তাহা গোপনে অপেক্ষা করিতেছে। ভারতের ছিল যে একটা বিপুল সৃজনপ্রতিভা তাহাতে যখন ভাটা ধরিয়াছে তখনই বলি আসিয়াছে অবনতির যুগ। সেই হৃজন-প্রতিভাকে যদি সম্যক্‌ হৃদয়ঙ্গম করিতে আমরা চাই, তবে তাহাকে দেখিতে হইবে তাহার ভরা জোয়ারের যুগে। ভারতের নবজন্ম অর্থ, আবার সেই জোয়ারের আবির্ভাব, সেই জোয়ারের প্রাণ যাহা ছিল—রূপ হয় ত সম্পূর্ণ বিভিন্ন হইতে পারে—তাহারই পুনর্বিকাশ। সুতরাং ভারতের নবজন্মের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিচার করিয়া দেখিতে হইলে, কি সব শক্তি তাহার ফুটিবে, কতদূর তাহার প্রসার হইবে, তাহা খোঁজ করিতে হইলে আমাদিগকে এই চলিত ধারণাটি ভুলিয়া যাইতে হইবে যে, বিষয়-বিমুখ পরত্র-মুখী দার্শনিক তত্ত্ববিচারই ছিল ভারতের জীবনের একমাত্র সুর এবং ইহারই মধ্যে ভারতের সব সৃষ্টির সব ছন্দ ডুবিয়া তলাইয়া গিয়াছে। তাহা নহে, ভারতের জীবনের মূল সুর দিয়াছে আধ্যাত্মিক উপলব্ধি— আর সে সুর মোটেও একটানা একঘেয়ে নয়, রঙের রেখার খেলায়,—রূপবৈদগ্ধ্যে—তাহা বহু বিচিত্র, যেমন তাহা সহজে নানাদিকে নানাভাবে আপনাকে বিস্তৃত, প্রসারিত করিয়া দিয়াছে তেমনি আবার উর্দ্ধ হইতে উর্দ্ধে, উচ্চ হইতে উচ্চতর গ্রামে উঠিয়া আপনার একাগ্র তীব্রতার পরিচয় দিয়াছে। অবশ্য এই আধ্যাত্মিকতার সুরটিই আর সকল সুর ছাপাইয়া উঠিয়াছে, এইটিই বহিয়াছে গোড়ায়, সদা সর্ব্বদা বারে বারে এইটিই আসিয়া দেখা দিয়াছে, আর যাহা কিছু তাহা দাঁড়াইয়াছে ইহাকেই ভিত্তি করিয়া। ভারতের গরিমার প্রথম যুগ ছিল এই রকম এক বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার যুগ। জীবনের সত্য তখন সে এক মনে এক চিত্তে খুঁজিয়াছে, একটা সাক্ষাৎ-বুদ্ধি, অপরোক্ষ-দৃষ্টির সহায়ে—বাহিরের ও ভিতরের, স্থূল ও সূক্ষ্ম জগতের বিষয় একটা অন্তর্ম্মুখী অনুভবের ও জ্ঞানের ভিতর দিয়া উপলব্ধি করিয়াছে ও ব্যাখ্যা দিয়াছে। এই গোড়ার আরম্ভ তাহার উপর যে ছাপ দিয়া গিয়াছে, ভারত কোনদিনই তাহা হারায় নাই—বরং যুগের পর যুগে অধ্যাত্মজগতের নূতন নূতন উপলব্ধি, নূতন নূতন আবিষ্কার দিয়া দেশের জীবনধারা তাহাকে সমৃদ্ধ, উপচিত করিয়াই চলিয়াছে। অবনতির যুগেও ভারত সব হারাইয়া বসিয়াছিল, কেবল এই জিনিষটি হারাইতে পারে নাই।

