ভারতে অলিকসন্দর/দ্বিতীয় ভাগ/ষষ্ঠ অধ্যায়



ষষ্ঠ অধ্যায়।

 অধ্যবসায়ের অবতার; অদ্ভুত বিক্রম অলিকসন্দর ভারতবিজয় বিষয়ে স্বীয় আশা অনুরূপ ফললাভে অসমর্থ হইলেও, তাঁহার দুঃসহ তেজ, অলৌকিক কার্য্য সম্পন্ন করিবার জন্য দুরাগ্রহ, দুদ্ধর্ষ শক্রকূল পরিবেষ্টিত হইয়া ও স্থিরভাবে কার্য্য করিবার অদ্ভুত শক্তি, চিরকাল বিস্ময়ের সহিত আলোচিত হইবে। অলিকসন্দরের, ভারতবর্ষে পদার্পণের সহিত ক্ষত্রিয়াদি বর্ণত্রয় যে প্রবল বাধা প্রদান করিয়াছিলেন, তাহাতে কিছুমাত্র আশ্চর্য্যের বিষয় নাই। কিন্তু তপস্যা ও স্বাধ্যায় নিরত নিরীহ প্রকৃতির ব্রাহ্মণগণ, যাঁহারা শত্রু ও মিত্র উভয়কেই সমানভাবে দর্শন করিয়া থাকেন; যাঁহারা স্ত্রী, পুত্ত্র, পরিজন, পরিত্যাগ করিয়া অরণ্য মধ্যে ঈশ্বর উপাসনায় জীবন অতিবাহিত করেন, যাঁহারা স্তুতি ও নিন্দ-লাভ ও অলাভ, অর্থ ও অনর্থ প্রভৃতি সাংসারিক বিষয়কে বিষবৎ পরিত্যাগ করিয়া নিস্পৃহভাবে অবস্থান করিয়া থাকেন; সমৃর্দ্ধি সম্পন্ন হইবার ইচ্ছা, যাঁহারা দূরে পরিত্যাগ করিয়া ভিক্ষাকেই একমাত্র উপজীবিকা করিয়া কোনরূপে জীবন যাত্রা নির্ব্বাহ করেন; সেই সকল নগ্ন প্রায় ব্রাহ্মণগণ, কি জন্য সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠদান হৃদয়ের শোণিতদান করিয়া জন্মভূমির পূজা করিয়াছিলেন? কি জন্য তাঁহারা বৈদেশিক আক্রমণ হইতে স্বদেশ রক্ষা করিবার জন্য দলে দলে এই পরম প্রিয়তম শরীরকে যুদ্ধযজ্ঞে আহুতি প্রদান করিয়াছিলেন? সে বিষয়ের কারণ অনুসন্ধান না করিলে আমাদের প্রস্তাব অসম্পূর্ণ অবস্থায় রহিয়া যায়, এজন্য আমরা সাধ্যানুসারে তাহার কারণ নির্ণয় করিতে যত্নশীল হইব।

 ব্রাহ্মণ দরিদ্র হইলেও ভারতীয় প্রজাবর্গের নিয়ন্তা ও প্রভু, জগতের জ্ঞান রাজ্যের সম্মানিত আদি গুরু, সুতরাং ব্রাহ্মণ নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্য্যাদা সম্যক্ প্রকারে রক্ষা করিবার জন্য সর্ব্বাগ্রে অভিনয়ক্ষেত্রে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ বুঝিয়া ছিলেন, বৈদেশিক অধীনতা পাশ হইতে স্বদেশ বাসীকে রক্ষা না করিলে, বিদেশীর সংসর্গে দেশের অধঃপতন হইবে, সকল বিষয়েই সাঙ্কর্য্য উপস্থিত হইবে, সঙ্করই সর্ব্ব প্রথমে বিনাশকে প্রাপ্ত হইয়া থাকে; তাই ব্রাহ্মণেরা নিজের প্রজা রক্ষা করিবার জন্য, অস্ত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন। পরাধীন জাতি সমৃদ্ধি সম্পন্ন হইলেও, ধীরে ধীরে সে কঠোর দারিদ্র্য প্রাপ্ত হইয়া থাকে; যে “আনন্দ হইতে জগতের উৎপত্তি,” মানুষ সেই আনন্দ বিহীন হইলে, বিনাশকে প্রাপ্ত হইয়াথাকে, তাই আনন্দকে ব্রহ্মের ন্যায় যাঁহারা উপাসনা করেন, সেই জগদগুরু ব্রাহ্মণগণ, দেশ বাসীকে নিরানন্দ হইতে, মৃত্যু মুখ হইতে, রক্ষা করিবার জন্য, সর্ব্বপ্রথমে অস্ত্র গ্রহণ করিয়া স্বদেশ বাসীকে রক্ষা করিবার জন্য, দ্রুতবেগে সর্ব্বাগ্রে গমন করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণগণ বুঝিয়াছিলেন, সিংহ, ব্যাঘ্র,প্রভৃতি অরণ্যচর জন্তুগণও, পিঞ্জর মধ্যে বন্দী হইলে, তাহাদিগের সে বন্য স্বাধীনতা অপহৃত হইলে, তাহারা যথেষ্ট পরিমাণে আহার্য্য পাইলেও,তাহাদিগের জনন শক্তি হ্রাস হইয়া যায়, শৈশব মৃত্যু বৃদ্ধি পায়। তাই কারুণিক ব্রাহ্মণগণ, পুত্ত্র কন্যা প্রতিপালন না করিলেও, আপনার যপযজ্ঞে এক হস্তের ব্যবহার করিলেও, স্বদেশবাসীকে রক্ষা করিবার জন্য, এই স্বাধীনতা সংরক্ষণ যজ্ঞে, হস্ত দ্বায়ের ব্যবহার করিয়াছিলেন। “পরাধীন ব্যক্তি নিত্য অশুচি”,[] অপবিত্রের দ্বারা কোন কার্য্য হইতে পারে না, তাই স্বার্থপর রাজন্য বর্গ অলিকসন্দরের শরণাপন্ন হইলেও, ব্রাহ্মণগণ দেশবাসীকে পবিত্র করিবার জন্য শাণিত অস্ত্রগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা জানিতেন, “নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ” (বেদ) তাই তাঁহারা, যাহাতে স্বদেশবাসী কার্য্যকালে ক্লীবের ন্যায় অবস্থান না করে, সেই জন্য তাঁহারা সর্ব্বপ্রথমে অস্ত্র লইয়া স্বদেশবাসীকে উৎসাহিত করিয়াছিলেন। শ্রাদ্ধাদি পবিত্র কার্য্য পরের ভূমিতে অনুষ্ঠিত হইলে, সে সমস্ত বিফল হইয়া হায়,[] তাই তাঁহারা আপনাদের দেশ রক্ষা করিবার জন্য কৃপাণপাণি হইয়া সর্ব্বাগ্রে গমন করিয়াছিলেন। দেশবাসীকে আপদ হইতে ব্রাহ্মণই উদ্ধার করিয়া থাকেন[] যিনি ইহা হইতে বিমুখ তিনি কখন ”ব্রাহ্মণ” এই পবিত্র নাম গ্রহণের যোগ্য নহেন তাই নিজেদের নাম অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য ব্রাহ্মণগণ দলে দলে অলিকসন্দরের গতিরোধ করিবার জন্য অস্ত্রপাণি হইয়া গমন করিয়াছিলেন।

 যাঁহারা দেশবাসী কর্তৃক সর্ব্বতোভাবে পূজিত হইয়া থাকেন, দেশবাসী যাঁহাদিগকে সকল প্রকারে রক্ষা করিয়া থাকেন, যাঁহাদিগকে কোনরূপ রাজস্ব প্রদান করিতে হয় না,[] তাঁহারা দেশবাসীর বিপদে কোনরূপেই নিশ্চেষ্ট ভাবে অবস্থান করিতে পারেন না। তাই তাঁহারা প্রত্যুপকারের বশবর্ত্তী হইয়া, স্বদেশবাসীকে রক্ষা করিবার জন্য অস্ত্রপাণি হইয়াছিলেন।

 ব্রাহ্মণগণ, আপনার প্রজা, বা অঙ্গ-স্বরূপ বিবেচনা করিয়া ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রগণকে রক্ষা করিবার জন্য, আপনাদিগের সুখ স্বচ্ছন্দতা দূরে পরিত্যাগ করিয়া, মাতা যেরূপ শিশুপুত্ত্রকে রক্ষা করিবার জন্য সর্ব্বাগ্রে অগ্রসর হন, সেইরূপ তাঁহারা গিরিগুহা, কানন, হইতে বহির্গত হইয়া ধাবিত হইয়াছিলেন।

