ভারতের নবজন্ম/৩
৩
বর্ত্তমানে যত রকম প্রেরণা যত দিকে স্পষ্টভাবে, অস্পষ্টভাবে খেলিতেছে, সেই বিরাট বিশৃঙ্খলতা ভেদ করিয়া তাহার ভিতর হইতে ভবিষ্যতের নবসৃষ্টি ঠিক কি রূপ সব গ্রহণ করিবে তাহা নিরূপণ করিবার চেষ্টা বিশেষ উপকারে আসিবে কি না সন্দেহ। বাদ্যযন্ত্রের সুরবাঁধার শব্দ হইতে তবে কি রাগরাগিণী বাজান হইবে, তাহা আবিষ্কার করিবার প্রয়াসও করা যাইতে পারে। আমাদের জাতীয় জীবনে বর্ত্তমানে দুই একটা দিকে ছাড়া ভবিষ্যৎ রূপায়নের স্পষ্ট নির্দ্দেশ কোথাও দেখা দেয় নাই—এমন কি, এই দুই একটা দিকেও যে নির্দ্দেশ পাই, তাহা হইতেছে প্রথম ইঙ্গিত বা আভাস মাত্র; সেখানেও যতটুকু ব্যক্ত হইয়াছে বলিয়া আমরা মনে করি তদপেক্ষা অনেক বেশীর ভাগই পিছনে অব্যক্ত রহিয়া গিয়াছে। ধর্ম্মে হউক, আর অধ্যাত্মসাধনায় হউক, চিন্তায় হউক, অনুভবে হউক, সাহিত্যে হউক, শিল্পকলায় হউক, সামাজিক ক্ষেত্রে হউক আর রাজনীতির ক্ষেত্রে হউক—সর্ব্বত্রই এই কথা প্রযোজ্য। সর্ব্বত্রই যে জিনিষটি দেখি, তাহা হইতেছে সূচনার সূত্রপাত—আরম্ভের আরম্ভ।
তবে একটিমাত্র জিনিষ সম্বন্ধে বোধ হয় নিঃন্দেহ হওয়া যাইতে পারে। সেইটি এই যে, অতীতকালের মত ভবিষ্যতেও ভারতের জীবনে মুখ্য ও মূল সুর হইবে আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিকতা বলিতে আমরা কেবল সূক্ষ্ম তত্ত্বপরায়ণতা অথবা কাজ করিবার অপেক্ষা স্বপ্ন দেখিবার প্রবৃত্তি বুঝিতেছি না। এই অর্থে আধ্যাত্মিকতা কথাটি প্রাচীন ভারত তাহার পূর্ণ সামর্থ্যের গৌরবময় যুগে কখনও গ্রহণ করে নাই— ইউরোপের ও ইউরোপীয় ভাবে প্রভাবান্বিত একদল সমালোচক বিরুদ্ধে যতই কিছু বলুন না কেন—এবং ভবিষ্যতের ভারতও কখন তাহা গ্রহণ করিবে না। ভারতের মানসশক্তির মধ্যে তত্ত্বচিন্তা একটা প্রধান বৃত্তিই হইয়া থাকিবে সন্দেহ নাই, এবং এই ক্ষেত্রে তাহার যে সমস্ত সামর্থ্য ও প্রতিভা তাহা যেন কখন সে না হারায়, ইহাও বাঞ্ছনীয়। তবে ইউরোপ যাহাকে দার্শনিকতত্ত্ব (metaphysics) বলে অর্থাৎ জর্ন্মণ বা ফরাসী পণ্ডিতের মত চুল-চেরা চিন্তা সব বিনাইয়া বিনাইয়া বলা অথবা আধুনিক বৈজ্ঞানিকদের মত স্থুল জগতের কয়েকটিমাত্র ব্যাপার লক্ষ্য করিয়া তাহা হইতে সর্ব্বসাধারণ একটা দর্শনের (Philosophy) সূত্র বা নিয়ম নিষ্কাষণের চেষ্টা—এই দুইটির কোনটিই ভারতের তত্ত্ববিদ্যা বা দর্শনের স্বরূপ নয়। ভারতের দার্শনিক তত্ত্ব মূলতঃ চিরকালই ছিল বুদ্ধির সহায়ে অধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে গোচর করিবার, নিকটে আনিবার প্রয়াস। অব্শ্য শেষাশেষি, এই দার্শনিক তত্ত্বপরায়ণতা জীবনের আয়তন হইতে অনেক দূরে সরিয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু গোড়ায় তাহার প্রকৃতি এ রকমের ছিল না। আদিকালের বেদান্তে অর্থাৎ উপনিষদের সাক্ষাৎজ্ঞানলব্ধ যে তত্ত্ব, তাহাতে এই জিনিষটি পাই না এবং পরবর্ত্তী কালে যখন দেখা দিল চিন্তাবৃত্তির সজীব সমর্থ নূতন সৃষ্টির একটা যুগ, তখনও যেমন গীতার মধ্যে—সেই উপনিষদেরই মূলসিদ্ধান্ত অটুট্ রহিয়া গিয়াছে, দেখিতে পাই। বৌদ্ধদর্শনই সর্ব্বপ্রথম জীবনকে বাস্তবিক সন্দেহের চোখে দেখিতে আরম্ভ করে। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম্ম দার্শনিক সিদ্ধান্ত হিসাবেই জীবনকে অস্বীকার করিতে চেষ্টা করিয়াছে—সাধনার, প্রয়োগের ক্ষেত্রে কার্য্যতঃ দেখি, সে জীবনকেই ধরিয়া চলিয়াছে, তাহাতে দিতে চাহিয়াছে শুধু একটা নূতন রূপ, নূতন অর্থ। বৌদ্ধদের প্রবর্ত্তিত সদাচার ও আধ্যাত্মিক সাধনার প্রণালী মানুষের জীবনযাত্রায় একটা তপশ্চর্য্যার কঠোর সামর্থ্য আনিয়া দিয়াছিল, সেই সাথেই আবার মিশাইয়া দিয়াছিল একটা প্রীতির কোমলতর আদর্শ। এই জন্যই সমাজে, রাষ্ট্রে এবং জীবনের রহস্য ব্যক্ত করিয়া ধরিতেছে যে সব শিল্পকলা, তাহাতে বৌদ্ধযুগ এতখানি সৃষ্টিক্ষম হইয়া উঠিয়াছিল। অধ্যাত্মের সত্য নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করা এবং তাহারই সহায়ে জীবনকে সঞ্জীবিত, পুনর্গঠিত করা— ইহাই হইতেছে ভারতের প্রকৃতির সনাতন বৃত্তি। যখনই আসিয়াছে স্বাস্থ্যের, সামর্থ্যের মহত্ত্বের যুগ, তখনই ভারত যে এই বৃত্তিটির কাছে ফিরিয়া যাইবে, তাহা অনিবার্য্য।
