ভারতের নবজন্ম/২
২
ভারতের নবজন্ম অবশ্যম্ভাবী। এখন আমাদিগকে দেখিতে হইবে, কি ধারায় এই পরিবর্ত্তনটি ঘটিতেছে, এই একটা জটিল ভাঙন ও পুনর্গঠনের কাজ চলিতেছে। অবশ্য শেষ ফল, পূর্ণ পরিণতি এখনও দূরে ভবিষ্যতের গর্ভে, তবে গোড়ার বনিয়াদ সব ইতিমধ্যেই হয় ত গাঁথা হইয়া গিয়াছে। কোন্ পথে চলিয়া প্রাচীন একটা শিক্ষাদীক্ষা রূপান্তরিত হইয়া নবযুগে পাইতেছে নবপ্রতিষ্ঠা? কারণ এ কথাটি স্মরণ রাখিতে হইবে, এখানে নবজাত একটা শিক্ষাদীক্ষা পুরাতন মৃত শিক্ষাদীক্ষার সহিত আপনাকে মিলাইয়া ধরিতেছে না—ভারতের নবজন্ম অর্থ সত্য সত্যই নূতন জন্ম অর্থাৎ পুনর্জন্ম। ভারতের এই পুনর্জন্মের ধারা যদি বিশ্লেষণ করি তবে দেখিতে পাই, কার্য্যকারণপরম্পরায় এবং ঐতিহাসিক ঘটনা-পরম্পরায়ও সেখানে রহিয়াছে তিনটি ধাপ। প্রথম ধাপ হইতেছে ইউরোপের সংস্পর্শে আসিয়া দাঁড়ান— ফল, পুরাতন শিক্ষাদীক্ষার অনেক প্রধান অঙ্গই আবার নূতন করিয়া যাচাই করিয়া দেখা, আর এমন কি, তাহার কতকগুলি মূল তত্ত্বকেই একেবারে বিসর্জন দেওয়া। দ্বিতীয় ধাপ হইতেছে, ইউরোপীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে ভারতীয় ভাবের প্রতিক্রিয়া—ফল, ইউরোপ যাহা কিছু দিতে চাহিয়াছিল তাহা এক রকম সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা আর দেশের অতীতের প্রধান অপ্রধান সব বিষয়েরই উপর অতিমাত্র জোর দেওয়া। অবশ্য এই প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও গোপনে চলিয়াছিল বাহিরের প্রভাবকে আত্মবশ করিয়া, আত্মসাৎ করিয়া লইবার একটা চেষ্টা। আর তৃতীয় ধাপটি সুরু হইতে চলিয়াছে বা সবে সুরু হইয়াছে মাত্র। এটি নূতন সৃষ্টির যুগ। এই নূতন সৃষ্টিতে ভারতের অধ্যাত্মশক্তি আবার সকলের উপর স্থান লইয়াছে, আবিষ্কার করিতেছে আপনার পূর্ব্ব পূর্ব্ব উপলব্ধ সত্য সব, আধুনিক ভাবের মধ্যে, রূপের মধ্যে যাহা প্রয়োজনীয়, যাহা অপরিহার্য্য, যাহা সত্য, যাহা সুস্থ দেখিতেছে তাহাই গ্রহণ করিতেছে কিন্তু সে সব এমনভাবে আত্মসাৎ করিয়া রূপান্তরিত করিয়া লইতেছে, নিজের স্বভাবের মধ্যে এমনভাবে একীভূত করিয়া ফেলিতেছে যে, তাহাদের বিদেশীয় প্রকৃতি লোপ পাইয়া যাইতেছে, তাহারা হইয়া উঠিতেছে ‘পুরাণী দেবী’ ভারত—শক্তিরই নিজস্ব লীলায়িত প্রতিভা-স্পষ্টই সেখানে আমরা দেখি, ভারত আধুনিক প্রভাব সব অমিতবলে অধিকার করিয়া গ্রাস করিয়া চলিয়াছে, আধুনিকের প্রভাব আর ভারতকে অধিকার করিতে গ্রাস করিতে পারিতেছে না।
