ভারতে এই যে নবজন্মের আয়োজন চলিতেছে কিন্তু উদযাপন এখনও হয় নাই, তাহাকে যদি সার্থকনামা হইতে হয়, যদি তাহার অর্থ হয় একটা নূতন শক্তিমান্ দেহে ভারতের অন্তরাত্মার পুনর্জন্ম, ভারতের স্বভাবজ সনাতন ধর্ম্মের—‘প্রজ্ঞা পুরাণী’র—নূতন রূপায়ন, তবে তাহাকে দ্বিধাশূন্য হইয়া আরও স্পষ্টতর, পূর্ণতর ভাবে জোর দিতে হইবে তাহার আধ্যাত্মিক প্রেরণাটির উপর; আরও নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সহিত চেষ্টা করিতে হইবে, যাহাতে সেই আধ্যাত্মিক প্রেরণাই আমাদের জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে মূর্ত্ত হইয়া উঠিতে থাকে। ফলতঃ কিন্তু দেখি, ঠিক এই কথাটা এখনও অনেকে ভুল বুঝিয়া থাকেন বা বুঝিতে মোটেও চাহেন না। অবশ্য তাঁহাদের এ রকম মনোভাবের হেতু যে নাই, তাহা নহে। আমাদের দেশে দুই একটা যুগে কালধর্ম্ম অনুসারে সন্ন্যাসবাদ ও ধার্ম্মিকতাকে এতখানি আতিশয্যের মাত্রায় টানিয়া লওয়া হইয়াছিল, আমরা এতখানি পরলোকসর্ব্বস্ব হইয়া পড়িয়াছিলাম এক সময়ে যে তাহারই প্রতিক্রিয়ায় আমাদের মধ্যে জন্মিয়াছে, জোর পাইয়াছে এই অবিশ্বাসের অনাস্থার ধারা। কিন্তু তবুও বলিব এই হেতুবাদের মধ্যে রহিয়া গিয়াছে একটা ফাঁক —ইহার দ্বারা যাহা প্রমাণিত করিবার চেষ্টা হয়, তাহা প্রমাণিত হয় না। আমাদিগকে সময়ে সময়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, সাহিত্যে, শিল্পে বা রাজনীতি ও সামাজিক জীবনে আধ্যাত্মিকতা বলিতে আমরা কি ছাই বুঝি—যদিও ভারতের সমস্ত অতীতের শিক্ষাদীক্ষার কথা মনে করিলে ভারতবাসীরই মুখে আজ আবার এ রকম প্রশ্ন শুনিয়া কিছু স্তম্ভিতই হইতে হয়। আমাদিগকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয় কাব্যে বা কলায় একটু আধ্যাত্মিকতার জল ছিটাইয়া দিলে তাহাদের এমন কি গৌরব বাড়িয়া যায়? এই হাওয়ার জিনিষটিকে দিয়া সমাজের বা রাষ্ট্রের যে সমস্ত স্থূল সমস্যা সেগুলির কোন্ সুরাহা হইবে? বাস্তবিক পক্ষে এই যে সব আপত্তি, তাহা ইউরোপের একটা ধারণার প্রতিধ্বনি মাত্র। ইউরোপে অনেক দিন ধরিয়া একটা সংস্কারের মত হইয়া গিয়াছে যে ধর্ম্ম, আধ্যাত্মিকতা হইতেছে এক দিকে, আর এক দিকে বুদ্ধিগত জ্ঞান, বাস্তব জীবন—এই দুইটি ধারা সম্পূর্ণ বিভিন্ন রকমের, তাহাদের প্রত্যেককে অনুসরণ করিতে হইবে আলাদা আলাদা পথ, প্রত্যেকের রহিয়াছে নিজের নিজের পৃথক্ ধরণধারণ, নিয়মকানুন। এই সঙ্গে আরও একটি সন্দেহ আমাদের উপর আসিয়া পড়ে যে, আধ্যাত্মিকতার নামে হয়ত বা আমরা বাস্তব হইতে কর্ম্মজীবন হইতে ফিরাইয়া লইয়া ভারতকে দিতে চাহিতেছি একটা ভাবুকতার, ধ্যানপরতার আদর্শ। ভারতকে আজ শক্তিমান্ কর্ম্মঠ সংহত ‘নেশন’ হইয়া উঠিতে হইবে,— বর্ত্তমান জগতের সঙ্ঘর্ষের মধ্যে বাঁচিয়া বর্ত্তিয়া থাকিতে হইলে তাহাকে বিচারবুদ্ধির আধুনিকতার পথেই অগ্রসর হইতে হইবে; কিন্তু তৎপরিবর্ত্তে আমরা কি পুরাকালের পুরাতন ধর্ম্মান্ধতাকে ডাকিয়া আনিতেছি না, যুক্তিহীন কুসংস্কার সব শিক্ষা দিয়া ভারতকে আবার অজ্ঞানের যুগে টানিয়া লইতেছি না? কথাটা তাহা হইলে আরও পরিষ্কার করিয়া আমরা বুঝাইতে চেষ্টা করিব—আধ্যাত্মিকতাকে ধরিয়া ভারতের নবজীবন গড়িয়া তুলিতে হইবে, আমাদের এই সুত্রটির প্রকৃত অর্থ কি।

