ভারতে অলিকসন্দর/দ্বিতীয় ভাগ/পঞ্চম অধ্যায়

পঞ্চম অধ্যায়

 পাঞ্জাব অতিক্রমণ করিয়া, অলিকসন্দর সিন্ধুদেশে উপস্থিত হইলেন। এপ্রদেশের অধিবাসীরা তাঁহাকে বাধা দিতে বড় কম ত্রুটি করে নাই। প্রাচীন লেখকদিগের, যে সকল ত্রুটিত বিবরণ আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহাতে এপ্রদেশের যুদ্ধকাহিনী বড় বিশেষরূপে বর্ণিত হয় নাই। যাহা বা বলা হইয়াছে কাহাও তাড়াতাড়ি সঙ্ক্ষেপে কথিত হইয়াছে। সঙ্ক্ষেপে কথিত হইলেও, তাহাতে আমরা বুঝিতে পারি, এপ্রদেশের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র, সকলে মিলিত হইয়া অব্যবস্থিত যুদ্ধ প্রণালী অবলম্বন করিয়া, অলিকসন্দরকে ব্যতিব্যস্ত করিয়াছিল। এবং তিনি প্রাণ ও মান লইয়া কোনরূপে পলায়ন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এজন্য ব্রাহ্মণগণকে, অলিকসন্দরের ক্রোধাগ্নিতে, বড় কম শরীর আহুতি প্রদান করিতে হয় নাই। পতঙ্গপালের ন্যায় জীবনবিসর্জন করিলেও, দেশবাসীর হৃদয়ে মৃত্যুজনিত আতঙ্ক উপস্থিত হইয়া, তাহাদিগকে কর্ত্তব্য পথ হইতে বিচলিত করিতে সমর্থ হয় নাই। তাঁহাদের অদ্ভুত আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিলে, শরীর লোমাঞ্চিত হইয় উঠে, মৃত্যু যেন অতি তুচ্ছ, খেলিবার সামগ্রী বলিয়া বোধ হইয়া থাকে। ”

 অলিকসন্ধর, চন্দ্রভাগা ও সিন্ধু সঙ্গমে অবস্থান করিয়া পাশ্ববর্ত্তী প্রদেশের অধীশ্বরবৃন্দকে পরাজয় করিবার জন্য, সেনানী সকল প্রেরণ করিয়াছিলেন। অগ্রসর হইলে পাছে তাহারা, পশ্চাদ্‌ভাগে বিঘ্ন সম্পাদন করে, সেইজন্য তিনি অগ্রসর হইবার অগ্রে তাহাদিগকে অধীনে আনয়ন করিতেন। গ্রীক গ্রন্থকার বলেন, পার্দ্দিকা, অবস্তানোই (Abastanoi) নামক স্বাধীন জাতিকে জয় করিয়া প্রত্যাগমন করেন। ডিওডোরস এই জাতিকে সম্বসতাই (Sambastai) নামে অভিহিত করিয়াছেন। মহাভারতে অম্বষ্ঠ রাজ্যের কথা দেখিতে পাওয়া যায়, ইহার সহিত তাহার কোন সংস্রব আছে কিনা তাহা ঠিক করিয়া বলা যায় না।

 ক্ষত্রই (Xathroi) নামক আর একটি স্বাধীনজাতি অলিকসন্দরের বশ্যতা স্বীকার করিয়া, তাহাদের প্রস্তুত কতকগুলি ৩০ দাঁড়ের ও কতকগুলি মালবোঝাই নৌকা প্রদান করে। ওসাদিওই (Ossadioe) নামক আর একটি স্বাধীন জাতি দূত প্রেরণ করিয়া বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিল; এই সঙ্ক্ষেপ কথায়, এই সকল লোকেরা কিরূপ ভাবে অলিকসন্দরের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিল। তাহা ভালরূপে অবগত হওয়া যায় না। নৌকা প্রদানে বুঝিতে পারা যায় যে, সেকালে আমাদের দেশে নৌকা প্রস্তুত বেশ ভালরূপই হইত। আর সেই নৌকা, অলিকসন্দরকে এদেশের বাহিরে লইয়া যাইবার পক্ষে সুবিধা সম্পাদন করিয়াছিল।

 চন্দ্রভাগা ও সিন্ধুর মিলন স্থল পরিত্যাগ করিয়া, অলিক সন্দর আবার অগ্রসর হইতে আরম্ভ করিলেন। সমস্ত হস্তী ও অধিকাংশ সৈন্যসহ সেনানী ক্রিতিরস, সিন্ধুর বাম তট অবলম্বন করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। এপ্রদেশের অধিবাসীরা অলিকসন্দরের বশ্যতা স্বীকার না করিয়া তাঁহার গমন পথে বাধা প্রদান করিয়াছিল। তাহাদিগকে বিভীষিকাগ্রস্ত করিবার জন্য এই বিপুল সেনাদল প্রেরিত হইয়াছিল। অলিকসন্দর নৌকাপথে সোগদই (Sogdoi) রাজধানী অধিকার করেন। এস্থানে তিনি নগর সুরক্ষিত, এবং আর একটি নৌকা নির্ম্মাণ স্থান প্রস্তুত করেন। এস্থানে তিনি, তাঁহার যে সকল নৌকা ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল,তাহা মেরামত করাইয়াছিলেন। অলিক সন্দর, চন্দ্রভাগার সঙ্গম স্থল হইতে সমুদ্র পর্য্যন্ত প্রদেশের রাষ্ট্রপতিপদে অজয়রথী, এবং পিথিয়নকে নিযুক্ত করেন।

 যে সকল সৈন্য যুদ্ধে আহত, এবং রোগে অকর্ম্মণ্য হইয়াছিল, অলিকসন্দর সেই সকল সৈন্যকে ক্রিতিরসের অধীনতায় স্বদেশে প্রেরণ করিতে মনন করেন। ইহাদের সহিত হস্তী সকলও অনুগমন করিয়াছিল। ইহারা সম্ভবতঃ বর্ত্তমান বোলন পথ অতিক্রমণ করিয়া কান্দাহার ও সিস্তান প্রদেশ দিয়া গমন করিয়াছিল।

 কুর্ত্তিয়স্ বলেন, সিন্ধুতটের অধিবাসীরা, অলিকসন্দরের নানারঙ্গের পতাকা শোভিত অগণিত নৌকা, তাহার আরোহীবর্গের অস্ত্র শস্ত্রের চাক্‌চিক্যে সম্মোহিত হইয়াছিল। ইহারা আবার অপর লোককে এই সকল কথা বলিয়া দেশবাসীকে মোহিত করিয়াছিল। তাই উপরোক্ত প্রদেশের লোকেরা অনায়াসে অলিকসন্দরের আজ্ঞাবহ হইয়াছিল। একথা কতদূর সত্য সে বিষয় সন্দেহ উপস্থিত হইয়া থাকে, কেননা রাজা বশ্যতা স্বীকার করিলেও, দেশবাসী, বিদেশীর বিরুদ্ধাচরণ করিতে পশ্চাদ্‌পদ হয় নাই।