ব্রাহ্মণগণ জ্ঞান বিষয়ে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিলেও, বাহুবলেও তাঁহারা কাহারো অপেক্ষা ন্যূন ছিলেন না। ব্রহ্মবল ও ক্ষত্রিয়বল উভয় বলে তাঁহারা অসাধারণ হইলেও, সমাজের হিতকল্পেই তাঁহাদের শক্তি ব্যয়িত হইত, সমাজ ধ্বংস করিবার জন্য তাহা প্রযুক্ত না হইয়া, আমাদের এই বর্ণাশ্রম সংযুক্ত ভারতীয় সমাজকে রক্ষা করিবার জন্য, তাঁহাদের অসীম শক্তি প্রযুক্ত হইত। বর্ণচতুষ্টয় পরস্পর যেন একটা আত্মীয়তা সূত্রে আবদ্ধ ছিলেন।

 পাশ্চাত্য শিক্ষার সহিত আমাদের দেশে দুইটা কথা আসিয়াছে যে, শূদ্রেরা এদেশের আদিম নিবাসী, আর ব্রাহ্মণ প্রভৃতি ভারতের বহির্ভাগ হইতে আগমন করিয়া এদেশ অধিকার করিয়াছেন। ইয়ুরোপীয়েরা এবিষয়ে যাহাই বলুন না কেন, সে সকল যুক্তির মূল্য খুবই কম। তাঁহারা বলেন, বেদে ইহা উক্ত হইয়াছে, তাঁহারা বেদের মুখ দিয়া যাই বলুন না কেন, আমাদের বেদ পুরাণ কিন্তু, ইহার প্রতিকূলে প্রমাণ প্রয়োগ করিয়া থাকেন। অনাদিকাল হইতে আমরা এই আর্য্যভূমি, আর্য্যাবর্ত্তে উৎপন্ন হইতেছি, এবং পুরাকালে, এই স্থান হইতে দূরতর প্রদেশে গমন করিয়া, আমাদের পূর্ব্বজগণ উপনিবেশ সংস্থাপন করিয়াছেন। খৃষ্টের ১৪ শত বৎসর পূর্ব্বে আমাদের, ভারতীয় সভ্যতা ভূমধ্যসাগরের উপকূল প্রদেশে বিস্তার লাভ করিয়াছিল, তাহা আমরা অভিনব আবিষ্কৃত শিলালিপিতে অবগত হই।

 শূদ্র সম্বন্ধে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে, যে, যে বিরাট পুরুষের অঙ্গ হইতে ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয় উৎপন্ন হইয়াছেন; সেই বিরাট পুরুষেরই অঙ্গ হইতে শূদ্রেরা জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। একটা শরীর কল্পনা করিতে হইলে, তাহার মস্তকের যেরূপ প্রয়োজন, পদদ্বয়ের তাহা অপেক্ষা কম প্রয়োজন নহে। মস্তক না থাকিলে শরীর পূর্ণতাকে প্রাপ্ত হইতে পারে না; পা, না থাকিলে শরীরের সেইরূপ অবস্থা হইয়া থাকে। তাই সমাজ—শরীরের মস্তক ও চরণ উভয়েরই প্রয়োজন আছে। একটি না থাকিলে, আর একটী কখনই থাকিতে পারে না। আমাদের সমাজ, পৃথিবীর সকল সমাজের আদর্শ স্থানীয়, পৃথিবীর সকল সমাজ অপেক্ষা শক্তিশালী, এবং সকল সমাজ অপেক্ষা প্রাচীন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দুই দিনের নূতন নূতন সমাজ মধ্যে, কত বিপ্লব কত মারামারি, কত কাটাকাটি অনুষ্ঠিত হইয়া দুই দিনের মধ্যেই কত বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে, তাহার সংখ্যা করা সুকঠিন। কিন্তু আমাদের সমাজ, অনন্তকাল হইতে পরস্পর কেমন সুন্দর রূপে মিলিত হইয়া, এই সমাজ শরীরকে রক্ষা করিতেছে; তাহা অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া অধ্যয়ন করিলে বিস্ময়াপন্ন হইতে হয়। এখানে ধনবান, দরিদ্রে মারামারি কাটাকাটি নাই, বিদ্বান মুর্খে, বিদ্বেষ নাই, সকলেই নিজের নিজের অবস্থায় প্রসন্নচিত্ত হইয়া সমাজ সেবায় যত্নশীল। গ্রীকরা, এদেশে আসিয়া দেখিলেন, তাঁহাদের দেশে দাসদের যেরূপ ঘোরতর দুরবস্থা, এদেশে তদ্রূপ কিছুই নাই, ইহা দেখিতে না পাইয়া তাঁহারা বিস্মিত হইলেন। একটি গৃহস্থের বাটীতে সকলেই কর্ত্তা হইলে যেরূপচলে না, কাহাকে কাট কাটিতে হয়, কাহাকে উপার্জ্জন করিতে হয়; কাহাকে বিদ্যানুশীলন করিতে হয়; সেইরূপ সেকালে আমাদের সমাজের ব্যক্তিগণ স্বতন্ত্র তার সহিত আপন আপন কার্য্য নির্ব্বাহ করিতেন। আমাদের এই অনাদিকালের সামাজিক ইতিহাসে, ব্রাহ্মণ শূদ্রে, বা জাতিতে জাতিতে, মারামারি, কাটাকাটি, হইতে কখন দেখি নাই। দুই একবার কোন এক ব্রাহ্মণের সহিত, কোন এক রাজা বা রাজবংশের সহিত বিরোধ হইয়াছিল। তাহা জাতিতে জাতিতে বিরোধ নহে, সে বিরোধ ব্যক্তিগত ভাবে। পশ্চিমে একটা কথা আছে যে, “বিভক্ত করিয়া শাসন কর, এই নীতি অনুসরণ করিয়া, তাঁহারা বলেন, “স্বার্থপর ব্রাহ্মণগুলা শূদ্রেদের প্রতি বড়ই অসদ্ব্যবহার করিতেন,—সমাজে তাহাদের স্থান অনেক নিম্নে, ইত্যাদি ইত্যাদি দোষারোপ করিয়া আমাদের দেশের অজ্ঞদের বুদ্ধিভেদ উৎপন্ন করিতে চেষ্টা করিয়া থাকেন। আমাদের দেশের একশ্রেণীর লেখক, তাঁহাদের গুরুদের কথার ভিতর প্রবেশ না করিয়া, আমনি তাহারাও ধুয়া তোলেন যে, ব্রাহ্মণগণের মতন দুষ্টজাতি জগতে আর নাই, হিন্দুর যাহা কিছু সর্ব্বনাশ এই ব্রাহ্মণদের দ্বারা সাধিত হইয়াছে। এই সকল প্রলাপ উক্তির সম্বন্ধে এইটুকু বলিলে যথেষ্ট হইবে যে, উপযুক্ত ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব, কেহই কখন অপলাপ করিতে সমর্থ হয় না। আর অনুপযুক্ত সহস্র চেষ্টাতেও গুরুস্থানে সমাসীন হইতে পারে না, তাহার পদচ্যূতি হইবেই হইবে। যে দেশে ব্যাধের নিকট ও ব্রাহ্মণ ধর্ম্ম কথা শ্রবণ করিতেন, যে দেশে নিষাদরাজের মিত্রতা সাদরে গৃহীত হইত, সে দেশে জাতি বিদ্বেষের কথা উঠা কোনরূপে উচিত নহে। জাতিভেদ সকল দেশেই আছে, ইহার সহিত বিদ্বেষও আছে, ভারতে জাতিভেদ থাকিয়াও বিদ্বেষ নাই, ইহাই ইহার বিশেষত্ব। আমাদের পরাধীনতার সহিত, আমাদের উদারবৃত্তি সকল সঙ্কুচিত হইয়াছে, আমাদের মনুষ্যত্ব আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া দূরে চলিয়া গিয়াছেন। আমরা উদার না হইলে, আমরা মানুষ না হইলে, আমাদের সমাজ সুরক্ষিত হইবে না। আমাদিগকে ধ্বংস করিবার জন্য যাহারা প্রস্তুত; অথচ যাহাদিগের সমাজ মধ্যে, স্ত্রী পুরুষ, ধনী নির্ধন পরস্পর কলহে প্রবৃত্ত, আমরা আত্মরক্ষার জন্য তাহাদিগের নিকট গমন করিতেছি, তাহাদিগের অনুকরণ করিতেছি, তাহাদিগকে আদর্শ করিতেছি। ঘোরতর উন্মাদ ও এরূপ কার্য্যে অগ্রসর হয় কি না, সে বিষয় সন্দেহ হইয়া থাকে। যদি বাঁচিয়া থাকিতে চাও, তাহা হইলে আমাদের নিজের প্রাচীন আদর্শকে অনুসরণ কর, তাহা হইলে রক্ষিত হইবে।

 অলিকসন্দরকে বাধা দিবার জন্য, শূদ্র রাজগণ,যথেষ্ট পরিমাণে চেষ্টা করিয়াছিলেন—অকাতরে শরীর বিসর্জ্জন দিতেও তাঁহারা পশ্চাদপদ হন নাই। ইহা আমাদের স্বাধীন ভারতবর্ষের কথা। ইহাঁরা কি সে কালে দাস বলিয়া ঘৃণিত হইতেন? বর্ত্তমান কালে বরোদার অধিশ্বর শ্রীমান সয়াজীরাও, যেরূপ প্রশংসিত হইয়া থাকেন, সেকালেও শূদ্র রাজেরাও, সেইরূপ উপযুক্ত হইলে প্রশংসাভাজন হইতেন।