 কিন্তু এই যে আধ্যাত্মিক ঝোঁক, তাহা শুধু উপরের দিকে, বস্তুকে বিসর্জ্জন দিতে দিতে কেবল সূক্ষ্ম তত্ত্বের দিকে, যাহা গুপ্ত যাহাকে ধরা-ছোঁয়া যায় না, কেবল তাহারই দিকে যে উঠিয়া চলে এমন নয়। এই আধ্যাত্মিকতাই আবার নীচের দিকে, বাহিরে চারিপাশে আপনার আলো ছড়াইয়া দেয়, চিন্তাজগতের সকল বহুল বৈচিত্র্য, জীবনের সকল বিপুল ঐশ্বর্য্যই, আলিঙ্গন করিয়া ধরে। তাই ভারতের গরিমার যে দ্বিতীয় যুগ, তখন আসিয়া দেখা দিল বিচারবুদ্ধি, নৈতিক আদর্শ, আধ্যাত্মিক সত্যের দীপ্তিতে জীবনকে গঠিত নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য জ্ঞানপ্রবুদ্ধ প্রচণ্ড কশ্মৈষণা। আত্মজ্ঞানের যুগের পর আসিল ধর্ম্মের যুগ, বেদ ও উপনিষদের পরে আসিল কর্ম্মের সৃষ্টির যুগ; ভারত তখন বীরবিক্রমে তাহার সমাজ-প্রতিষ্ঠান, তাহার চিন্তার আয়তন, তাহার দর্শনকে ঢালিয়া পিটিয়া তাহাদের মূল রূপ সব গড়িয়া তুলিতে সুরু করিল। ভারতের জীবনধারা ভারতের শিক্ষাদীক্ষার যে বাহিরের কাঠাম, তাহার মোটামুটি আকার এই যুগেই চিরকালের জন্য স্থিরীকৃত হইল, ভবিষ্যতে যে সব নূতন সৃষ্টি হইবে তাহারও বীজ এই যুগেই উপ্ত হইল। এই সতেজ চিন্তাবৃত্তির খেলা যখন ক্রমে সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সমাজনীতি, রাজনীতি সমস্ত প্রাকৃত জীবনেরই ব্যাপার ধরিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খের সূক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসায় বিকশিত মুঞ্জরিত হইয়া উঠিল তখনই এই যুগের পূর্ণ পরিণতি, তখনই আসিল, যাহাকে পাশ্চাত্যেরা বলিয়া থাকেন সংস্কৃত শিক্ষাদীক্ষার ‘ক্লাসিকাল্’ যুগ। এই যুগেই হইয়াছিল সৌন্দর্য্যবোধের চরম বিকাশ, —সকল রকম চিত্তাবেগের, ইন্দ্রিয়ানুভবের—কেবল তাই নয়, ভোগের ও ইন্দ্রিয়পরতার রহস্যও ভারত এই যুগেই খুঁজিয়া খুঁড়িয়া দেখিয়াছিল। কিন্তু প্রাণের ও মনের এই বিপুল ক্রিয়াশীলতার পিছনে সর্ব্বদাই জাগরূক ছিল ভারতের প্রাচীন অধ্যাত্ম-বোধ। তাই দেখি, এই যুগের শেষভাগে ভারতের সাধনা হইয়াছিল সমস্ত নিম্নপ্রকৃতিকে উপরে তুলিয়া ধরিতে, অধ্যাত্মের প্রভায় তাহাকে মণ্ডিত করিতে। পুরাণের, তন্ত্রের, ভক্তিমার্গের যে সাধনা, তাহার অর্থই এই। এই ভাবই পূর্ণরূপে ফুটিয়া উঠিল ভারত-প্রতিভার অন্তিম দীপ্তি উত্তরকালের বৈষ্ণব সাধনায়। বৈষ্ণব সাধনা চেষ্টা করিয়াছিল, মানুষের মধ্যে আছে যে রসানুভূতির, চিত্তাবেগের, ইন্দ্রিয়গত লিপ্সার স্তর, তাহাকে তুলিয়া ধরিয়া অধ্যাত্মের সেবায় নিয়োগ করিতে। যে দৃষ্টি দিয়া ভারত তাহার জীবনযাত্রা শুরু করিয়াছিল, এই রকমে ঘুরিয়া আবার সেইখানেই আসিয়া পৌছিল।