বিশ্ব-প্রকৃতির যে বহুল কর্ম্মধারা মানুষকে লইয়াই হউক, আর জড়বস্তু লইয়াই হউক, তাহার মধ্যে কোথাও অকস্মাৎ, বিনা কারণে কিছু ঘটিয়া যায় না, অথবা বাহিরের অবস্থাই সেখানে একমাত্র নিয়ন্তা নহে। পরিবর্ত্তনের ধারা যত বিপুল হউক না কেন, তাহার মূল আবেগ আসিতেছে বস্তুর অন্তরের প্রকৃতি হইতে। ভিতরে ভিতরে যে জিনিষ যাহা তাহারই চাপে কর্ম্মক্ষেত্রে সে অভিনব অপ্রত্যাশিত মূর্ত্তি সব লইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। ভারতের আছে যে অন্তরের সনাতনী প্রকৃতি, ভারত ভিতরে ভিতরে নিজে যাহা তাহারই দরুণ অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়িয়াছে, পূর্ব্ব হইতেই নির্দ্দিষ্ট হইয়া আছে, বর্ত্তমানের এই যুগান্তর, জটিল রূপান্তর। ভারত যে রাতারাতি এক নিঃশ্বাসে পাশ্চাত্যের ভাব ও রূপ সব গলাধঃকরণ করিয়া ফেলিবে, নিজের অতীতের যে সব অধিষ্ঠাত্রী ভাব সেগুলি বিসর্জ্জন দিয়া, সব্যাজে যেন তেন প্রকারেণ বিদেশীর আবহাওয়ায় আপনাকে মিলাইয়া ধরিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িবে—ইহা এক অসম্ভব ব্যাপার। অবশ্য এই রকম একটা ত্বরিত পরিবর্ত্তনের ফলেই আধুনিক জাপান জন্ম লইয়াছে; কিন্তু জাপানের মত যদিই-বা ভারত বাহ্যিক অবস্থার আনুকূল্য পাইত তবুও ভারতে সে ভাবের কিছু কখন ঘটিতে পারিত না। কারণ, জাপান জীবন যাপন করিতেছে তাহার চিত্তের যে বিশেষ গড়ন বা মেজাজ, তাহার যে রঞ্জিনীবৃত্তি বা সৌন্দর্যবোধ তাহাকেই মুখ্যতঃ কেন্দ্র করিয়া; জাপান চিরকালই পরের বস্তু কি ভাবে আপনার করিয়া লইতে হয় সে কৌশল অভ্যাস করিয়া আসিয়াছে। জাপানের আছে একটা ধাতুগত দৃঢ় নিষ্ঠা, তাহারই ফলে সে আপন জাতীয় বিশেষত্বকে অটুট রাখিতে পারিয়াছে; আর শিল্পীর যে সৌন্দর্য্যদৃষ্টি তাহারই শক্তিতে সে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে দেশের অন্তরাত্মাকে। কিন্তু ভারতের জীবন মুখ্যতঃ প্রতিষ্ঠিত তাহার অধ্যাত্মসভায়। ভারতের তুলনায় জাপানের প্রাণের আছে একটা উৎফুল্ল তরলতা, একটা সুলভ বেগপ্রবণতা। জাপানের মত ভারত এত সহজেই কর্ম্মের মধ্যে মত্ত হইয়া যাইতে, বাহিরের দিকে ছুটিয়া চলিতে পারে না, অল্পেতেই সাড়া দিয়া চেতিয়া উঠে না। তাই দেখি, অবস্থা অনুসারে আপনাকে পরিবর্ত্তন করিয়া ধরিবার পটুতা তাহার অপেক্ষাকৃত কম; কিন্তু তাহার যাহা আছে, তাহা হইভেছে একটা গভীরতর, নিবিড়তর ধ্যানপ্রতিষ্ঠ স্থৈর্য্য। ভারত যে কাজ করে, তাহা করিতে সে চায় ধীরে সুস্থে বিচার বিবেচনা করিতে করিতে ইতস্ততঃ করিতে করিতে। তাহার কাজ সময় সাপেক্ষ; কারণ, জিনিষকে সে আগে লইয়া চলে নিজের গভীরত্বে এবং অন্তরের এই অন্তরতম প্রদেশ—এই ‘গুহাগতং গহ্বরেষ্ঠং’—হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমে তবে বাহিরের জীবনের যেখানে যাহা পরিবর্ত্তন করিবার, পুনর্গঠন করিবার, তাহা সে করে। যতক্ষণ পর্য্যন্ত বাহিরের দেওয়া জিনিষকে লইয়া সে এই ভাবে আপনার মধ্যে না ডুবিয়া যাইতে পারিয়াছে, তাহাকে নিজের অন্তর্ভূক্ত, অঙ্গীভূত না করিয়া লইতে পারিয়াছে, যে শক্তি জিনিষকে আবার নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিবে, তাহা যতক্ষণ পর্য্যন্ত ভিতরে ভিতরে সে প্রস্তুত না করিয়া ধরিতে পারিয়াছে, ততক্ষণ পর্য্যন্ত যে নূতন পথ সে ধরিয়াছে, তাহাতে স্বচ্ছন্দগতিতে অগ্রসর হইয়া চলিতে পারিবে না। ভারতের নবযাত্রা বহুমুখী, জটিল; এই জন্যেই যে সব সমস্যা তাহার সম্মুখে উঠিতেছে তাহাদের মীমাংসা এমন দুরূহ। যতই সে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে, ততই এত রকমের মতবাদ, দেখিবার ভঙ্গী, চলিবার ধারা, সব ফুটিয়া উঠিয়াছে মিশামিশি হইয়া এমন বিরাট গোলমাল পাকাইয়া তুলিয়াছে যে সেখানে কোন স্পষ্ট নিঃসন্দেহ পরিণতি সহজে সম্ভব হইতেছে না—মনে হয় যেন আমরা চলিয়াছি অন্ধকারের মধ্য দিয়া অনির্দ্দিষ্ট ঘটনাচক্রের তাড়নায়, ভবিষ্যতের লক্ষ্য সম্বন্ধে আমাদের পরিষ্কার ধারণা কিছু নাই, ঢেউএর মত একটা আবেগে এক সময়ে উঠিয়া পড়িতেছি, আবার আর এক খেয়ালে পরমুহূর্ত্তে নামিয়া পড়িতেছি—আমরা চলিয়াছি এই ভাবে ভাসিয়া ভাসিয়া। তবুও একথা সত্য যে, এই সকল অনিশ্চয়তার অন্তরালে ভিতরে ভিতরে একটা লক্ষ্য নির্ণীত হইয়া উঠিতেছে, তাহার অভিব্যঞ্জনা বাহিরেও আসিয়া দেখা দিতেছে। ফল তাহার আর যাহাই হউক, সে জিনিষ যে পাশ্চাত্য আধুনিকতার প্রাচ্য সংস্করণ নহে, সে জিনিষ যে সম্পূর্ণ নূতন একটা সৃষ্টি, সমস্ত মানবজাতির ভবিষ্যৎ শিক্ষাদীক্ষা যে তাহার উপর অনেকখানি নির্ভর করিবে, এইটুকু এখনই নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে।
পাশ্চাত্যশিক্ষার ফলে ভারতে সর্ব্বপ্রথম যাঁহাদের মস্তিষ্ক গড়িয়া উঠিয়াছিল—সংখ্যায় তাঁহারা সামান্য হইলেও, প্রতিভায় ও সৃজন-সামর্থ্যে তাঁহারা ছিলেন বিশেষ শক্তিমান্—তাঁহাদের কিন্তু মনের ভাব এ রকমের ছিল না। তাঁহারা আশায় আশায় ছিলেন যে, তাড়াতাড়ি একটা পরিবর্ত্তন হইয়া যাইবে—পরে জাপান অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সহিত যাহা করিতে পারিয়াছিল, সেই ধরণের কিছু। নবীন ভারত মনে, প্রাণে, অন্তরাত্মায়, সর্ব্ববিষয়ে সম্পূর্ণরূপে আধুনিক হইয়া উঠিবে—ইহাই ছিল তাঁহাদের পরম আকাঙ্ক্ষা। তীব্র স্বদেশপ্রেমে তাঁহারা উদ্বুদ্ধ হইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাদের চিন্তার ভঙ্গী ছিল বিজাতীয়। আমাদের প্রাচীন শিক্ষাদীক্ষা শুধু অর্দ্ধসভ্যতার পরিচয়—পাশ্চাত্যের এই অভিমত তাঁহারা স্পষ্ট কথায় না হউক, কার্যতঃ মানিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহাদের মূল আদর্শ সব পাশ্চাত্য হইতে গৃহীত, যে পাশ্চাত্য শিক্ষায় তাঁহারা গঠিত হইয়াছিলেন তাহারই ভাবে, ভঙ্গীতে, ধরণধারণে অনুপ্রাণিত। মধ্যযুগের ভারত হইতে তাঁহারা বিদ্রোহ-ভরে সরিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন—তখনকার যাহা কিছু সৃষ্টি, সে সকলকে ধ্বংস করিতে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করিতে তাঁহারা বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন; সেখান হইতে যদিই বা কখন কিছু গ্রহণ করিতেন, তবে কেবল কবিত্বময় অলঙ্কার হিসাবে, অথবা তাহাদের একটা বাহ্যিক, আধুনিক অর্থ করিয়া দিয়া। প্রাচীন ভারতের প্রতি তবুও তাঁহারা গর্ব্বভরে চক্ষু ফিরাইয়া ধরিয়াছিলেন—সব দিকে না হউক, অন্ততঃ কোন কোন দিকে। তাঁহাদের নূতন দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে যাহাই মিলাইয়া ধরিতে পারিয়াছেন, প্রাচীনের তাহাই সাদরে বরণ করিয়া লইয়াছেন। কিন্তু এই ভাবে কোন জিনিষেরই মূল অর্থ, সত্যকার ব্যঞ্জনার মধ্যে প্রবেশ করিতে তাঁহারা পারেন নাই, তাঁহাদের পাশ্চাত্য মস্তিষ্কের সাথে যে বস্তুর সামঞ্জস্য স্থাপন করিতে অপারগ্ হইয়াছেন, তাহাকেই কাটিয়া ছাঁটিয়া ফেলিয়া দিতে চাহিয়াছেন। ধর্ম্মকে তাঁহারা যতদূর পারেন, বুদ্ধিবিচারের মাপকাঠি দিয়া সহজ সাদামাঠ। যুক্তিবদ্ধ করিয়া ফেলিলেন; যে সাহিত্য তাঁহারা সৃষ্টি করিলেন, তাহার মধ্যে ইংরাজীর হাবভাব, তাঁহাদের ইংরাজী আদর্শের সমস্ত প্রাণই দুইহাতে আমদানী করিতে লাগিলেন— অবশ্য আর সকল শিল্পকলার দিকে ফিরিয়াও নজর দিলেন না। রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাঁহাদের আশা ও ভরসা হইল ইংরাজের