 যিনি মর্য্যাদা দানে অকুণ্ঠ, তিনিই ময্যাদালাভের অধিকারী। পরাধীন প্রাণ খুলিয়া প্রশংসা, বা ভদ্রভাবে নিন্দা করিতে সমর্থ হয় না, তাহাতেও যেন তাহার অধীনতার কথা ব্যক্ত হইয়া পড়ে। অযোধ্যাধিপতি মহারাজ রামচন্দ্রের, বনে গমন করিবার পূর্ব্বেই, নিষাদাধিপতি তাঁহার “আত্মসম” সখিত্বকে লাভ করিয়াছিলেন। বনে গমনকালে গুহক নানাবিধ অন্ন ব্যঞ্জনাদি ভোজ্য দ্রব্য ও অর্ঘাদি দিয়া তাহার পূজা করিয়াছিলেন। ইত্যাদি কথা বর্ত্তমান কালে কবি কল্পনাপ্রসূত বলিয়া কি বিবেচিত হইবে? বর্ত্তমান কালে, কোন শক্তিশালী নৃপতির রাজ্যের সীমান্ত প্রদেশে, কোন দুর্ব্বল বা বিভিন্ন প্রকৃতির নরপতির রাজ্য করা, যেরূপ সর্ব্বদাই বিপদপূর্ণ; সে কালে সেরূপ ছিল না বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। প্রবল পরাক্রান্ত অযোধ্যাপতির রাজ্যের সীমান্ত প্রদেশে, একজন নিষাদপতিকে অবস্থান করিতে দেওয়া সামান্য উদার রাজনীতির ফল নহে।

 জাতি যখন স্বাধীন থাকে, তখন আবশ্যক অনুসারে সমাজ শরীরের সঙ্কোচন ও সম্প্রসারণ হইয়া থাকে। বল্লালসেনের সময় আমরা দেখিতে পাই; নাবিক কৈবর্ত্তের জল, রাজ আজ্ঞায় চল হইয়াছিল। আবার তাঁহারই আজ্ঞায়, উচ্চবর্ণজ সুবর্ণ বণিকগণের জল অচল হইয়াছিল! মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আজ্ঞায় কাহারও জল অচল হইয়াছিল কি না, তাহা আমাদের স্মরণ হয় না, কিন্তু গোয়ালাদিগের জল প্রচলন হয়, সে কথা আমরা অবগত আছি। সমাজ বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন, এ সকল বিষয়ে, আমরা যদি প্রাচীনকালের উদারতা অনুসরণ না করি, তাহা হইলে সমাজ দুর্ব্বল হইবে, নষ্ট হইয়া যাইবে, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠিবে।

 মনু প্রভৃতি ধর্ম্মশাস্ত্রের প্রবর্ত্ত্বকগণ, শূদ্রের সহিত কোথায় যাইবে না, শূদ্রকে বিশ্বাস করিবে না, শূদ্রকে উপদেশ দিবে না, ইত্যাদি যে কতকগুলি বিধান প্রণয়ন করিয়াছেন; তাহা কখন যে কার্য্যে পরিণত হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয় না। অথচ সাংসারিক বিষয়ে তাহার, সম্পূর্ণ বিপরীত দেখিতে পাওয়া যায়। পুরাকালে আমাদের দেশের সমস্ত শিল্পদ্রব্য প্রায়ই শূদ্রগণকর্তৃক নির্ম্মিত হইত; সুতরাং শূদ্র ও বণিকগণ যে বিশেষরূপে অর্থশালী হইত, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। শূদ্রগণ কত প্রকার কারুকার্য্য করিয়া সমাজের সেবা করিতেন, তাহা রামায়ণ পাঠে অবগত হওয়া যায়। রাম বনে গমন করিলে, অযোধ্যার মণিকার, সুদক্ষ কুম্ভকার, তন্তুবায়, অস্ত্র নির্ম্মাণ কারক, মায়ুরকে (ময়ুর পুচ্ছের নানাবিধ দ্রব্য প্রস্তুতকারক) ক্রাকচিক (করাতী) মুক্তাদি বেধক, দন্তকার, রোচক? সুধাকর, (চূণ ব্যবসায়ী) গন্ধোপজীবী, (সুগন্ধদ্রব্য যাহারা প্রস্তুত করে) সুবর্ণকার, কম্বলকার, স্নাপক, অঙ্গমর্দ্দক, ধূপক (যাহারা ধুপ করে) শৌণ্ডিক, রজক, তুন্নবায় (দর্জ্জী) গ্রাম ঘোষ[] প্রভৃতি নাগরিকগণ, ভরতের অনুগমন করিয়াছিল। ভরতের যাইবার পূর্ব্বে, ভূমি প্রদেশজ্ঞ, সূত্রকর্ম্ম বিশারদ, খনক, যন্ত্রক, স্থপতি, যন্ত্রকোবিৎ, মার্গিণ, বৃক্ষতক্ষক[] প্রভৃতি গমন করিয়া, শিবির সকল সংস্থাপন, রাস্তাঘাট প্রস্তুত করিয়াছিল। এই সকল শিল্পী ও ব্যবসায়ী যে সমাজে অবস্থান করে, তাহাদিগের সভ্যতা সম্বন্ধে বেশী বলা বাহুল্য। বর্ত্তমানকালে আমরা এরূপ অধঃপতিত হইয়াছি যে, আমাদের স্বদেশী ভাষায় এই সকল ব্যবসায়ীর নাম কথিত হওয়াতে অনেকের মনে সেরূপ সম্মান বুদ্ধি উপস্থিত হয় না। যখন ইঞ্জিনিয়ার, মেক্যানিক ইঞ্জিনিয়ার, ওভারসিয়ার, জুয়েলার, গোল্ডস্মিথ, পার্ফিউমামার, ট্যানার, প্রভৃতি শব্দ প্রযুক্ত হয়, তখনই যেন মনে একটা কেমন কেমন ভাবআসিয়া উপস্থিত হইয়া থাকে।