 এই পূর্ণ পরিক্রমার পরে হইতে আরম্ভ ভারতের অবনতির যুগ। সে অবনতির সূচনা হইল তিনটি লক্ষণ দিয়া। প্রথমতঃ, ভারতের ছিল যে প্রচুর পরিপ্লাবী প্রাণশক্তি তাহার প্রবাহ স্তিমিত হইয়া আসিল, ছিল যে জীবনের আনন্দ, স্বজনের আনন্দ, তাহাতেও মলিনতা ধরিল। তবুও অধঃপতনের মধ্যেও ভারত যে সামর্থ্য দেখাইয়াছে তাহা বাস্তবিকই অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক। খুব অল্প সময়ের জন্যই সে সামর্থ্যটুকুও চলিয়া গিয়া প্রায় দেখা দিয়াছিল তামসিকতার পূর্ণগ্রাস। কিন্তু তাহা হইলেও অতীতের বিরাট্ মহত্ত্বের সহিত তুলনা করিলে স্পষ্টই বোধ হইবে কি রকমে ভারত ক্রমাগতই অধঃপতনের দিকে অব্যর্থভাবে চলিয়া আসিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ, ভারত হারাইল তাহার পুরাতন যুগের স্বাধীন চিন্তাবৃত্তির অবাধ খেলা— তাহার সজাগ সত্যজিজ্ঞাসা, তাহার তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধি মলিন হইয়া আসিল, মলিন হইয়া আসিল তাহার সৃষ্টি-ক্ষম দৃষ্টি। যাহা রহিল তাহা ক্রমেই পুরাতন জ্ঞানের অবোধ চর্ব্বিতচর্ব্বনে পর্য্যবসিত হইয়া চলিল। অতীতের সজীব বুদ্ধি যে সজীব রূপ সব সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহারই ভগ্নাবশেষের মধ্যে ভারতের জীবনমন নিথর জড়ত্ব পাইয়া বসিল। শাস্ত্রের প্রমাণের যে মর্ম্ম, যে অর্থ, তাহা লোপ পাইল, সেখানে দেখা দিল শুষ্ক বিধিনিষেধের অকাট্য আদেশ। আদেশের পিছনে যেখানে প্রাণের অভাব, সেখানে আদেশ হইবে যে অত্যাচার তাহা ত স্বাভাবিক। পরিশেষে, আধ্যাত্মিকতাও কায়ক্লেশে বাঁচিয়া থাকিল বটে, কিন্তু তাহাতে রহিল না প্রাচীন যুগের সে বৃহৎ, সে উজ্জ্বল জ্ঞানতেজ; এখানে ওখানে সময়ে সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে তাহার তীক্ষ্ণ তীব্রধারা ফুটিয়া বাহির হইতে লাগিল বটে, কিন্তু তাহাতে পাই না পুরাতনের সে বিশাল সমন্বয়ের ভাব; তাহাতে দেখা দিল একদেশদর্শিতা, অন্য সকল সত্যকে ঠেলিয়া ফেলিয়া একটিমাত্র সত্যকেই একান্তভাবে আঁকড়িয়া ধরিয়া থাকিবার অন্ধ প্রয়াস।