 কিন্তু আগে আমাদের সূত্রটির অর্থ কি যে নয়, সেই কথাটাই বলিব। বলা বাহুল্য, সূত্রটি এমন শিক্ষা দেয় না যে, জাগতিক জীবনকে একটা ক্ষণিকের মোহরূপে মনে করিতে হইবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের সকলকেই মুনি সন্ন্যাসী হইয়া পড়িতে হইবে, মঠের, গিরিগুহার, পর্ব্বতশিখরের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াই সামাজিক জীবনের সমস্ত বিধিব্যবস্থা বাঁধিতে হইবে, মানবজাতির সমবেত উন্নতি অথবা ইহলোকের সংস্পর্শে আসে, এমন কোন কিছু লক্ষ্য সামাজিক জীবনের থাকিতে পারিবে না, জীবনের আদর্শ হইবে স্থির নিশ্চল স্থাণুত্বলাভ করা। এই ধরণের প্রেরণা ভারতের মনে এক সময় প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল, সন্দেহ নাই—কিন্তু তাই বলিয়া ইহা ছাড়া আর কোন প্রেরণা ভারতের যে ছিল না, তাহা নয়। তারপর, আধ্যাত্মিকতা বলিতে এমন বুঝায় না যে, কোন একটা বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের যে সব সঙ্কীর্ণ সিদ্ধান্ত, বিধান, অনুষ্ঠান, তাহারই ছাঁচে ফেলিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে একটা সমগ্র জাতীয় সত্তা। এই প্রয়াস পূর্ব্বকালে অনেকবার হইয়াছে বটে এবং বর্ত্তমানেও পুরাতন সংস্কার যেখানে যেখানে নির্ম্মূল হইতে পারে নাই, সেখানে সেখানে চলিতেছে। কিন্তু যে দেশ এত বিভিন্ন বিরুদ্ধ ধর্ম্মমতে পরিপূর্ণ, যাহার মধ্যে আশ্রয় পাইয়াছে পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্ম্মের ধারা এবং প্রতি মুহূর্ত্তেই যেখানে নূতন নূতন শাখা উপশাখা সব জন্মগ্রহণ করিতেছে, সেই দেশে অন্ততঃ এই ধরণের কোন চেষ্টা সঙ্গতও নয়, সম্ভবও নয়। একটা বিশেষ ধর্ম্মমত অপেক্ষা আধ্যাত্মিকতা অনেক বৃহত্তর জিনিষ। আর আধ্যাত্মিকতা যে নূতন একটা ব্যাপকতর অর্থ লইয়া জগতে ফুটিয়া উঠিতেছে, তাহার মধ্যে অতি উদারতম ধর্ম্মমতও হইয়া পড়িবে একটা ধারা, একটা অঙ্গমাত্র। সেই আধ্যাত্মিকতা হইতেছে বিশ্বজনীন ধর্ম্ম অর্থাৎ যাহার প্রেরণায় মানুষ খুঁজিতেছে, শাশ্বতকে, দিব্যকে, বৃহত্তর সত্তাকে, একত্বের উৎসকে; চেষ্টা করিতেছে যাহাতে লৌকিক জীবনের সহিত লোকাতীত জীবনের স্থাপিত হয় একটা নিকট সম্বন্ধ, সহজ সামঞ্জস্য, সম্মিলন।

 আধ্যাত্মিকতা বলিতে আমরা যে কোন রকম জিনিষ কিছু বাদ দিয়া রাখিতে চাহি, তাহা নয়। মানবজীবনে যাহা কিছু মহৎ আদর্শ, আধুনিক জগতে যাহা কিছু বৃহৎ সমস্যা, মানুষের যে কোন প্রকারের উর্দ্ধমুখী প্রয়াস, মানুষের অন্তরাত্মা যে কোন নিবিড় প্রেরণা বা বিশেষ উপায়কে ধরিয়া চাহিতেছে বিকাশ, উন্নতি, প্রসারতা, শক্তি, সামর্থ্য, আনন্দ, জ্যোতিঃ, পরিপূর্ণতা— সকলই, সমস্তই আমাদের লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত। দেহ নাই যাহার, মন নাই যাহার সেই আত্মা বা পুরুষ আর যাহাই হউক, মানুষ নয়। সুতরাং মানুষের যে আধ্যাত্মিকতা তাহা দেহ প্রাণ মনকে যেন হীন অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বিবেচনা করে না। বরং এই সমস্তকে বিশেষ প্রয়োজনীয়, বিশেষ মূল্যবান বলিয়াই ধরিতে হইবে—কারণ, এই সকলের ভিতর দিয়া, এই সকলকে যন্ত্র করিয়া তবে মানুষের অধ্যাত্মজীবন লীলায়িত হইয়া উঠে। ভারতের যে প্রাচীন দীক্ষা, তাহা পূর্ব্বতন গ্রীক বা আধুনিক বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের মতনই—তবে ভিন্ন লক্ষ্যে ও মহত্তর উদ্দেশ্যে—জোর দিয়া আসিয়াছে দেহ, প্রাণ ও মনের স্বাস্থ্য শক্তি উন্নতির উপরে। তাই যাহা কিছু দিয়া এই অঙ্গ কয়টির পূর্ণতা সাধন হইতে পারে, তাহারই অবাধ অনুশীলনের পথ সে করিয়া দিয়াছে। মস্তিষ্কের চর্চ্চা, দর্শন