 আমাদের দেশের নমঃশূদ্রও কৈবর্ত্তরা, চিরকালই সুপ্রসিদ্ধ নাবিক। খৃষ্টের জন্ম গ্রহণের বহুপূর্ব্ব হইতে, নৌ-চালন বিষয়ে ইহার যথেষ্ট দক্ষতা দেখাইয়াছে। ঋক্ বেদের “নাব সমুদ্রীয়” এবং মনুস্মৃতি, রামায়ণ প্রভৃতি গ্রন্থ হইতে ভূরি ভূরি উদাহরণ উদ্ধৃত করিয়া,অতি প্রাচীনকালে আমাদের সমুদ্রগমনেরও সামুদ্রিক বাণিজ্যের কথা কহিয়া, পাঠকগণকে ভারাক্রান্ত করিতে ইচ্ছা করি না। পাঠকের বোধ হয় স্মরণ আছে, নিয়ার্কস, বাত্ত্যা প্রপীড়িত হইয়া বর্ত্তমান করাচির কাছে সুবিস্তৃত পোতাশ্রয়ে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহার প্রশস্ততা দেখিয়া তিনি তাহাকে “অলিকসন্দরের পোতাশ্রয়” নাম প্রদান করেন। ইহাতেও আমরা আমাদের পূর্বকালের নৌ-শক্তির কথা অবগত হইয়া থাকি। অলিকসন্দরের মৃত্যুর অল্পকাল পরে আমাদের ভারতীয় নাবিকগণ, একবার ঝড়ের বেগে জর্ম্মাণীর উপকূলে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন। ভারতীয় সাংয়াত্রিকগণ, সে দেশের রাজাকে আমাদের ভারতীয় অপূর্ব পণ্যদ্রব্য উপহার দিয়াছিলেন। যে গ্রন্থে এই ঘটনা লিপিবদ্ধ হইয়াছিল, তাহা নষ্ট হইয়া গিয়াছে। খৃষ্টের প্রায় সমসাময়িক সুপ্রসিদ্ধ রোমক গ্রন্থকার প্লীনি, এ কথা তাঁহার গ্রন্থে লিখিয়া গিয়াছেন। সুতরাং এ বিষয় অবিশ্বাসের কোন কারণ নাই। এখন কথা হইতেছে যে, যে সময়, বর্ত্তমানকালের নৌ-শক্তিশালী ইয়ুরোপীয়দিগের পূর্ব্বপুরুষগণ, বাস্তবিকই উলঙ্গভাবে বনমধ্যে বিচরণ করিত, কোনরূপে ডোঙ্গা, ভেলা, প্রস্তুত করিয়া নদীর পারে গমনাগমন করিত, তাহাদিগের, ঐতিহাসিক যুগের অতীতকালে, ভারতবাসীরা নানা প্রকার বিপদ সঙ্কুল জলধিজল অতিক্রম করিয়া ইয়ুয়োপের উত্তর সমুদ্রে গমন করিয়াছিলেন, এক কথা কি বর্ত্তমান ভারতবাসী বিশ্বাস করিবেন? দিঙ্‌মুঢ় ব্যক্তিকে দিকের কথা যথার্থ কহিয়া দিলেও, তাহার যেরূপ সন্দেহ দূর হয় না; সেইরূপ উপরের কথায় যে, আমাদের মুঢ়তা বিদূরিত হইবে বলিয়া বোধ হয়না। অধ্যবসায়ের অবতার সেইসকল ভারতবাসী, কেমন করিয়া জর্ম্মণীর উপকূলে জাহাজ লইয়া গমন করিয়াছিলেন, তাহা এক্ষণে আমাদের কাছে অদ্ভুত বিষয় বলিয়া বিবেচিত হইতে থাকিবে। খুব সম্ভবতঃ তাঁহারা আফ্রিকা প্রদক্ষিণ করিয়া গমন করিয়া থাকিবেন। কেহ কেহ কষ্ট কল্পনা করিতে পারেন যে, চির তুষারাবৃত উত্তর মেরুপ্রদেশ অতিক্রম করিয়া তাঁহারা গমন করিয়াছিলেন! খৃষ্টজন্মের বহুপূর্ব্বে আমাদের ভারতবাসীরা, প্রসান্ত মহাসাগরের তটবর্ত্তী ভূভাগে গমন করিয়া হিন্দু উপনিবেশ সংস্থাপন, এবং হিন্দু সভ্যতা বিস্তার করিয়া অধ্যবসায়, ক্লেশ সহিষ্ণুতা, এবং নৌ-চালন বিষয়ক পাণ্ডিত্য, যথেষ্টরূপে প্রকাশ করিয়াছেন। কলম্বস, ইয়ুরোপীয়দিগের নিকট, আমেরিকা আবিষ্কার করিয়া ধন্য ধন্য হইয়াছেন। ভারতবাসীরা কিন্তু, তাঁহার বহুশত শতাব্দী পূর্ব্বে আমেরিকা মহাদেশে গমন করিয়াছিলেন। বর্ত্তমানকালেও, তথায় ভারতবাসীর গমনের বহু নিদর্শন, ভগ্নস্তুপ প্রভৃতি হইতে আবিষ্কৃত হইতেছে। রামায়ণের এক স্থানে উক্ত হইয়াছে, “উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণদিকস্থ দ্বীপবাসী এবং সামুদ্রিক বণিকগণ কোটি কোটি রত্ন উপহার প্রদান করুক।[] যাহারা নানাদেশে গমন করিতেন, সে দেশবাসী বণিকগণ নানাপ্রকার রত্ন আনয়ন করিয়া দেশকে সমৃদ্ধি সম্পন্ন করিবে ইহা কিছু আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। হে সুবর্ণ বণিক, গন্ধবণিক, প্রভূতি বঙ্গীয় বণিকগণ! তোমরা কি এখন সুদ গুনিয়া, অথবা গোলামী করিয়া জীবন অতিবাহিত করিবে। তোমরা এক সময় পৃথিবীর নানাস্থান হইতে, নানাবিধ ধনরত্ন আনয়ন করিয়া স্বদেশকে সমৃদ্ধি সম্পন্ন করিয়াছিলে। তোমরা এক সময় পৃথিবীর নানাস্থানে ভারতীয় সভ্যতার পতাকা উড্ডীন করিয়া, দেশের গৌরব বর্দ্ধন করিয়াছিলে। তোমরা এক সময় অন্যান্য সাধারণ অধ্যবসায় দেখাইয়া জগৎকে স্তম্ভিত করিয়াছিলে। একবার মোহনিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া জাগরিত হও। একবার পূর্ব্বের অবস্থা স্মরণ করিয়া বর্তমান অবস্থাকে তুলনা কর। একবার আত্মশক্তি অনুসারে পৌরুষ প্রকাশ কর, দেখিবে অনতিকাল মধ্যেই তোমরা দেশে বাণিজ্য বিষয়ক যুগান্তর আনয়ন করিতে সমর্থ হইবে।

 ক্ষত্রিয়েরাই আমাদের ভারতে রাজার জাতি; এইজন্য ইহারা রাজন্য নামে অভিহিত হইয়া থাকেন। সে কালে চোর ডাকাতের কোনরূপ ভয়ের কারণ না থাকিলেও, গ্রামবাসী ক্ষত্রিয়গণ, সর্ব্বদাই গোব্রাহ্মণ এবং বৈশ্য শূদ্র প্রভৃতি সকলকে রক্ষা করিবার জন্য সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিতেন। প্রজার ধন-ধান্য অপহৃত হইলে, চোর ধরিতে না পারিলে রাজাকে নিজের ধনাগার হইতে ক্ষতিপূরণ করিতে হইত। ইহাতে ব্রাহ্মণ শূদ্র ভেদ কোন রূপ লক্ষিত হইত না। এরূপ ভাবে রাজ্য পরিপালন ভারতেই সম্ভবে। গ্রীক মেগাস্থিনিস বলেন, আমাদের দেশ প্রচুর পরিমাণে ধন ধান্যে, ও ফল মূলে পরিপূর্ণ ছিল; সুতরাং দুর্ভিক্ষ কখনও আমাদের দেশে পদার্পণ করিতে সমর্থ হইত না।

 সে কালের রাজারা পরস্পর ঘোরতর যুদ্ধ করিলেও তাঁহারা হিন্দুর ন্যায় যুদ্ধ করিতেন। তাই যুদ্ধকালে ক্ষেত্র সকল কর্ষিত হইত। শষ্য সকল বিধ্বস্ত হইত না। প্রজা যদি দুর্ভিক্ষে অথবা মহামারীতে পীড়িত হইত, তাহা হইলে সে রাজার নিন্দার সীমা থাকিত না। তিনি কুনৃপতি নামে অভিহিত হইতেন। সমদর্শী বিজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা রাজ্যের বিচার কার্য্য নির্বাহ করিতেন। গ্রীক দূত বলেন, এদেশের লোকেরা চুক্তি ভঙ্গ, বা বিশ্বাসঘাতকতাদি সম্বন্ধে কোন মকর্দ্দমা করে না। সুতরাং ব্রাহ্মণ বিচারপতিগণকে বিচারাসনে উপবেশন করিতে হইত না। ভারতবাসীর গৃহে, সম্পত্তি প্রভৃতি অরক্ষিত অবস্থায় পড়িয়া থাকে, কোন দ্রব্য অপহৃত হয় না বিদেশী, রাজ্য মধ্যে উপস্থিত হইলে, যাহাতে তাহার কোন রূপ অসুবিধা না হয়, সে জন্য কর্ম্মচারী সকল নিযুক্ত হইত। রাজ্যের দূরতর প্রদেশে, অভ্যন্তর ভাগে কোথায় কি হইল, সেই সমস্ত সংবাদ, রাজ্যেশ্বর যথাযথ রূপে অবগত হইতেন। সংবাদ সংগ্রহ করা ভারতীয় রাজ্যবর্গের অতিপ্রাচীনতম পদ্ধতি। রামায়ণে ও অন্যান্য সংহিতাতে একথা আমরা অবগত হইয়া থাকি। অশোকের সময় যে কর্ম্মচারী সংবাদ সংগ্রহ করিত, তিনি “প্রতিবেদক” নামে পরিচিত হইতেন। এরিয়ান ও এরূপ কর্ম্মচারীর কথা উল্লেখ করিয়াছেন।

 পান্থশালা, চিকিৎসালয় প্রভৃতি সংস্থাপন করা, অতিপ্রাচীন কাল হইতে আমাদের দেশে চলিয়া আসিতেছে। পৃথিবীর অন্য প্রদেশ যখন ঘোরতর অজ্ঞান অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল, তখন আমাদের দেশে এইরূপ সাধারণের হিতজনক কার্য্য অনুষ্ঠিত হইত। প্রজাদিগের জলকষ্ট দূর, এবং শষ্য জননের সুবিধার জন্য, খালাদি খনন কার্য্য অতি প্রাচীন কাল হইতে আমাদের দেশের রাজারা অতি যত্নের সহিত সম্পন্ন করিতেন। অশোকের অনুশাসন, এবং রামায়ণ, মহাভারত, প্রভৃতি গ্রন্থে এবিষয়ের ভূরি ভূরি প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়।