 অলিকসন্দর মনে করিয়াছিলেন, তাঁহার গমন পথে যে সকল রাজন্যবর্গ অবস্থান করেন, তাঁহারা, তাঁহার পদপ্রান্তে উপস্থিত হইয়া বশ্যতা স্বীকার করিবে। কিন্তু সকল সময় তাহা হয় নাই। অনেক সময়ে ভারতবাসীরা পুরুষের মতন অসি হস্তে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিল। বর্ত্তমান সীকারপুর প্রদেশে, বৈদেশিকদের মুষিকান (Mousikanos) নামক এক জাতি অবস্থান করিত। ভারতবর্ষের মধ্যে তাঁহারা বিশেষ সমৃদ্ধি সম্পন্ন বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। ইঁহারা অন্যশাস্ত্র অপেক্ষা আয়ুর্ব্বেদের বিশেষরূপে অনুশীলন করিতেন। আহার বিহার সম্বন্ধে তাঁহারা বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করিতেন, মিতাচারী ছিলেন বলিয়া তাঁহারা দীর্ঘজীবন লাভ করিতেন। একশত তিরিশ বৎসর তাঁহাদিগকে জীবিত থাকিতে দেখিয়া, মাসিদনরা বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিল। ইয়ুরোপ সে সময় অজ্ঞান অন্ধকারে আবৃত ছিল, বন্য পশুসহ তথাকার অধিবাসীরা যখন অরণ্য মধ্যে বিচরণ করিত, এমন কি গ্রীকদিগেরও চিকিৎসা বিজ্ঞান যে সময়, কতিপয় মুষ্টিযোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সে সময় আমাদের ভারতের ব্রাহ্মণেরা, আয়ুর্ব্বেদ বিদ্যায় পারদর্শী হইয়াছিলেন,—ইহার উন্নতির জন্য তাঁহারা আমাদের দেশের অসংখ্য বনৌষধির অদ্ভূত গুণ অভিনিবেশ সহকারে পরীক্ষা করিতেন, কোন অভিনব রোগ প্রাপ্ত হইলে, তাঁহারা তাহার প্রশমন উপায়ের জন্য ধ্যানস্থিত হইতেন। তাঁহারা সকল বিষয়েই অন্যান্য সাধারণ একাগ্রতা, নিঃস্বার্থ পরতার উদাহরণ প্রদান করিয়াছেন। এই পঞ্চনদ প্রদেশে, আমাদের আয়ুর্ব্বেদের সর্ব্বপ্রধান গ্রন্থ চরক সংহিতার প্রথম প্রচার হইয়াছিল। মুষিকান্‌দের দেশে স্বর্ণ রৌপ্যের খনি বর্ত্তমান থাকিলেও, তাহারা ইহার ব্যবহার করিত না, সুতরাং অর্থজনিত, দুশ্চিন্তা, নিরানন্দ, হিংসা, দ্বেষ, তাহাদিগকে অধিকার করিতে সমর্থ হইত না। সে কালে স্পার্টা প্রভৃতি স্থানে, যেরূপ দাস প্রথার প্রচলন ছিল, আমাদের ভারতে তাহা দেখিতে না পাইয়া, গ্রীকগণ বিস্মিত হইয়াছিল। মুষিকান দেশের যুবকেরা কৃষিকার্য্য সম্পন্ন করিত। স্পার্টানরা যেরূপ সকলে মিলিত হইয়া সাধারণ ভোজনাগারে ভোজন করিত, সেইরূপ বোধ হয় মুষিকান্‌দিগকে ভোজ উপলক্ষে সকলকে একত্র ভোজন করিতে দেখিয়া, বৈদেশিকগণ ইহাদিগকে স্পাটানদিগের সহিত তুলনা করিয়া থাকিবেন। যে সমাজের লোক সকল সংযতচিত্ত, সে সমাজে আইন আদালতের দরকার হয় না। তাই গ্রীক গণ, ইহাদিগের মধ্যে আইনের বাহুল্য দেখিতে পান নাই। নরহত্যা আদি উগ্র অপরাধের জন্যই দোষী রাজদ্বারে আনীত হইত। বলা বাহুল্য যে এরূপ ঘৃণিত কার্য্য ক্কচিৎ অনুষ্ঠিত হইত। আমাদের ভারতবর্ষ ব্যতীত, এরূপ রাজ্যপ্রণালী পৃথিবীর অন্যত্র সম্পূর্ণ অসম্ভব।

 মুষিকান্‌দিগের অধীশ্বর, পরের পদানত হইবার শিক্ষা কখন প্রাপ্ত হন নাই। তাই তিনি অলিক সন্দরের পদতলে উপহার লইয়া লুন্ঠিত হন নাই। অলিকসন্দর, প্রবল পরাক্রান্ত মুষিকান্ অধিপকে আগমন করিতে না দেখিয়া শঙ্কিত হইলেন। পাছে তিনি প্রস্তুত হইয়া তাঁহার গমন পথে বাধা প্রদান করেন, এই ভাবিয়া যুদ্ধশাস্ত্রের মর্ম্মজ্ঞ মহাবীর অলিকসন্দর, অতি দ্রুতগতিতে তাঁহার সীমান্ত প্রদেশে আগমন সংবাদ পৌছিবার পূর্ব্বেই, মুষিকানদিগের রাজধানী আক্রমণ করেন। অপ্রস্তুত সৈন্ধবগণ, বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের ন্যায় কিংকর্ত্তব্য বিমূঢ় হইয়া পড়ে। এরূপ অবস্থায় তাহারা বিদেশীর বশ্যতা স্বীকার করিয়া, ভবিষ্যৎ কার্য্যপ্রণালী স্থির করিবার জন্য অবকাশ গ্রহণ করেন। অলিকসন্দর ইহাঁদিগের রাজধানী এবং নানাপ্রকার শষ্যে ও ফলমূলে পরিপূর্ণ রাজ্য দেখিয়া, অত্যন্ত প্রীতিলাভ করিয়াছিলেন। এ স্থান পরিত্যাগ করিবার পূর্ব্বে; অলিকসন্দর, নিকটবর্ত্তী প্রদেশের অধিবাসীগণকে বিভীষিকাগ্রস্ত করিবার জন্য, স্থানীয় দুর্গ সুদৃঢ় করিয়া কতকগুলি সৈন্য এস্থানে রক্ষা করেন।

 মুষিকান্‌গণকে অধীনে আনয়ন করিয়া এরিয়ান বলেন, অলিকসন্দর, অক্ষিকানস্ (Oxykanos) এর বিরুদ্ধে গমন করেন। অক্ষিকান, বিদেশীর বশ্যতা স্বীকার, অথবা দূত প্রেরণ করিয়া তাঁহার সম্বর্দ্ধনা করেন নাই, তাই অলিকসন্দর, ইহাঁর শাসিত প্রদেশ অধিকার করিবার জন্য আগমন করেন। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হইয়াছিল, বীরবর অলিকসন্দর, ক্ষিপ্রকারিতা সহকারে দুইটি নগর হস্তগত করেন দ্বিতীয় নগর রক্ষাকালে অক্ষিকানরা ঘোরতর যুদ্ধ করিয়া অলিকসন্দরের হস্তে বন্দী হন। এই সকল নগর লুণ্ঠন করিয়া অলিকসন্দর যে সকল দ্রব্য প্রাপ্ত হইলেন, হস্তী ব্যতীত সমস্ত দ্রব্য সৈন্যগণ মধ্যে বণ্টন করিয়া দেন।

 কুর্ত্তিয়স্‌ বলেন, অলিকসন্দর মুষিকানিগণকে পরাজয় করিয়া, প্রয়স্তি (Praesti) নামক জাতির বিরুদ্ধে গমন করেন। প্রয়স্তিপতি পোর্ত্তিকানস (Porticanus) একটি সুদৃঢ় নগরে আশ্রয় লইয়া আত্মরক্ষা করেন। অলিকসন্দর তিন দিন এই নগর অবরোধ করিয়া ও হস্তগত করিতে সমর্থ হন নাই। তারপর কোন রূপে ইহা হস্তগত করিতে পারিলেও, নগরবাসীরা দুর্গমধ্যে গমন করিয়া আবার যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করেন। দুর্গবাসীরা সন্ধি সংস্থাপনের চেষ্টা করিলেও, তাহারা সফলকাম হয় নাই। দুর্গ রক্ষা, এবং গ্রহণ করিবার জন্য ভারতবাসী ও মাসিদনগণ, যখন অসীম বীরত্বের সহিত কর্ত্তব্য সম্পাদন করিতেছিল, সে সময় দুর্গের বুরুজ ভীষণ শব্দ করিয়া, ভূপতিত হয়। মাসিদনগণ উন্মত্তের ন্যায় সেই স্থান দিয়া প্রবেশ করিয়া ভারতবাসীর সহিত ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। এই দারুণসংগ্রামে মহাবীর পোর্ত্তিকানস, স্বদেশ রক্ষা করিবার জন্য অসি হস্তে যুদ্ধ করিতে করিতে এই নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করিয়া সুরলোকে গমন করেন।

 অলিকসন্দর, এ প্রদেশে কিরূপ বাধা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহা তাহার ক্রোধের পরিমাণ দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারা যায়। তাঁহার ক্রোধ এরূপ পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়াছিল ষে, মনুষ্যত্ব তাঁহার নিকট হইতে দূরে পলায়ন করিয়াছিল, তিনি মন্যুময়ে পরিণত হইয়াছিলেন। নগর আক্রমণ কালে, যে সকল বালক, বালিকা, স্ত্রী ও বৃদ্ধ, যুদ্ধ করিয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয় নাই, তাহারা এরিষ্টটলের সুশিক্ষিত শিষ্যের হস্তে পতিত হইয়া, কৃতদাস রূপে বিক্রীত হইয়াছিল। ইহা করিয়াও অলিকসন্দরের হৃদয় পরিতৃপ্ত হয় নাই। তিনি আমাদেয় ভারতীয় নগর সকল অগ্নিযোগে ভস্মসাৎ, এবং ভাঙ্গিয়া ধূলিসাৎ করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর, বর্ব্বরের ন্যায় এইরূপ দারুণ কার্য্য করিয়াও, তিনি ভারতবাসীর হৃদয়ে কিঞ্চিৎমাত্রও ভীতির সঞ্চার করিতে সমর্থ হন নাই। যখন তিনি এইরূপ পৈশাচিক কার্য্যের অনু– ষ্ঠান করিয়া দিগ্বিজয়ী নাম অর্জ্জন করিতেছিলেন, সেই সময়ে মুষিকান্‌দের অধিপতি, নাম মাত্রও অধীনতা পাশ ছিন্ন করিয়া, বিদেশী বর্ব্বর শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। গ্রীক গ্রন্থকারেরা বলেন, মুষিকপতি, কৌপীনধারী ব্রাহ্মণদের উত্তেজনায় পার্থিব সুখের কথা ভুলিয়া গিয়া, স্বগীয় কীর্ত্তি রক্ষা করিবার জন্য, প্রাণপণে ঘোরতর বিক্রমে বিদেশীগণকে বিদূরিত করিবার জন্য, অব্যবস্থিত সমরের অবতারণা করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এরূপ অদ্ভুত সমর, আর কোন দেশে হইয়াছে কিনা তাহা আমরা অবগত নহি। রাজশক্তি সংরক্ষণ এবং নিজেদের সুখ স্বচ্ছন্দতার যাহাতে হানী না হয়, সে জন্য ক্লেশ সহনে অনভ্যস্ত রাজন্যবর্গ, অলিকসন্দরের শরণাপন্ন হইলেও, ব্রাহ্মণগণ দেশের জন সাধারণকে মিলিত করিয়া, যে রূপ উদ্যম, ক্লেশসহিষ্ণুতা, নিঃস্বার্থপরতা, এবং মৃত্যুভয়শূন্যতা, দেখাইয়া ছিলেন,তাহা পৃথিবীর ইতিহাসে নিতান্ত সুলভ নহে। ব্রাহ্মণগণ, গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে, গমনকরিয়া সকলকে সমুত্তেজিত করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণদের উদাহরণে অনুপ্রাণিত হইয়া, দেশের ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, সকলে মিলিত হইয়া নানাপ্রকারে, ব্যষ্টি ও সমষ্ঠি ভাবে যে যাহাতে সুবিধা পাইল, সে সেইরূপ ভাবে বৈদেশিক শ্ত্রুকে ব্যতিব্যস্ত করিতে লাগিল। ভারতবাসীরা, স্বদেশ রক্ষার জন্য শত শত সহস্র সহস্র সংখ্যায় জীবন বিসর্জ্জন করিলেও, এক মুহুর্ত্তের জন্য তাহাদিগের হৃদয়ে মৃত্যুভয় জনিত অবসাদ আসিয়া, তাহাদিগকে অবসন্ন করিতে সমর্থ হয় নাই |

 অলিকসন্দর, এইরূপ প্রতিপদে বাধাপ্রাপ্ত হইয়াও, তিনি বিমূঢ় চিত্ত হন নাই। তিনি সাম্ব (Sambo) রাজ্য আক্রমণ করিলেন। সাম্বপতি পৈত্রিক প্রাণ রক্ষার জন্য, অলিকসন্দরের শরণাপন্ন হইলেও, তাঁহার রাজ্যের অধিবাসীরা, তাঁহার আচরণ অনুকরণ করে নাই। তিনি বিদেশী শত্রুর আগমন জন্য নগর দ্বার অনর্গল করিলেও, তাঁহার প্রজাবৃন্দ নগর দ্বার রোধ করিয়া প্রচণ্ড পরাক্রমে মাসিদনদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া আপনাদিগের স্বতন্ত্রতা রক্ষা করিয়াছিল।

 অলিকসন্দর, এই প্রদেশের একটি সুদৃঢ় নগর অবরোধ করিয়া কোনরূপে হস্তগত করিতে সমর্থ না হইলে, অবশেষে তিনি সুড়ঙ্গ খনন করিয়া সসৈন্যে নগর মধ্যে আবির্ভূত হন। গ্রীক গ্রন্থকারেরা বলেন, ইহাতে ভারতবাসীরা অত্যন্ত চমৎকৃত হইয়াছিল। সম্মুখ সমরে বিফল কাম হইয়া, এইরূপে প্রতারণা করিয়া অলিকসন্দর কার্য্যে সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দরের ক্রোধ, ব্রাহ্মণদের উপর বেশী করিয়া পতিত হইয়াছিল। এই অল্প পরিমিত ভূভাগে, অল্প সময়ের মধ্যে, কত যে ব্রাহ্মণ হত্যা করিয়াছিলেন, তাহা ইয়ত্বা করা যায় না। কেহ বলেন তিনি ৮০ হাজার মনুষ্য হত্যা করিয়াছিলেন। আর কত যে ক্রীতদাস রূপে বিক্রয় করিয়াছিলেন, তাহার হিসাব কিছু পাওয়া যায় না।

 প্লুতার্ক বলেন, সাম্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যে সকল ব্রাহ্মণ, মাসিদনদিগের বিরুদ্ধে জন সাধারণকে উত্তেজিত করেন তাঁহাদিগের মধ্যে দশ জন প্রধান ব্রাহ্মণ ধৃত হইয়া, অলিকসন্দর সমীপে আনীত হন। যে সকল ব্রাহ্মণ শাস্ত্রচর্চায় জীবন অতিবাহিত করিয়াছেন, যাহারা শত্রুমিত্র ভেদ জ্ঞান না করিয়া সমস্ত ভূত গ্রামের কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন, এরূপ প্রকৃতির ব্রাহ্মণগণও স্বদেশ রক্ষার জন্য শস্ত্রপাণি হইয়াছিলেন। অদ্ভূত প্রকৃতির অলিকসন্দর, অজেয় ব্রাহ্মণগণকে সমীপে সমাগত দেখিয়া, কূট প্রশ্নে তাঁহাদিগকে পরাজয় করিতে মনস্থ করেন। তিনি ব্রাহ্মণগণকে বলিলেন, যিনি তাঁহার প্রশ্নের সদুত্তর প্রদান না করিবেন, তাঁহাকে তিনি প্রথমে হত্যা করিয়া পর্ষ্যায়ক্রমে অবশিষ্টকে নিহত করিবেন।

 অলিকসন্দর প্রথমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বহুসংখ্যক কে মৃত না জীবিত?” “মৃত্যুভয় বিরহিত উদ্বেগহীন ব্রাহ্মণ প্রত্যুত্তরে বলিলেন, “জীবিত, যেহেতু মৃত বিনষ্ট হইছে।”

 দ্বিতীয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “জলে না স্থলে, কোথায় সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ জন্তু বাস করিয়া থাকে?” উত্তরে বলিলেন, “স্থলে যেহেতু জল পৃথিবীরই অন্তর্গত।”

 তৃতীয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন প্রাণী সর্ব্বাপেক্ষা সুচতুর?” উত্তরে কহিলেন, “যাহার সহিত এখনও মানুষের পরিচয় হয় নাই।”