অনুসরণ করা বা হুবহু অনুকরণ করা অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংলণ্ডে ছিল যে মধ্যবিত্তদের কর্ত্তৃত্বাধীন একটা ভুয়ো-গণতন্ত্র, তাহাকে সাঙ্গোপাঙ্গ তুলিয়া আনিয়া ভারতে স্থাপন করা। সমাজকেও তাঁহারা ঢালিয়া আবার সাজিতে চাহিয়াছিলেন ইউরোপের সামাজিক আদর্শ, ইউরোপীয় সমাজের গড়ন অনুসারে। এই রকম অন্ধ শ্রদ্ধাবশে তাঁহারা যে যে জিনিষ আঁকড়িয়া ধরিয়াছিলেন, ভবিষ্যতে তাহাদের কোন কোনটির সার্থকতা কিছু থাকিলেও হয়ত থাকিয়া যাইতে পারে; কিন্তু যে উপায় বা পথ তাঁহারা লইয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ ভুল, কথা আজ আমরা স্বীকার করিতেছি। ইংরাজী ভারতবর্ষ যে কখনও সম্ভব বা বাঞ্ছনীয়, তাহা আমরা আর মনেও করিতে পারি না। ফলতঃ, ভারতবর্ষকে যদি সত্য সত্যই ইংরাজী ভাবাপন্ন করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিতাম, তবে আমরা হইয়া পড়িতাম—বড়জোর দীন নকলনবীশ, হীন অনুচর;—দেখিতাম ইউরোপের পশ্চাতে ছুটিতে ছুটিতে আমরা প্রতিপদে হোঁচট্ খাইয়া পড়িয়া যাইতেছি আর চিরদিনই অন্ততঃ পঞ্চাশ বছর পিছনে রহিয়া গিয়াছি। পাশ্চাত্য প্রভাবান্বিত সে মনের ধারা বেশী দিন ভারতে ছিল না, থাকা সম্ভব ছিল না। আজকাল এখানে ওখানে তাহার দুই একটা নিদর্শন দেখা গেলেও যাইতে পারে, কিন্তু তাহাতে প্রাণের স্পন্দন নাই, তাহাকে সজীব, সমর্থ করিয়া তোলা দুঃসাধ্য নয়, অসাধ্য।
তবুও, সকল সত্ত্বেও, এই স্থূল অনুকরণের যুগও একেবারে বিফলে যায় নাই। এমন কতকগুলি জিনিষ সে সৃষ্টি করিয়া দিয়াছিল, যাহা না হইলে ভারতের নবজীবন কখন শক্তিশালী হইয়া উঠিতে পারিত না। সে সকলের মধ্যে সব চেয়ে প্রধান যে তিনটি, তাহাদেরই কথা এখানে আমরা বলিব। প্রথমতঃ, ভারতে আবার জাগিয়াছে মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তির অবাধ খেলা। প্রথম প্রথম এই বৃত্তিটি খুব সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ ছিল, বেশীর ভাগ পরের প্রতিধ্বনি করিয়াই চলিত বটে; কিন্তু ক্রমে তাহা দেশের সহিত, মানবজাতির সহিত যে বিষয়ের কিছু সম্পর্ক আছে, তৎসমুদয়ের উপরই আপনাকে ছড়াইয়া দিতেছে, যতই দিন যাইতেছে ততই দেখিতেছি তাহার অনুসন্ধিৎসা বাড়িয়া যাইতেছে, যে ক্ষেত্র ধরিতেছে সেই ক্ষেত্রেই তাহার নিজস্বতা উত্তরোত্তর ফুটাইয়া তুলিতেছে। প্রাচীন ভারতের ছিল যে সকল প্রকার জ্ঞানের জন্য একটা অশ্রান্ত আকাঙ্ক্ষা, তাহাই যেন