 এই যে চারিদিকে ক্ষয় ধরিল, তাহার ফলে ভারত তাহার সমস্ত শিক্ষাসাধনার লক্ষ্যটি হইতে এক রকম ভ্রষ্ট হইয়া পড়িল। বাহ্যজীবনের, মনোবুদ্ধির ক্ষেত্রকে পর্য্যন্ত পূর্ণ আধ্যাত্মিক রূপে রূপান্তরিত করিয়া ভারত চলিতেছিল, সে পথে আর অগ্রসর হওয়া তাহার হইল না। যে ভাবে সে আরম্ভ করিয়াছিল তাহা অপূর্ব্ব, অতুলনীয়, যে বিকাশের ধারায় চলিয়াছিল তাহাও অপরূপ কিন্তু ঠিক যেখানে শুরু হওয়া উচিত ছিল, পূর্ণতা, পরিণতি, নূতন সমন্বয়, নূতন উন্মেষ—ফলের আবির্ভাব, সেই সন্ধি-মুহূর্ত্তেই প্রাচীন দীক্ষার প্রেরণা হঠাৎ থামিয়া গেল— ভারত চলিল কতক যেন পিছনে হটিয়া, কতক যেন পথ হারাইয়া। তবে এ কথা সত্য, আসল বস্তু ছিল যাহা, তাহা একেবারেই নষ্ট হইতে ভারত দেয় নাই—শুধু স্মৃতি, অন্ধ অভ্যাসের আচারের মধ্যেই নয়, কিন্তু দেশের প্রাণের মধ্যেই তাহা বর্ত্তিয়া রহিল ও এখনও রহিয়াছে। কিন্তু ভিতরের সেই বস্তুর প্রকাশের পথ নানা জালজঞ্জালে অবরুদ্ধ হইয়া পড়িল— তাহার ক্রিয়ায় দেখা দিল নানা বিকৃতি। এই রকম অবস্থা হইল কেন, অন্তরের ও বাহিরের কোন্ কারণপরম্পরায়, সে কথা এখন আমরা বিচার করিব না। যে কারণেই হউক, অবস্থা দাঁড়াইল এই; আর ইহারই দরুণ ঠিক এই সময়েই ভারতকে যে একটা অভিনব, অভূতপূর্ব্ব ঘটনাচক্রের সম্মুখীন হইতে হইল, তাহাতে দেখি ক্ষণকালের জন্য সে অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়াই পড়িল।

 কারণ, এই সময়েই ভারতের উপর আসিয়া পড়িল ইউরোপের বন্যা। সম্পূর্ণ বিভিন্ন, সম্পূর্ণ বিপরীত শিক্ষাদীক্ষার সহিত সংঘর্ষের প্রথম ফল হইল এই যে, প্রাচীন যাহা কিছুর আর বাঁচিয়া বর্ত্তিয়া থাকিবার সামর্থ্য ছিল না তাহা অধিকাংশই ধ্বংস হইয়া গেল, অনেকানেক জিনিষ গলিয়া নূতনের কুক্ষিগত হইল; বাকী যাহা রহিল তাহাদের জীবনীশক্তি ক্ষীণ হইয়া চলিল। সেই সাথে নূতন একটা কর্ম্মোদ্দীপনাও দেখা দিল বটে, কিন্তু প্রথম প্রথম তাহার লক্ষ্য হইল বিদেশী শিক্ষাদীক্ষার স্থূল বিশৃঙ্খল যেন তেন অনুকরণ। ভারতের পক্ষে সত্যই এ একটা ছিল দারুণ সঙ্কটের—ভীষণ অগ্নিপরীক্ষার মুহূর্ত্ত। তাহার প্রাণশক্তি যদি স্বভাবতঃই এতখানি প্রচুর ও সমর্থ না হইত, তবে একদিকে আপনকার পুরাতন আদর্শের মৃত ভার, আর একদিকে পরধর্ম্মের অন্ধ অনুকরণ, এই দুইদিকের চাপে সে প্রাণশক্তি যে নিষ্পিষ্ট হইয়া যাইত, লোপ পাইয়া বসিত, সেই সম্ভাবনাই ছিল বেশী। এই ধরণের অবস্থায় পড়িয়া এক একটা দেশ ও জাতি যে কি ভাবে উৎসন্ন যাইতে পারে, তাহার সাক্ষ্য ইতিহাসই দিয়াছে। কিন্তু ভারতের ভাগ্য, তাহার জীবনীশক্তি একেবারে লুপ্ত হইয়া যায় নাই; তাহা ছিল শুধু সুপ্ত—তাই ব্যাধির প্রতিকার সে পাইল নিজেরই ভিতরে। ইউরোপীয় শিক্ষাদীক্ষার রূঢ় সংঘাতের ফলে তাহার জীবনে সাময়িকভাবে যতই পচ্ যতই ক্ষয় ধরুক না কেন, সেইখান হইতেই আসিল ভারতের তখন প্রয়োজন ছিল যে তিনটি প্রেরণা। প্রথমতঃ, সাড়া পাইয়া জাগিয়া উঠিল তাহার সুপ্ত চিস্তাবৃত্তি, বিচারশক্তি। দ্বিতীয়তঃ, তাহার জীবনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হইল, তাহার মধ্যে ফুটিল নূতন সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা। আর তৃতীয়তঃ, অভিনব সব অবস্থা ও আদর্শের সাক্ষাৎ সম্মুখে পড়িয়া ভারতের নবশক্তিকে তাহাদের সহিত বাধ্য হইয়া বুঝাপড়া করিতে হইল— তাহাদিগকে দেখিবার শুনিবার, জয় করিবার, আত্মসাৎ করিয়া লইবার একান্ত প্রয়োজন তাহার হইল। ভারত নূতন এক দৃষ্টিতে আপনার প্রাচীন শিক্ষাদীক্ষার দিকে চাহিল, তাহার অর্থ ফিরিয়া আবার সে হৃদয়ঙ্গম করিল, শুধু তাই নয়, আধুনিক জ্ঞানের আদর্শের সহিত তাহাকে মিলাইয়া দেখিতে লাগিল। এই নবোদ্ভিন্ন দৃষ্টি ও প্রেরণা হইতেই ভারতের আসিতেছে নবজন্ম, ইহাই নিয়ন্ত্রিত করিবে ভবিষ্যতের ধারা। এই নবজন্মের সর্ব্বপ্রথম ও সর্ব্বপ্রধান কাজ ভারতের প্রাচীন আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা—তেমনি গভীর, সমৃদ্ধ, অখণ্ডভাবে, সকল মহিমায় ভরিয়া দিয়া। দ্বিতীয় কাজ— এই আধ্যাত্মিকতাকে দর্শন, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, সকল রকম অনুসন্ধানেরই নূতন একটা রূপের মধ্যে প্রবাহিত করিয়া দেওয়া। আর তৃতীয় এবং সর্ব্বাপেক্ষা কঠিন কাজ হইতেছে, ভারতের অন্তরাত্মার ধর্ম্ম যাহা, তাহাকে ধরিয়া, তাহারই সহায়ে সম্পূর্ণ নূতন ভাবে আধুনিক সকল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা, সমাজকে আধ্যাত্মিকতারই জাগ্রত বিগ্রহ করিয়া তুলিবার জন্য একটা বৃহত্তর সমন্বয়সূত্র আবিষ্কার করা। এই তিনটি ধারায় ভারতের নবজন্ম যে পরিমাণে সফলকাম হইবে, ঠিক সেই পরিমাণেই জগতের মানবজাতির ভবিষ্যৎ উন্নতির পথে সে হইবে সহায়।