ভারতের যত আন্দোলন জীবনকে ঢালিয়া গড়িতে চেষ্টা করিয়াছে, তাহার প্রত্যেকটির সূত্রপাত হইয়াছে দেখি একটা নূতন অধ্যাত্ম জিজ্ঞাসা দিয়া, প্রায়ই একটা নূতন ধর্ম্ম-প্রচেষ্টা দিয়া। বেশী দূর যাইতে হইবে কেন, এই যে সেদিনকার ইউরোপীয় ভাবের আক্রমণ, তাহা ছিল কতথানি তর্কপন্থী, যুক্তিবাদী, ধর্ম্মভাবের পক্ষে অপেক্ষা বিপক্ষেই সে চলিয়াছে বেশী; তাহার আদর্শ, অনুপ্রেরণা ছিল অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের ইহসর্ব্বস্ব বহির্ম্মুখী বুদ্ধি; অথচ ভারতবর্ষের উপর তাহার প্রথম ফল হইল ধর্ম্মসংষ্কারের চেষ্টা, চেষ্টা শুধু কেন, কার্যতঃ কয়েকটি নূতন ধর্ম্মমতেরই সৃষ্টি। ভারতের এই বোধ একরকম নৈসর্গিক যে চিন্তাজগৎকে সমাজকে নূতন করিয়া গড়িতে হইলে আগে দরকার একটা আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠা; ধর্ম্মের প্রেরণা ও ধর্ম্মের রূপায়ন দিয়াই তাহা আরম্ভ করিতে হইবে। ব্রাহ্মসমাজের পত্তন হয় একটা উদার বিশ্বজনীন্ ভাব লইয়া, যে সমন্বয়ের চেষ্টা সে করিয়াছে, তাহার জন্য উপকরণাদি সে সংগ্রহ করিয়াছে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ও জাতির ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাদীক্ষা হইতে। তাহার মূল অনুপ্রেরণা ছিল বৈদান্তিক, কিন্তু বাহ্য রূপের জন্য সে গিয়াছিল ইংলণ্ডের Unitarian (একেশ্বরবাদী) সম্প্রদায়ের নিকট বা এই ধর্ম্মমতের কতকটা ধরণধারণ, কতকটা খৃষ্টানী প্রভাব, অনেকখানি যুক্তিবাদ ও বুদ্ধিসর্ব্বস্বতা প্রভৃতি মিলিয়া মিশিয়া হইয়াছে ব্রাহ্মধর্ম্ম। কিন্তু এখানে যাহা লক্ষ্য করিবার বিষয়, তাহা হইতেছে এই যে, ব্রাহ্মধর্ম্মের সূত্রপাতই হয় বেদান্তকে ফিরিয়া নূতন ভাবে প্রতিষ্ঠা করিবার প্রয়াসে। শুধু তাই নয়, দেশের সনাতন শিক্ষাসাধনার মধ্যে যাহাকে বলা যাইতে পারে প্রতিবাদের ধারা, তাহাও কি রকমে সমষ্টিগত ধারারই আকৃতি প্রকৃতি অনুসরণ করিয়া চলিয়াছে সেই রহস্যেরও আছে একটা বিশেষ অর্থ। ভারতের যে ধর্ম্মবৃত্তি তাহা চিরন্তন কাল হইতে তিনটি প্রেরণার উৎসকে ধরিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে—জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম্ম। ঠিক এই তিনটিকে ধরিয়া একের পর একে ব্রাহ্মধর্ম্ম ক্রমে তিনটি ভাগে শাখায়িত হইয়া উঠিয়াছে। তারপর পাঞ্জাবে যে আর্য্যসমাজ তাহার প্রতিষ্ঠা বেদের এক নূতন ব্যাখ্যার উপর, তাহার চেষ্টা হইতেছে বৈদিক সত্য সকল আধুনিক জগতের জীবনক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ ছিলেন যে ধর্ম্মান্দোলনের মাথায় তাহা চাহিয়াছে অতীত যুগের সকল ধর্ম্মসিদ্ধান্ত ও অধ্যাত্মউপলব্ধিকে একটা বিরাট্ উদার মহাসমম্বয়ে বিধৃত করা—সে সমন্বয় প্রাচীন বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসকে আবার সকলের উপরে স্থাপন করিয়াছে সত্য বটে, কিন্তু তাহারই সঙ্গে মিশাইয়া দিয়াছে নূতন জীবন্ত সাধনার ধারা, জনসেবার আগ্রহ, দেশে বিদেশে প্রচারের উৎসাহ। এমন কি, গোঁড়া যে হিন্দুধর্ম্ম, তাহারও গায়ে নূতন জাগরণের হাওয়া লাগিয়াছে——যদিও ২৫৷৩০ বৎসর পূর্ব্বে সে জিনিষটির যেমন জোর ছিল, আজ ঠিক তেমন নাই। ভারতের অন্যান্য ভাগও এই সকল বিপুল প্রাদেশিক আন্দোলনের ঢেউ কিছু কিছু অনুভব করিয়াছে, কোথাও বা নিজেরাই ছোট ছোট আন্দোলন সৃষ্টি করিয়াছে। বঙ্গদেশে ধর্ম্মভাবের সর্ব্বাপেক্ষা আধুনিক পরিণতি হইতেছে একটা নব বৈষ্ণবভাবের প্রসার; তাহাতে প্রমাণ হয়, যে-সব নব সৃষ্টির প্রয়াসের ভিতর দিয়া দেশ আপনাকে তৈয়ার করিয়া লইতেছে এখনও তাহাদের কাজ শেষ হয় নাই। সমস্ত ভারতবর্ষ ব্যাপিয়াই দেখি যাবতীয় পুরাতন ধর্ম্মসম্প্রদায় বা সাধন-পথ নূতন প্রাণে সমর্থ সজাগ হইয়া উঠিতেছে, ফিরিয়া আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য যত্নপর হইয়াছে। ইস্লামও কিছু দিন হইল এই সর্ব্বত্রব্যাপী সাড়ায় যোগ দিয়াছে —ভারতের যে মুসলমান জনসাধারণ দীর্ঘকাল ধরিয়া তামসিকতার ঘোরে নিমজ্জিত ছিল তাহার মধ্যেও চেষ্টা চলিয়াছে ইস্লামের সনাতন আদর্শ আবার জীবন্ত করিয়া ধরিতে অথবা নূতন নূতন ভাবে আবার ঢালিয়া গড়িতে।