আবার ফিরিয়া আসিতেছে; সেই জ্ঞানে আস্তে আস্তে প্রাচীনকালেরই প্রসারতা, গভীরতা, কার্য্যপটুতা যে ফুটিয়া উঠিবে, তাহাও সন্দেহ করিবার নহে। ভারতের বুদ্ধির মধ্যে দেখা দিয়াছে একটা নিরঙ্কুশ বিচারশক্তি, পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণক্ষমতা, সংস্কারমুক্ত হইয়া সত্যসিদ্ধান্তে পৌঁছিবার দৃঢ়তা— মস্তিষ্কের এই কয়টি গুণ পূর্ব্বকালে মুষ্টিমেয় জ্ঞানীর মধ্যে ও সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, কিন্তু বর্ত্তমানে তাহারা হইয়া পড়িয়াছে সাধারণ হিসাবে বুদ্ধিবৃত্তির অনিবার্য অঙ্গ। অনুকরণের যুগে অবশ্য এই সকল ধারা ভারত বেশীদূর লইয়া যাইতে পারে নাই, কিন্তু বীজ তখনই বপন করা হইয়াছিল; সেই বীজ ফলে ফুলে কি রকমে মুঞ্জরিত হইয়া উঠিতেছে তাহা দেখিতেছি আজ আমরা। দ্বিতীয়তঃ, এই যুগে আধুনিক ভাব চিন্তা সব আমাদের প্রাচীন শিক্ষাদীক্ষার মধ্যে প্রবেশ লাভ করিয়া আমাদের সনাতন দৃষ্টিভঙ্গীকে ভাঙ্গিয়া দিয়াছে—তাই কেবল গতানুগতিক সংস্কারের মাপকাঠিতে আধুনিক ভাবচিন্তাকে বিচার না করিয়া, সম্পূর্ণ নূতন রকমে সেগুলিকে দেখাশুনা আমাদের পক্ষে সম্ভব হইয়াছে। সকলের শেষে, আমাদের প্রাচীন সম্পদের প্রতিও আমরা দিতে পারিতেছি একটা অভিনব দৃষ্টি এবং ইহারই কল্যাণে আমরা উদ্ধার করিতে পারিতেছি এতদিনকার অঙ্ক অথর্ব্ব অনুষ্ঠানাদির মধ্যে গুপ্ত লুপ্ত হইয়া ছিল প্রাচীনের যে অর্থ যে প্রাণ; শুধু তাই নয়, এই নূতন দৃষ্টির সহায়েই আমরা প্রাচীন সত্যের ভিতর হইতে খুলিয়া ধরিতে পারিতেছি নূতন নূতন রূপ, নূতন নূতন অভিব্যঞ্জনা—আমরা আবিষ্কার করিতেছি নবতর সৃষ্টির, নবতর রূপান্তরের সম্ভাবনা। এই প্রথম যুগে আমাদের প্রাচীন শিক্ষাদীক্ষাকে আমরা ভুল বুঝিয়াছি— কিন্তু তাহাতে কিছু আসে যায় না। আমরা জিনিষকে যে ফিরিয়া নূতন করিয়া দেখিতে শিখিয়াছি, এমন কি, গোঁড়া প্রাচীনপন্থী যে মন, তাহাকেও বাধ্য হইয়া এই শিক্ষা যে গ্রহণ করিতে হইয়াছে—ইহাই হইতেছে সকলের চেয়ে বড় কথা।
অনুকরণের যুগের পর প্রতিক্রিয়ার যুগ। এই দ্বিতীয় যুগে ভারত ঘরমুখী হইয়াছে, চলিয়াছে নিজের জাতীয় সত্তার বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করিতে করিতে—লাভ করিয়াছে ধর্ম্মের ও কর্ম্মের গভীরতর সত্যতর ইঙ্গিত প্রেরণা সব। প্রথমতঃ, ইংরাজীয়ানার স্রোতের মুখে অনতিবিলম্বেই আসিয়া দেখা দিল ভারতের প্রাচীন প্রাণ এবং ইহারই রঙে ক্রমশঃ সে ইংরাজীয়ানা নিবিড়ভাবে রঙিয়া উঠিতে লাগিল। আজকাল আধুনিক-শিক্ষিত যাঁহারা এখনও জোর করিয়া পাশ্চাত্যের ভাবে অভিভূত হইয়া আছেন তাঁহারা সংখ্যায় অতি অল্প এবং দিন দিনই কমিয়া আসিতেছেন। আর ইঁহারাও, এক সময়ে যে সাধারণ রীতিই একটা হইয়া উঠিয়াছিল প্রাচীনকে মুক্তকণ্ঠে তারস্বরে গালাগালি দেওয়া, সেই রকম কিছু করেন না। আধুনিক-শিক্ষিতদের মধ্যে বেশীর ভাগেরই ভাব বদলাইয়াছে আস্তে আস্তে, তাঁহাদের আধুনিকতা ক্রমশঃ ভরিয়া উঠিয়াছে প্রাচীনের ভাবে, অনুভবে, উত্তরোত্তর তাঁহারা হৃদয়ঙ্গম করিয়া চলিয়াছেন ভারতীয় জিনিষের যে বিশেষ ধরণধারণ, তাহার অর্থ কি—প্রাচীনের রূপ অপেক্ষা ভাবকে মোটামুটি গ্রহণ করিয়া তাঁহারা দিতে চেষ্টা করিয়াছেন একটা নূতন ব্যাখ্যা। প্রথম প্রথম আমরা যে অর্থ করিয়াছি, তাহার মূল কথাটি স্পষ্টই আধুনিক ছাঁচে ঢালা ছিল, তাহার সর্ব্বাঙ্গে পাশ্চাত্যের অনুপ্রেরণাই ব্যক্ত হইয়া পড়িয়াছিল; কিন্তু আমাদের এই চিন্তাপ্রবাহ স্বেচ্ছায় সাগ্রহে আপনার মধ্যে বরণ করিয়া লইয়া চলিল প্রাচীনের চিন্তাপ্রবাহ সব এবং ক্রমে ক্রমে প্রাচীনের যে আসল সত্য ভাব তাহার দ্বারাই গাঢ় হইতে গাঢ়তর রঞ্জিত হইয়া উঠিতে লাগিল। এই অম্বুরঞ্জনের পথে শেষে আমরা এতদূর চলিয়া গিয়াছি, গোড়ায় যে চিন্তা, যে ভাব দিয়া শুরু করিয়াছি, পরে রঙ্ রেখা বদ্লাইতে বদ্লাইতে তাহা এমন রূপ লইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, তাহা ভারতেরই একান্ত নিজস্ব সৃষ্টি হইয়া উঠিয়াছে। এই রকমে যে রূপান্তর ঘটিয়াছে, তাহার ধাপ আমরা নির্দ্দেশ করিতে পারি দুই জনের সৃষ্টি দিয়া—ইদানীন্তন কালের সাহিত্যস্রষ্টাদের মধ্যে যে দুইজন প্রতিভার বিশেষত্বে ও নূতনত্বে সর্ব্বাপেক্ষা গরীয়ান্—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
পাশ্চাত্যের সংস্পর্শজনিত এই যে পরিবর্ত্তনের ধারা, তাহার সাথে সাথেই আবার বিপরীত দিক্ হইতে একটি আরও বিশেষ ধরণের বলবত্তর ধারা বহিয়া চলিয়াছে। গোড়ায় এইটির আরম্ভ পূর্ণ বিদ্রোহ দিয়া—ভারতের যাহা কিছু, তাহা ঠিক যেমন আছে তেমনিই সে গ্রহণ করিয়াছে, জোর করিয়া সমর্থন করিয়াছে; আর কোন কারণের জন্য নহে, শুধু এই কারণে যে, তাহা ভারতের। এই ধাক্কার জের এখনও আমাদের মধ্যে পাওয়া যায়, এখনও ইহার অনেক প্রভাব সজীবভাবে বর্ত্তিয়া চলিয়াছে; কারণ, ইহার কাজ এখনও শেষ হয় নাই। কিন্তু এই যে প্রতিক্রিয়া, বাস্তবিক