 অধ্যাত্ম কাহাকে বলি? অধ্যাত্ম অর্থ আত্মায় প্রতিষ্ঠিত। অধ্যাত্ম হইতেছে বীজসত্য সব লইয়া রহিয়াছে উপরে যে অনন্ত; আর সেই সব বীজসত্যকে ধরিয়া বাড়িয়া উঠিতেছে, পরিপূর্ণতার দিকে, সার্থকতার দিকে—নিজের নিজের সত্য অভিমুখে, চলিয়াছে নীচেরকার অনস্তের যে সব সম্ভাবনা তাহা লইয়াই অধিভূত বা জীবন। আমাদের বুদ্ধি, আমাদের ইচ্ছাশক্তি, আমাদের কর্তব্যবোধ, আমাদের সৌন্দর্য্যবোধ—সবই এই দুই অনন্তের মধ্যে মধ্যস্থের বা দর্পণের কাজ করিতেছে। পাশ্চাত্য জীবনকেই অতিকায় করিয়া দেখিতে শিখিয়াছে, কিন্তু এই জীবনকে অনুপ্রাণিত শ্রীমণ্ডিত করিবার জন্য উপরের শক্তির আবাহন সে খুব অল্পই করিয়াছে। ভারতের পথ সম্পূর্ণ বিপরীত। ভারত চাহিয়াছে আগে অধ্যাত্মকে—অন্তরে সত্য-পুরুষকে আবিষ্কার করিতে, উর্দ্ধতন শক্তিরাজির যত গহনতম ধারা তাহা ব্যক্ত করিয়া ধরিতে; ভারত জীবনের সামর্থ্য বাড়াইয়া তুলিতে চাহিয়াছে, সেইজন্য আগে চেষ্টা করিয়াছে জীবনকে কোন না কোন প্রকারে এমন বশীভূত করিতে, ইচ্ছামত এমন গড়িয়া পিটিয়া লইতে, যাহাতে সেখানে প্রতিফলিত প্রতিরণিত হইয়া উঠিতে পারে অধ্যাত্মেরই শক্তি। একদিকে সে সহজ বৃত্তিগুলিকে সহজভাবেই ফুটাইয়া ধরিতে চেষ্টা করিয়াছে, —বুদ্ধি, ইচ্ছাশক্তি, কর্ত্তব্যবোধ, সৌন্দর্যবোধ, চিত্তাবেগ প্রভৃতি মানস-বৃত্তির মনের মধ্যেই কতদূর কি সম্ভাবনা তাহা তলাইয়া দেখিয়াছে; অন্যদিকে আবার এই সকল বৃত্তিকেই সে চেষ্টা করিয়াছে মনের উপরে তুলিয়া ধরিতে, বৃহত্তর জ্যোতির শক্তির দিকে ঘুরাইয়া তাহাদের নিজেদেরই সমুচ্চ সত্য-প্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত করিতে।

 ভারতের নবজন্মের কাজ হইবে এই অধ্যাত্মশক্তিকে, এই সমুচ্চ দৃষ্টিকে, এই গভীর প্রতিভাকে জগতের জীবনক্ষেত্রে আবার একবার সজীব সৃজনক্ষম করিয়া ধরিতে, সকল শক্তির উপরে একচ্ছত্র শক্তিরূপে স্থাপন করিতে। কিন্তু নিজের নবজন্মের এই যে ভিতরের সত্য, সে সম্বন্ধে ভারত এখনও সম্পূর্ণ সচেতন হইয়া উঠিতে পারে নাই, অস্পষ্টভাবে অনুভব করিতেছে মাত্র। বর্ত্তমানে সে যাহা কিছু করিতেছে তাহার বেশীর ভাগই ইউরোপীয় ভাবে, ইউরোপীয় ভঙ্গীতে অনুপ্রাণিত। আমাদের অন্তর-পুরুষের সহিত তাহার মিল সামঞ্জস্য নাই বলিয়া, তাহা আমাদের গভীরতম সত্তা হইতে উৎসারিত হইতেছে না বলিয়াই সে কাজের প্রেরণার মধ্যে তীব্রতা নাই, গড়নের মধ্যে সামর্থ্য নাই, ফলও আশানুরূপ নহে। দুই একটি ক্ষেত্রে মাত্র একটা আত্মজ্ঞানের পরিষ্কার লক্ষণ যেন দেখিতে পাই। কিন্তু যতদিন এই আত্মজ্ঞানের জ্যোতিঃ সকল দিকে না ছড়াইয়া পড়িবে, সাধারণ হইয়া না পড়িবে ততদিন ভারতের নবজন্ম ভবিষ্যতের আশা রূপেই থাকিবে, বর্তমানের বাস্তব বস্তু হইয়া উঠিবে না।