পুরাতনের জন্য এই যে সকল নূতন রূপ আবিষ্কৃত হইতেছে তাহার কোনটি তাই বলিয়া কিন্তু পাকা হইয়া উঠে নাই। এ সব প্রয়াসকেই পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করিয়া লইতে হইবে— ভারতের অধ্যাত্মবোধ কি রকমে আস্তে আস্তে চারিদিক হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া জাগিয়া উঠিতেছে, অতীতের স্মৃতিকে উদ্ধার করিয়া ভবিষ্যতের দিকে মুখ ফিরাইয়া দেখিতেছে, তাহারই নিদর্শন হিসাবে। ভারত হইতেছে সকল ধর্ম্মের মিলনক্ষেত্র। তাহাদের মধ্যে আবার এক হিন্দুধর্ম্মেরই কি বিশালতা, কি জটিলতা! বস্তুতঃ, হিন্দুধর্ম্ম একটা বিশেষ ধর্ম্ম নয়, তাহা হইতেছে বহুল বিবিধ অথচ অতি-সূক্ষ্ম একটা মিলনসূত্রে গ্রথিত অধ্যাত্মচিন্তার, উপলব্ধির, আদর্শের পুঞ্জ। এত সব ধারার এত রকমারি অনুপ্রেরণার যে চাঞ্চল্য, যে বিপুল হট্টগোল তাহার ভিতর হইতে কি বস্তু যে বাহির হইয়া আসিবে তাহা ভবিষ্যতের গর্ভেই নিহিত। তবে যাহা হইয়াছে দেখিতে পাইতেছি তাহা এই—নূতন কর্ম্মের সৃষ্টির জন্য আমাদের আসিয়াছে একটা সত্যকার প্রেরণা, পুরাতন যে সব রূপায়ন তাহাদের মধ্যে আসিয়াছে একটা নূতন প্রাণ নূতন জীবন, প্রাচীন শিক্ষার সাধনার শাস্ত্রের সিদ্ধান্তের চলিয়াছে পুনরালোচনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; দৃষ্টান্তস্বরূপ নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে, বেদ বেদাস্ত পুরাণ যোগ এবং কিছুদিন হইতে তন্ত্র পর্য্যন্ত আমাদের বুদ্ধিকে নাড়া দিতে আরম্ভ করিয়াছে—যদিও একথা বলা যায় না যে, আমরা সে সকলের পূর্ণ অর্থ সম্যক্ উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি বা বাস্তব জীবনে তাহাদের কিছু প্রয়োগ করিয়াছি,—ব্যবহারিক জগতে আমাদের চিন্তার মনোভাবের উপর তাহাদের বাস্তবিক ফল কিছু হইয়াছে। মোটের উপর দেখিতে পাইতেছি, আমরা যেন সত্যের বৃহৎ হইতে বৃহত্তর ক্রমবিকাশের পথে চলিয়াছি, প্রাচীন ভাবের চিস্তার নূতনতর উপলদ্ধি অনুভূতির ভিতর দিয়া নব রূপসৃষ্টির দিকে অগ্রসর হইতেছি। শেষ পরিণতি যাহাই হউক না, নবীন ভারতের যে বিশেষত্বটুকু সকল জিনিষের উপরে আজ ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহা হইতেছে এই আধ্যাত্মিকতার এই ধর্ম্মভাবের আলোড়ন বিলোড়ন। এই ক্ষেত্রেই স্পষ্ট দেখা দিয়াছে একটা সৃষ্টির, নূতন গঠনের সামর্থ্য; কিন্তু অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে, অন্ততঃ সে দিন পর্য্যন্ত, ভারত দেখাইয়া আসিয়াছে বেশীর ভাগ ভাঙ্গিবার বা সমালোচনা করিবার প্রেরণা। আর একটি বিশেষত্ব সকল প্রয়াসের মধ্যে আস্তে আস্তে জাগিয়া উঠিতেছে, সেটি হইতেছে অধ্যাত্মকে জীবনের উপর ফলাইয়া ধরা। আজ দেশের নূতন প্রাণ চাহিতেছে যে, অধ্যাত্মজীবন যেন তাহার ব্যবহারের জীবনেরই প্রতিষ্ঠা হইয়া দাঁড়ায়। এমন কি, সন্ন্যাস, বৈরাগ্যও দেখিতেছি আর কেবল ধ্যানমগ্ন, আত্মসমাহিত বা উদাসীন হইয়া থাকিতে পারিতেছে না, প্রচারের জন্য, শিক্ষার জন্য, জনসেবার, মানবের কল্যাণ কর্ম্মের জন্য উৎসুক হইয়া পড়িয়াছে। দেশের যাঁহারা চিন্তাবীর মনীষী, তাঁহারা সকলেই এই জীবন-সাধনার উপরে দিনের পর দিন উত্তরোত্তর বেশী জোর দিয়া চলিয়াছেন। ভবিষ্যতে আমরা কোন্ দিকে কি করিব বর্ত্তমানে তাহার বিশেষ ইঙ্গিত বোধ হয় এইখানেই। ইহারই মধ্যে হয়ত রহিয়াছে ভারতের নবজন্মের গুপ্ত রহস্য। ভারত চাহিতেছে তাহার জীবনপ্রতিষ্ঠানের যে সব বাহ্যিক রূপ তাহা হইতে আপনাকে সরাইয়া লইয়া অন্তরাত্মার গভীরতম সত্তার মধ্যে ডুবিয়া যাইতে এবং সেখান হইতে একটা অধ্যাত্মশক্তির মুক্তধারা লইয়া আসিয়া, ফিরিয়া আবার সমস্ত জীবনকে ওতপ্রোত ভাবে তাহার দ্বারায় অভিষিক্ত করিয়া তুলিতে।