 চতুর্থ জিজ্ঞাসিত হইলেন, “কি জন্য তিনি সাম্বগণকে অভ্যুত্থানের জন্য উৎসাহিত করিয়াছিলেন?” প্রতুত্তরে ব্রাহ্মণ অবিকৃত বদনে বলিলেন, “আমার ইচ্ছা তাহারা মর্য্যাদার সহিত জীবিত থাকুক, অথবা মর্য্যাদার সহিত মৃতুকে আলিঙ্গণ করুক্।”

 পঞ্চমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্রথমে কি হইয়াছে, দিবা না রাত্র?” প্রত্যুত্তরে ব্রাহ্মণ বলিলেন “দিবাই প্রথমে অহোরাত্রের মধ্যে “অলিকসন্দরকে বিস্ময় প্রকাশ করিতে দেখিয়া ব্রাহ্মণ বলিলেন, অসম্ভব প্রশ্নের অবম্ভব উত্তর হইয়া থাকে।”

 অলিকসন্দর ষষ্ঠের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “মানুষ কেমন করিয়া সকলের প্রিয়পাত্র হইতে পারে?” প্রত্যুত্তরে বলিলেন, “যদি তিনি শক্তিশালী হন, তাহা হইলে যাহাতে তিনি লোকের ভয়ের কারণ না হন এরূপ আচরণ করিলে।” অবশিষ্ট তিন জনের একজনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মানুষ কেমন করিয়া দেবতা হইতে পারে?” উত্তরে ব্রাহ্মণ বলিলেন, “যাহা মানুষের অসাধ্য এরূপ কার্য্য করিতে পারিলে।”

 তারপরের কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “জীবন ও মরণ এই দুইটির মধ্যে কোনটি কঠিন?” প্রত্যুত্তরে বলিলেন, “জীবন” যেহেতু ইহা নানাপ্রকার বিপদে পরিপূর্ণ।

 অলিকসন্দর, নবম ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলেন “কতদিন জীবিত থাকা মানুষের পক্ষে সম্মানের বিষয়?” ব্রাহ্মণ বলিলেন, “যতদিন মানুষ বাঁচিবার পরিবর্ত্তে মৃত্যু কামনা না করে।”

 অলিকসন্দর, দশম ব্যক্তি, যিনি মধ্যস্থ হইয়াছিলেন, তাঁহার দিকে তাকাইয়া এই সকল উত্তর সম্বন্ধে তাহার অভিপ্রায় জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বলিলেন, “প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অপেক্ষা অপকৃষ্ট উত্তর প্রদান করিয়াছেন।” এ কথা শুনিয়া,অলিকসন্দর বলিলেন, “যদি আপনার এইরূপই মন্তব্য হয়, তাহা হইলে আপনাকেই সর্ব্বপ্রথমে প্রাণ প্রদান করিতে হইবে।” ইহা শুনিয়া ব্রাহ্মণ বলিলেন, রাজন্‌! এরূপ কখনই হইতে পারে না। আপনার কথা যদি অসত্য না হয়, তাহা হইলে আপনি যে বলিয়াছেন, যে খারাপ উত্তর দিবে সেই ব্যক্তিকেই সর্ব্বপ্রথমে মরিতে হইবে।” সেই সকল মৃত্যুভয়-বিরহিত ব্রাহ্মণগণকে, প্লতার্ক বলেন, অলিকসন্দর, উপহার প্রদান করিয়া গৃহে পাঠাইয়া দেন। চিরকাল প্রধূমিত হওয়া অপেক্ষা, একবার প্রজ্বলিত হইয়া ভস্মীভূত হওয়া সহস্রাংশে শ্রেয়স্কর বিবেচনা করিয়া, মুষিকগণের অধিপতি বিদেশী বন্ধন ছিন্ন ভিন্ন করিয়া অস্ত্রধারণ করেন। গ্রীক গ্রন্থকার বলেন, তিনি ব্রাহ্মণদের পরামর্শে অলিকসন্দরকে এদেশ হইতে দূর করিয়া দিবার জন্য, স্বদেশের সম্মান রক্ষার জন্য, ঘোরতর বিক্রমে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। অলিকসন্দর, মুষিকপতির অভ্যুত্থানের কথা অবগত হইয়া, সেই প্রদেশের নবীন ছত্রপ (Satrap) পিথনকে উপযুক্ত সৈন্যসহ তাঁহাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। উভয় পক্ষে তুমুল সংগ্রামের অভিনয় হইল। যবন ও হিন্দু উভয়েই পরস্পরকে পরাভব করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কুনৃপতির রাজ্য যেরূপ দুর্ভিক্ষ, মহামারি এবং দস্যু কর্তৃক প্রপীড়িত হয়[] সেইরূপ অলিকসন্দর বাহিনী, নগর সকলকে ধূলিসাৎ—দুর্ব্বলগণকে কৃতদাস, এবং যোদ্ধাগণকে ভূমিসাৎ করিয়াছিল। ভারতবাসীর হস্তে তাঁহারা কোন্ গতিকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, সে বিষয় বিদেশী গ্রন্থকার একেবারে নীরব, সুতরাং সে বিষয় আমরা কিছু বলিতে পারিলাম না। সেনানী পিথন, মুষিকপতি এবং অনেকগুলি ব্রাহ্মণকে হস্তগত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তাঁহাদিগকে বন্দী করিয়া অলিকসন্দরের সমীপে আনয়ন করিলে, তিনি হিন্দু বীরগণকে তাহাদের নগরে কীলকবিদ্ধ করিয়া হত্যা করিতে প্রেরণ করেন। এইরূপ কত শত ব্যক্তি যে, এইরূপে এই নশ্বর শরীর পরিত্যাগ করিয়াছিলেন তাহার ইয়ত্তা নাই। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, এইরূপে শত শত, সহস্র সহস্র, ব্যক্তি নিহত হইলেও তাহারা বিদেশী শত্রুকে বাধা দিতে কিছু মাত্র ত্রুটি করে নাই।

 পটল অভিমুখে গমন কালে, ব্রাহ্মণদের দেশের শেষ সীমায়, ডিওডোরস বলেন, দুর্গমপ্রদেশে হর্ম্মতলা (Harmatelia) নামে একটি নগর ছিল। বলা বাহুল্য যে, তাহারা মেষের দলের উদাহরণ অনুকরণ করিয়া, অলিকসন্দরের শরণাপন্ন হন নাই। তাঁহারা নিজেদের বাহু বলের উপর নির্ভর করিয়া স্বতন্ত্রতা রক্ষা করিয়াছিলেন। অলিকসন্দর, কতকগুলি সৈন্য ইহাদিগের বিরূদ্ধে প্রেরণ করেন। হিন্দু বীরগণ, শত্রুকে আগমন করিতে দেখিয়া নগর হইতে বহির্গত হইয়া ঘোরতর বিক্রমে তাহাদিগকে আক্রমণ করিলেন, মাসিদনগণ বিপক্ষ প্রহারে জর্জ্জরিত হইয়া রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করেন। বিদেশী গ্রন্থকারেরা বলেন, মাসিদনেরা পলায়ন করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু সে ভয়ে নহে, যুদ্ধনীতি অনুসরণ করিয়া। সে যাহাই হউক, অলিকসন্দর উপস্থিত হইয়া যুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। উভয় পক্ষে ঘোরতর সমর প্রজ্বলিত হইল। কতক গুলি ভারতবাসী যুদ্ধে নিহত ও বন্দী হইল। ভারতবাসীর শাণিত অস্ত্রপ্রহারে মাসিদনরা ও যমলোকের অতিথি হইল যাহার শরীরে তলবারের একটু সামান্য আঁচড়ও লাগিয়াছিল সেও দারুণ যন্ত্রণা ভোগ করিয়া মৃত্যু মুখে পতিত হইতে লাগিল। চিকিৎসকেরা ইহার কোনরূপ প্রতিকার করিতে পারিলেন না। ভারতবাসীরা, সর্পের দারুণ বিষ অস্ত্রে লাগাইয়া, এই নিদারুণ শত্রুর হস্ত হইতে নিস্কৃতি পাইবার জন্য এই উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন। অলিকসন্দর সকলের অগ্রে অবস্থান করিয়া যুদ্ধ করিয়া থাকেন, সুতরাং কোন রূপে তাঁহাকে এই বিষদিগ্ধ অস্ত্রে আহত করিতে পারিলে, সমস্ত ক্লেশের অবসান হইবে বিবেচনা করিয়াছিলেন, ভারতবাসীর আশাপূর্ণ হয় নাই। অলিকসন্দরের বাল্য সহচর ও বিশ্বস্ত সেনানী তুরময়, ইহাতে আহত হইয়া, মৃতবৎ পতিত হইলেন অলিকসন্দর ব্যহিত হইলেন, পনাহার পরিত্যাগ করিয়া বন্ধুর পার্শ্বে অবস্থান করিতে লাগিলেন, বিষাদের চিহ্ন, সকলের মুখে স্পষ্ট রূপে প্রকাশ পাইতে লাগিল। অনেকে বলেন, এ সময় ক্ষিন্ন অলিকসন্দর, নিদ্রিত হইলে স্বপ্নে ঔষধ পাইয়াছিলেন, আবার কেহ বলেন একজন স্বদেশদ্রোহী ভারতবাসী অর্থলোভে মুগ্ধ হইয়া ইহার ঔষধ বলিয়া দেন, অলিকসন্দর নিজের মহিমা প্রচার করিবার জন্য, স্বপ্ন বৃত্তান্ত লোকসমাজে প্রচার করেন। এই ঔষধে তুরময় আরোগ্য লাভ করিলেন, এবং অন্যান্য আহত ব্যক্তি তখনও যাহারা মৃত্যুমুখে পতিত হয় নাই তাহারাও নিরাময় হইল।

 দৈব যখন প্রতিকূল হন, তখন মানুষের সমস্ত পুরুষার্থ বিফল হইয়া যায়। অব্যর্থ কূটনীতি অবলম্বন করিয়া যুদ্ধ করিলেও সমস্ত ব্যর্থ হইয়া গেল। ব্যর্থ হইলেও কিন্তু তাঁহাদের পুরুষকারের ফল ফলিয়াছিল। অলিকসন্দর, এরূপ দারুণ দুর্দ্দমনীয় শত্রুর উপর কোন রূপ দণ্ড প্রয়োগ না করিয়া সম্ভবতঃ মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিয়া থাকিবেন।

 অলিকসন্দর যে সময় মুষিকদের রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া দক্ষিণাভিমুখে গমন করিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, সেই সময়ে পটল দেশের মহারাজের (Moeres) নিকট হইতে দূত আসিয়া বশ্যতা স্বীকার করেন। অলিকসন্দর, দূতকে সম্মানের সহিত গ্রহণ করিয়া, তাঁহার যাত্রার সাহায্য করিবার জন্য আদেশ করিয়া তাহাকে স্বদেশে পাঠাইয়া দেন।

 পাঠকের বোধ হয় স্মরণ আছে যে, অলিকসন্দর ইতিপূর্ব্বে তাঁহার কৃতি সেনাপতি ক্রিতিরসকে, আমাদের দেশে ডাকাতি করিয়া যে সকল দ্রব্য প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, সেই সকল দ্রব্যের সহিত সমস্ত হস্তীও, অকর্ম্মণ্য এবং কতকগুলি কর্ম্মঠ সৈন্য, স্বদেশাভিমুখে প্রেরণ করেন। মুষিকগণের উৎপাতে ব্যাপার গুরুতর হওয়াতে অলিকসন্দরের ইচ্ছা এত দিন কার্য্যে পরিণত হয় নাই। মুষিক বিভ্রাট হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য, ক্রিতিরস কিছু দূর গমন করিলে, তিনি তাঁহাকে আবার ডাকিয়া পাঠান। সমস্ত শক্তি মিলিত হইলে, তবে অলিকসন্দর প্রবল পরাক্রান্ত মুষিকগণের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। অলিকসন্দর, এখন কোন রূপে একটু নিষ্কৃতি লাভ করিয়া, এত কষ্টের লুন্ঠিত দ্রব্য সকল পাছে, আবার ভারতবাসীর হস্তে পতিত হয়, সম্ভবতঃ এই ভাবিয়া তাহা স্বদেশে শীঘ্র শীঘ্র প্রেরণ করেন।

 অলিকসন্দর আবার অগ্রসর হইতে লাগিলেন, পাছে হিন্দুরা অকস্মাৎ আক্রমণ করিয়া সমস্ত ধ্বংস করিয়া ফেলে, এজন্য সিন্ধু নদের উভয় কুলে পূর্ব্বের ন্যায় সৈন্য সকল গমন করিতে লাগিল, যে সকল স্থান অধীনে থাকিলে, আত্মরক্ষার পক্ষে সুবিধা সম্পাদন করে, এরূপ স্থলে কিছু কিছু সৈন্য রক্ষিত হইয়াছিল। অলিকসন্দর নির্ব্বিঘ্নে পটলে (Patala) পৌছিলে পর পশ্চাদবর্তী সৈন্য সকল আগমন করিয়াছিল। গ্রীক গ্রন্থে এ সকল প্রদেশের কথা এত সংক্ষেপে কথিত হইয়াছে যে, তাহাতে বোধ হয় অলিকসন্দর এ প্রদেশে উত্তম মধ্যম খুব ভাল রূপই শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

 প্রাচীন পটল কোথায় ছিল, বর্ত্তমান কালে তাহা স্থির করা অসম্ভব,অনেকের ধারণা সুপ্রাচীন ব্রাহ্মণাবাদে, অথবা ইহার নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে প্রাচীন পটল অবস্থিত ছিল। বর্ত্তমান মনসুরিয়া নগরের প্রায় তিন ক্রোশ পশ্চিমে ব্রাহ্মণাবাদের ভগ্ন চিহ্ন পুঞ্জাকারে পতিত রহিয়াছে। ইয়ুরোপীয় ইতিহাসের অতীত যুগের বহু চিহ্ন এখনও এস্থানের ভূগর্ভে নিহিত আছে বলিয়া অনেকে মনে করেন।

 অলিকসন্দর নৌপথে তিন দিন গমন করিবার পর, পটলের নিকটবর্ত্তী হইলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন, এদেশের অধিবাসীরা —স্বাধীন প্রকৃতির অধিবাসী না হইতে পারে— এদেশের অধীশ্বর তাঁহার অভ্যর্থনার জন্য নানারূপ আয়োজন করিয়াছেন। আসিয়া যাহা, দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার সে ভ্রম দূর হইল। গ্রাম ও নগর জনপ্রাণীবিহীন কান্তারে পরিণত হইয়াছে। ক্ষেত্র ও উদ্যান, নানাপ্রকার শস্য ও ফলপুষ্পে সুশোভিত হইলেও, তাহাতে লোক নাই। রমণীয় গৃহ সকল নানাপ্রকার সাজসজ্জায় বিভূষিত হইলেও, তাহাতে মনুষ্য না থাকায় যেন মায়ানগর বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। এরিয়ান বলেন, অলিকসন্দর দেশের অবস্থা দেখিয়া, কতকগুলি সৈন্য দেশের অভ্যন্তরভাগে প্রেরণ করেন। তাহারা অধিবাসীগণকে অভয় দিয়া নগরে প্রত্যাগমন করিতে অনুরোধ করেন। বৈদেশিক গ্রন্থকারেরা বলেন, অনেকেই ইহাতে নগরে প্রত্যাগমন করেন। একথা কতদূর সত্য, সে বিষয় সন্দেহ উপস্থিত হইয়া থাকে। এই এরিয়ান স্থানান্তরে বলিয়াছেন যে, এদেশের জলপথের জ্ঞান না থাকায় অলিকসন্দর পথ পরিদর্শক সংগ্রহ করিবার জন্য দেশের ভিতরে লোক ধরিতে সৈন্য পাঠান।

 অলিকসন্দর, পটলের সামরিক আড্ডার অনুকুল ভৌগোলিক সংস্থান দেখিয়া এ স্থানে সুদৃঢ় বন্দর ও পোতাশ্রয় নির্ম্মাণ করিয়া ইহাকে বিশেষরূপে উপযোগী করিয়াছিলেন। ইহার নিকটবর্ত্তী প্রদেশে পেয় জলের অভাব থাকায় অলিকসন্দর কতকগুলি লোককে কূপ খনন করিবার জন্য প্রেরণ করেন। এদেশ বাসীর আক্রমণে, তাহার কার্য্য সমাধা করিবার পূর্ব্বে যমলোকের অতিথি হইয়াছিল। অলিকসন্দর এই ঘটনা অবগত হইলে, আরো বেশী লোক তাহাদের সাহায্যের জন্য প্রেরণ করিয়া কার্য্য সম্পন্ন করান। এ দেশের লোকেদের বেশী কিছু করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। তাহারা মরুভূমিতে আশ্রয় লইয়া আত্মরক্ষা করিয়াছিল।

 মনুষ্যের ব্যক্তিগত চরিত্রের ন্যায়, জাতীয় চরিত্র, উভয়েই অনেক সময় একই প্রকার গতি অবলম্বন করিয়া থাকে। ক্লীবভাবাপন্ন দুর্ব্বল ব্যক্তিরা, অত্যাচারী আততায়ীর যে হস্তে, নিগৃহীত, লাঞ্ছিত ও উৎসাদিত হইয়াছে, সেই শত্রুর প্রথম আক্রমণেই, তাহাকে বাধা দিবার সমস্ত সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিয়া, সেই হস্তে, আগ্রহের সহিত চন্দনচর্চ্চিত করিবার জন্য অগ্রসর হইয়া থাকে। আর যাহারা তাহাকে প্রবলপরাক্রমে বাধা দিবার জন্য প্রতিপদে অকাতরে শোণিত পাত করিয়া থাকেন, এক শ্রেণীর স্বদেশবাসী, তাহাদিগের দুর্ব্বলতারবিষয় সেই অত্যাচারীর জ্ঞানগোচর করিয়া নিজের ক্লীবত্ব প্রকাশ করিয়া থাকে। অপর পক্ষে, পুরুষ প্রকৃতির দেব চরিত্রের দৃঢ়চেতাগণ, স্বেচ্ছাচারী শত্রুর অত্যাচার হইতে দেশকে রক্ষা করিবার জন্য, সমস্ত কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া, সর্ব্বতোভাবে তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়া আত্মশক্তি অক্ষুণ্ণ রাখিবার চেষ্টা করিয়া থাকেন। অত্যাচারীর আচরণ যতই উগ্রতর হয়, তাঁহাদিগের বাধা দিবার দুর্দ্দমনীয় শক্তি ততই বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। তাঁহারা সর্ব্বোভাবে উৎপীড়িত হইলেও, আত্যাচারীর বিরুদ্ধে হস্তোত্তলন করিতে কোন ক্রমেই বিরত হন না। সকল সময় বাধাপ্রদান করিতে সমর্থ না হইলে, সকলপ্রকারে তাহার সংস্রব পরিত্যাগ করিয়া দূরতর প্রদেশে অবস্থান করেন। এবং উপযুক্ত সুযোগ প্রাপ্ত হইলেই ভীম পরাক্রমে, শত্রুর উপর আপতিত হইয়া তাহাকে সমূলে ধ্বংস করিতে চেষ্টা করিয়া থাকেন। আমাদের স্বদেশবাসীরা অধিকাংশ স্থলে শেষের প্রকৃতি অবলম্বন করিয়াছিলেন।

 পটলের নিকটে, সিন্ধু দুইভাগে বিভক্ত হইয়া, সমুদ্রাভিমুখে প্রবাহিত হইয়াছে। অলিকসন্দর, সিন্ধুর গতি এবং কতদূরে সমুদ্রে মিলিত হইয়াছেন, ইহা স্বচক্ষে দেখিবার জন্য, দক্ষিণ প্রবাহ অবলম্বন করিয়া নৌকাযোগে গমন করেন। সেনানী লিওনেটস কিছু সৈন্য লইয়া স্থলপথে এই নৌবাহিনীকে অনুগমন করিতে আদিষ্ট ইন। জলপথ না জানার জন্য তাঁহাদিগকে বড় কম ক্লেশভোগ করিতে হয় নাই। স্থানীয় লোক সকল বৈদেশিকদিগের আগমনের পূর্ব্বেই, স্থান ত্যাগ করিয়া গমন করিয়াছিল। সুতরাং তাঁহারা এই অজ্ঞাত পথে বিপন্ন হইয়াছিলেন। পটল পরিত্যাগের দ্বিতীয় দিবসে, প্রবল ঝড়বৃষ্টীতে তাহাদের ক্লেশের মাত্রাকে অধিকতর বৃদ্ধি করিয়াছিল। ইহার প্রকোপে অলিকসন্দরের কতগুলি নৌকা চূর্ণ বিচূর্ণ, আর কতকগুলি ভাঙ্গিয়া যায়। এই বিপদের উপর আর একটি অচিন্তনীয় ঘটনায় মাসিদনগণকে বিস্ময়ে অভিভূত করিয়াছিল। সমুদ্র জলের হ্রাস বৃদ্ধি, ভূমধ্যসাগরে পরিলক্ষিত হয় না। সুতরাং জোয়ার ভাঁটার বিষয় গ্রীকদিগের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। সিন্ধুনদের প্রবল জোয়ারে অলিকসন্দরের নৌবাহিনী ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, পরস্পরের ঘাতপ্রতিঘাতে ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। জোয়ারের জল বৃদ্ধি দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিল। অলিকসন্দর ভগ্ন নৌকা মেরামত করিয়া অগ্রসর হইয়াছিলেন। সিন্ধুর মোহনাতে কিলৌতা নামক একটী দ্বীপ তাহারা দেখিতে পাইয়াছিল। সেই দ্বীপে সুবিস্তৃত অনেকগুলি পোতাশ্রয় স্থল ছিল, অলিকসন্দর তাঁহার নৌকা সকল তথায় রক্ষা করিতে আজ্ঞা দিয়া স্বয়ং দ্রুতগামী কয়েক খানি নৌকা লইয়া বাহির সমুদ্র দেখিতে অগ্রসর হন। আর একটা দ্বীপ তাঁহারা দেখিতে পাইয়াছিলেন। এখানে অলিকসন্দর যাহাতে নির্ব্বিঘ্নে তাঁহার নৌবাহিনী পারস্য উপকূলে পৌঁছিতে সমর্থ হয়, সেই অভিপ্রায়ে পূজা ও দেবোদ্দেশে বষোৎসর্গ করিয়া স্বর্ণপাত্র সহ তাহা সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন।

 সমুদ্রের উপকূলবর্তী প্রদেশ পর্যবেক্ষণ করিয়া অলিকসন্দর আবার পটলেপ্রত্যাগমন করিলেন। প্রত্যাগমন করিয়া দেখিলেন পোতাশ্রয় এবং পোত নির্ম্মাণ স্থলের নির্ম্মাণ কার্য্য, অনেকদূর অগ্রসর হইয়াছে, পিথনও সদলবলে দেশের আভ্যন্তরিক অবস্থা পরিদর্শন করিয়া প্রত্যাগমন করিয়াছেন। সিন্ধুর যে প্রবাহ বামদিকে সমুদ্রাভিমুখে প্রবাহিত হইয়াছে, অলিকসন্দর সেই প্রবাহ অবলম্বন করিয়া সমুদ্রাভিমুখে গমন করেন। এরিয়ান বলেন, এদিকের রাস্তা অপেক্ষাকৃত সুগম। সিন্ধু সঙ্গমের নিকট, একটী বৃহৎ হ্রদ অলিকসন্দর দেখিতে পাইয়াছিলেন। এখানকার সমুদ্রে তাঁহারা অদৃষ্টপূর্ব্ব বৃহৎ বৃহৎ মৎস্য দেখিতে পাইয়াছিলেন। অলিক সন্দর, লিওনিটসকে সমুদ্রের তট দিয়া গমন করিতে আদেশ দিয়া স্বয়ং নৌকাযোগে গমন করিয়া জলপথ সকল পরিদর্শন করেন। জলপথের সুগমতা দেখিয়া অলিকসন্দর যথেষ্ট প্রীত হইয়াছিলেন। লিওনিটস, তিন দিনের পথ অতিক্রমণ করিয়া নৌবাহিনীর পেয়জলের জন্য স্থানে স্থানে কূপ খনন করিতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন। এ সকল কথা কতদূর সত্য সে বিষয় যথেষ্ট সন্দেহ উপস্থিত হইয়া থাকে। যাঁহারা এপ্রদেশের অবস্থা পরিজ্ঞাত আছেন, তাঁহারাই জানেন, ইহা কিরূপ দুর্গম ও ক্লেশপ্রদ স্থান। বর্ষাকালে এই সকল জলপ্রবাহে, বহুল প্রদেশ জলে পরিপূর্ণ হইয়া থাকে; সে সময় এ প্রদেশে অশ্বারোহণ করিয়া গমন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আর এক কথা, এ সকল প্রদেশে তাহারা যে কুপ খনন করাইয়াছিলেন, এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা যাইতে পারে না। এ সকল প্রদেশ সমুদ্র অপেক্ষাও কিছু নিচু, জোয়ার হইলেই সমস্ত ভূমি ডুবিয়া গিয়া থাকে। কতিপয় বৎসর পূর্ব্বে এ প্রদেশে লবণ প্রস্তুত করিবার জন্য উদ্যোগ করা হইয়াছিল। শ্রমজীবীদের পানের জন্য এক বিন্দু পরিমিত জল ও এস্থানে প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। দূরতর স্থান হইতে নৌকা করিয়া জল আনিতে হইত। এরূপ কত মিথ্যা কথা লিপিবদ্ধ করিয়া, তাঁহারা স্বদেশবাসীর গৌরববৃদ্ধি করিয়াছেন তাহা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন।

 অলিক সন্দর, পটলে প্রত্যাগমন করিয়া, পূর্ব্ব কথিত হ্রদের তটে, একটি পোতাশ্রয় এবং সমুদ্রের তীরে আরো অধিক সংখ্যক কূপ খনন করিবার জন্য, কতকগুলি লোক প্রেরণ করেন। ইহা অসম্ভব মিথ্যা বলিয়া এ স্থলে উল্লেখ করা গেল।

 অলিকসন্দর পটলে উপস্থিত হইয়া, স্বদেশে প্রত্যাগমণের জন্য উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। তাঁহার বাল্যসহচর নিয়ার্কসের অধ্যক্ষতায় নৌকা সকল সমুদ্রপথে পারস্য উপসাগরে পাঠাইবার আয়োজন করিলেন। এ পথের কথা গ্রীকদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত হইলেও, আমাদের দেশের নাবিকদের অজ্ঞাত ছিল বলিয়া বোধ হয় না। আমাদের দেশবাসীর কৃপায় যে তাঁহারা, স্বদেশে গমন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, এ কথা সম্ভবতঃ তাঁহারা ইচ্ছা করিয়া উল্লেখ করেন নাই। পাঠকের বোধ হয় স্মরণ আছে যে, অলিকসন্দর ইতিপূর্ব্বে যে সময় সিন্ধুর মেহনায় গমন করিয়া যে দ্বীপ দেখিয়াছিলেন, তাহাতে অনেকগুলি পোতাশ্রয় দেখিতে পান; এবং সে সকল স্থলে নিজেদের জাহাজ রাখিয়া দিয়াছিলেন। দূর সমুদ্রে গমনাগমন না করিলে কখন এরূপ স্থলে পোতাশ্রয় নির্ম্মিত হয় না; ইহা ব্যতীত অলিকসন্দরের প্রায় একশত বৎসর পরে, একজন গ্রীক লেখক(Agatharchides) বলেন, আরবের বন্দর সমূহে এসিয়ার যত জাহাজ জন্য আগমন করে। তাহার মধ্যে, অলিকসন্দরের সংস্থাপিত পোটান (Potana) নামক বন্দর হইতে অধিকাংশ জাহাজই আগমন করিয়া থাকে। এই উক্তিতে যৎসামান্য ভ্রম পরিলক্ষিত হইলেও, এই পোটনা আমাদের পটল ব্যতীত অন্য কোন স্থান হইতে পারে না। এই সমুদ্রপথ আমাদের নাবিকদের সুপরিজ্ঞাত ছিল। বিদেশী শত্রুরা কখনই অজ্ঞাত পথ অনুসরণ করিয়া, অজ্ঞাত প্রদেশে গমন করিত না। তাই বোধ হয় যে নিয়ার্কস, আমাদের দেশের নাবিকের সাহায্যে স্বদেশাভিমুখে গমন করিতে সমর্থ হইয়া, এই ইয়ুরোপীয়দের অজ্ঞাত প্রদেশ আবিষ্কার করিয়া—এখনও পর্য্যন্ত তিনি স্বদেশবাসী ইয়ুরোপখণ্ডের লোকের কাছে ধন্যবাদ প্রাপ্ত হইতেছেন। আর আমরা যে অন্ধকারে সেই অন্ধকারেই মৃতের ন্যায় নিশ্চেষ্ট ভাবে অবস্থান করিতেছি।

 অলিকসন্দর, যে সময় স্বদেশে প্রত্যাগমনের উদ্যোগ করিতেছিলেন, সে সময় তাঁহার কিরূপ অর্থ-কষ্ট উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা নিম্নের ঘটনায় বেশ বুঝিতে পারা যায়। ভারতবর্য লুট করিতে আসিয়া অর্থ-কষ্টের কথা বড়ই অসম্ভব। জানি না কোন অসম্ভবকে ভারতবাসীরা সম্ভবে পরিণত করিয়া অলিকসন্দরের এই দারুণ অভাবকে আনয়ন করিয়াছিলেন। তাহা বিদেশীরা কিছুমাত্র উল্লেখ করেন নাই, সুতরাং আমাদিগকেও এ বিষয় নিরবে অবস্থান করিতে বাধ্য হইতে হইয়াছে। নায়কের গৌরব ম্লান হইবে বলিয়া, নিম্নের ঘটনাটি অলিকসন্দরের কোন চরিত্র লেখক লিপিবদ্ধ করেন নাই। প্লুতার্ক তাঁহার ইউমিনসের চরিত্রে ইহা উল্লেখ করিয়াছেন। অলিকসন্দর, অর্থ– কষ্ট দূর করিবার জন্য তাঁহার সহচরদের নিকট কিছু কিছু টাকা লইয়াছিলেন, সেক্রেটারী ইউমিনসের নিকট তিন শত টালাণ্ট চাহিয়াছিলেন, ইউমিনস অত টাকা তাঁহার নাই বলিয়া, একশত টালাণ্ট দিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন। অলিকসন্দর সে টাকা লন নাই, ফিরাইয়া দিয়াছিলেন, বুঝিলেন তাঁহাকে ইউমিনস প্রতারণা করিয়াছে। অলিকসন্দর, অনুগতের এ অপরাধ উপেক্ষা করিবার পাত্র নহেন। তিনি গোপনভাবে ভৃত্যকে দিয়া ইউনিমসের শিবিরে অগ্নি প্রদান করিলেন, দেখিতে দেখিতে সকলের সম্মুখে, ইউনিমসের শিবির ভষ্মীভূত হইয়া গেল অলিকসন্দরের যে সকল কাগজ পত্র ছিল, তাহাও ইহার সহিত পুড়িয়া গেল। সমস্ত পুড়িয়া গেলে দেখা গেল প্রায় এক সহস্র টালাণ্ট মুল্যের স্বর্ণ, রোপ্য, গলিয়া তাল বাঁধিয়া গিয়াছে। অলিকসন্দর নাকি দয়া করিয়া ইউমিনসের নিকট হইতে আর কিছুই চাহেন নাই। যে সকল কাগজ পত্র পুড়িয়া গিয়াছিল, সে সকল পূরণ করিবার জন্য অলিকসন্দর কর্ম্মচারীগণকে তাহাদের পত্রের অনুলিপি পাঠাইতে আদেশ করিয়া ইহার পূরণ করিয়াছিলেন। এই ঘটনাতে অলিকসন্দরের অবস্থা বেশ ভাল করিয়া বুঝিতে পারা যায়। ক্রোধন অলিকসন্দরের, অভাবজনিত ক্রোধের মাত্রা সীমা অতিক্রম করিয়া বর্দ্ধিত হইয়াছিল, তাই তিনি কর্ত্তব্য অকর্ত্তব্য বিচার না করিয়া অনুজীবীর শিবিরে অগ্নিপ্রদান করিয়াছিলেন। ইহাতে বেশ বুঝিতে পারা যায় যে, ভারতবাসীর হস্তে তিনি বেশ লাঞ্ছিত হইয়াছিলেন, ইহাদিগের উৎপীড়নে তিনি কর্ত্তব্য বুদ্ধি হারাইয়াছিলেন, বিপাশার তটে তিনি যেরূপ অতি বৃহৎ শয়ন-শয্যা প্রভৃতি নির্ম্মাণ করাইয়া প্রবঞ্চনা করিয়াছিলেন, সেইরূপ বোধ হয় সমুদ্র তটে পেয় জল প্রাপ্তির জন্য কূপ খনন প্রভৃতি মিথ্যাকথা লিপিবদ্ধ করাইয়া অসাধারণত্বকে লাভ করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর, বিতস্তার তটে, তাঁহার বিজয়ক্ষেত্রে যে নগর স্থাপন করিয়াছিলেন, সেইস্থান হইতে পটলে আসিতে, এরিষ্টোবুলস বলেন, দশমাস সময় অতিবাহিত হইয়াছিল। যদি কোন বাধা প্রাপ্ত না হওয়া যায়, তাহা হইলে এই পথ ১৫/২০ দিনের মধ্যে অবলীলাক্রমে অতিক্রম করা যাইতে পারে। এই ১৫/ ২০ দিনের রাস্তা অতিক্রম করিতে, অলিকসন্দরের ন্যায় মহাবীরকে সুদীর্ঘ দশমাস অতিবাহিত করিতে হইয়াছিল। এই দশমাসের মধ্যে তাঁহাদিগের দুর্দ্দশা সীমা অতিক্রম করিয়া বৃদ্ধি পাইয়া ছিল। এই দশমাসে ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের ভুজবলের দারুণ প্রভাব তাঁহারা ভালরূপেই অবগত হইয়াছিলেন। এই দশমাস ক্লেশ ভোগের পর, কোনরূপ সুফল প্রসূত হইয়াছিল কিনা, তাহা আমরা অবগত নহি, কিন্তু তাঁহাদিগের লুষ্ঠিত ধনের ভাণ্ডার, নিঃশেষ প্রায় হইয়াছিল, তাহা আমরা সুবিদিত আছি। অলিকসন্দর কীর্ত্তিক মাসে বিতস্তা তট পরিত্যাগ করিয়া শ্রাবণ মাসে পটলে উপস্থিত হইয়াছিলেন। সিন্ধু প্রদেশের দুঃসহ উত্তাপ, ভারতবাসীর মর্ম্মভেদী তীক্ষ্নশর অপেক্ষাও যে, তাঁহা দিগকে প্রপীড়িত করিয়াছিল সে বিষয় সন্দেহ নাই।

 অলিকসন্দর পটল প্রদেশে প্রায় ২০॥৹ মাসকাল অবস্থান করিয়া আশ্বিনের শেষভাগে পুনরায় গমন করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। বায়ু অনুকুল না থাকাতে নিয়ার্কস জলপথে যাত্রা করিতে সমর্থ হন নাই। অলিকসন্দরের গমনের পর আমাদের ভারতবাসীরা নিয়ার্কস প্রমুখ ইয়ুরোপীয়গণকে ঘোরতর পরাক্রমে আক্রমণ করেন। ইতিপূর্ব্বে যাহারা কোনরূপে যুদ্ধস্থলে ভারতবাসীর সম্মুখীন হইতে সমর্থ হইয়াছিল, তাহারা এক্ষণে ভারতবাণীর কাছে বিতাড়িত হইয়া পলায়নে প্রবৃত্ত হইল। নিয়ার্কসের এই পলায়ণ কথা, এরিয়ান, কুর্ত্তিস্ প্রভৃতি অলিকসন্দরের চরিত্র লেখকগণ কেহই কোনরূপ উল্লেখ না করিয়া চাপা দিয়া গিয়াছেন। খৃষ্টের সমকালের, সুবিখ্যাত লেখক ষ্টার্বো যদি এ কথা প্রকাশ না করিতেন, তাহা হইলে আমরা, বৈদেশিকগণকে আমাদের ভারতভূমি হইতে বিতাড়িত করিবার জন্য আমাদের স্বদেশবাসীরা যে ঘোরতর পরাক্রম প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহা অবগত হইতাম না। নিয়ার্কস মনে করিয়াছিলেন, বায়ু একটু অনুকুল হইলে সমুদ্রযাত্রা করিবেন; কিন্তু তাহা হইল না, তাহাকে বাধ্য হইয়া কিছুদিন আগেই যাত্রা করিতে হইয়াছিল। যাত্রার প্রথমভাগে তাঁহাকে জলঝড়ের জন্য বিপদগ্রস্ত হইতে হইয়াছিল। বর্ত্তমান করাচির কাছে তাঁহাকে ২৪ দিন অবস্থান করিতে হইয়াছিল। যে স্থানে অবস্থান করিয়াছিলেন, তাহাকে তিনি অলিকসন্দরের বন্দর নামে অভিহিত করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর দল বাঁধিয়া লুটপাট করিতে করিতে, গ্রীকদিগের আরবিয়স (Arbios) বর্ত্তমান পুরালীনদী অতিক্রম করিয়া বেলুচিস্থানের ভিতর দিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। এ সকল প্রদেশের হিন্দু অধিবাসীরা, আপনাদিগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রচণ্ডপরাক্রম প্রকাশ করিয়া মুদ্ধ করিয়াছিলেন। স্বাধীন প্রকৃতির অরিইতাইরা (Arritai) অলিকসন্দরের আগমন সংবাদ অব– গত হইয়া, তাঁহার বা সেনাদলের কোনরূপ সাহায্য প্রদান করেন নাই। এই অপরাধে সহস্র সহস্র অরিইতাই সন্মুখসমরে প্রাণত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিল। বর্তমান লাসবেলা, অরিইতাই রাজ্য। এস্থান দিয়া গমনকালে রামবাক(Rambakia) বারামবাগ (বর্ত্তমান খাইরো কোট, লিয়ারির উঃ পঃ অবস্থিত।) নামক স্থানে অবস্থান করেন। [] এস্থান দেখিয়া অলিকসন্দর প্রীত হইয়াছিলেন। এখানে একটি উপনিবেশ সংস্থাপন করিবার জন্য হিপাস্তিয়নকে আদেশ করিয়াছিলেন। এস্থান হইতে অলিকসন্দর হিঙ্গল নদেরতটে অবস্থান করিয়াছিলেন; ইহারই নিকটে আমাদের সুপ্রসিদ্ধ হিংলাজ তীর্থ। এ স্থানের দেবতা ইয়ুরোপীয় ইতিহাসের অতীতকাল হইতে সকলজাতি কর্তৃক পূজিত হইয়া ছিলেন। বর্ত্তমানকালেও হিন্দু, মুসলমান, উভয়ের কাছেই ইনি সমানভাবে পূজিত হইয়া থাকেন।

  1. কু নৃপস্য যথারাজ্যং দুর্ভিক্ষব্যাধি তস্করৈঃ।
    দ্রাব্যতে তদ্বদাপন্ন পান্ডবৈস্তব বাহিনী॥

    মহাভরত, দ্রোণপর্ব্ব ৯৫ অঃ।
  2. এই রামবাগ দেখিয়া ইয়ুরোপীয় পণ্ডিত মহাশয়েরা বড়ই বিচলিত হইয়া পড়েন। অলিকসন্দরের পূর্ব্বে যখন বেলুচিস্থানে রামবাগ স্থাপিত হইয়াছে। তখন অযোধ্যার রাম যে বহু শত বৎসর পূর্ব্বে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, সেই কথা ভাবিয়া তাঁহারা আকুলিত হন। বলা বাহুল্য যে পরশ্ব দিবস যাহারা মানুষ হইয়াছে, তাহারা বনিদি ঘরকে ছোট করিবার জন্য বড়ই ব্যতিব্যস্ত হইয়া থাকে।