বিজ্ঞানের আলোচনা, রসবোধের তৃপ্তি, ছোট বড় সকল রকম শিল্পকলা, শরীরের স্বাস্থ্য ও বল, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, সমস্ত জাতিটিরই সমৃদ্ধি, স্বচ্ছলতা, পারিপাট্য, তাহার ক্ষাত্রশক্তি, রাষ্ট্রীয় শক্তি, সামাজিক শক্তি—সকল দিকেই ভারত সমান মনোযোগ দিয়া আসিয়াছে। আজকাল যেমন আমাদিগকে শিক্ষা দিবার চেষ্টা হয়, সে রকম কোন দিনই ভারত দারিদ্র্যকে একটা জাতীয় আদর্শ বা সাধনারূপে গ্রহণ করে নাই, কোন দিনই এমন বিধান সে দেয় নাই যে নগ্নতা শ্রীহীনতাই হইতেছে আধ্যাত্মিকতার একমাত্র অঙ্গরাগ। প্রাচীন ভারতের লক্ষ্য ছিল উর্দ্ধে, কিন্তু নীচের প্রতিষ্ঠাকেও সে দৃঢ় ও বিস্তৃত করিয়া গড়িয়া দিয়াছিল, এবং যে সকল যন্ত্রপাতি উপকরণ দিয়া গোড়ার বাঁধ, সেগুলির উপরও বিশেষ যত্নই সে দিয়া আসিয়াছে। নবীন ভারতকেও এই সাধনাই করিতে হইবে, তবে নূতন নূতন পথে, নবতর বৃহত্তর সব ভাবের প্রেরণায়; আর তাহার যন্ত্রাদিকেও আধুনিক জগতের যে জটিলতা তদনুরূপ করিয়া ঢালিতে হইবে। শুধু তাই নয়, তাহার কর্ম্মের প্রয়াসের প্রসারতা, তাহার মনোবৃত্তির বৈচিত্র্য প্রাচীন ভারতের অপেক্ষা অল্পতর হইবে না, বরং আরও বিপুলতর হইয়াই দেখা দিবে। আধ্যাত্মিকতাকে কেবল ‘নেতি নেতি’ হইতেই হইবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই; তাহার মধ্যে আবার সকল জিনিষই স্থান পাইতে পারে —আর এইটিই আধ্যাত্মিকতার পূর্ণ রূপ।

 তবুও বলিতে হইবে যে জগৎকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে দেখা আর শুধু জড়ের স্তর বা মনের স্তর হইতে দেখা এক জিনিষ নয়—উভয়ের মধ্যে আছে বিপুল পার্থক্য। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে আমরা দেখি দেহ প্রাণ আর মন মানুষের লক্ষ্য নয়, উপায় মাত্র; আর উপায়ের মধ্যেও তাহা শ্রেষ্ঠ বা চরম নয়; দেহ প্রাণ মন লইয়া হইতেছে আধারের অতি বাহিরকার যন্ত্র, মানুষের সমস্ত সত্তা ইহারই মধ্যে নিঃশেষ হয় নাই। আধ্যাত্মিক দৃষ্টি দেখাইয়া দেয় যে সকল সসীম জিনিষের পিছনে রহিয়াছে অসীম, এই অসীমের কষ্টিপাথরেই ধরিয়া সে নিরূপণ করে সব সসীমের মূল্য। অসীমের অসম্পূর্ণ খণ্ড খণ্ড রূপায়ন হইতেছে সসীম, সসীমের নিত্য প্রয়াস অসীমকে আরও যথাযথ প্রকাশ করিয়া ধরিতে। মানুষের জগতের পশ্চাতে, ব্যক্ত বাস্তব অপেক্ষা রহিয়াছে যে একট! মহত্তর বাস্তব, আধ্যাত্মিক দৃষ্টি কেবল তাহাই উদ্ঘাটন করিতেছে না; কিন্তু মানুষের, জগতের অন্তরে, অন্তরাত্মার মধ্যে সে দেখিতেছে পুরুষকে, এই পুরুষকেই সকলের উপরে সে আসন দিয়াছে, মানুষের আর সকল অঙ্গকে নির্দ্দেশ দিতেছে যে প্রকারে হউক না কেন এই দিব্য সত্তাকে প্রকাশ করিয়া মূর্ত্ত করিয়া ধরিতে। এই আত্মা, এই পুরুষ, এই দিব্যসত্তাকেই যেন মানুষ জগতে সকল বাহ্যরূপের অন্তরালে প্রতিনিয়ত দেখিতে শুনিতে চেষ্টা করে, নিজের জীবন মন যেন ইহারই সহিত একীভূত করিয়া ধরে, ইহারই মধ্যে যেন সকল মানুষের সহিত একত্ব অনুভব করে। ফলে, আমাদের সাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক দৃষ্টিকে যে অনেকখানি বদলাইয়াই ধরিতে হইবে, তাহাতেও সন্দেহ নাই। মানবজীবনের সকল লক্ষ্যকেই ধরিয়া রাখিলেও, তাহাদের দিতে হইবে নূতন একটা অর্থ, নূতন একটা সার্থকতা।