কিন্তু জীবনকে ধরিয়া চালাইবার জন্য এই অধ্যাত্মশক্তি কোন্ কোন্ মৌলিক চিন্তাসূত্র, কি রকম করণ বা প্রণালী সব আশ্রয় গ্রহণ করিবে, তাহা এখনও স্থির করিয়া বলা যাইতেছে না। কারণ, নবভারত এখনও বস্তুকে বুদ্ধির মধ্যে সুস্পষ্ট সুসীম করিয়া ধরিতে পারে নাই; নানা ধর্ম্মমত, অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান সবই তাহার হইতেছে পিছনের আধ্যাত্মিক প্রেরণার বাহ্য লক্ষণ মাত্র—ধর্ম্মসাধনা জিনিষটাই এখন হইতেছে আপনার নিভৃত শক্তিকে লাভ করিবার জন্য অধ্যাত্মশক্তির নিবিড় প্রয়াস। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ বা প্রসার হইতে থাকে তখন, যখন সে আধ্যাত্মিকতা মনের মধ্যে এমন সমর্থ চিন্তা তুলিয়া ধরে যাহার কাজ জীবনে রূপ সৃষ্টি করা, এমন সব আদর্শ ফুটাইয়া তোলে যাহা নূতন নূতন দিকে বুদ্ধিকে নিযুক্ত করে, ফলাইয়া ধরিবার জন্য প্রাণশক্তিকে প্রচালিত করে।
ভারতবর্ষে দর্শনের কাজ ছিল বুদ্ধির সহায়ে বুদ্ধির ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা উপলব্ধিকে প্রকাশ করা। কিন্তু বর্ত্তমানে এই দার্শনিক বুদ্ধি এখনও কোন নূতন সৃষ্টি সম্যক্ আরম্ভ করিতে পারে নাই। এ যাবৎ ইহা পুরাতন জ্ঞানসম্পদ্কেই ফিরিয়া আবার—হয় ত ভিন্ন কথায়—বলিতে চেষ্টা করিয়াছে; কিন্তু জ্ঞানের, আদর্শের পরিধি বাড়াইয়া ধরিবার জন্য কোন নূতন তথ্য স্থাপনের দিকে তেমন অগ্রসর হইতে চাহে নাই। ইউরোপীয় দর্শনের সংস্পর্শও তাহার মধ্যে নবসৃষ্টির ধারা কিছু উৎপাদন করিতে পারে নাই। ইহার অবশ্য কারণ আছে প্রথমতঃ, দর্শনের ক্ষেত্রে ইউরোপের নিকট হইতে গ্রহণ করিবার মত ভারতের তেমন কিছু আছে কি না সন্দেহ। ইউরোপের দর্শনে পাই যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ তথ্য, তাহা দেখি ভারতবর্ষ আগেই আবিষ্কার করিয়া বসিয়া আছে, তাহার নিজের আধ্যাত্মিক প্রকৃতি ও প্রতিভার সহিত সামঞ্জস্য থাকে এমন যথাযোগ্য ভাবে ও রূপে। অবশ্য ইদানীন্তনকালে নীট্শ, বের্গসন ও জেম্স’এর চিন্তা এখানে ওখানে দুই একটি মনকে স্পর্শ করিয়াছে বলা যাইতে পারে; কিন্তু তবুও ইহাদের সিদ্ধান্তে স্থুল প্রত্যক্ষ, বাহ্য কর্ম্মফল, মানুষের প্রাণশক্তিকে এতখানি বড় করিয়া দেখা হইয়াছে যে, মনে হয় না ভারত তাহাকে সত্যতঃ কখন আপনার বস্তু করিয়া লইতে পারিবে। ভারতের দর্শন বিকশিত হইয়া উঠিতে পারে একমাত্র অধ্যাত্মদৃষ্টিকে আশ্রয় করিয়া। গত শতবৎসর ধরিয়া যত ধর্মান্দোলন উঠিয়াছে, তাহারা যে সব অধ্যাত্মজিজ্ঞাসা তুলিয়া ধরিয়াছে, তাহারই ফলস্বরূপ শুধু পাওয়া যাইতে পারে ভারতের নবদর্শন। ইউরোপের মত, কেবল বিচার-বিশ্লেষণ-পরায়ণ তর্কবুদ্ধি অথবা বৈজ্ঞানিক চিন্তা জ্ঞান কখন ভারতে দর্শনের জন্ম দিতে পারিবে না। তা ছাড়া, নূতন সৃষ্টি করিতে পারে এমন সমর্থ তর্কবুদ্ধিও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে উঠিয়া সে ধরণের ক্ষেত্র কিছু প্রস্তুত করিয়া যাইতে পারে নাই। যাঁহাদেরই ছিল নিজস্ব একটা চিন্তাশক্তি, তাঁহারা সে বৃত্তি তাঁহাদের প্রয়োগ করিয়া দিয়াছেন বিশুদ্ধ সাহিত্যে, কিম্বা ব্যাপৃত হইয়া পড়িয়াছেন আধুনিক ভাব চিন্তা সব আত্মসাৎ করিয়া লইতে, বড় জোর, ভারতীয় ছাঁচে ঢালাই করিতে। আজকাল হয়ত একটা সমর্থতর চিন্তাশক্তির খেলা ফুটিয়া উঠিতেছে, কিন্তু তাহার মধ্যে স্থিরত্ব কিছু নাই, তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও কিছুই বলা চলে না।