 অলিক সন্দর ও তাঁহার সহচর বিজ্ঞ গ্রীকগণ, আমাদের রাজ্যশাসন ব্যবস্থা দেখিয়া প্রসন্ন হইয়াছিলেন। তাঁহারা আমাদের দেশে রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র উভয় প্রকার শাসন প্রণালী দেখিয়াছিলেন। আমাদের দেশের রাজারা যেরূপ ভাবে শিক্ষিত হইতেন, তাহাতে তাঁহারা যথেচ্ছাচারী হইতে পারিতেন না। তাঁহারা জাগতিক সুখ দুঃখে মুগ্ধ না হইয়া, ন্যায়ানুসারে প্রজা পালন না করিলে পতিত হইতে হইবে, ভাবিয়া কর্ত্তব্য পালন করিতেন। যে দেশের নরপতিরা বার্দ্ধক্যে রাজঐশ্বর্ষ্য পরিত্যাগ করিয়া ঈশ্বর উপাসনায় জীবন অতিবাহিত করিতেন; সে দেশের রাজার, অল্পদিনের জন্য যথেচ্ছাচারী হওয়া সম্ভবপর নহে। বেণাদির ন্যায় যে সকল মহীপতি, প্রজাপীড়ন করিয়া সকলের বিরাগ ভাজন হইতেন, বলাবাহল্য তাঁহাদিগের পরিণাম ও অত্যন্ত শোচনীয় হইত! যে দেশের জন সাধারণ যে হস্তে রাজাকে দেবতার ন্যায় পূজা করিত, আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, সেদেশে অত্যাচারী নরপতিকে দণ্ডপ্রদান করিবারজন্য, তাহারাই আবার সেই হস্তে, অস্ত্রগ্রহণ করিয়া ভৈরব মূর্ত্তি ধারণ করিত।

 গ্রীকেরা আমাদের দেশে প্রজাতন্ত্রের রাজ্য দেখিয়াছিলেন। বর্ত্তমান কালে আমাদের অনেকের কাছে ইহা অত্যন্ত অদ্ভুত বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। পঞ্চায়িৎ প্রথার জন্মভূমিই আমাদের দেশ। দেশে রাজা থাকুন আর নাই থাকুন, উভয়স্থলেই, সংসারে যাঁহাদিগের কোনরূপ বাধ্য বাধকতা নাই; এরূপ অনাসক্ত চিত্ত ব্রাহ্মণ সভা কর্তৃক রাজকার্য্য সকল নির্ব্বাহিত হইত। সুতরাং সে দেশে অত্যাচার বা অবিচার হওয়া সম্ভবপর নহে। বর্ত্তমান কালে আমরা বিদেশী, নির্ব্বাচন প্রথার নামে আত্মহারা হইয়া পড়ি। জন সাধারণ কর্তৃক যাহারা নির্ব্বাচিত হয়, তাহাদের সহিত জন সাধারণের কিরূপ সম্বন্ধ, এই সকল সভ্যের সহিত, ইহাদের নির্ব্বাচিত মন্ত্রি সভার সহিত বা কিরূপ সম্বন্ধ, তাহা একটু ভাল করিয়া দেখিলে, ইহার প্রতি অশ্রদ্ধা উপস্থিত হইয়া থাকে। জন সাধারণ কর্তৃক যাহারা নির্ব্বাচত হয়, তাদের বিশেষ কোন গুণের আবশ্যক হয় না। যে ব্যক্তি বেশী করিয়া ভ্রমরের মত ভ্যান্‌ ভ্যান্ করিতে পারে,— বেশী করিয়া আকাশের চাঁদেৱ মতন অনেক দ্রব্য দিতে পারিবে বলিয়া জন সাধারণকে প্রতারণা করিতে পারে, যে ব্যক্তির দলের লোক, যাচ্ছেতাই, যাহার মাতা নাই মুণ্ড নাই, এরূপ প্রলাপ বক্তৃতা করিয়া জন সাধারণ রূপ ভ্যাড়ার দলের মনের ভিতর স্থান অধিকার করিতে সমর্থ হয়, সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি “মান্যবর” বিশেষণে সম্মানিত হইতে পারেন। তার পর ইহাঁরা যাহাকে তাঁহাদের নেতা নির্ব্বাচন করেন; সেই সেই দলপতির ইচ্ছা অনুসারে সমস্ত দেশ পরিচালিত হইয়া থাকে। এখানেও সেই এক জনের উপর সমস্ত শক্তি অর্পিত হইয়া থাকে। তিনি যদি কর্ত্তব্য ভুলিয়া যান; তাহা হইলে তিনি নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, কোন জাতির সহিত যুদ্ধ বাঁধাইয়া সমস্ত দেশ শোণিতসিক্ত করিতে কিছুমাত্র কুন্ঠাবোধ করেন না, দেশের স্বার্থের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া নিজের উদর পূর্ণ করিতে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ প্রকাশ করেন না। এরূপ পদ্ধতির লীলাভূমি, ইয়ুয়োপের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে, এবিষয়ে যথেষ্ট উদাহরণ দেখিতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশের প্রজাতন্ত্র, এরূপ নির্ব্বাচন ভিত্তির উপর স্থাপিত না হইলেও, দেশের লোকের যাঁহার উপর আস্থা আছে, আর দেশের উপর যাঁহার আস্থা আছে; অথচ যিনি সাংসারিক স্বার্থে বিজড়িত নহেন— যিনি এক হস্তে চন্দন চর্চ্চিত, বা অপর হস্তে অগ্নি দগ্ধ হইলেও, উভয়েই যিনি নির্ব্বিকার চিত্ত, সেইরূপ পুরুষ প্রবরের উপর রাজশক্তি আরোপিত হইত, তিনি প্রজার স্বার্থ সম্যকপ্রকারে সংরক্ষণ করিয়া থাকেন। আমাদের দেশে, রাজ্য শাসন করি– বার জন্য একটি জাতি প্রস্তুত করা হইয়াছিল। আবার যাহাতে তাহারা বিপথগামী না হন, এজন্য আমাদের সে কালের লোকেরা বলিতেন যে, ক্ষত্রতেজের সহিত ব্রহ্মতেজ মিলিত হইলে, সেই সম্মিলিত শক্তি দেশের অভ্যুদয়ের কারণ স্বরূপ হইয়া থাকে। এরূপ রাজশক্তির, অথবা রাজ্যের বিপত্তিতে দেশের লোক সে কালে উপবাস করিয়া সহানুভূতি প্রকাশ করিতেন[]

 আমাদের দেশ, চিরকালই সমৃদ্ধি সম্পন্ন ছিল। অর্থের সমতা সংরক্ষণ জন্য, দেশের ভিতর একটা আনন্দের উৎস স্থায়ী রূপে প্রবহমান রাখিবার জন্য, সে কালে বড় বড় যাগ যজ্ঞ সর্ব্বদাই অনুষ্ঠিত হইত। বড় বড় রাজারা, সে কালে বিশ্বজিৎ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া সর্ব্বস্ব দান করিয়া ইচ্ছাপূর্বক নিঃস্ব হইতেন। একজনের অগাধ ধন, সাধারণের কল্যাণ কল্পে সমস্ত দেশের মধ্যে বিতরিত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে, এরূপ ব্যাপার এক ভারতবর্ষ ব্যতীত অপর স্থানে কখন লিখিত হয় নাই। অলিকসন্দরের প্রায় সহস্র বৎসরের পর, আমাদের কান্যকুব্জের অধিশ্বর মহাবাহু হর্ষবর্দ্ধন (শ্রীহর্ষ) যাহা করিয়াছেন, তাহাও পৃথিবীর অপর দেশের ইতিহাসে অদ্ভূত ব্যপার। প্রতি পঞ্চমবর্ষে প্রয়াগক্ষেত্রে, ৭৫ দিনে তাঁহার অতুল ঐশ্বর্য্য ব্রাহ্মণ, শ্রমণ এবং দরিদ্র প্রজাগণ মধ্যে বিতরিত হইত। শেষের দিনে মহারাজ আপনার বহুমূল্যের পরিচ্ছদ ও আভরণ দান করিয়া অপরের নিকট হইতে সামান্য বস্ত্রগ্রহণ করিয়া বলিতেন, “আজি আমি সম্পতি রক্ষার চিন্তা হইতে নিশ্চিন্ত হইলাম।” সেই ভারতীয়দানবীরের কথা স্মরণে শরীর পুলকিত হয়। বৈদেশিক পর্য্যটক যদি ইহার উল্লেখ না করিতেন, তাহা হইলে ইহাও অন্যান্য শত শত অলিখিত ঘটনার সহিত বিস্মৃতিসাগরে নিমজ্জিত হইত। আজকাল পুত্ত্র পৌত্রাদি, কি খাইবে এই ভাবনায় আকুলিত হইয়া, ধনবানেরা যেরূপ অর্থ সঞ্চয় করিয়া থাকে, সে কালের ধনবানেরা যে এরূপ প্রথা অবলম্বন করিতেন না; তাহা আমরা বিশ্বজিৎ যজ্ঞ প্রভৃতিতে অনুমান করিতে পারি। ঈশ্বরের রাজ্যে, কোন পশু, পক্ষী, পুত্ত্র পৌত্রাদির জন্য কখন কোনরূপ সঞ্চয় করেন না, তাহারা সন্তানগণকে কার্য্যক্ষম করিয়া পরিত্যাগ করিয়া থাকে। বলা বাহুল্য তাহাদের সে সকল সন্তান, দৃঢ়, বলবান ও কার্য্যক্ষম হইয়া থাকে। আমাদের সে কালের ধনবানেরা স্বভাবের অনুমোদিত পন্থা অবলম্বন করিয়া, তাঁহারা সর্ব্বস্ব প্রদান করিয়া দেশের আনন্দবর্দ্ধন করিতেন, দেশকে পরিপুষ্ট করিতেন, আর সন্তান সন্ততিগণকে রুগ্ন, ভীরু এবং অলসের পরিবর্ত্তে কার্য্য পটু শ্রমশীল, সাহসী, এবং নীরোগ ও দীর্ঘজীবী করিতেন। আমাদের দেশের লোক কার্য্যে যাহা করিয়া গিয়াছেন, পৃথিবীর অন্যত্র কেহ ইহা কল্পনা করিতে ও সমর্থ নহে।

 ভারতীয় প্রজা সৃষ্টি, অন্যদেশের মর্কট ভাবাপন্ন মনুষ্য হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন, সেই সকল অচিন্ত্য পূর্ব্ব সৃষ্টি, আপনা অপনি স্বভাবের সহিত উৎপন্ন হইয়া বিলীন হইয়া যাইতেছে। আমরা যখন, আমাদের উৎপত্তি প্রকরণ দেখি, তখন আমরা সেইঅতীত যুগের গোত্র প্রবর্ত্তক ঋষিদিগের প্রজাগণের কল্যাণ জন্য অনন্য সাধারণ তপস্যা, কঠোরতা, অধ্যবসায় দেখিয়া, বিমুগ্ধ হইয়া পড়ি[]। যে সমাজ সংযম মিতাচার ও দীর্ঘকালের সুচিন্তার পরিণাম; সে সমাজ, পৃথিবীর অন্যান্য উচ্ছৃঙ্খল সমাজ অপেক্ষা দীর্ঘজীবী, নানাপ্রকার বিপ্লব তরঙ্গের আঘাত সহনে সুপটু হইবে ইহা কিছু আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। আমাদের সম্মুখে, মিশ্র, এসিরিয়ান, চ্যালডিয়ান, প্রভৃতি কত সমাজের উত্থান ও পতন হইল, তাহার ইয়ত্তা নাই, কিন্তু আমরা এখনও দাঁড়াইয়া আছি। কিন্তু আর আমরা কত দূর সমর্থ হইব, সেই ভয়ঙ্করী চিন্তা আসিয়া আমাদিগকে ঘোরতর আকুলিত করিয়া তোলে। আমাদের সমাজ যেরূপ ভাবে উচ্ছৃঙ্খল হইতেছে, যেরূপ ভাবে অসংযত, যেরূপ ভাবে স্বার্থপর হইতেছে, তাহাতে ইহা কিপ্রকারে প্রাচীন গৌরব রক্ষা করিতে সমর্থ হইবে, সে বিষয় ঘোরতর সন্দেহ উপস্থিত হইয়া থাকে।

 সেকালের হিন্দু বিশেষতঃ ব্রাহ্মণগণ কিরূপভাবে শিক্ষিত ও দীক্ষিত হইতেন কিরূপভাবে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেন এই সকল প্রাচীন কথা। আলোচনা করিতে প্রবৃত্ত হইলে, সর্ব্ব প্রথমে আমাদের দৃষ্টি আহারের উপর আপতিত হয়। একটা কথা আছে, যে যেরূপ ভোজন করে, সে সেইরূপ চিন্তা করে, আর যে যেরূপ চিন্তা করে, সে সেইরূপ কথা কহিয়া থাকে। কথাটি সারগর্ভ, ভোজনের উপর সমস্ত নির্ভর করিয়া থাকে। পেট খারাপ হইলে, সমস্ত শরীর খারাপ হইয়া থাকে; পান ভোজনে অমিতাচারী হইলে, কি গৃহের কি বাহিরের সকল কার্য্যেই বিশৃঙ্খল হইয়া সমাজ দুর্ব্বল হইয়া পড়ে, এবং বিনাশের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। প্রাচীন ও বর্ত্তমানকালে যেসকল সমাজ, যথেষ্ট পরিমাণে পার্থিব উন্নতিলাভ করিয়াছিলেন, ও করিয়াছেন; তাঁহাদিগের প্রতি চাহিলে আমরা দেখিতে পাই; যতদিন পর্য্যন্ত তাঁহারা ভোজন বিষয়ে সংযত ছিলেন, ততদিন তাঁহারা নানাদেশ জয় করিয়া অদ্ভুত পরাক্রম দেখাইতে সমর্থ হইয়া ছিলেন। তারপর যখন, তাহারা নানাপ্রকার গুরুপাক দ্রব্য ব্যবহার করিয়া রুগ্নপ্রায় হইলেন, ইহার সহিত তাঁহাদের বিলাসের পরিণাম বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। অনন্তর, চিররুগ্ন বিলাসীর যে দশা উপস্থিত হয়, সেই অবস্থা প্রাপ্ত হইয়া সমূলে জগৎ হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে।

 আমাদের বাড়ীর পার্শ্বের, একবার প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের কথা স্মরণ করুন। সম্রাট কাইরসের সময় তাঁহারা যথেষ্ট উন্নতি লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহারা যথেষ্ট মিতাচারী ছিলেন বলিয়া, সেই উন্নতি লাভে সমর্থ হইয়াছিলেন। এ বিষয় আমরা নিজের কথা কিছু না বলিয়া একজন বিজ্ঞ গ্রন্থকারের মর্ম্ম কথা অনুবাদ করিলাম। (Rollin's Amcient History)

 “কাইরস, অতি সামান্য অবস্থা হইতে, পারস্যকে যেরূপ সমৃদ্ধিশালী, দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাম্রাজ্যে পরিণত করিয়াছিলেন, সেরূপ, পৃথিবী আর দেখে নাই। তিনি অনেক অধিক যুদ্ধ যাত্রা করিয়াছিলেন; বহুসংখ্যক যুদ্ধে অদ্ভুত বিক্রম প্রকাশ করিয়া যুদ্ধে জয়লাভ করিয়াছিলেন; তিনি ক্লেশ সহিষ্ণুতা, যুদ্ধে প্রচণ্ডতা এবং শারীরিক দৃঢ়তা যেরূপ দেখাইয়াছিলেন, সেরূপ আর এ পর্য্যন্ত কোন সেনানী দেখাইতে সমর্থ হয় নাই। তিনি অতি বাল্যকাল হইতে লঘুপাক, খুব সাদা-সিদে শাক-সবজি খাইয়া, ও কেবল জলমাত্র পান করিয়া ক্ষুৎ-পিপাসা দূর করিতেন। তাঁহার সহিত যে সকল পারসিক সৈন্য অবস্থান করিত, তাহারাও এইরূপ লঘুপাক শাক-সবজি ভোজন করিয়া যুদ্ধস্থলে অদ্ভূত কার্য্য সম্পাদন করিয়াছিল।

 পারসীকদের সেই সুদিনে, গ্রীক হিরোডোটস বলেন,তাহারা বিস বৎসর পর্য্যন্ত অন্য সকল শিক্ষা অপেক্ষা, অশ্বে আরোহণ— অস্ত্রধারণ এবং সত্যভাষণ, এই তিনটি বিষয়ে, যাহাতে বালক পটুতা লাভ করে, সে বিষয় পারসীকেরা বিশেষরূপে দৃষ্টি প্রদান করিতেন। সেই উন্নতিরকালে পারসীকেরা দিবাতে একবারমাত্র ভোজন করিয়া, রাত্রিতে কিছু জলযোগ করিয়া শরীর ধারণ করিতেন। তারপর যখন পারসীকেরা বিলাসী হইল, তাহাদের গুরুপাক ভোজনের মাত্রা যখন বৃদ্ধি পাইল, তখন তাহারা ধীরে ধীরে পৃথিবী হইতে অন্তর্হিত হইয়া গেল।

 গ্রীস যখন বাহুবলে প্রাধান্য লাভ করেন, সে সময় তাঁহারা দুইবার মাত্র ভোজন করিতেন, দ্বিপ্রহরে একবার, রাত্রিকালে একবার। তাঁহাদের খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে শাক সবজিই বেশী থাকিত, ইহাতে তৈল ব্যবহার করিতেন। মাছ মাংস বেশী ব্যবহার করিতেন না।

 সুপ্রসিদ্ধ রোমকগণ, তাহাদিগের অভ্যুদয়েরকালে, নিরামিষ ভোজী ছিলেন। তারপর তাঁহাদিগের ধনবৃদ্ধির সহিত, তাঁহাদিগের আমিষ ভোজন বৃদ্ধি পাইয়াছিল। রোমক পণ্ডিত সেনাকা বলেন, ভোজনোৎসব তাঁহারা সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে সুশিক্ষিত না হইলেও, শত্রুজয়ে তাঁহারা সিদ্ধ হস্ত এবং প্রজাপালনে সুনিপুণ ছিলেন। ঐশ্বর্য্য যেরূপ সদ্‌গুণের বিরোধী এরূপ আর কিছুই নহে। রোমের জগৎজয়ের পর, অর্থই রোমকে পরাজয় করিয়াছিল। ইহার যে দ্বার দিয়া নির্ধনতা বাহিরে গমন করিয়াছিলেন, সেই দ্বার দিয়া বিজাতীয় বিদেশী পাপ সকল নগর মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। তারপর সেই অদ্ভূত পরাক্রম পরিমিতাচারী রোমকদিগের বংশধরগণ ভোজন বিষয়ে এরূপ উচ্ছৃঙ্খল হইল, এরূপ কদাচারী হইল, তখন তাহা দিগের বিলোপ সাধন প্রকৃতির বাঞ্ছনীয় হইয়া উঠিল।

 বেশী উদাহরণ দিয়া আমরা আর বিষয় বাড়াইতে ইচ্ছা করি না, অল্পদিনের কথা স্মরণ করুন, মুসলমানেরা সামান্য সময়ের মধ্যে কি অপূর্ব্ব প্রভাব দেখাইয়াছিলেন। তাহাও জাগতিক ইতিহাসে স্মরণীয় বিষয়। যে সময় মুসলমানগণ জগদ্‌জয়ে প্রবৃত্ত হন, সে সময়ে তাঁহারা খুব পরিমিতাচারী ছিলেন। সে সময় মুসলমান সৈন্যগণের উদকই প্রধান পেয়,দুগ্ধ ফল মূল এবং অন্নই তাহাদিগের প্রধান খাদ্য পরিকল্পিত হইয়াছিল। মহাপ্রাণ ওমর, যবের রুটি আর জল খাইয়া শরীর পোষণ করিয়াছিলেন। তারপর, মুসলমানদের বিলাসীতা যেন পৃথিবীর সকল জাতি অপেক্ষা সীমা অতিক্রম করিয়া বৃদ্ধি পাইয়াছিল। তাহাদের রাজবাটির দৈনিক ব্যয় আড়াই লক্ষ টাকার বেশী, তাঁহাদের রন্ধনের ইন্দনের জন্য, দালচিনি, চন্দনকাষ্ঠ ব্যবহৃত হইত। বলা বাহুল্য, ইহার ফলও অল্প সময়ের মধ্যে ফলিয়া ছিল। মানুষ যেমন অতিভোজন করিয়া কালগ্রাসে পতিত হয়। সেইরূপ সমাজও অমিত ভোজন করিয়া, ধ্বংস মুখে পতিত হইয়াছে,তাহা আমরা দেখিতে পাই। ভোজন বিশৃঙ্খলাতে নানাপ্রকার নূতন নুতন রোগের সৃষ্টি হইতেছে, এ কথা বেশী করিয়া বলা বাহুল্য; যেহেতু আমরা চক্ষের উপর তাহা দেখিতে পাইতেছি। এই জন্যই সমাজ রক্ষকেরা, আমাদের সমাজ রক্ষা করিবার জন্য, অখাদ্য ভোজীকে নিগৃহীত করিতেন, তেমন তেমন হইলে, তাহাকে সমাজ হইতে বিদূরিত করিয়া দিতেন। এরূপ রোগের ইহাই বিজ্ঞান অনুমোদিত চিকিৎসা। আজকাল অতিভোজী ইয়ুরোপীয়দের যাঁহারা অনুকরণ করেন, তাঁহাদের কাছে এই সকল চিকিৎসকেরা অজ্ঞ, স্বার্থপর, প্রভৃতি বিশেষণে বিভূষিত হইয়া থাকেন।

 সেকালের গ্রীকেরা আমাদের পূর্ব্বজগণকে পরিমিত ভোজী দেখিয়াছিলেন। সেকালে তণ্ডলের ব্যবহার বেশী ছিল, মদ্য, মাংস ও মৎসের একেবারে প্রচার ছিল না এরূপ নহে। বর্ত্তমান কালের ন্যায় অধিকাংশ ভারতবাসী ইহা ব্যবহার করিতেন না, যাহারা ইহা ব্যবহার করিতেন না, তাঁহারা প্রশংসিত হইতেন। আমাদের বালকগণ যাহাতে বাল্যকাল হইতে খাদ্যাখাদ্য বুঝিয়া পথ্য, সুপাচ্য, দ্রব্য খাইতে শিক্ষিত হয়, সে বিষয় আমাদের জাতীয় শিক্ষাপরিষদেয় দৃষ্টি পড়া উচিত।

 সেকালে সকলেই আপন আপন বর্ণ অনুসারে শিক্ষণ প্রাপ্ত হইতেন। যাহাতে না বংশ মধ্যে ব্রহ্মবন্ধু জন্মগ্রহণ করে, সে জন্য ব্রাহ্মণেরা ভগবানের কাছে সর্ব্বদা প্রার্থনা করিতেন। ইহাতেই বুঝা যায় সেকালে আমাদের দেশে কিরূপ লেখাপড়ার প্রচার ছিল। লেখা সম্বন্ধে ইয়ুরোপীয় পণ্ডিত এবং আমাদের দেশী তাঁহাদের শিষ্যগণ বলেন, বিদেশীদের নিকট হইতে আমরা লিখন প্রণালী অবগত হইয়াছি! গ্রীক মেগাস্থিনিস, “চন্দ্রগুপ্তের সৈনিকগণ মধ্যে লিখিত নিয়ম কিছু নাই,” এই কথা উল্লেখ করিয়াছেন। এইরূপ কথার উপর নির্ভর করিয়া, অনেকে বলেন, আমাদের সেকালে লিপিজ্ঞান ছিল না, ইহা আমরা অন্য জাতির কাছে শিক্ষা করিয়াছি। এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করিতে আমাদের প্রবৃত্তি হয় না। অলিক সন্দরের অন্যতম সেনানী নিয়ার্কস, কাপড়ের উপর লেখার কথা উল্লেখ করিয়াছেন; মেগস্থিনিস ও ক্রোশ জ্ঞাপক শিলালিপির কথা প্রকাশ করিয়াছেন। এ সকল ব্যতীত আমাদের মনু, যাজ্ঞবল্ক, প্রভৃতি তাঁহাদের সংহিতায়, লিখার কথা বহুবার উল্লেখ করিয়াছেন। ভগবান বিষ্ণু স্বীয় সংহিতায়, পুস্তক অবিভাজ্য, এ কথা স্পষ্ট করিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। বেদ মন্ত্রাত্মক, ইহা গুরুমুখ হইতে অনুশ্রত হইত বলিয়া ইহা শ্রুতিনামে অভিহিত হয়। ইয়ুরোপীয় পণ্ডিত মহাশয়েরা,এই শ্রুতি শব্দ দেখিয়া স্থির করিলেন, আমরা লিখিতে জামিতাম না। ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, প্রভৃতি বেদের অঙ্গ কখন শ্রুতিনামে অভিহিত হয় নাই। এ সকল বিষয় খৃষ্টজন্মের বহুসহস্র শতাব্দীপূর্ব্বে আমাদের ভারতবর্ষে উৎকর্ষতালাভ করিয়া ছিল। ব্রহ্মা, আয়ুর্ব্বেদ সম্বন্ধে লক্ষ শ্লোকাত্মক একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। লিখার প্রচলন না থাকিলে গ্রন্থ রচনা সম্পূর্ণ অসম্ভব। অনেকে, মুখে মুখে রাশী রাশী গ্রন্থ রক্ষা করা কল্পনা করিয়া থাকেন, তথাপি ও লিপি কল্পনা করিতে তাঁহাদের কষ্ট বোধ হইয়া থাকে!

 ব্রাহ্মণ, যাহাতে গোলাম না হইয়া ব্রাহ্মণ হন, সে বিষয় সমাজ, সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিতেন, ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ হইলে সমাজের দুর্র্গতি দূর হইয়া থাকে। ব্রাহ্মণ নিঃস্বার্থভাবে সমাজের দুঃখ দূর করিয়া থাকেন। এবিষয় গ্রীকগণও সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছেন; এবং আমাদের ইতিহাসও সাক্ষ্য প্রদান করেন। কাশ্মীর মণ্ডলে যে সময় ভিক্ষু (বৌদ্ধ) বিপ্লব উপস্থিত হইয়াছিল, সে সময় কাশ্যপ চন্দ্রদেব, তাহা দূর করিয়া দেশে শান্তি আনয়ন করিয়াছিলেন। আবার যখন যক্ষ (মধ্য এসিয়াবাসী) বিপ্লব উপস্থিত হয়, সে সময় অপর চন্দ্রদেব, তাহাদিগকে দূর করিয়া দেশ মধ্যে শান্তি সংস্থাপন করেন[১০]। শিশুর জন্মকাল হইতেই, যাহাতে সে মানুষ হয়, যাহাতে সে সমাজের হিতকারী বন্ধুরূপে পরিণত হয়, সে বিষয় অতি শৈশবকাল হইতেই তাহাকে ভাবনা দেওয়া হইত। “হে পুত্ত্র ভূমি গোষানে আরোহণ করিয়া শত্রু সংহার কর”[১১]। “ব্রাহ্মণ কখন নিষ্ক্রয় থাকিতে পারেন না”[১২]। “যে ব্যক্তি নিজে স্বর্গে গমন করিতে অসমর্থ, সে কিরূপে পিতৃগণকে উদ্ধার করিতে সমর্থ হইবে”[১৩]। ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবনায় ভাবিত ব্রাহ্মণগণ জগতের মঙ্গলের জন্য আত্মেৎসর্গ করিতেন। জড়ের ন্যায় ক্রিয়াশূন্য হইয়া যে ব্যক্তি গৃহে অবস্থান করে, সে ব্যক্তি অনতিবিলম্বে রুগ্ন হইয়া ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে উপনীত হয়। তাই ভগবান ব্যাসদেব বলিয়াছেন, অপ্রবাসী ব্রাহ্মণ, আর যুদ্ধ বিমুখ রাজা, এই উভয়কে পৃথিবী গ্রাস করিয়া থাকেন[১৪]। তাই সে কালের ব্রাহ্মণ, সমস্ত পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিয়া, সমস্ত পৃথিবীর মানবগণকে জ্ঞানালোকে উদ্ভাষিত করিয়াছিলেন[১৫]। হে ব্রাহ্মণাদি বর্ণচতুষ্টয়! আপনারা পৃথিবীর অন্যান্য সকল জাতির অগ্রে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, আপনারা জগতের জ্ঞানগুরু, আপনাদিগের শিষ্যানুশিষ্যগণ, আপনাদিগের সুদীর্ঘ নিদ্রিত কালের মধ্যে, কতদূরে অগ্রসর হইয়া গিয়াছে দেখুন! আর কি মৃতের ন্যায় নিদ্রিত অবস্থায় অবস্থান করা ভাল দেখায়। উঠুন! আত্মশক্তি অনুসারে পৌরুষ প্রদর্শন করুন। তাহা হইলে আপনারা, আপনাদিগের সেই অনাদিকালের জগতের শিক্ষকত্ব লাভে সমর্থ হইবেন এ বিষয় অনুমাত্র সন্দেহ নাই।

  1. যে দেশ পরাধীন, সে দেশের অধিবাসী নানাকারণে চিররোগী, সর্ব্বদা ঋণগ্রস্ত, ধর্ম্ম কার্য্য বিবর্জ্জিত মূর্খ হইয়া থাকে। ভগবান অত্রি, এই সকল অপবিত্র লোকের নাম উল্লেখ কালে পরাধীন ব্যক্তিরও নাম ইহার মধ্যে পরিগণিত করিয়াছেন। বলা বাহুল্য স্বাধীন ব্যক্তির কাছে, গোলাম সবই সমান—ইহাতে ছোট বড় ভেদ নাই।

    ব্যাধিতস্য কদর্য্যস্য ঋণগ্রস্তস্য সর্ব্বদা।
    ক্রিয়াহীনস্য মূর্খস্য স্ত্রীজিতস্য বিশেষতঃ॥
    ব্যসনাসক্ত চিত্তস্য পরাধীনস্য নিত্যশঃ।
    স্বাধ্যায় ব্রতহীনস্য সততং সুতকং ভবেৎ॥  অত্রিসংহিতা॥

  2. ভগবান বিষ্ণুবলেন, “ন ম্লেচ্ছ বিষয়ে শ্রাদ্ধং কুর্য্যাৎ”। উশনস বলেন। “পরস্য ভূমি ভাগে তু পিতৃণাং বৈন নির্ব্বপেৎ”॥
  3. ভগবান বশিষ্ঠ বলেন, ব্রাহ্মণ আপদ উদ্ধরতি।
  4. এই সে দিন, মুসলমান রাজ্যের অন্তিম কালেও, একমাত্র বাঙ্গলার ব্রাহ্মণাদি ব্রহ্মোত্তর প্রভৃতিরূপে ৮০ লক্ষ বিঘা ভূমি নিষ্কর অধিকার করিয়াছিলেন। একজন মনস্বী ইংরেজ দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন, “It is incredible that should have allowed eight million of beeghas of land to be permanently alienated from the State.”
     সাহেব যে ভাবেই বলুন না কেন, আমরা ও বলি যাহারা এই প্রচুর ভূমি ভোগ করিতেছে, তাহারা সুদীর্ঘকালের মধ্যে দেশের বা দশের কি উপকার করিয়াছেন? যাহারা দেশবাসী কর্তৃক পরিপুষ্ট হইয়াও, স্বদেশবাসীর হিতকর কার্য্য করিবার সময় আলস্য প্রকাশ বা বিরুদ্ধাচরণ করিয়া থাকে তাঁহাদিগের এই সম্মান ভোগ কালে লজ্জিত হওয়া উচিৎ।
  5. মণিকারশ্চ যে কেচিৎ কুম্ভকারাশ্চ শোভনাঃ
    সূত্র কর্ম্ম-বিশেষজ্ঞ যে চ শস্ত্রোপাজীবিনঃ।
    মাযুকা ক্রাকচিকা বেধকা রোচকা স্তথা।
    দন্তকারাঃ সুধাকারা যে চ গঙ্গোপ জীবিনঃ॥
    সূবর্ণকারা প্রখ্যাতা স্তথা কম্বল কারকাঃ ।
    স্নাপকোঞ্চদকা বৈদ্যা ধূপিকা শৌন্ডিকা স্তথা।
    রজকা স্তুন্নবায়াশ্চ গ্রাম ঘোষমহত্তরা॥ রামায়ন, অযো,৮৩অ।

  6. অথ ভূমি প্রদেশজ্ঞাঃ; সুত্রকর্ম্ম বিশারদাঃ।
    স্বকর্ম্মাভিরতাঃ শূরাঃ; খনকা যন্ত্রকা স্তথা॥
    কর্ম্মান্তিকা স্থপতয়ঃ পুরুষা যন্ত্রকোবিদাঃ।

    তথা বার্দ্ধকয়শ্চৈব মার্গিণো বৃক্ষতক্ষকাঃ॥
    সুপকারা সুধাকারা বংশচর্ম্মকৃতস্তথা।
    সমর্থা যে চ দ্রষ্টারঃ পুরুষশ্চ প্রতস্থিরে। অযো, ৮২ অঃ।

  7. উদীচ্যাশ্চ প্রতীচ্যাশ্চ, দাক্ষিণাত্যাশ্চ কেবলা।
    কোট্যাপরান্তাঃ সামুদ্র্য রত্নান্যুপ হরন্তুতে॥ অযোধ্যা,৮২ অধ্যায়।

  8. রাজ্যব্যসনে নাশ্মীয়াৎ। ৬৮ অধ্যায়, বিষ্ণুসংহিতা।
  9. কাষ্ঠপোহ্যথ বশিষ্ঠঃ প্রাণশ্চ প্রাণপুত্রকঃ।

    * * * * *
    অছরৎ স তপস্তীব্রং পুত্রার্থে বহুবার্ষিকম্॥

    পুত্রং লেভেয়ং ধর্মিষ্ঠং যশসা ব্রহ্মণা সমম্। ব্যাসদেব॥

  10. কাষ্ঠপ শ্চন্দ্রদেবাখ্য স্তপ স্তোপে ততো দ্বিজঃ ১৮২।

    * * *
    আদ্যেন চন্দ্রদেবেন শমিতো যক্ষবিপ্লবঃ।

    দ্বিতীয়েন তু দেশেস্মিন্ দুঃসহো ভিক্ষুবিপ্লবঃ॥ ১৮৪॥ রাজতরঙ্গিণী॥

  11. আরোহ প্রোষ্ঠং বিযহম্বশত্রুন্। বৌধায়ন গৃহ্যসূত্র।
  12. ক্রিয়াময়ং হি ব্রহ্মেণ্যং নাক্রিয়ং ব্রহ্মোচ্যতে না ক্রিয়ও ব্রহ্মোচ্যতে। অপর স্থলে,না ক্রিয়ো ব্রাহ্মণো, না সংস্কারো দ্বিজো, না বিদ্বান বিপ্রো। (ঐ)
  13. ন মাংস পেশলঃ পুত্রো না বিদ্বান্ নাপ্যকর্ম্মকৃৎ।
    স্বয়ং ন যাতি যঃ স্বর্গং কিং পুনঃ পিতরং তরেৎ॥ (ঐ)

  14. দ্বানিভৌ গ্রসতে ভুমিঃ সর্পো বিলশয়া নিব।
    রাজানং চাপ্য যোদ্ধারং ব্রাহ্মণং চাপ্রবাসিনম্॥

    মহাভারত, উদ্যোগ, প্রজাগর পর্ব।
  15. এতদ্দেশ প্রসূতস্য সকাশাদগ্রজন্মনঃ।
    স্বং স্বং চরিত্রং শিক্ষেরন্ পৃথিব্যাং সর্ব্ব মানবাঃ॥ মনু। ২০।২ অ