 আমরা চাহি দেহের স্বাস্থ্য ও সামর্থ্য—কিন্তু কোন্ উদ্দেশ্যে? বলা যাইতে পারে, স্বাস্থ্য ও সামর্থ্যের জন্যই জিনিষটা স্পৃহণীয়, তাই। অথবা বলা যাইতে পারে, দীর্ঘজীবনের জন্য, মনে প্রাণে চিত্তে যাহাতে সম্যক্ ভোগ করিতে পারি, তাহার একটা পাকা বনিয়াদের জন্য। নিরাময় সবল দেহের জন্যই চাই নিরাময় সবল দেহ—এ কথা এক হিসাবে সত্য; কিন্তু এই হিসাবে যে দেহও হইতেছে আত্মার প্রকাশ, দেহেরও চাই পরিপূর্ণতা, মানুষের যে অখণ্ড জীবনযাত্রা তাহারই অন্তর্ভূক্ত দেহের সার্থকতা। তা ছাড়া, আরও সত্য হইতেছে এই কথা যে, দেহকে প্রতিষ্ঠা করিয়াই ঊর্দ্ধে উঠিয়া চলিতে হয় মানুষের মধ্যে দিব্য পুরুষের অনুসন্ধানে—সেই জন্যই ত বলা হইয়াছে, ‘শরীরং খুলু ধর্ম্মসাধন’, ধর্ম্মের সাধনা করিতে হইলে অর্থাৎ যে অন্তরাত্মার সত্যবিধান লইয়া চলে ভগবৎসমীপে, তাহাতে প্রতিষ্ঠিত হইতে হইলে শরীরকেও একটা উপায় বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে। সাধারণ বুদ্ধিতে বলা হয় যে মনকে প্রাণকে চিত্তকে উন্নত পরিপুষ্ট করিয়া তোলা দরকার, কারণ, তাহাতে মানুষ অধিকতর আনন্দের অধিকারী হয়, মানুষ তাহাতে পায় আপনার শুদ্ধতর প্রকৃতিরই পরিতৃপ্তি, তাহাতেই সে জীবনের সার্থকতা অনুভব করে। এ কথা সত্য সন্দেহ নাই; কিন্তু আমরা বলিব যে, মন প্রাণ চিত্তও হইতেছে আত্মারই প্রকাশ, মানুষের মধ্যে ইহারা খুঁজিতেছে আপন আপন দিব্য রূপায়ন, ইহাদের শুদ্ধি স্ফূর্তি শক্তি সিদ্ধির ভিতর দিয়া মানুষ জগতের মধ্যে প্রকট যে দিব্যসত্য, তাহার অনুসন্ধান পায়, তাহাকে বহুল বিচিত্র ভাবে অধিগত করে, তাহারই ছন্দে পরিশেষে নিজের সমস্ত জীবনকে মিলাইয়া মিশাইয়া ধরিতে পারে। নীতি বা সদাচার বলিতে সাধারণতঃ বুঝায় ব্যক্তিগত ও সমাজগত জীবনের এমন শৃঙ্খলিত কর্ম্মধারা, যাহার কল্যাণে সমাজ বাঁচিয়া বর্ত্তিয়া থাকে; সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সহিত ব্যক্তির আদানপ্রদান নিয়ন্ত্রিত হয় একটা ন্যায়ের, দরদের, আত্মসংযমের ও আত্মোৎসর্গের বিধান অনুসারে। কিন্তু আধ্যাত্মিক অর্থে নীতি হইতেছে কর্ম্মের মধ্যে, কর্ম্ম অপেক্ষাও বিশেষভাবে স্বভাবের মধ্যে আমাদের অন্তরস্থ দিব্য পুরুষকে ফুটাইয়া তুলিবার একটা উপায়, ভাগবত প্রকৃতির মধ্যে উঠিয়া চলিবার পথে একটা সোপান।

 আমাদের অন্যান্য লক্ষ্য, অন্যান্য কর্ম্মৈষণা সম্বন্ধেও ঐ একই কথা। আধ্যাত্মিকতা সে সকল গুলিকেই বরণ করিয়া লইতেছে, কিন্তু প্রত্যেকেরই দিতেছে একটা বৃহত্তর, গভীরতর, নিবিড়তর দিব্যভাবের অর্থ। পাশ্চাত্যের ধরণ দিয়া বিচার করিতে গেলে, দর্শন হইতেছে শুদ্ধ যুক্তির সহায়ে সৃষ্টির মূলতত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা বা গবেষণা। এই সব মূলতত্ত্ব আমরা বাহির করিতে পারি, এক, জড়বিজ্ঞান আমাদের দুয়ারে আনিয়া দিতেছে যে সব বাস্তব সত্য, তাহা পর্যবেক্ষণ করিয়া, আর না হয়, যুক্তির যে সব মূল বৃত্তি, মস্তিষ্কের যে সব ধারণা, তাহাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করিয়া, অথবা যুগপৎ এই দুই পন্থার আশ্রয় লইয়া। কিন্তু আধ্যাত্মিক দিক্ দিয়া ধরিতে গেলে, আমরা দেখি যে সৃষ্টির সত্য কেবল যুক্তির সহায়ে কি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের সহায়ে পাওয়া যায় না, তাহা পাওয়া যায় অপরোক্ষ অনুভূতির, অন্তরের উপলব্ধির দ্বারা। দর্শনের কাজ হইতেছে যত রকম উপায়ে যত রকম জ্ঞান পাওয়া যায়, তাহা সাজাইয়া গুছাইয়া ধরা এবং শেষে সেই সকল জ্ঞান একটা সমন্বয়ের সূত্রে পরম সত্যের সহিত—একম্ অদ্বিতীয়ম্ যে বিশ্বজনীন বস্তু—তাহার সহিত মিলাইয়া ধরা। ফলতঃ, দর্শনের মূল্য ও সার্থকতা ততখানিই, যতখানি তাহা আধ্যাত্মিক উপলব্ধির প্রতিষ্ঠা গড়িয়া দিতে পারে, যতখানি তাহা মানুষকে মানবীসত্তা হইতে দিব্য ভাগবত স্বরূপে তুলিয়া ধরিতে সাহায্য করে। এইভাবে বিজ্ঞানও তাহার জগতের জ্ঞান লইয়া বিশ্বের মধ্যে বিশ্বের অধিষ্ঠাতৃ পুরুষেরই কর্ম্মধারাকে ফুটাইয়া ফলাইয়া ধরে। বিজ্ঞান অর্থ যে শুধু স্থূলের জ্ঞান, স্থূলজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ অথবা জড় ও জড়শক্তিকে ধরিয়া জীবনীশক্তির, মানুষের, মানুষের মনের বিশ্লেষণ ব্যাখ্যাই হইতে হইবে এমন কোন কথা নাই। আধ্যাত্মিক শিক্ষাদীক্ষা বিজ্ঞানের পরিধিকে আরও বাড়াইয়া দিবে, গবেষণার জন্য নূতন নূতন ক্ষেত্র খুলিয়া ধরিবে। প্রাচীনকালে ছিল যে এক সূক্ষ্ম জগতের বিজ্ঞান, যে সব বিজ্ঞান অন্তরাত্মাকে পুরুষকে মূল সত্য রূপে ধরিয়া চলিত; মনের, এমন কি মনের উপরে রহিয়াছে যে বৃহত্তর শক্তি, তাহাকে নামাইয়া কার্য্যকরী করিয়া তুলিত জীবনগতির মধ্যে, স্থূল বস্তুর আয়তনে—সেই সূক্ষ্ম বিজ্ঞানেরও পুরাতন ও নূতন নূতন রূপ বিজ্ঞান আলোচনারই অঙ্গ হইয়া উঠিবে। তারপর শিল্পকলা ও কাব্যের গোড়াকার প্রাকৃত লক্ষ্য হইতেছে মানুষের ও প্রকৃতির প্রতিরূপ সৃষ্টি করা, যাহাতে আমাদের সৌন্দর্য্যবোধ তৃপ্ত হয়, যাহাতে বুদ্ধিবৃত্তির এবং কল্পনার ভাবরাশি সুচারুরূপে আমাদের সম্মুখে মূর্ত্ত হইয়া উঠে। কিন্তু শিল্পকলা, কাব্য যখন হয় অধ্যাত্মদৃষ্টির সৃষ্টি, তখন তাহার লক্ষ্য মানুষের ভিতরে লুক্কায়িত আছে যে মহত্তর পদার্থ সব তাহা ব্যক্ত করিয়া ধরা; যে অধ্যাত্ম রসায়ন, যে বিশ্বসৌন্দর্য্য জগৎ বেড়িয়া আছে তাহাকে প্রকাশ করা। রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, মানবজীবনের গোড়াপত্তনের দিক দিয়া দেখিলে হইতেছে মানুষ যাহাতে সমবেতভাবে বাঁচিয়া থাকিতে, ধনজন-উৎপাদন করিতে, বাসনা চরিতার্থ করিতে, ভোগ করিতে পারে, যাহাতে দেহপ্রাণমনকে, কর্ম্মপটু, সমর্থ করিয়া ধরিতে পারে, তাহারই একটা ব্যবস্থা। কিন্তু আধ্যাত্মিক দীক্ষা এই সকল প্রতিষ্ঠানের আনিয়া দিবে আরও নূতনতর সার্থকতা। প্রথমতঃ, ইহারা হইয়া উঠিবে জীবনের সাধনক্ষেত্র অর্থাৎ মানুষের এখানে থাকিয়া জাগিবে নিজের সত্যস্বরূপকে দেবত্বকে জানিবার আকাঙ্ক্ষা, পাইবার প্রয়াস। দ্বিতীয়তঃ, ভাগবতসত্তার যে ধর্ম্ম, তাহাকে জীবনলীলার মধ্যে উত্তরোত্তর ফুটাইয়া ধরিতে থাকিবে ইহারা। তৃতীয়তঃ, এই সব আয়তনকে ধরিয়া মানুষ সমবেতভাবে উঠিয়া চলিবে জ্যোতির, শক্তির, শান্তির, একত্বের, সম্মিলনের দিকে; মানবজাতি অন্তরে চাহিতেছে যে দিব্য প্রকৃতি, তাহারই মধ্যে। আধ্যাত্মিক শিক্ষাদীক্ষা, জীবনে অধ্যাত্মের প্রয়োগ বলিতে আমরা যাহা বুঝি, তাহা হইতেছে এই, ইহা অপেক্ষা বেশী আর কিছু নয়, কিন্তু ইহা অপেক্ষা কমও নয়, এইটুকুর মধ্যে আছে যত সম্ভাবনা তৎসমস্তই।

 এই আদর্শে যাঁহাদের আস্থা নাই অথবা যাঁহারা ইহা বুঝিতেই পারেন না, তাঁহারা এখনও পাশ্চাত্যসুলভ জীবনকল্পনায় বিমূঢ় হইয়া আছেন। পাশ্চাত্যের বন্যা ভারতের নিজস্ব ভাবকে এক সময়ে যে ভাসাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিয়াছিল, তাঁহারা আজও সেই স্রোতে গা ছাড়িয়া দিয়া চলিয়াছেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত যে, ইউরোপ ইতিমধ্যে নিজেই তাহার পরিচিত গতানুগতিক সংস্কারকে ছাড়াইয়া উঠিবার চেষ্টা করিতেছে এবং সেই জন্য ঠিক প্রাচ্যেরই দ্বারস্থ হইতেছে। আমরা দেখিতেছি না কি, প্রাচ্যের আদর্শ প্রভৃতি—অবশ্য বাহ্যরূপ নয়, কিন্তু ভিতরের আসল ভাব বস্তু—কি রকমে আস্তে আস্তে ইউরোপের মধ্যে প্রসারিত হইয়া পড়িতেছে? পাশ্চাত্যের চিন্তা, কাব্য, শিল্পকলা, ব্যবহারনীতি সবই প্রাচ্যের রঙ্গে রঙ্গীন্ হইয়া উঠিতেছে? পাশ্চাত্যের উপর এই প্রাচ্যের বন্যা তাই বলিয়া পাশ্চাত্যের নিজস্ব শিক্ষাদীক্ষাকে ভাঙ্গিয়া ভাসাইয়া দিতেছে না, কিন্তু তাহাকে নূতন করিয়া, বৃহৎ করিয়া গড়িয়া তুলিতেছে। ইউরোপ যখন এই ভাবে নূতন সত্যের আলোকে নিজেকে গরীয়ান্ করিয়া ধরিবার চেষ্টা করিতেছে, অধ্যাত্মের তত্ত্ব সব ধীরে ধীরে স্বীকার করিয়া মানুষের ভিতরে বাহিরে একটা রূপান্তরের সাধনা করিতেছে, ঠিক সেই সময়ে আমরা ভারতবাসী কি ইউরোপের পরিত্যক্ত জীর্ণবাস বরণ করিয়া লইব, যে পথ চলিয়া সে ছাড়িয়া দিয়াছে, সেই পথেই চলিতে থাকিব, চিরকালই কাল যাহা সে ফেলিয়া দিয়াছে, আজ তাহা আমরা আদরে ঘরে তুলিয়া লইতে থাকিব? ইউরোপ যে মুহূর্ত্তে আমাদের উপর আসিয়া পড়িল তখন ঘটনাচক্রে আমাদের অবসাদের, দুর্ব্বলতার অবস্থা—এ রকম অবস্থা সকল উন্নত জাতির ভাগ্যেই একদিন না একদিন আসিয়া থাকে। কিন্তু তাই বলিয়া, আমরা যেন আমাদের শিক্ষাদীক্ষার স্বাতন্ত্র্যে আস্থা না হারাইয়া বসি। তাই বলিয়া এমন কিছু প্রমাণ হয় না যে, আমাদের আধ্যাত্মিকতা, আমাদের সাধনা, আমাদের আদর্শ সব ভুল,—সুতরাং আমাদের উচিত যেন-তেন প্রকারে আমাদের ব্যবহারিক জীবনকে ইউরোপের নাস্তিকতার, জড়বাদের ছাঁচে ঢালাই করিয়া ফেলা, আধ্যাত্মিকতা, ধর্ম্মসাধনা প্রভৃতি যাহা কিছু ভারতের ভারতত্ব, তাহা যৎসামান্য ভাবে পিছনে কোথাও শোভারূপে বসাইয়া রাখিলেই যথেষ্ট! বিগত ইউরোপীয় যুদ্ধ ইউরোপের পক্ষে একটা প্রলয়, কিন্তু তাহাতে প্রমাণ হয় কি যে ইউরোপের বিজ্ঞান, গণতন্ত্র, ক্রমপ্রগতি সব মায়া মরীচিকা—ইউরোপের উচিত আবার মধ্যযুগে যাওয়া অথবা চীনের কি তিব্বতের শিক্ষাদীক্ষাকে অনুকরণ করিয়া চলা? যাহারা ভাবিয়া দেখিতে চাহে না বা পারে না, বাহিরের দুই একটা অসংলগ্ন ঘটনা হইতেই যাহারা ত্বরিতে একটা সাধারণ সূত্র কষিয়া বসিতে চাহে, তাহারাই এমন অপসিদ্ধান্ত করিতে সু-পটু।

 ভুল ইউরোপও করিয়াছে, আমরাও করিয়াছি; নিজ নিজ আদর্শের অনুসরণে উভয়েরই পদস্খলন হইয়াছে, উভয়েই অস্বাভাবিক অতিমাত্রায় চলিয়া গিয়াছে। তবে ইউরোপ ঠেকিয়া শিখিতে পারিয়াছে, নিজেকে সংশোধন করিয়া লইতে প্রয়াস পাইতেছে। কিন্তু তাই বলিয়া তাহার বিজ্ঞানকে, গণতন্ত্রকে, ক্রমোন্নতিবাদকে সে বিসর্জ্জন দিয়া বসে নাই, বরং সে চাহিতেছে এ গুলির অভাব ত্রুটী সারিয়া পূর্ণাঙ্গ করিয়া ধরিতে, মহত্তর উদ্দেশ্যে কল্যাণকর পথে তাহাদিগকে চালাইয়া লইতে। প্রাচ্যের জ্যোতিঃ সে বরণ করিয়া লইতেছে বটে, কিন্তু তাহার নিজস্ব চিন্তার ধারা, জীবনযাত্রার প্রণালীকেই প্রতিষ্ঠা করিয়া তবে নিজেকে খুলিয়া ধরিতেছে অধ্যাত্মের সত্যের অভিমুখে; আপনার বিশিষ্ট জীবনের সত্যকে, সামাজিক আদর্শকে, জ্ঞানবিজ্ঞানকে জলাঞ্জলি সে দেয় নাই। আমাদিগকেও ঠিক তেমনি নিষ্ঠাভরে, তেমনি ভাবে সংস্কারমুক্ত হইয়া ভারতের সনাতন সত্যকে এবং আধুনিক প্রভাব সকলকে কাজে লাগাইতে হইবে। যেখানে যেখানে ভুল হইয়াছে, তাহা সারিয়া লইতে হইবে; আমাদের আধ্যাত্মিকতাকে আরও বৃহত্তর, উদারতর করিয়া জীবনক্ষেত্রে প্রয়োগ করিতে হইবে; আমাদের পূর্ব্বপুরুষদিগের অপেক্ষা কম নয়, যদি সম্ভব হয়, তবে বেশীই আধ্যাত্মিক হইতে হইবে। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানকে, যুক্তিকে, উন্নতিশীলতাকে, আধুনিক যুগের সকল মূল সত্যকেই আমরা গ্রহণ করিব, কিন্তু আমাদের নিজস্ব জীবনধারার উপর দাঁড়াইয়া, আমাদের অধ্যাত্ম আদর্শ ও লক্ষ্যের সহিত মিলাইয়া ধরিয়া। আমাদের চারিদিকে যে জীবনপ্রবাহ বিপুলস্পন্দনে ছুটিয়া চলিয়াছে, আধুনিক প্রাণে যত ঐহিক প্রেরণা, যত আধিভৌতিক কর্ম্মৈষণা খেলিয়া উঠিতেছে, তাহার মধ্যে আমরা ঝাঁপ দিয়া পড়িতে পারি; কিন্তু সে জন্য ঈশ্বর সম্বন্ধে, মানুষ সম্বন্ধে, প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের যে মূল উপলব্ধি তাহা পরিত্যাগ করিতে হইবে কেন? দুইটির মধ্যে ত কোন বিসম্বাদ নাই। বরং তাহারা একটি আর একটির সহায়, পরস্পরের নিভৃত অর্থ রূপায়ন তাহারা পরস্পরে বিকশিত করিয়া তুলিতেছে, উভয়ে উভয়কে সমৃদ্ধ, ঐশ্বর্য্যপূর্ণ করিয়া ধরিতেছে।

 ভারত তাহার নিজত্বে প্রতিষ্ঠিত হইয়া, স্বধর্ম্মকে অনুসরণ করিয়াই নিজে উন্নত হইবে, জগতের সেবায় আসিবে। এই কথার অর্থ এমন নয়—সঙ্কীর্ণ মন লইয়া সংস্কারান্ধ হইয়া অনেকে যেমন সিদ্ধান্ত করিয়া বসেন— যে কালস্রোতে নূতন যাহা কিছু আমাদের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইতেছে অথবা ইউরোপ যাহা কিছু সর্ব্বপ্রথম আবিষ্কার করিয়াছে বা সামর্থ্যের সহিত ব্যক্ত করিয়াছে, তৎসমস্তই দূর করিয়া ফেলিয়া দিতে হইবে। এ রকম মনের ভাব যুক্তির দিক দিয়া যেমন মূঢ়তার পরিচয়, কাজের দিক দিয়া তেমনি অসম্ভব— শুধু তাই নয়, ইহা আধ্যাত্মিকতার অভাব। কারণ, সত্যকার আধ্যাত্মিকতা কোন নূতন জ্ঞানকেই পরিহার করে না, মানবজাতির আত্মোন্নতির উপায় বা উপকরণ যদি আরও কিছু জুটিয়া যায় তবে তাহা ফেলিয়া দেয় না। আমাদের অন্তরাত্মাকে, আমাদের সত্তার বিশিষ্ট ধরণকে, আমাদের সহজাত স্বভাবকে অক্ষুণ্ণ রাখিতে হইবে এবং তাহার সহিত মিলাইয়া মিশাইয়া ধরিতে হইবে আমরা যাহা কিছু বাহির হইতে আহরণ করিব আর তাহার ভিতর হইতেই বিকসিত করিয়া ধরিতে হইবে আমরা যাহা কিছু কর্ম্ম করিব, যাহা কিছু সৃষ্টি করিব। ইহাই হইল আমাদের সূত্রটির অর্থ। অধ্যাত্মধর্ম্মই বিশেষভাবে ভারতের মনোযোগ চিরকাল আকর্ষণ করিয়া আসিয়াছে—ইহাই হইল ভারতের অন্তরপুরুষের কথা। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে অত্যধিক ধর্ম্মালোচনাই ভারতের সর্ব্বনাশ করিয়াছে; সমস্ত জীবনকে যে আমরা ধর্ম্ম বলিয়া মনে করি অথবা ধর্ম্মকেই আমরা যে মনে করি সমস্ত জীবন,—ঠিক এই কারণেই আমরা জীবনযুদ্ধে হটিয়া গিয়াছি, আমরা তলাইয়া গিয়াছি। এই অনুযোগের উত্তরে আমি কবির ঈষৎ অন্য প্রসঙ্গে ব্যবহৃত ভাষায় বলিতে চাহি না যে আমাদের অধঃপতনে কিছু আসে যায় না, যে ধূলায় পড়িয়া ভারত গড়াইতেছে তাহাও পবিত্র। পতনে, ব্যর্থতায় অনেকখানিই আসে যায়; মানুষের পক্ষে হউক, জাতির পক্ষে হউক ধূলায় পড়িয়া গড়ান খুব সম্মানকর কাজ নয়। কিন্তু আসল কথা, পতনের কারণ যাহা নির্দ্দেশ করা হইয়াছে তাহা ত নয়। ভারতের অধিকাংশ লোক যদি সমস্ত জীবনকে সত্য সত্যই ধর্ম্মসর্ব্বস্ব করিয়া তুলিতে পারিত, তবে আর আমাদের এমন অবস্থা হইত না। আমাদের অধঃপতন হইয়াছে, কারণ সমষ্টিগত জীবনে আমরা হইয়া পড়িয়াছিলাম ভীষণ অধার্ম্মিক, আত্মসর্বস্ব, নাস্তিক, জড়বাদী। হইতে পারে, এক সময়ে আমরা একদিকে অত্যধিক ধার্ম্মিকতার দিকে, অর্থাৎ অত্যধিক পরিমাণে বাহ্যিক অনুষ্ঠান, শাস্ত্র, আচার নিয়মের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছিলাম; অন্য দিকে আবার চলিয়া গিয়াছিলাম সন্ন্যাসের বৈরাগ্যের অতিমাত্রায়—ফলে, যাঁহারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ তাঁহারাই সমাজ হইতে সরিয়া পড়িয়াছিলেন, প্রাচীন ঋষিদের মত তাঁহারা সমাজের পিছনে সমাজের অধ্যাত্ম প্রতিষ্ঠারূপে দাঁড়াইয়া, সমাজের উপর জ্ঞানের আলো, জীবনের শক্তি ঢালিয়া দিতে পারেন নাই। কিন্তু ভারতের দুরবস্থার মূল হেতু হইতেছে, একটা উদার বিস্তৃত অধ্যাত্ম প্রেরণার সঙ্কোচন, মুক্ত ও সতেজ বুদ্ধিবৃত্তির হ্রাস, মহৎ আদর্শের ক্রমিক অভাব, প্রাণশক্তির ক্ষয়।

 এক অর্থে হয়ত আমাদের মধ্যে ধার্ম্মিকতার অত্যধিক প্রাদুর্ভাবই হইয়াছিল। ধার্ম্মিকতা শব্দটি আমরা ইংরাজী ‘রিলিজন্’ (Religion) এর পরিবর্ত্তে ব্যবহার করিতেছি—‘রিলিজন্‌’ কথাটির ঠিক ভারতীয় প্রতিশব্দ কিছু নাই, ইহার সহিত বিশেষ একটা মতবাদ, আচার অনুষ্ঠান, বাহ্যিক সৎকর্ম্ম, পুণ্য আহরণ এই সব জড়িত। এই অর্থে ধার্ম্মিকতা ছিল খুবই। ধার্ম্মিকতা ছিল, কিন্তু ছিল না ধর্ম্ম। ধর্ম্ম বলিতে আমরা বুঝি আধ্যাত্মিক প্রেরণাকে পূর্ণ অখণ্ড ভাবে অনুসরণ করিয়া চলা, আর আধ্যাত্মিকতা বলিতে বুঝি আমাদের যে সর্ব্বোত্তম আত্মসত্তা, যে ভাগবত সর্ব্বব্যাপী একত্ব তাহাকে জানা, তাহাতে বসবাস করা, জীবনের প্রত্যেক অঙ্গকে তাহার দিব্যরূপে তুলিয়া ধরা। এই ধর্ম্মের প্রাচুর্য্য্য ত ছিলই না, বরং ছিল যথেষ্ট অপ্রতুল; আর যতটুকুও বা খুঁজিয়া পাওয়া যাইত তাহা ছিল গণ্ডীবদ্ধ, সঙ্কীর্ণ। ভারতের এই সনাতন আদর্শকে খাট করিয়া ধরিলে রোগের প্রতিকার হইবে না, তাহা সুপ্রাচীনকালে ছিল যেমন তেমনি উদার করিয়া ধরিতে হইবে, আরও বৃহত্তর করিয়া ছড়াইয়া দিতে হইবে, যেন জাতির সমগ্র জীবন সত্য সত্যই এই আধ্যাত্মিক অর্থে মূর্ত্ত ধর্ম্ম হইয়া দাঁড়ায়। এই দিকেই দেখি আস্তে আস্তে ইউরোপের কাব্য, দর্শন, শিল্পকলা হাতড়াইয়া চলিয়াছে, অন্ধকারে অন্ধকারে চলিলেও তাহার পথে ক্রমশঃই আলো ফুটিয়া উঠিতেছে, তাহার রাষ্ট্রনীতিক সামাজিক আদর্শাদির মধ্যেও নূতন একটা সত্যের প্রভা যেন বিচ্ছুরিত হইতেছে। কিন্তু এই সত্যের পূর্ণ জ্ঞান, এই আদর্শের সজ্ঞান প্রয়োগকৌশল একমাত্র আছে ভারতের ভাণ্ডারে। তাই ত যে সব তথ্যের ব্যবহার এক সময়ে ভারত করিতে পারে নাই, তাহা আজ সে নূতন জ্ঞানের আলোকে সতেজ করিয়া ধরিতে পারে, তাহার পূর্ব্বতন সাধন-ধারায় যাহা কিছু ছিল জীর্ণ, অথর্ব্ব, তৎসমস্ত আজ সে সংস্কার করিয়া লইতে পারে। তাহার আধ্যাত্মিক আদর্শকে বাহিরের আক্রমণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য যে জাঙ্গাল দেউল তুলিয়া দিয়াছিল, তাহাই পরে তাহার প্রকাশের বিস্তৃতির পথে অন্তরায় হইয়া উঠে; আজ সেগুলি ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তাহার অন্তরাত্মাকে সে দিতে পারে একটা মুক্তগতি, বিশাল লীলায়তন। ভারত যদি সঙ্কল্প করে, তবে মানবজাতি আজ যে সকল সমস্যা লইয়া বিব্রত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছে, তাহাদের দিতে পারে একটা অব্যর্থ মীমাংসা, একটা নূতন নির্দ্দেশ। সে সব সমস্যা- সমাধানের মূল সূত্র যে রহিয়াছে তাহারই প্রাচীন জ্ঞানের মধ্যে। ভারতের নবজন্ম আজ ভারতের সম্মুখে এই যতখানি সুযোগ আনিয়া উপস্থিত করিয়াছে তাহা সম্পূর্ণরূপেই সে করায়ত্ত করিয়া উঠিতে পারিবে কি পারিবে না, তাহা জানেন ভারতের ভাগ্যবিধাতা।