উপসংহার।

 অলিকসন্দর, অতি কষ্টে মরুভূমি উত্তীর্ণ হইয়া কোনরূপে গোডরোসিয়ার রাজধানী পুরা নামক স্থানে উপস্থিত হইতে সক্ষম হইয়াছিলেন। দুঃখের সময় পুরুষ উত্তমরূপে পরীক্ষিত হইয়া থাকে। অলিকসন্দর এই কঠোর পরীক্ষা প্রশংসার সহিত উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। অন্নাভাবে ও জলাভাবে সৈন্যগণের ক্লেশের সীমা ছিল না। ভারবাহী ঘোটকাদি পশুহত্যা করিয়া বুভুক্ষিত সৈন্যগণ কর্ত্তৃক ভুক্ত হইয়াছিল। এক সময় একটি পার্ব্বত্য নদীর ধারে সৈন্যগণ অবস্থান করে, বৃষ্টি হওয়াতে সেই নদী অকস্মাৎ প্রবল বেগে স্ফীত হইয়া, তটস্থিত সৈন্যগণকে বহিয়া লইয়া যায়, ইহাতেও অনেকে মৃত্যুমুখে নিপতিত হইয়াছিল। রাত্রিকালে সৈন্যগণ গমন করিত, ইহাতেও অনেক সৈন্য নিদ্রাভিভূত হইয়া রাস্তার ধারে পড়িয়া থাকিত, অনেকে এইরূপে রাস্তা হারাইয়া পথ ভুলিয়া বিষম বিপাকে পড়িয়া প্রাণ হারাইয়াছে। অলিকসন্দর, প্রকৃত নেতার ন্যায় সামান্য সৈনিকের মত অবস্থান করিয়া, সাধারণ দুঃখ সমান ভাবে ভোগ করিয়াছিলেন। ইহাতে সৈন্যগণ আপনাদের দুঃখের কথা ভুলিয়া গিয়া তাঁহার প্রতি আরো অনুরাগ প্রকাশ করিত।

 পারস্যের উর্ব্বর ভূমিতে উপস্থিত হইলে, আবার সকল দ্রব্য তাঁহারা প্রচুর পরিমাণে প্রাপ্ত হইলেন, সৈন্যগণসহ অলিকসন্দরের অমিতাচার যথেষ্টরূপে বর্দ্ধিত হইল। যে সকল ব্যক্তি তাঁহার অবর্ত্তমানে অত্যাচার অবিচার করিয়াছিল, তাহাদিগকে যথাযোগ্য দণ্ডপ্রদান করিয়াছিলেন। সুসাতে অবস্থান কালে পারসীকদের সহিত নৈকট্য সম্বন্ধ সংস্থাপন করিবার জন্য, দারার কন্যা স্তাতিরার পানিপীড়ন করেন; ইহাঁর উদাহরণে তাঁহার আশি জন সেনানী, পারসীক সম্ভ্রান্ত বংশীয় কন্যার সহিত পরিণীত হইয়াছিলেন। দশ হাজার মাসিদন সৈনিক পুরুষও, পারসীক কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিল। এই সকল বিজাতীয় বিবাহ ব্যাপার দেখিয়া সম্ভ্রান্ত মাসিদনগণ অত্যন্ত বিরক্ত হন। অবশেষে তাহারা অলিকসন্দরকে পরিত্যাগ করিয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন করেন। এই সময় তাঁহার প্রিয়তম বন্ধু হিপাস্তিয়ন, মৃত্যুমুখে পতিত হন। ইহাতে অলিকসন্দর অত্যন্ত ভগ্নহৃদয় হইয়া পড়েন। অলিকসন্দরের অমিতাচার যথেষ্টরূপে বর্দ্ধিত হইয়াছিল, ইহাতে তাঁহার শরীর জর্জ্জরিত হয়। হিপাস্তিয়ান বিয়োগে, তিনি যেন শক্তিশূন্য হইয়া পড়িয়াছিলেন; ব্যাবিলনে তাঁহার জ্বর হয়, ইহার উপর মদ্য পানের তাঁহার বিরাম ছিল না, ব্যাবিলনে আসিতে নিষিদ্ধ হইয়াছিলেন, জ্বরের সময় এই কথায় তিনি সম্ভবতঃ অভিভূত হইয়া পড়েন, তাঁহার জর্জ্জরিত শরীর আর জ্বরবেগ সহ্য করিতে পারিল না। খৃ পূ ৩২৯ অব্দে জুন মাসে প্রায় ৩৩ বৎসর বয়ক্রমে এবং ১৩বৎসর রাজ্য ভোগ করিয়া এই নশ্বর শরীর পরিত্যাগ করেন।