পক্ষে তাহা হইতেছে একটা আরও সূক্ষ্ম সম্মিলনের একীকরণের আয়োজন। অতীতের জিনিষকে সর্ব্বতোভাবেও সমর্থন করিতে গিয়া আমরা বাধ্য হইয়া দেখিতেছি যে, সে কাজটি এমন ভাবে করিতে হইবে যাহাতে প্রাচীন ও নবীন মনোভাব, গতানুগতিক সংস্কার ও আধুনিক বিচারবৃত্তি দুইই একসাথে মিলিতে পারে,—যুগপৎ পায় চরিতার্থতা। ইহার ফলে আমরা কেবল আর অতীতে ফিরিয়াই চলিতে পারি না, জ্ঞানতঃ হউক, আর অজ্ঞানতঃ হউক, কাজে আমরা অনতিবিলম্বেই অতীতকে নূতনেরই সংজ্ঞায় ব্যক্ত করিতে থাকি। বস্তুতঃ, পরে এই অতীতের দিকে চলা, এই নিজের ঘরের অভিমুখে যে গতি, তাহার মধ্যে পাই একটা পূর্ণ সমন্বয়ের প্রয়াস। এই যুগে আমরা অতীত শিক্ষাদীক্ষার প্রাণটি চাহিয়াছি বটে, এমন কি, তাহার বাহিরের রূপ সবও অটুট্ রাখিতে, বাঁচাইয়া তুলিতে যত্নপর হইয়াছি; তবুও সেই সাথে যাহা একেবারে জীর্ণ শীর্ণ—তাহা ফেলিয়া দিতে বা নূতন করিয়া গড়িতে কুণ্ঠিত হই নাই,—শুধু তাই নয়, নূতন যাহা কিছু দৃষ্টিভঙ্গী পুরাতন অধ্যাত্মদৃষ্টির অঙ্গীভূত হইয়া যাইতে পারিয়াছে বা তাহার উদারতর গভীরতর পরিণতির পক্ষে সহায় হইয়াছে, তাহাও অবলীলাক্রমে আমরা স্বীকার করিয়াছি। অতীত ও বর্ত্তমানকে এই রকমে মুক্তভাবে মিলাইয়া মিশাইয়া চলা, নূতন গড়ন দিয়া পুরাতনের রক্ষণ— এই আদর্শের শক্তিমান্ বিগ্রহ ছিলেন বিবেকানন্দ।
কিন্তু ইহাও শেষ কথা নয়—এখান হইতেই আবার আর একটা নূতন সৃষ্টির ধারার সূত্রপাত। অন্যথা, আমরা যে চিন্তার ও প্রেরণার যুগলধারার কথা পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি, তাহার ফলে পাইতাম একটা বিসদৃশ মিশ্রণ—শরীরে যেমন আমরা আজকাল ধারণ করি ইউরোপীয় ও ভারতীয় পোষাকের একটা অপরূপ খিচুড়ী, মনের জগতে কতকটা হইত সেই রকম একটা বস্তু। ভারতকে অখণ্ডভাবে ফিরিয়া পাইতে হইবে তাহার অন্তরাত্মার গভীরতম প্রদেশে যে নৈসর্গিক শক্তি, বর্ত্তমানের প্রয়াস ভবিষ্যতের লক্ষ্য সব ধরিয়া দিতে হইবে ঐ অন্তরাত্মার শক্তির কাছে—এই শক্তিই জীবনের সকল প্রকাশকে যথাযথ ভাবে মিলাইয়া মিশাইয়া গড়িয়া পিটিয়া তুলিবে। এই ধরণের যে জীবন্ত, যে নিজস্ব সৃষ্টি হইতে পারে, তাহার বিশেষ একটা নিদর্শন আধুনিক ভারতের নব চিত্রকলা। এই নিজস্ব সৃষ্টির ধারা যখন আমাদের জাতীয় জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে ফুটিয়া উঠিতে থাকিবে, তখনই নিঃসন্দেহে বুঝিব যে, ভারতের নবজন্ম পাইয়াছে অখণ্ড অটুট্ আত্মপ্রতিষ্ঠা।