পক্ষান্তরে, সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে স্পষ্ট কিছু যে আরম্ভ হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মত এই কয়টি বিষয়েও বঙ্গদেশই প্রধানতঃ পথ দেখাইতে আরম্ভ করিয়াছে। বাঙ্গলাই যেন ভারতশক্তির প্রথম পরীক্ষাগার; এখানেই নূতন আদর্শ, নূতন আশা, নূতন আকাঙ্ক্ষা সব নূতন রূপের মধ্যে সর্ব্বপ্রথম ঢালাই পেটাই হইতেছে। ভারতের আর আর প্রদেশে নবসৃষ্টির প্রয়াস অনেক চলিয়াছে বটে, এক আধ জন প্রতিভাশালী লেখক বা কবিরও উদ্ভব হইয়াছে শুনা যায়; কিন্তু একমাত্র বাঙ্গলাই ইতিমধ্যে গড়িয়া তুলিয়াছে রীতিমত একটা সাহিত্যের রাজ্য—সে সাহিত্যের আছে নিজস্ব প্রাণ, নিজস্ব রূপ, পাকা বনিয়াদ তাহার স্থাপিত হইয়াছে; তাই এখন দিন দিনই তাহা বাড়িয়া চলিয়াছে। বাঙ্গলার চিত্রশিল্প আর নগণ্য নয়,— একটা সূক্ষ্ম সৌন্দর্য্যবোধ, একটা আধ্যাত্মিক দৃষ্টির দ্বারা অনুপ্রাণিত এই বাঙ্গলার আপনকার শিল্প বিশ্বশিল্পের খুলিয়া দিয়াছে একটা নূতন ধারা। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দুই জনের নাম আমরা সকলেই জানি—তাঁহাদের এক জনের আবিষ্কার ত একটা ওলট্পালট্ ঘটাইয়াছে তা ছাড়া, বাঙ্গলায় যে তরুণ গবেষকমণ্ডলী গড়িয়া উঠিয়াছে, বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে তাহাদের দানও আজকাল হিসাব করিতে হইতেছে। সুতরাং বঙ্গদেশের দিকে লক্ষ্য করিলেই আমরা বুঝিতে পারি, ভারতের মতি, ভারতের গতি বিশেষ ভাবে, বাঙ্গলার চিত্রকলা এ বিষয়ে আমাদের যতখানি সাহায্য করিবে, ততখানি আর কিছুতে করিবে না—এমন কি, বঙ্কিমের গদ্যও নয়, রবীন্দ্রের কাব্যও নয়। তার কারণ, বাঙ্গলার কবিতাকে হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া চলিতে হইয়াছে, এবং এখনও সে যে ঠিক পথটায় পাকাপাকি উঠিতে পারিয়াছে, এমন বলা যায় না; কিন্তু বাঙ্গলার চিত্রশিল্প এমন চেষ্টাতে পা বাড়াইতেই, একটা যেন অপরোক্ষ উপলব্ধির বলেই, একেবারে তাহার স্বধর্ম্মের স্বরূপের পথে গিয়া দাঁড়াইয়াছে।
এ রকম যে হইয়াছে তাহার প্রথম হেতু এই যে, বাঙ্গলার নূতন সাহিত্যের গোড়া-পত্তন হইয়াছে বিদেশী প্রভাবের, একটা অস্পষ্টতার অনিশ্চয়তার যুগে। ভারতের শিল্প কিন্তু সে সময়ে চুপ করিয়া পড়িয়াছিল, কোন রকম সাড়াশব্দ দেয় নাই—অবশ্য রবিবর্ম্মার বীভৎস প্রয়াস মাঝখানে কিছু দিন সোরগোল তুলিয়াছিল, কিন্তু সুন্দরের নামে সে কুৎসিতের পূজা বন্ধ্যা নারীর গর্ভবেদনার মতই যে নিরর্থক, নিষ্ফল হইয়া পড়িবে তাহা স্বাভাবিক। ভারতের নব শিল্প জন্ম লইল ভারত যখন আপনাকে পাইতে চলিয়াছে, দেখিয়াছে একটা স্পষ্টতর জ্ঞানের আলোক। তা ছাড়া, দ্বিতীয় হেতু হইতেছে এই যে, সাহিত্যের আশ্রয় যে বাক্য ও অর্থ তাহাতে যতখানি আছে অবকাশ, তারল্য, বৈচিত্র্য, তাহার তুলনায় চিত্র বা ভাস্কর্য্য যে সব রূপ ও ভাব ধরিয়া চলে, তাহাতে আছে বেশী রকম বাঁধাবাঁধি। কিন্তু চিত্র বা ভাস্কর্য্যের ক্ষেত্র এই রকমে সঙ্কীর্ণ বলিয়াই তাহার আছে একটা সহজ নিবিড়তা, তীব্রতা আর সেই জন্যই তাহাদের মধ্যে সাহিত্যের চেয়ে সহজে পাই স্পষ্ট নিশ্চয় নির্দ্দেশ। আর বাঙ্গলার নবীন শিল্পীদিগের বিশেষত্ব, সমস্ত শক্তি দেখি এইখানে, যে তাঁহারা জিনিষের স্থূলরূপ ও ব্যক্ত অর্থকে ধরিয়া দেখাইতে চাহেন নাই, গোড়া হইতেই তাঁহাদের সঙ্কল্পই ছিল জিনিষের অন্তরাত্মার অব্যক্ত রহস্যের সন্ধান। বাঙ্গলার শিল্পের উৎস অপরোক্ষ অনুভূতি, এবং যে রূপ সে রচিয়া তুলিয়াছে, তাহা হইতেছে এই অপরোক্ষ অনুভূতিরই নিজস্ব ছন্দঃ, আমাদের তর্কবুদ্ধি স্থূল চক্ষুর প্রমাণে যে আকার মাপিয়া জুকিয়া তৈয়ার করে সে সকলের সহিত উহার কোন সম্বন্ধই নাই। এই শিল্প সীমার উপর ভর করিয়া হেলিয়া পড়িয়াছে অসীমের অব্যক্তের দিকে, তাহারই কিছু ইঙ্গিত আভাস আবিষ্কারের জন্য; বাহিরের জীবনের, স্থুল প্রকৃতির দিকে সে ফিরিয়াছে, তাহার উপরে এমন রেখা, এমন রঙ, এমন ছন্দঃ, এমন রূপ সব খেলাইয়া তুলিতে যেন ফুটিয়া উঠে আর এক রকম জীবনের, জীবনাতীতের অভিব্যঞ্জনা, আর প্রকৃতির, স্থূল প্রকৃতি আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছে যে প্রকৃতি তাহার দৃশ্যাবলী। ভারতীয় শিল্পকলার ইহাই হইল সনাতন ধর্ম্ম। এই সনাতন ধর্ম্মেরই নূতন প্রয়োগ, নূতন ধারা আজ সে দেখাইতেছে। প্রাচীনতর শিল্পে