 অলিকসন্দরের ভারত পরিত্যাগের পর, ভারতবাসীর সন্মোহ দূর হইল, ধীরে ধীরে তাঁহারা নিজেদের অবস্থা বুঝিতে পারিলেন; আত্মজ্ঞানের সহিত তাঁহাদের প্রচ্ছন্নশক্তির আবির্ভাব হইল। অলিকসন্দরের প্রধান কর্ম্মচারী ফিলিপো ঘাতক হস্তে নিহত হইলেন। বৈদেশিকদিগের নাম মাত্র অধীনতা পাশ তাঁহাদিগের ভাল লাগিল না, তাহা ছিন্ন করিবার জন্য সকলে একত্র হইয়া চেষ্টা করিলেন। ইত্যবসরে অলিকসন্দরের মৃত্যু সংবাদ ভারতবর্ষে উপস্থিত হয়। যাহারা একটু ইতস্ততঃ করিতেছিল তাহারাও এই সংবাদে নির্ভয় হইয়া অস্ত্রধারণ করেন। এই সময় আর একটি ঘটনায় বৈদেশিকদের উপর ভারতবাসীর যথেষ্ট ঘৃণা উপস্থিত হয়। ইউডেমস, নামক মেসিদন কর্ম্মচারী, একজন রাজাকে, সম্ভবত বীরবর পুরুকে, বিশ্বাসঘাতকতা পূর্ব্বক হত্যা করিয়া তাঁহার হস্তী সকল অধিকার করিয়া স্বদেশের যুদ্ধে যোগদিবার জন্য গমন করেন। এই ঘটনায়, ভারতবাসীরা, বিদেশীদের উপর খড়্গ হস্ত হন। যে যুবক বিদেশীদিগকে ভারতবর্ষ হইতে বিদূরিত করিবার জন্য বদ্ধ পরিকর হইয়াছিলেন, যিনি মাসিদনদিগের আগমন চিহ্নও ভারতবক্ষ হইতে উৎখাত করিয়া দেশের পবিত্রতা সাধন করিয়াছিলেন, যিনি বিপুল অক্ষৌহিণীর অধিপতি হইয়া, আফগানিস্থান, বেলুচিস্থান প্রভৃতি প্রদেশও আপনার দোর্দ্দন্ড প্রতাপের অধীনে আনয়ন করিয়াছিলেন, ব্রাহ্মণ চাণক্য পরিচালিত, সেই মহাবল পরাক্রান্ত যুবকের নাম মহারাজ চক্রবর্ত্তী চন্দ্রগুপ্ত। অলিকসন্দরের ন্যায়, ইনিও অতি সামান্য অবস্থা হইতে, পার্থিব উন্নতির চরমসীমায় উপনীত হইয়াছিলেন। ইহাঁর বন্ধুত্ব গ্রীকগণ আগ্রহের সহিত কামনা করিতেন। ইহাঁরই সভায় মেগাস্থিনিস, পাটলি পুত্রনগরে দূতরূপে অবস্থান করিয়াছিলেন। ইহাঁরই পৌত্ত্র ধর্ম্মবুদ্ধি অশোক প্রজাগণকে পুত্ত্র নির্ব্বিশেষে পরিপালন করিয়া এবং বৌদ্ধধর্মের প্রচার কল্পে তন্ময়তা দেখাইয়া সবিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন।

সম্পূর্ণ