যতখানি ছিল রূপকের, পৌরাণিক কথাকাহিনীর আধিপত্য, ভাবের বা তত্ত্বের বৃহৎ ব্যঞ্জনা, আধুনিক শিল্পে তাহা নাই; আধুনিক শিল্প দিতে চাহিতেছে আভাসে ইঙ্গিতে অতি সন্তর্পণে একটা নিবিড় সাক্ষাৎ সূক্ষ্ম রূপায়ন। এই শিল্প বাস্তবিকই একটা নূতন সৃষ্টি; আশা করা যায়, বাঙ্গলা এই যে পথ খুলিয়া দিয়াছে, তাহাতে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ উঠিয়া আসিয়া চলিতে থাকিবে। শুধু তাই নয়, কলিকাতার নূতন শিল্পীমণ্ডলী শিল্পের দিয়াছে যে বিশেষ ধরণধারণ, তাহা বাঙ্গলার প্রাণেরই অন্তরঙ্গ বিকাশ; সুতরাং অন্যান্য স্থানের নূতন শিল্পী আরও নূতন ধরণধারণে আপনাকে প্রকাশ করিয়া চলিতেছেন, ভিন্ন ভিন্ন পথ খুলিয়া ধরিতেছেন, এরকমও আমরা অচিরে দেখিতে পারি। কিন্তু ভারতের মহত্ত্ব এইখানে যে, একদিকে তাহার আছে যেমন প্রদেশগত শিক্ষাদীক্ষার বিপুল বৈচিত্র্য, তেমনি অন্যদিকে সে সমস্তকে ধরিয়া আছে তাহার একটা নিবিড় অখণ্ড দেশগত ঐক্য। ভারতশিল্পের নব অভ্যুত্থানে ভারতের এই প্রকৃতিটিই যথাযথ প্রতিফলিত হইয়া উঠিবার সম্ভাবনা।
বঙ্গদেশের কাব্য ও সাহিত্য স্পষ্ট দুইটি বাঁক পার হইয়া আসিয়াছে এবং মনে হয় এখন আর একটি অনুসরণ করিবার উপক্রম করিতেছে; কিন্তু এই তৃতীয়টির স্বরূপ যে কি হইবে, তাহা আগে হইতেই ঠিক বলা যাইতেছে না। তাহার আরম্ভ ইউরোপীয় অর্থাৎ বেশীর ভাগই ইংরাজী প্রভাব লইয়া; সেই যুগেই আমদানী হইয়াছে গদ্যের ও পদ্যের নূতন নূতন ছাঁচ, নূতন নূতন সব সাহিত্যিক ভাব, রসায়নের বিধান। তখনকার সৃষ্টিতে ছিল প্রাচুর্য্য, ছিল উৎফুল্লতা; অনেক কবি তখন দেখা দিয়াছেন—শুধু পুরুষ নয়, মেয়েদের মধ্যেও। তাঁহাদের দুই জন বা একজন ছিলেন রীতিমত প্রতিভাবান স্রষ্টা, অন্যান্যের কবিত্বশক্তিও অকিঞ্চিৎকর ছিল না। সৌন্দর্য্যে মহত্ত্বে পরিপূর্ণ অনেক কিছুই রচিত হইয়াছিল। ফলতঃ, বলা যাইতে পারে জাঙ্গাল ভাঙ্গিয়া সরস্বতীর মুক্তধারা তখন বিপুল উচ্ছ্বাসে ছুটিয়া চলিয়াছিল। তখনকার কাজে কেবলই ছিল যে স্থূল অনুকরণের ছাপ, তাহা নয়। সত্য বটে, বিদেশীর প্রভাব সর্ব্বত্রই চক্ষু চাহিলেই নজরে পড়িত, কিন্তু দেশের প্রাণ তাহাকে আত্মসাৎ করিয়া লইতেছিল, কেবলই অবশ হইয়া তাহার দ্বারা চালিত হইতেছিল না। বাঙ্গলার যে বিশেষ ধাত, তাহার নিজস্ব যে রসবোধ, তাহারই ছাঁচে সকল বাহিরের প্রভাবকে ফেলিয়া ঢালাই করিয়া সে গড়িয়া তুলিতেছিল আপনারই অস্তরাত্মার বাঙ্ময় মূর্ত্তি। তবুও স্বীকার করিতে হইবে যে, রূপ হিসাবে যাহাই হউক কিন্তু বস্তু হিসাবে সেখানে যাহা পাই, তাহা দেশের অন্তরাত্মারই সম্পদ বলিয়া মনে হয় না, তাই সেখানে অনুভব হয় কেমন একটা শূন্যতা। সাহিত্যের দেহে,— তাহার ভঙ্গীতে, তাহার ভাষায় দেখি লাগিয়া রহিয়াছে বাঙ্গলার কবিতার জন্ম-সিদ্ধ চিরপরিচিত একটা লালিত্য, একটা সুঠাম কমনীয় গড়ন; কিন্তু আসল যে জিনিষ, যে পদার্থ এমন সুন্দর পরিচ্ছদে ব্যক্ত করিয়া ধরা হইয়াছে তাহার মূল্য কষিয়া দেখিতে গেলে বিশেষ কিছু পাই না। এ রকম হইতে বাধ্য। স্রষ্টা যত বড়ই হউন না কেন, তাঁহার সৃষ্টিতে স্বাধীন চিন্তার, নিজস্ব অনুভূতির আবেগের অপেক্ষা বেশীর ভাগই যখন থাকে অপরের ভাব ও ভঙ্গী নিজের করিয়া লইবার আয়াস, তখন সে সৃষ্টি সমর্থ সারবান হইতে পারে না, স্রষ্টার বাস্তব সৃষ্টি স্রষ্টার ভিতরের সামর্থ্যের তুলনায় অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হয়।
কিন্তু এই যুগও অনেকদিন পার হইয়া গিয়াছে। তাহার যে কাজ করিবার তাহা সে করিয়াছে। তাহার সাহিত্য-সৃষ্টি এখন অতীত ইতিহাসের মধ্যে আপন ন্যায্য স্থান করিয়া লইয়াছে। এই যুগের স্রষ্টাদের মধ্যে প্রধান হইতেছেন দুই জন। এক জনের ভিতর দিয়া বাঙ্গলার গদ্য সাহিত্য পাইয়াছে চরম স্ফূর্তি— এক দিকে তাঁহার চিন্তার ধারা যেমন ছিল নূতন সম্পূর্ণ নিজস্ব, অপর দিকে তেমনি ছিলেন তিনি রসজ্ঞ সিদ্ধ রূপদক্ষ। আর একজন যিনি তিনি এই যুগের শেষ আলোকবর্তিক। যখন জ্বলিয়া নিবিয়া যাইবে যাইবে করিতেছে তখন আসিয়া দেখা দিলেন; তিনি কিন্তু সেই শেষের স্ফুলিঙ্গ হইতে আবার নূতন একটা সুর, কবিত্বের একটা গভীরতর মূর্ছনা জাগাইয়া ধরিলেন, বাঙ্গলার যে সত্যকার প্রাণ তাহাকেই মূর্ত্ত করিয়া তুলিলেন। বঙ্কিমের যে কাজ তাহা এখন অতীতের বস্তু। তাঁহার কাজ বাঙ্গলার নবীন মনের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গিয়াছে— বাঙ্গলার এই নবীন মন তাঁহারই প্রভাবে যতখানি গড়িয়া উঠিয়াছে আর কিছুতে তাহা হয় নাই। রবীন্দ্রনাথ এখনও বর্ত্তমানের অনেকখানি ধরিয়া চালাইতেছেন— তবুও বর্ত্তমানকে ছাড়াইয়া ভবিষ্যতের পথও তিনি খুলিয়া দিয়াছেন বলিয়া মনে হয়। বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ দেখাইতেছেন দেশ কি রকমে আপনার অন্তরাত্মার দিকে ক্রমেই ফিরিয়া চলিয়াছে, ভারতের সনাতন অন্তরাত্মাই কি রকমে আপনাকে নূতন নূতন রূপে ব্যক্ত করিতেছে। দুইজনেই ঊষার বৈতালিক; তাঁহারা পাইয়াছেন যাহা তাহা অপেক্ষা খুঁজিতেছেন বেশী, যাহা গোচর করিয়া ধরিয়াছেন তাহা অপেক্ষা যাহার আভাস দিতেছেন তাহা বেশী। বর্ত্তমানে আবার দেখিতেছি একটা নূতন কিছু গড়িয়া উঠিবার প্রস্তাবনা চলিয়াছে। একদিকের প্রয়াস রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে ধরিয়া, তাহাকে বাড়াইয়া, তাহারই নূতনতর বিকাশের পথে চলা; অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের বিরোধী ধারা, তাহা চায় আরও জাতীয় ভাবের, সম্পূর্ণ এই দেশের মাটির অনুপ্রেরণা। কিন্তু পরিণাম যে ঠিক কি হইবে তাহা এখনও পরিষ্কার দেখা যাইতেছে না। তবুও মোটের উপর বোধ হইতেছে যেন বাঙ্গলার সাহিত্যের ধারাও তাহার নব্যশিল্পের ধারা চলিয়াছে যে দিকে সেই দিকেই ঘুরিয়া চলিবে—তবে সাহিত্যের উপকরণ, কথা ও অর্থ, স্পষ্ট বাক্য ও স্ফুট চিন্তা বলিয়া সেখানে আমরা আশা করি স্বভাবতই দেখা দিবে প্রকাশের ধারায় আরও ব্যাপকতা, ভাবের কল্পনায় অধিকতর বৈচিত্র্য। কিন্তু বঙ্গসাহিত্যে এখন পর্য্যন্তও তেমন কোন চরম স্রষ্টা পুরুষ আসিয়া আবির্ভূত হন নাই, যাঁহার বাণীর মধ্যে আমরা এই রকমের একটা স্পষ্ট অব্যর্থ নির্দ্দেশ পাইয়া স্থির হইতে পারি। তবে আশার কথা, চারিদিকের অনিশ্চয়তার মাঝে যে সব কবিকণ্ঠ মন্ত্রিত হইয়া উঠিয়াছে, ইতিমধ্যে তাহাতেই আমরা পাইতেছি একটা আভাস ইঙ্গিত, একটা ভরসা যে, নবীন ভারতের হইবে নূতন ধরণের এক সাহিত্য, তাহার প্রতিষ্ঠায় থাকিবে গভীরতর কল্পনা, অপরোক্ষ অনুভূতি।
মনের জগতে—যত সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রের মধ্যেই হউক না কেন—একটা কিছু স্পষ্ট আরম্ভ বা আরম্ভের সূচনা যে হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু দেশের বাহিরের জীবনের দিকে যখন তাকাই, তখন দেখি সেখানে কেবলই অনিশ্চয়তা, কেবলই বিশৃঙ্খলতা। এই অবস্থার কারণ বেশীর ভাগ দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থা—সে ব্যবস্থা প্রাচীন ব্যবস্থা নয়, প্রাচীনের প্রাণ তাহার মধ্য হইতে অনেক দিনই চলিয়া গিয়াছে— আবার কার্যতঃ তাহা ভবিষ্যতের ব্যবস্থারও অনুরূপ হইয়া উঠিতে পারে নাই। একবার আশা আর একবার নিরাশার তরঙ্গে তরঙ্গে ক্রমাগতই প্রতিহত হইয়া দেশ যে উৎকণ্ঠা ও চাঞ্চল্যের ঘূর্ণিপাকে বিপর্য্যস্ত হইয়া চলিয়াছে, সে রকম অবস্থায় নবজন্মের অনিবার্য্য নির্দ্দেশ দেশের জীবনে মূর্ত্ত হইয়া ফুটিতে পারে না। যেটুকু স্পষ্ট নিশ্চিত বর্ত্তমানে তাহা এই যে, বাহ্যিক অনুকরণের যুগ, যে যুগে ইউরোপের রাজনীতিক আদর্শ ও উপায়ের অন্ধ অনুসরণ আমরা করিয়াছি সেই প্রথম যুগ কাটিয়া গিয়াছে। বিগত বৎসর দশেক ধরিয়া যে আন্দোলন হইয়াছে তাহার ধাক্কায় ভারতবাসীর প্রাণে একটা নূতন রাজনীতিক ভাব জাগিয়াছে—সে আন্দোলন একটা উগ্র দেশপ্রেমকে একান্ত করিয়া ধরিয়া চলিয়াছে, দেশ ছাড়া আর কোন কথা বলিতে চাহে নাই, দেশসেবাকেই তাহা ধর্ম্মসাধনার পদে উন্নীত করিয়া ধরিয়াছিল, রাজনীতির ক্ষেত্রে ধরিয়া প্রয়োগ করিতেছিল প্রাচীন ধর্ম্মের দর্শনের সব সংজ্ঞা, দেশকে মাতারূপে শক্তিরূপে ইষ্ট করিয়া পূজা করিয়াছে, ভারতের সহজাত আধ্যাত্মিক চিন্তা ও প্রেরণার উপর দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করিতে চাহিয়াছে আধুনিক গণতন্ত্রবাদকে। সে আন্দোলন দেশের আত্মপ্রকাশের কোন সুঠাম রূপায়ন গড়িয়া দিতে পারে নাই; তাহার ধরণধারণ অনেক সময়েই ছিল অতিস্থূল রকমের, নেহাৎ অনিশ্চিতভাবের; সমস্ত চেষ্টা সে সংহত করিয়া প্রয়োগ করিয়াছে অতীতের ও বর্ত্তমানের অবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য, কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে নূতন সৃষ্টির সংগঠনের কাজ সুচারুরূপে পরিচালিত করিতে সফল হয় নাই। তবুও এই শৃঙ্খলাহীন প্রয়াস দেশের লোককে সত্য সত্যই জাগাইয়া গিয়াছে, ভারতের রাজনীতিক মন ও জীবনকে একটা বিশেষ ধারায় ঘুরাইয়া ধরিয়াছে—ইহার শেষ ফল আজ আমরা দেখিতে পারি না, দেখিব সেই দিন, যে দিন নিজের ভাগ্যকে নিজে নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য ভারতের হইবে অবাধ পুরুষকার ও সামর্থ্য।
ভারতের সমাজের অবস্থা আরও বিশৃঙ্খল ও অনিশ্চিত। চারিদিকের আবহাওয়ার চাপে পুরাতন রূপ সব খসিয়া ধ্বসিয়া পড়িতেছে, যে সত্যে যে প্রাণে তাহারা সঞ্জীবিত ছিল তাহা ক্রমেই লুপ্ত হইয়া যাইতেছে অথচ বাহিরের কাঠামটি কোন রকমে টিকিয়া চলিয়াছে। লোকে বহুদিনের অভ্যাসকে ছাড়িতে পারিতেছে না, গতানুগতিক চিন্তার ও প্রেরণার বশেই জড়ের মত পুরাতনের খাত অঙ্গুসরণ করিতেছে; অথচ নূতনের জন্মগ্রহণ করিবার মত পরিণতি ও সামর্থ্য এখনও হয় নাই। ভাঙ্গন চলিয়াছে বটে অনেক দিকে, কিন্তু তাহা এত ধীরে ধীরে যে এক রকম লক্ষ্যই করা যায় না। অতীত একটা নিথর জগদ্দল পাথরের মত শক্ত অসাড় হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে— তাহার মধ্যে নূতন গঠনের কোন অবকাশেরই সম্ভাবনা এখন পর্য্যন্তও দেখা যায় না। সমাজসংস্কার লইয়া খুব সোরগোল হইয়াছে বটে। কত জনা ইউরোপীয় সমাজের নমুনা ও আদর্শ দেশের সম্মুখে ধরিয়াছেন, অনেকে আবার পুরাতন কালেরই বিধিব্যবস্থা চরম সুন্দর বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। কিন্তু ফলে সর্ব্বত্রই হইয়াছে বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া। কারণ এরকম ভাসা ভাসা আন্দোলনে অভাব দৃঢ় নিষ্ঠা, সাধারণ লোকের উপর সে সকল কোন প্রভাবই বিস্তার করিতে পারে নাই, তাহাদের যে প্রাণের সত্য তাহাকে স্পর্শও করিতে পারে নাই। সমাজসংস্কার যখন ধর্ম্ম-প্রেরণার সহিত সংযুক্ত হইয়া দাঁড়াইয়াছে—যেমন ব্রাহ্মসমাজ, আর্য্যসমাজ প্রভৃতি কয়েকটি নূতন সমাজে— তখনই শুধু দেখি একটা স্থায়ী সমর্থ কিছু কাজ হইয়াছে। এই সাথে সাথেই আবার গোঁড়া যে হিন্দুসমাজ তাহাও আপনাকে বাঁচাইয়া বর্ত্তাইয়া রাখিবার জন্য চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। বলা বাহুল্য, এ আন্দোলনের পিছনেও গভীর কোন প্রেরণা নাই—সেখানে আছে বুদ্ধির খোসখেয়াল আর না হয় হৃদয়াবেগের বিলাস—যে সব সত্য যে সব শক্তি বাস্তবকে আজ ধরিয়া গড়িতেছে তাহাদের ছায়া পর্যন্ত উহার মধ্যে পাই না। তবে আস্তে আস্তে দেশবাসীর চেতনায় এই কথা ক্রমেই স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে যে আমাদের সামাজিক নীতি, সামাজিক প্রতিষ্ঠান সব নূতন করিয়া ঢালিয়া সাজিতে হইবেই হইবে এবং সেই জন্য দেশকে নিজের অন্তরের সত্যে প্রবুদ্ধ হইতে হইবে,—যে সব সত্য তাহারই নিজের শিক্ষাদীক্ষার অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত সে সকল রহিয়াছে গভীরতর স্তরে অব্যক্ত অবস্থায়, কেবল সামর্থ্যের ও সুবিধার অভাবে তাহাদিগকে সে জাগ্রতে ফুটাইয়া তুলিতে পারিতেছে না। বোধ হয়, ভারতের জাতীয় জীবনে যখন আসিবে আরও মুক্ত একটা অবস্থা, তখনই তাহার নবজন্মের পূর্ণতর শক্তি লোকের সামাজিক মন ও কর্ম্মের উপর জাগ্রত প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবে।