ভারতে অলিকসন্দর/প্রথম ভাগ/সপ্তম অধ্যায়

সপ্তম অধ্যায়

 দেখিতে দেখিতে আবার বসন্তের আবির্ভাব হইল। অলিকসন্দরের অভিযানের প্রথম এবং জীববের একুশ বৎসর অতীত হইল। বাইস বৎসরের একটা ছেলে এসিয়াখণ্ডে যেরূপ নরহত্যার স্রোত প্রবাহিত, কত শত সহস্র, তাহার মত লোককে দুঃখ সাগরে নিমগ্ন করিয়াছিল, সেরূপ আর কেহ করিতে পারে নাই। পারমিনিও প্রভৃতি সেনানী ও সৈন্যগণ সহ অলিকসন্দর আবার যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতরণ করিলেন। গরডিয়ম পরিত্যাগ করিয়া দক্ষিণাভিমুখে গমন কালে পথিমধ্যে প্যাফলাগোমিয়া প্রদেশের দূত তাঁহার নিকট উপস্থিত হয়। এপ্রদেশ প্রচুর শক্তিশালী হইলেও, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায় লক্ষ অশ্বারোহী লইয়া যাইতে সমর্থ হইলেও, তাহারা অলিকসন্দরের ভয়প্রদ নামের প্রভাবে সম্মোহিত হইয়া পড়িল। একবার সম্মোহিত হইলে, একবার পেশল হৃদয়ে ভয় প্রবেশ করিলে, সুদৃঢ় হস্ত পদাদি ও অবসন্ন হইয়া পড়ে, তখন মানুষ নিজের শক্তি সামর্থের কথা সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়া গিয়া থাকে। বিনা অস্ত্র প্রয়োগে, এক বিন্দু রক্তপাত না করিয়া,অলিকসন্দর প্যাফলাগোনিয়াপ্রদেশ হস্তগত করিলেন। তিনি এ প্রদেশের শাসন ভার নিজের লোকের হস্তে অর্পণ করিয়া, ক্যাপাডোসিয়া অভিমুখে গমন করেন। এখানেও ভাগ্য লক্ষ্মী তাঁহার প্রতি সুপ্রসন্না হইলেন। পূর্ব্বের ন্যায় এপ্রদেশও বিনা আয়াশে তিনি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ক্যাপাডোসিয়া হইতে সিলিসিয়াতে যাইতে হইলে টরস পর্ব্বতের সঙ্কীর্ণ পথ অতিক্রমণ করিয়া গমন করিতে হয়। ইহা সমুদ্র হইতে প্রায় ৩ হাজার ৬ শত ফিট উচ্চ, এরূপ স্থল সুরক্ষিত হইলে অল্প লোকের সাহায্যে বহু সংখ্যক সৈন্যের গতি রোধ করিতে পারা যায়। পারসীকেরা, অলিকসন্দরের গতি রোধ করিবার জন্য এই সঙ্কট বর্ত্ম সুরক্ষিত করিয়াছিলেন। কোন কঠিন কার্য্য উপস্থিত হইলে অলিকসন্দর, কর্ম্মচারীদের উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতেন না। নিকটে পারমিনিওর ন্যায় অভিজ্ঞ সেনানী থাকিলে ও তিনি তাঁহার উপর একার্য্যের ভার প্রদান না করিয়া নিজেই সামান্য সৈনিকের ন্যায় সকলের অগ্রগামী হইয়া সকলকে পরিচালনা করিয়া বিপদ সমুদ্রে অবগাহন করিলেন। এরূপ করিতেন বলিয়াই তিনি সর্ব্বত্র বিজয়শ্রীলাভ করিতেন। ইহাই তাঁহার সফলতা লাভের একতম গোপনীয় রহস্য। বিপদের সম্মুখীন হইতে অভ্যস্ত না হইলে দেবতারা সুপ্রসন্ন হন না।

 যাহার নামের প্রতাপে শত্রুকূল অস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া বশ্যতা স্বীকার করিয়া থাকে, সঙ্কটবর্ত্মের প্রহরী সকল, তাঁহাকে স্বয়ং আগমন করিতে দেখিয়া বিহ্বল হইয়া পড়িল। তাহারা নিজেদের প্রাণরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হইয়া কর্ত্তব্য ভুলিয়া গিয়া পলায়নে প্রবৃত্ত হইল। অলিকসন্দর বিনা বাধায় এই দুর্গমস্থল অধিকার করিয়া সৈন্যগণসহ সিলিসিয়াতে অবতরণ করিলেন। দারার কর্ম্মচারী এসময় বিপক্ষের আক্রমণ হইতে তারসুস নগর রক্ষা করিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন। যখন তিনি শুনিলেন, সঙ্কটপথ অলিকসন্দর হস্তগত করিয়াছেন, তখন যাহাতে নগরের ধন ধান্য, শত্রুর হস্তে পতিত না হয়, সে জন্য তিনি স্বয়ং ইহা লুণ্ঠন করিতে সঙ্কল্প করেন। চরমুখে একথা অলিকসন্দরের কর্ণগোচর হইতে বিলম্ব হইল না। তিনি বিদ্যুৎগতিতে পারসীক কর্ম্মচারীর সঙ্কল্পকার্য্যে পরিণত হইবার পূর্ব্বেই, নগরের উপর বজ্রের ন্যায় আপতিত হইলেন। অলিকসন্দরের আগমন সংবাদ শুনিয়াই পারসীককর্ম্মচারী প্রাণভয়ে বিহ্বল হইয়া পলায়ন করিয়াছিলেন। অলিকসন্দর বায়ুবেগে আগমন করায় অত্যন্ত শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। সূর্য্যের উত্তাপে তাঁহার শরীর ঘর্ম্মাক্ত হইয়াছিল। তিনি কিঞ্চিৎমাত্র অপেক্ষা না করিয়া নগর মধ্যবাহিনী নদীর শীতল ও স্বচ্ছজলে অবগাহন করিয়া স্নান করিতে আরম্ভ করিলেন। ইহার ফল ফলিল, প্রবল জ্বর আসিয়া তাঁহাকে অধিকার করিল।

 ইহার সহিত অনিদ্রা, অস্থিরতা, মূর্চ্ছা, প্রভৃতি উপসর্গ আসিয়া ইহাকে অধিকতর প্রবল করিয়া তুলিল। চিকিৎসকও সঙ্গীগণ তাঁহার জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়া হতাশ হইয়া পড়িলেন। রাজবৈদ্য ফিলিপ,রাজার জীবনের আশা পরিত্যাগ করেন নাই। তিনি অনুমান করিয়াছিলেন, কোষ্ঠপরিষ্কার করাইতে পারিলে জ্বরও ইহার সহিত উপসর্গ সকল কমিয়া যাইবে। অলিকসন্দর, তাঁহাকে ঔষধ প্রস্তুত করিতে আজ্ঞা করিলেন। এই সময় পারমিনিও একখানি পত্র অলিকসন্দরের হস্তে প্রদান করেন। তাহাতে লিখিত হইয়া ছিল যে “ফিলিপ, পারস্যপতির উৎকোচে বশীভূত হইয়া ঔষধের সহিত বিষ প্রদান করিয়া প্রাণনাশ করিবে”। অলিকসন্দর পত্রপাঠ করিয়া কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না। ফিলিপ ঔষধ প্রস্তুত করিয়া আনিলে তিনি তাঁহাকে পত্রখানি পাঠ করিতে দিয়া স্বয়ং অবিকৃত বদনে ধীরে ধীরে ঔষধ পান করিতে লাগিলেন। পত্রপাঠকালে ফিলিপের মুখে কোনরূপ ভীতির লক্ষণ দেখিতে পাওয়া গেল না। ফিলিপ যে নির্দ্দোষ ইহা বুঝিতে কাহারও বাকি রহিল না। অল্প সময়ের মধ্যে অলিকসন্দর সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করেন। এ সময়ের অলিকসন্দর চরিত্র অতীব বিস্ময়জনক, তিনি বোধ হয় বিবেচনা করিয়াছিলেন, যে স্বদেশবাসীর কল্যাণ-কল্পে তিনি জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, সেই স্বদেশবাসী যদি নিজের দুইদিনের নারকীয় উন্নতির জন্য, বিপক্ষ প্রদত্ত অর্থে মোহিত হইয়া তাঁহার হত্যা চেষ্টা করেন, তাহা হইলে এরূপ অবস্থায় মৃত্যুই আলিঙ্গনের বিষয়। সেইজন্য কি তিনি নির্ভয়চিত্তে ঔষধ পান করিয়াছিলেন? সে যাহাহউক এ সময় অলিকসন্দর, তাঁহার পক্ষের লোকের উপর অটল বিশ্বাস অনন্য সাধারণ, কিছুদিন পরে এই চরিত্র কিরূপ কলুষিত ঘৃণিত ও নীচত্বকে প্রাপ্ত হইয়াছিল তাহাও দেখাবার বিষয়। নয়বৎসর পরে হিপাস্তিয়ন, জ্বরে, পঞ্চত্ব লাভ করিলে তাঁহার চিকিৎসককে অলিকসন্দর নির্দ্দয়রূপ নিহত করিয়া শমন সদনে প্রেরণ করেন!

 অনতিকাল মধ্যে, অলিকসন্দর সম্পূর্ণরূরে আরোগ্য লাভ করিলেন। তিনি পার্মিনিওকে প্রধান ২ গিরিপথ সকল পারসীকদের অধিকার করিবার পূর্ব্বে অধিকার করিতে প্ররণ করিলেন। অলিকসন্দর স্বয়ং দুর্ব্বল হইলে ও তারসুস পরিত্যাগ করিয়া আঞ্চিএলম নগর অধিকার করিয়া, সোলী নগর হস্তগত করেন। এ স্থানের নাগরিকরা পারসীকদের প্রতি আনুগত্য দেখাইত, এই অপরাধে তাহাদিগকে দুইশত রৌপ ট্যালাণ্ট অর্থাৎ আমাদের বর্ত্তমান মুদ্রায় ৭লক্ষ ২৬হাজার টাকা দণ্ড প্রদান করিতে হইয়াছিল। যে সকল সিলিসিয়াবাসী পর্ব্বতে আশ্রয় লইয়া অলিকসন্দরের প্রতিপক্ষতা করিতেছিল, তিনি তাহাদিগকে দমন করিবার জন্য এস্থান হইতে যাত্রা করেন। সপ্তাহকালের মধ্যে তিনি শত্রুগণকে পরাজিত এবং রাজব্যবহারে তাহাদিগকে তাঁহার অনুগত করিয়া সোলী নগরে প্রত্যাগমন করেন। এস্থানে অবস্থানকালে তিনি তাঁহার সেনাপতিগণের বিজয়বার্ত্তা শ্রবণ করিয়া সবিশেষ উৎফুল্ল হন। তাঁহার উৎকট রোগ হইতে আরোগ্য লাভ, এবং সেনানীগণের বিজয় লাভের জন্য তিনি এই নগরে কএকদিন উৎসবের অনুষ্ঠান করেন। ইহাতে নৃত্যগীত ও নানাপ্রকার ব্যায়াম প্রদর্শিত হইয়াছিল। এ দেশের অধিবাসীরা অলিকসন্দরের কৃপায় স্বরাজ্য শাসনের ভারপ্রাপ্ত হইয়া কৃতকৃতার্থ হইয়াছিল। এ স্থান হইতে তিনি মালুস নগরে উপস্থিত হইয়া প্রতিপক্ষগণকে দণ্ড এবং স্বপক্ষীরদিগকে সম্বর্দ্ধনা করিয়া নিজের শক্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর যে সময় বিষম জ্বরে অভিভূত হইয়া শয্যাশায়ী হইয়াছিলেন, সে সময় তাঁহার অসুখের কথা দারার কাছে নীত হইয়াছিল। দারা প্রচুর সৈন্য সঙ্গে লইয়া অলিকসন্দরকে আক্রমণ করিবার জন্য শীঘ্রগতিতে আগমন করেন। তিনি ইউফেষ্ট্রীস নদীতে নৌসেতু প্রস্তুত করিয়া বিপুল সেনাসহ উত্তীর্ণ হন। নদী পার হইতে এই বিশাল সেনার পাঁচদিন সময় অতিবাহিত হইয়াছিল। প্লুতার্কও এরিয়ান বলেন, দারার সহিত ৬লক্ষ যোদ্ধা আগমন করিয়াছিল, অপর পক্ষে ডিওডোরস্ ও জষ্টিন বলেন যে ৪ লক্ষ পদাতিক এবং এক লক্ষ অশ্বারোহী সৈন্য অলিকসন্দরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য আগমন করিয়াছিল। এই বিপুল লোকসমষ্ঠির আহার্য্য দ্রব্যাদি লইয়া যাইবার জন্যও বড় কম সংখ্যক অশ্বাদি পশুর প্রয়োজন হয় নাই। কেবল মাত্র পারস্য সম্রাটের ধনরত্ন বহন করিয়া লইয়া যাইবার জন্য ৬শত অশ্বতর এবং তিন শত উষ্ট্র নিযুক্ত হইয়াছিল। পারস্যপতি এই বিপুল বাহিনী লইয়া মসপটমিয়ার সমতলক্ষেত্রে অলিকসন্দরের সহিত বাহুবলের পরীক্ষা করিতে প্রথমতঃ মনন করিয়াছিলেন। মানুষের যখন বুদ্ধিবিপর্য্যয় উপস্থিত হইয়া থাকে, তখন সে ছোটকে বড় এবং বড়কে ছোট বিবেচনা করিয়া প্রতারিত হয়। পারস্যপতি বিবেচনা করিলেন, অলিকসন্দর তাঁহার বহুল সৈন্যসহ আগমন কথা শ্রবণ করিয়া বিভীষিকাগ্রস্ত হইয়াছেন, সুতরাং তিনি তাঁহার ভয় ভাঙ্গিবার পূর্ব্বেই তাঁহাকে আক্রমণ করিয়া সমূলে ধ্বংস করিবার জন্য অগ্রসর হইলেন। ইহার প্রতিকূলে যে কেহ পরামর্শ প্রদান করিলেন তাহা দারারুচিকর হইল না।

 সিলিসিয়াতে গমন করিতে হইলে দুইটি গিরিপথ অতিক্রম করিতে হয়। প্রথম সমুদ্রকুলবর্ত্তী সিরিয়া ঘাটি, ইহা দক্ষিণদিকে, উত্তর দিকে এমিনিক ঘাটি, ইউফেষ্ট্রীস নদীর তটবর্ত্তী ভূভাগ হইতে আগমন করিতে হইলে এই ঘাটি অতিক্রম করিতে হয়। দারা এমিনিক ঘাটি অতিক্রমণ করিয়া পর্ব্বত ও সাগরের মধ্যবর্ত্তী সংকীর্ণ ভুভাগে অবতরণ করেন। দারা মনে করিয়াছিলেন, তাঁহার এই বিপুলবাহিনী দ্বারা অলিকসন্দরের সৈন্য বেষ্টন করিয়া বন্দী করিয়া লইবেন। একটি সামান্য ঘটনা তাঁহার এই কল্পনাকে অধিকতর বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছিল। অলিকসন্দর ইতিপূর্ব্বে ইসস অধিকার করিয়া কতকগুলি রুগ্ন সৈনিক এস্থানে পরিত্যাগ করিয়া যান, দারা তাহাদিগকে অনায়াসে হস্তগত করিতে সমর্থ হইয়া নিজেকে অলিকসন্দর বিজয়ী বিবেচনা করিতে লাগিলেন। দারা যখন এইরূপ কাল্পনিক সুখে অভিভূত ছিলেন, সে সময় অলিকসন্দর দারাকে আক্রমণ করিবার জন্য, জল-ঝড়ের বাধা না মানিয়া সিরিয়াঘাটি অতিক্রমণ করিতেছিলেন। হটাৎ সৈন্যসহ দারার পশ্চাতে আগমন সংবাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন না করিয়া, অলিকসন্দর তাঁহার কতিপয় সহচর সৈন্যকে নৌকা করিয়া দেখিবার জন্য প্রেরণ করেন। তাহারা দূর হইতে দারার বিপুল সৈন্য দেখিয়া প্রত্যাগমন করিয়া সমস্ত সংবাদ প্রদান করিল। ইতিমধ্যে দারার হস্তে নিগৃহীত সৈনিকগণও অলিকসন্দরের কাছে আগমন করিয়া দারার উৎপীড়িন কথা নিবেদন কলিল

 দারার নিকটে আগমন কথা নিশ্চয়রূপে অবগত হইয়া, অলিকসন্দর তাঁহার পদাতিক অশ্বারোহী সৈন্যের সেনাপতিগণ, এবং বন্ধুভাবে সমাগত গ্রীকদলপতিগণকে আহ্বান করিয়া, তাঁহাদিগের অতীত ও বর্ত্তমান অবস্থা বুঝাইয়া দিয়া বলিলেন, “আপনারা ইতিপূর্ব্বে বহুসংখ্যক যথেষ্ট বিপজ্জনক কার্য্য সম্পন্ন করিয়া আসিয়াছেন, সেইসকল অতীত কার্য্য স্মরণ করিয়া আপনারা এক্ষণেবর্ত্তমান বিপদ উত্তীর্ণহইবার জন্য বদ্ধপরিকর হউন। এক্ষণে আপনাদিগকে, আপনাদিগের সেই পরাজিত শত্রুর সম্মুখীন হইতে হইবে। বিধাতা যেন আমাদিগের সাহায্যের জন্য দারাকে বিস্তৃত ভূমি হইতে সংকীর্ণ স্থানে আনয়ন করিয়াছেন। ইহাতে আক্রমণ করিবার পক্ষে যথেষ্ট অনুকূলতা সাধিত হইবে, অথচ দারার অগণিত সৈন্যসকল স্থানের সংকীর্ণতার জন্য যুদ্ধকালে অকর্ম্মণ্য হইয়া পড়িবে। শত্রুসৈন্য বাহুবলে বা ধৈর্য্যে তাঁহাদের সমকক্ষ কোনরূপেই হইতে পারে না—পারসীক এবং তাহাদের সাহায্যকারী অন্যান্য সৈনিকগণ ব্যসনের দাস উদ্যমবিহীন; অপর পক্ষে মামিদনের বীরগণ,বহুদিনহইতে শ্রমজনক ও বিপদপূর্ণ কার্য্যে অভ্যস্ত এবং স্বাধীন, এই সকল মুক্তপুরুষের সহিত যুদ্ধকালে পারসীক দাসগণ কখন অবস্থান করিতে সমর্থ হইবে না। আর এক কথা, যে সকল গ্রীকগণ শত্রুসহ মিলিত হইয়া আমাদের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য আগমন করিয়াছে, তাহাদের উদ্দেশ্য আর আমাদের উদ্দেশ্য দুইটি সম্পূর্ণ বিভিন্ন। তাহারা অকিঞ্চিৎকর বেতন লোভে মুগ্ধ হইয়াছে, সে বেতনও যথেষ্ট নহে। আর আমরা স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া স্বদেশের চিরশত্রুকে ধ্বংস করিবার জন্য অসিকোষ মুক্ত করিয়াছি—স্বদেশের গৌরব বৃদ্ধি করিবার জন্য চিরস্থায়ীকীর্ত্তি সংস্থাপন করিবার জন্য এই নশ্বর শরীরকে উৎসর্গ করিয়াছি। আমাদের সহিত ইয়ুরোপের সর্ব্বপ্রধান বলিষ্ঠ ও যুদ্ধপ্রিয় জাতি সকল অবস্থান করিতেছে। ইহাদিগের সহিত এসিয়ার দুর্ব্বল, চিরকারী, যুদ্ধবিমুখ জাতির যুদ্ধের পরিণাম যে কিরূপ হইবে, তাহা সহজে অনুমান করা যাইতে পারে। ইহা ব্যতীত দারা স্বয়ং যখন আমাদের বিরুদ্ধে সমর ক্ষেত্রে অবতরণ করিয়াছে, তখন ইহাতেই আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হইতেছে। আর এক কথা আমরা যত বেশী বিপদের সম্মুখীন হইব, আমাদের পুরস্কারের পরিমাণ ও ততই বাড়িয়া যাইবে। এখন আমাদিগকে দারার প্রতিনিধি সেনানীর সহিত যুদ্ধ করিতে হইবে না—অথবা গ্রেনীকসের অশ্বারোহী কিম্বা বিশ হাজার ভাড়াটে গ্রীক সেনার সম্মুখীন হইতে হইবেনা। এখন আমাদিগকে দারা পরিচালিত সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্যের নানা জাতীয় সৈন্যের বাহুবল পরীক্ষা করিতে হইবে—এই পরীক্ষার অবসানে আর আমাদিগকে কিছুই করিতে হইবে না। কেবলমাত্র সমগ্র এসিয়ার অধিকার গ্রহণ করিতে হইবে। আর আমাদের বহুদিনের সহচর ক্লেশকে বিদায় দিতে হইবে।” এই সকল কহিয়া অলিকসন্দর সমষ্টিগত সেনানীগণের অধ্যবসায়, যুদ্ধে অবিমুখতা, ধৈর্য্য, বীরত্ব প্রভৃতি গুণাবলী উল্লেখ করিয়া প্রশংসা করিলেন। তার পর যে সকল বীরবৃন্দ যুদ্ধকালে অদ্ভুত কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছিলেন, সেই সকল বীরের প্রত্যেকের নামোল্লেখ করিয়া তাঁহাদের রণপাণ্ডিত্য অতিমানুষ অবদান পরম্পরা কীর্ত্তণ করিয়া সকলকে সমুত্তেজিত করিয়া তুলিলেন। অনন্তর তিনি যেনেফন ও দশ হাজার গ্রীকের কথা সকলকে স্মরণ করাইয়া বলিলেন, তাঁহারা সংখ্যায় ও বীরত্বে আমাদের সৈন্যের কোনরূপ সমকক্ষ না হইলে, ও তাঁহাদিগের সহিত আমাদিগের ন্যায় বিওসিয়ান, ফিলোপনিসিয়ান, ফ্রেসিয়ান অশ্বারোহী না থাকিলেও তাহারা পারসীকগণকে পরাস্ত করিয়া গন্তব্য স্থানে উপস্থিত হইতে সমর্থ হইয়াছিল।” ইত্যাদি এবং অন্যান্য তৎকালোচিৎ বাক্যে অলিকসন্দর সেনানীগণকে সমুৎসাহিত করিয়াছিলেন। শ্রোতৃবর্গ অলিকন্দরের কথায় যুদ্ধের জনা এরূপ অধীর হইয়াছিল, যে ক্ষণবিলম্বও তাহাদিগেরপক্ষে ক্লেশ জনক হইয়াছিল। আলেকজন্দর সেনা ও সেনানীগণকে ভোজন করিতে আজ্ঞা দিয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতে আদেশ দিলেন। ঘাটির অবস্থা অবগত হইবার জন্য, তিনি কতকগুলি অশ্বারোহী ও ধনুর্ধারীকে তদভিমুখে প্রেরণ করিলেন। তিনি স্বয়ং সমস্ত সৈন্য পরিচালনা করিয়া নিশীথ রাত্রে পুনরায় ঘাটি অধিকার করেন। যাহাতে শত্রু অকস্মাৎ আক্রমণ করিতে না পারে সেজন্য উপযুক্ত প্রহরীগণকে যথা স্থানে অবস্থান করিতে আদেশ করিলেন।

 অলিকসন্দর সেনানীগণকে উৎসাহিত করিবার জন্য, মুখে যাই বলুন না কেন, তিনি বিপদের গুরুত্ব যথাযথ অনুভব করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। বিজয় লাভে অসমর্থ হইলেও তাঁহার এ পরাজয় ও শ্লাঘনীয় বোধে চিরদিন স্মরণীয় হইত, এবিষয়ে সন্দেহ নাই। অলিকসন্দর জয় ও পরাজয় উভয়ের জন্য প্রস্তুত হইয়া, পর্ব্বতের শিখরদেশে মশালের আলোক সাহায্যে অধিরোহণ করিয়া জয়লাভের জন্য ভগবানের উদ্দেশে উপাসনা করেন। সৈন্যগণ যুদ্ধসজ্জাতেই কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিয়া সুর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে গমন করিতে আদিষ্ট হইল। সুর্য্যোদয়ের সহিত আপন আপন নির্দ্দিষ্ট স্থান সেনানীগণ অধিকার করিল। এস্থান হইতে দারা প্রায় দেড় মাইল দূরে অবস্থান করিতেছিলেন, অগ্রে অবস্থিত সৈনিক মুখে, একথা অবগত হইয়া অলিকসন্দর সৈন্যগণকে অপেক্ষা করিতে আদেশ দিয়া যুদ্ধের জন্য ব্যুহহরচনা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

 দারা, কৃষকদিগের মুখে, অলিকসন্দর তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আসিতেছেন, একথা শুনিয়া কোনরূপে তাহাতে বিশ্বাস স্থাপনকরিতে প্রবৃত্ত হইলেন না।—যাহার তিনি পশ্চাৎ অনুসরণ করিতেছেন,—যে তাঁহার বিপুলবাহিনীর ভয়ে পলায়নে প্রবৃত্ত হইয়াছে, সে যে তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আসিবে, একথা তাঁহার মনে প্রথমে কোনরূপ স্থানলাভ করিল না। সৈন্য সকল যদৃচ্ছাক্রমে গমন করিতে প্রস্তুত হইতেছিল, এরূপ অবস্থায় অকস্মাৎ তাহাদিগকে যুদ্ধ করিতে হইবে, ইহাতে তাহাদিগের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা দিল। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইবার সময়, পারসীকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল। দারা প্রথমে মনে করিয়াছিলেন, পাহাড় অধিকার করিয়া এক দল শত্রুর সম্মুখ, অপর দল পশ্চাৎ ভাগ আক্রমণ করিবে। অপর এক ভাগ তাঁহার বামভাগে সমুদ্রের তটে অবস্থান করিয়া শত্রুসৈন্য আক্রমণ করিতে আদিষ্ট হইল। আর বিশ হাজার তীরন্দাজ উভয় সৈন্যের মধ্যবর্ত্তী পিনারস নামক নদী অতিক্রমণ করিয়া যুদ্ধ করিবার জন্য অনুজ্ঞাত হইল। দারার দুরদৃষ্ট ক্রমে তাঁহার আজ্ঞানুসারে কার্য্য হইল না। কোন বিভাগ ভীরুতা বশত তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করিতে বিলম্ব করিল। আর যাহারা কার্য্য করিল, তাহারা পূর্ণ হৃদয়ে না করায়, সমস্ত সৈন্য মধ্যে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল। যেখানে শৃঙ্খলা, যেখানে কর্ত্তব্য প্রতিপালনে অনুরাগ, যেখানে বীরগণ অকাতরে শোণিতধারা প্রবাহিত করিয়া স্বদেশের গৌরব অর্জ্জনের জন বদ্ধপরিকর, সেখানে অভিনেতা পুরুষগণের সংখ্যা অতি অল্প পরিমাণে হইলেও বিজয়শ্রী তাঁহাদিগকেই আলিঙ্গন করিয়া থাকেন।

 অলিকসন্দর, তাঁহার অভেদ্য বাহিনীকে সম্মুখভাগে স্থাপন করিয়া পারমিনিও পুত্ত্র নিকানরকে দক্ষিণ ভাগে রক্ষা করিলেন, তাঁহার নিকট পর্য্যায়ক্রমে কেইনস্, পার্দ্দিকা, মিলেগার, তুরময়, আমিত্তাস প্রভৃতি বীরগণ স্বীয় স্বীয় বাহিনী লইয়া শত্রুপক্ষ আক্রমণ করিবার জন্য অবস্থান করিলেন। বামভাগে সমুদ্রের দিকে ক্রিতিরস ও পার্মিনিও নামক অভিজ্ঞ সেনানী দ্বয়ের জন্য নির্দ্দিষ্ট হইল।

 উভয় সেনা পরস্পরের নিক্ষিপ্ত তীরের বহির্দেশে অবস্থান করিলেও পরস্পরের দৃষ্টির বিষয়ীভূত হইল। পারসীকদিগের অগ্রবর্ত্তী সৈনিকগণ শত্রুগণকে দেখিয়া, পরস্পর বিষম স্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল। গ্রীকগণ এক স্বরে তাহার প্রত্যুত্তর প্রদান করিল—বোধ হইল যেন অসংখ্য সৈন্য কণ্ঠ হইতে সেই স্বর নিঃসৃত হইয়াছে, তাহা পর্ব্বতে ও বনে প্রতিধ্বনিত হইয়া সে প্রদেশকে অত্যন্ত মুখরিত করিয়া তুলিল। শত্রুগণ এই স্বর শ্রবণ করিয়া, সম্মোহিত হইয়া মনে করিল ইহারা সংখ্যাতেও বড় কম নহে। অলিকসন্দর, সৈন্যগণকে গর্জ্জন করিতে দেখিয়া তাহারা পাছে যুদ্ধের পূর্ব্বেই এইরূপ চীৎকার করিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়ে, এজন্য শব্দ করিতে নিষেধ করিয়াদিলেন। অলিকসন্দর, অশ্বারোহণ করিয়া নানাদেশীয় সমবেত গ্রীক সেনার অগ্রবর্ত্তী হইয়া, তাহাদের প্রত্যেক জাতিকে লক্ষ্য করিয়া উত্তেজিত করিয়া ছিলেন। মাসিদুনিয়ানদিগকে, তাহাদিগের পূর্ব্ব বীর্য্য স্মরণ করাইয়া বলিলেন “বীরত্বের ইতিহাসে তোমাদের দুর্জ্জয় সাহস সুপ্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছে, ইয়ুরোপীয় বহু যুদ্ধে তোমরা বিজয়শ্রী অনেকবার লাভ করিয়াছ। এক্ষণে তোমরা আমার সহিত স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এবং সুদূর প্রাচ্যভূমি পদানত করিবার জন্য মিলিত হইয়াছে। ভীম পরাক্রম হারকুলিস এবং প্রবল প্রতাপ ব্যাকস্ যে প্রদেশে কখন গমন করিতে সমর্থ হন নাই, তোমরা সে দেশেও গমন করিয়া তাহা অধীনে আনয়ন করিয়া এক অভিনব সাম্রাজ্য সংস্থাপন করিবে। কেবলমাত্র পারসীকরাই এ সাম্রাজ্যের অধিবাসী হইবে না, পরন্তু সকলজাতিই ইহার অন্তর্ভূক্ত হইবে। আমাদের পরাজিত দেশের মধ্যে ব্যাক্ত্রিয়া (বহ্লিক) ভারতবর্ষ প্রভৃতি দেশ পরিগণিত হইবে। এই যুদ্ধে বিজয় লাভের সহিত তোমরা বহুবিধ অভাবনীয় বহুমূল্য দ্রব্য হস্তগত করিতে সমর্থ হইব। ইলিরিয়ম বা থ্রোসের অনুর্ব্বর পার্ব্বতীয় ভূমি, তোমাদের পরিশ্রমের পুরষ্কার স্বরূপ হইবে না। পরন্তু প্রাচ্যদেশের প্রচুর ধনরত্নরাজী পরিপূর্ণ ভাণ্ডার গৃহের দ্বার তোমাদের জন্য উদ্ঘাটিত হইবে। ইহার জন্য তোমাদিগকে যে বিশেষরূপে অস্ত্র চালনা করিতে হইবে বলিয়া আমার বোধ হয় না। ঐ দেখ ইহার মধ্যেই শত্রুসৈন্য মধ্যে চাঞ্চল্য দেখাদিয়াছে, তাহারা যেন বিভীষিকাগ্রস্ত হইয়াছে। ঢালের ধাক্কাতেই আমরা জয় শ্রীলাভ করিতে পারিব, বলিয়া আমার বোধ হইতেছে। অলিকসন্দর, তাঁহার পিতার এথেন্স বিজয়ের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া, তিনি নিজেদের থেবস ধ্বংস এবং অন্যান্য বিজয় লাভের কথা স্মরণ করাইয়া দিলেন—গ্রেণিকসের যুদ্ধের কথা কহিয়া, বহু সংখ্যক এসিয়ার নগর তাহাদের বীরত্বে কিরূপে পদতলগত হইয়াছে, সে সকল কথা উল্লেখ করিয়া তিনি ম্যাসিদুনিয়ার যোদ্ধাগণকে যুদ্ধের জন্য উন্মত্ত করিয়া তুলিলেন। অলিকনন্দর, গ্রীক সৈনিকগণের মধ্যগত হইয়া তাহাদিগের উদ্দেশে বলিলেন “ঐ দেখ বর্ব্বর দিগের সৈন্য সকল, আমাদিগের পুরোভাগে অবস্থান করিতেছে। ইতিপূর্ব্বে, ইহারা দারা ও জারাক্‌সেস কর্ত্তৃক পরিচালিত হইয়া গ্রীকবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিল—ইহারা তোমাদের জল ও স্থল কলুষিত ও অপবিত্র করিয়াছিল—ইহারা তোমাদের প্রেয় প্রস্রবণ ও ভোজ্যদ্রব্য সকল বিধ্বংস করিয়া অত্যাচারের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছিল। ইহারাই তোমাদের গ্রাম ও নগর সকল লুণ্ঠন, এবং দেবালয় সকল অগ্নিযোগে ভস্মীভূত করিয়া বর্ব্বরতার এক শেষ প্রকাশ করিয়াছিল, ইত্যাদি কহিয়া অলিকসন্দর, লুণ্ঠনাদি কার্য্যে সুনিপুণ ইলিরিয়া এবং থ্রেস দেশবাসীর মধ্যবর্ত্তী হইয়া তাহাদিগের উদ্দেশে বলিলেন “শত্রুসৈন্য নিরীক্ষণ করিয়া দেখ, উহারা কেমন বহুমূল্য বস্ত্রে ও অলঙ্কারে পরিশোভিত হইয়াছে, ইহাদের শারীরে বর্ম্ম নাই—এই সকল স্ত্রীভাবাপন্ন ব্যক্তিদিগের নিকট হইতে বহুমূল্য দ্রব্য সকল গ্রহণ করিবার জন্য উদ্যম কর। তোমাদের তৃণশূন্য, শুষ্ক, শীতল, তুষার পর্ব্বতের পরিবর্ত্তে, পারস্যের উপাদেয় ফল ফুল পরিপূর্ণ উর্ব্বর ভূমি গ্রহণ করিবার জন্য বদ্ধপরিকর হও।” অলিকসন্দর যখন প্রত্যেক সেনানী ও সৈন্যগণকে লক্ষ্য করিয়া যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করিতেছিলেন, সেই সময় পারসীক সৈন্য তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিবার জন্য অগ্রসর হয়। অল্পক্ষণের মধ্যে এই বিপুল সেনাসমষ্টি পরস্পর দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। পারসীকগণ সংকীর্ণ স্থানে বহুসংখ্যক অবস্থান করায় তাহাদের অস্ত্রচালনায় অত্যন্ত অসুবিধা উপস্থিত হইল—এরূপ অসুবিধা হইলেও তাহারা যুদ্ধ করিতে পরাংমুখ হয় নাই।

 পারস্যপতির গ্রীক সৈন্যগণ, ভীম পরাক্রমে মাসিদুনিয়ান বাহিনী আক্রমণ করিয়া বিপর্য্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল। এ সময় বিজয়লক্ষ্মী দারার অঙ্কশায়িনী হইল বলিয়া বোধ হইল। এসময় যদি পারসীকগণ অপরদিকে দৃঢ়তার সহিত যুদ্ধ করিত, তাহাহইলে অলিকসন্দরের নাম গন্ধ চিরকালের জন্য সেইস্থানে অন্তর্হৃত হইত। মাসুদুনিয়ানগণ, গ্রীকদিগের সহিত তাহাদিগের পূর্ব্ব শত্রুতা স্মরণ করিয়া, ঘোরতররূপে যুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইল। এই সময়ের ঘোরতর যুদ্ধে, সেলুকস পুত্র প্তলোমি প্রমুখ যোদ্ধাগণ প্রচণ্ডকার্য্য সম্পন্ন করিয়া পঞ্চত্ব লাভ করেন। অলিকসন্দর, স্বহস্তে দারাকে নিধন করিবার জন্য, শত্রুসৈন্যসমুদ্রে অবগাহন করেন।—দারাকে রক্ষা করিবার জন্য সম্ভ্রান্ত পারসীক কর্ম্মচারীগণ অকাতরে শরীর বিসর্জ্জন করিয়া, প্রভুভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। পারসীক সৈন্য ঘোরতর বিক্রমে যুদ্ধ করিলেও তাঁহারা বিজয়শ্রীলাভ করিতে সমর্থ হইলেন না। শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণে যখন পারসীক সৈন্য রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়নে প্রবৃত্ত হইল, যখন রণস্থলে অবস্থান করিলে অলিকসন্দরের হস্তে দারার বন্দী বা নিহত হইবার সম্ভাবনা বিবেচিত হইল, তখন পারস্যপতি রণস্থলে আর অবস্থান করা শ্রেয়স্কর নহে বিবেচনা করিয়া, অশ্বারোহণ করিয়া কাপুরুষের ন্যায়, প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তর, সম্মান পরিত্যাগ করিয়া প্রাণ লইয়া পলায়ন করিলেন। এতদিনের পরিশ্রম, উদ্যম—আশা—সম্মান একদিনের কয়েক মুহূর্ত্তের কাপুরুষতায় ধূলায় মিলাইয়া গেল। অপর পক্ষে অলিকসন্দর, ধন, জন বলে বলীয়ান হইলেন, এবং তাঁহার উন্নত আশা অধিকতর উন্নত হইল।

 এই যুদ্ধের পূর্ব্বে, যে সকল গ্রীসবাসী প্রবল প্রতাপ এসিয়ার নামেই সম্মোহিত হইয়াছিল, তাহাদিগের সে মোহ দূর হইতে আরম্ভ হইল। হঠকারিতার জন্যই দারাকে এই দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইতে হইয়াছিল। তিনি যদি তাঁহার নৌবল সাহায্যে, অথবা বিপুল বাহিনী দ্বারা অলিকসন্দরের সংবাদ আদান প্রদান এবং খাদ্যাদি প্রাপ্তি পক্ষে বাধা দিয়া তাঁহাদিগকে বিপন্ন করিতে পারিতেন, তাহা হইলে তাঁহার শোচনীয় পরিণাম তত শীঘ্র কখনই হইত না। তিনি মসপটামিয়ার সমতলক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়া,এবং অলিকসন্দরের কোনরূপ সংবাদ না রাখিয়া কেবলমাত্র নিজের তথা কথিত শ্রেষ্ঠতার উপর নির্ভর করিয়া এই দশা কে প্রাপ্ত হইয়াছেন।

 ইসসক্ষেত্রে যুদ্ধ বেশী না হইলেও, মনুষ্য হত্যা যথেষ্টরূপে হইয়াছিল। পারসীক পক্ষীয় প্রায় একলক্ষ পদাতিক এবং দশ হাজার অশ্বারোহী, এই ক্ষেত্রে চিরনিদ্রায় শয়ন করিয়াছিলেন। এরূপ কথিত হয় দারাকে অনুসরণকালে একটী নদী শবদেহে এরূপ পরিপূর্ণ হইয়াছিল যে তাহা অতিক্রমণকালে তাহাদের উপর দিয়া গমনাগমন করিতে হইয়াছিল। ৪০।৫০ হাজার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ-প্রাণ প্রদান করিয়াও অভিষ্ট সাধনে কৃতনিশ্চয় পুরুষের হস্তে যে, একলক্ষ পদাতিক এবং দশ হাজার অশ্বারোহী নিহত এবং প্রায় পাঁচলক্ষ সৈনিক যে পরাভূত হইয়া প্রাণ লইয়া পলায়ন করিবে ইহা কিছু আশ্চর্য্য নহে। যেখানে পুরুষ, একপ্রাণে—চামড়ার সুখ দুঃখের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করিয়া, কার্য্য করিতে অগ্রসর হন, সেখানে তাঁহাদের প্রতিকূলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দণ্ডায়মান হইলেও, সেই লোকোত্তর পুরুষগণ অসামান্য সফলতা লাভ করিয়া জগৎমধ্যে প্রপূজিত হইয়া থাকেন! এই ঘোরতর সংগ্রামে অলিকসন্দরের পক্ষীয় পাঁচশত চারজন আহত, এবং একশত ৮২ জন যুদ্ধবীর সুরলোকে গমন করিয়াছিল। এই যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া অলিকসন্দর যেরূপ প্রধান্য লাভ করিয়াছিলেন, তাহার তুলনায় এই হতাহতের সংখ্যা কিছুই নহে ইহা বলাই বাহুল্য।

 একটা ছেলের অবিমৃষ্যকারিতার ফলে যে দারাকে স্ত্রীপুত্র মাতা প্রভৃতিকে পরিত্যাগ করিয়া প্রাণ লইয়া পলায়ণ করিতে হইবে, ইহা তিনি স্বপ্নেও চিন্তা করিতে পারেন নাই। যুদ্ধস্থল পরিত্যাগ করিয়া, দারা অতি অল্প সংখ্যক সহচর সহ পলায়ণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। রাত্রির অন্ধকার, তাঁহার এই কার্য্যের সহায়তা করিয়াছিল। এরূপ কথিত হয়, দারা যে ঘোটকীতে আরোহণ করিয়াছিল, সেই ঘোটকী তাহার নবপ্রসূত সাবকের অনুরাগে অতি দ্রুতবেগে গৃহ উদ্দেশ্যে গমন করিয়াছিল। এজন্য পরিশ্রান্ত অলিকসন্দর ও তাঁহার সৈনিকগণ দারার অনুসরণ করিতে সমর্থ হয় নাই। এইজন্য দারা ও নির্ব্বিঘ্নে নিরাপদ স্থানে গমন করিতে পারিয়াছিলেন।

 দারার ৪ হাজার টালাণ্ট বা ১ কোটী ১২ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা এবং বিলাসদ্রব্য পরিপূর্ণ সুন্দর সুন্দর শিবির সকল বিজেতার করতলগত হইল। যুদ্ধোপযোগী দ্রব্যসম্ভার অপেক্ষা স্বর্ণ ও রৌপ্যপাত্রে এবং নানা প্রকার বহুমূল্য বস্ত্রে এই সকল শিবির পরিপূর্ণ ছিল। দারার মাতা, স্ত্রীপুত্র কন্যা ও দুর্ভাগ্য বশতঃ বিজেতার হস্তগত হইয়াছিলেন। অলিকসন্দর তাঁহাদিগের প্রতি যথেষ্ট সুজনতা দেখাইয়াছিলেন—পাছে তাঁহারা অবমানিত হন, এজন্য তিনি স্বয়ং গমন, বা অন্য কাহাকেও তাঁহাদের শিবিরে যাইতে আজ্ঞা প্রদান করেন নাই। দারার মহিষী এসিয়ার মধ্যে অনিন্দ্যসুন্দরী বলিয়া সে সময়ে কীর্ত্তিত হইতেন। তাঁহার সৌন্দর্য্যের কথা, অলিকসন্দর তাঁহার কাছে কীর্ত্তণ করিতে নিষেধ করিয়া দেন। দারার অনুসরণ হইতে অলিকসন্দর প্রত্যাগমন করিলে, শকটে পারস্য পতির পরিত্যক্ত পরিচ্ছদ ও ধনুক আনীত হইয়াছিল। পারসীক শিবিরের কর্ম্মচারীরা ইহা দেখিয়া তাহাদের অধিপতির মৃত্যু হইয়াছে অনুমান করিয়া দারার জননীর কাছে এই সংবাদ প্রেরণ করে। ইহাতে তাঁহাদিগের মধ্যে ক্রন্দন রোল উপস্থিত হয়। অলিকসন্দরের জঙ্ঘা দেশে তরবারির আঘাতে কাটীয়া গেলেও তিনি যখন তাঁহার সহচরগণের ভোজন সময়ে উপস্থিত থাকিয়া তাঁহাদিগকে সম্বর্দ্ধনা করিতে ছিলেন। সেই সময় সহসা এই রোদনধ্বনি তাঁহাদের শ্রুতিগোচর হয়। ইহার কারণ অবগত হইলে তিনিতাঁহারএকজন বিশ্বস্তব্যক্তিকে “দারার মৃত্যুহয় নাই” এইসংবাদ প্রেরণ করিয়া তাঁহাদিগকে আশ্বস্ত করেন। পরদিন প্রাতঃকালে অলিকসন্দর তাঁহার তুল্য পরিচ্ছদ ও অবয়ব এরূপ এক বন্ধুসহ দারার মাতাকে দেখিতে গমন করেন। দারার জননী, বন্ধুকে, অলিকসন্দর ভ্রমে অবনত হইয়া অভিবাদন করিলে পর তিনি স্বীয় ভ্রম বুঝিতে পারিয়া লজ্জিত হন। অলিকসন্দর তাঁহাকে লজ্জিত হইতে দেখিয়া বলেন, “হিপাস্তিয়ান ও একজন অলিকসন্দার” অর্থাৎ বন্ধুর শরীর পৃথক হইলেও প্রাণ এক বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। আলিকসন্দর দুর্দশাপন্না দারার জননীকে “রাজ্ঞী” “জননী” ইত্যাদি শব্দে সম্বোধন করিয়া, এবং নিহত সম্ভ্রান্ত পারসীক যোদ্ধাগণকে সামরিক প্রথায় সমাহিত করিয়া, যথেষ্ট মহত্ত্বতার পরিচয় দিয়াছিলেন। খৃঃ পূঃ, ৩৩ অব্দের কার্ত্তিকমাসে এই যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছিল।

 যুদ্ধে বিজয় লাভ করিয়া অদূরদর্শী সেনাপতির ন্যায় উৎসবে নিমগ্ন না থাকিয়া অলিকসন্দর সেনানী পার্ম্মিনিওকে দামাস্কাস অভিমুখে প্রেরণ করেন। এ স্থানে দারার অধিকাংশ ধনসম্পত্তি এবং যুদ্ধোপযোগী দ্রব্য সকল রক্ষিত হইয়াছিল। পার্মিণিও অনায়াসে সেই সকল দ্রব্য হস্তগত করিয়া রাজধনভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেন। ইহার সহিত দারার নর্ত্তকী, পাচক প্রভৃতি এবং সম্ভ্রান্ত কর্ম্মচারীদের পরিজন সকল এবং গ্রীস হইতে সমাগত দূত সকল ও তাঁহার হস্তে আপতিত হয়।

 অলিকসন্দর স্বয়ং সমুদ্রের তটস্থ ভূভাগ অধিকার করিয়া, মারাথস নামক স্থানে উপনীত হন। এ স্থানে দারারদূত তাঁহার কাছে আগমন করিয়া, স্বীয় প্রভুর জননী, পত্নী, প্রভৃতির মুক্তি প্রার্থনা করিয়া পত্র এবং বক্তব্য নিবেদন করেন। পত্রে লিখিত হইয়াছিল যে, “অলিকসন্দারের উচিত তাঁহার মাতা, স্ত্রী ও সন্ততিগণের মুক্তি প্রদান করা, এজন্য সমস্ত মাসিদোনিয়ার যত মুল্য তত অর্থ প্রদান করিতেও প্রস্তুত। সাম্রাজ্য সম্বন্ধে অলিকসন্দরের কোনরূপ অভিপ্রায় থাকিলে, তিনি অন্যক্ষেত্রে আর একবার পরীক্ষা করিবেন। অলিকসন্দার যদি সৎপরামর্শ গ্রহণ করেন, তাহা হইলে পরের রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার নিজের রাজ্য সন্তুষ্টচিত্তে অবস্থান করা উচিত। যদি এরূপ করেন তাহা হইলে তিনি দারাকে বন্ধুরূপে প্রাপ্ত হইতে পারেন। বিশ্বাস স্থাপনের জন্য কার্য্য করিতে প্রস্তুত আছেন। অলিকসন্দর এ পত্রের প্রত্যুত্তরে লিখিলেন—রাজা অলিকসন্দরের নিকট হইতে দারার কাছে।

 তুমি যে দারার নামগ্রহণ করিয়াছ, তিনি আইওনিয়ার গ্রীক ঔপনিবেশিক এবং হেলিসপণ্ট এর উপকূল নিবাসী গ্রীকগণকে নির্দ্দয়রূপে নিহত করিয়াছিলেন। অনন্তর তিনি সমুদ্র উত্তীর্ণ হইয়া মেসিদন এবং গ্রীসদেশ আক্রমণ করেন। তারপর, সেই বংশোদ্ভব জারাক্‌সাস অগণিত বর্ব্বর সহ আমাদিগকে আক্রমণ করিয়াছিলেন। যদিও তিনি নৌযুদ্ধে পরাস্ত হইয়াছিলেন, তথাপিও তিনি মার্দ্দনিয়নগণকে গ্রীসে রাখিয়া যান, তাহারা তাহার অবর্ত্তমানে, গ্রাম ও নগর সমুহ লুণ্ঠন, শস্যক্ষেত্র সকল দহন করিয়াছিল। আর কে না অবগত আছে, তোমার অর্থে পরিপুষ্ট জনগণ কর্ত্তৃক আমার পিতা নিহত হইয়াছেন। তোমরা কূটনীতি অনুসরণ করিয়া যুদ্ধ পরিচালনা কর,অস্ত্রের অভাব না থাকিলেও, তুমি তোমার শত্রুর মস্তক অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করিতে ঢেষ্টা করিয়া থাক। সম্প্রতি তুমি বহু সৈন্যসহ অবস্থান করিলেও, আমাকে হত্যা করিবার জন্য সহস্র ট্যালাণ্ট প্রদান করিতে স্বীকৃত হইয়াছিলে। আমি প্রথমে শত্রুতায় প্রবৃত্ত হই নাই, এরূপ ভাবে যাহারা শত্রুতা করে, তাহাদিগকে সমূলে ধ্বংস করিবার জন্য আমি অস্ত্রধারণ করিয়াছি। বিধাতা ন্যায়ের পক্ষপাতী। এসিয়ার বহু প্রদেশ আমার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে, এবং স্বয়ং তোমার উপরও জয়লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছি। যুদ্ধনীতি অনুসারে তুমি আমার সহিত ব্যবহার কর নাই, তজ্জন্য আমার নিকট তুমি সদয় ব্যবহার প্রত্যাশা করিতে পার না। তথাপিও যদি তুমি অনুগ্রহ প্রার্থী হইয়া আমার নিকট উপস্থিত হও, তাহা হইলে আমি স্বীকার করিতেছি যে, তোমার মাতা স্ত্রী ও সন্ততিগণকে বিনা অর্থে মুক্তি প্রদান করিব। কেমন করিয়া জয় করিতে হয়, এবং কিরূপেই বা পরাজিতের দুঃখ বিমোচন করিতে হয়, তাহা আমি অবগত আছি। আমার নিকটে আসিতে কি তুমি ভীত হও? এখানে আসিলে তোমার গমনাগমনের কোনরূপ প্রতিবন্ধক উপস্থিত হইবে না। তোমার বিশ্বাসের জন্য প্রতিভূ প্রেরণ করিতে প্রস্তুত আছি। ভবিষ্যতে যখন পত্র লিখিবে তখন স্মরণ রাখিবে যে, একজন রাজাকে লিখিতেছে না, কিন্তু তোমার রাজাকে লিখিতেছ। থারসিপস কোনরূপ কথা বলিতে নিষিদ্ধ হইয়া এইপত্র লইয়া দারার নিকট গমন করিয়াছিল।

 যুদ্ধের পূর্ব্বে যে সকল এথিনিয়ন, স্পার্টান ও থেরবাসী দূত মেসিনদের বিপক্ষে দারার সাহায্য প্রাপ্তি বাসনায় আগমন করিয়াছিল, পার্মিণিও তাহাদিকে বন্দী করিয়া অলিকসন্দর সমীপে প্রেরণ করেন। এই সকল সম্ভ্রান্ত বংশীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি অলিকসন্দরের নিকট আনীত হইলে, তিনি স্পার্টান ব্যতীত থেব ও এথেন্সবাসীকে মুক্তি প্রদান করেন। প্রথমোক্তদের সম্বন্ধে তিনি বলেন, যাহাদের দেশ, মেসিদনবাসীরা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করিয়া ফেলিয়াছে, যাহারা তাহাদের কৃতদাসরূপে পরিণত হইয়াছ, তাহারা যে নিজেদের প্রাচীন গৌরব পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য,আমাদের শত্রুর সহিত মিলিত হইবে,ইহা কিছু অস্বাভাবিক নহে, ইহা কহিয়া তিনি তাহাদিগকে মুক্তি প্রদান করেন। এবং ব্যক্তিগত ভাবে এক জনের উচ্চবংশের জন্য, অপরকে অলিমফিক ক্রিড়ায় জয়লাভের জন্য সম্মানিত করেন। অলিকসন্দর, এথেন্সের প্রতি সদ্ভাব, এবং তাঁহার পিতাকে সম্মান দেখাইবার জন্য এথিনিয়ন ইপিক্রেতসকে নিজের সহচররূপে নিযুক্ত করেন। ইপিক্রেতস আ-মৃত্যু বিশেষ পদমর্য্যাদার সহিত, অলিকসন্দরের কাছে অবস্থান করিয়াছিলেন। মৃত্যুর পর অলিকসন্দর, তাঁহার অস্থি দেশে স্বজনগণের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। স্পার্টানদের সহিত শত্রুতা থাকায়, স্পার্টানবাসী কিছুদিন বন্দীভাবে অবস্থান করেন। কালক্রমে তিনিও মুক্তিলাভ করিয়াছিলেন। বিপুল পারসীক সৈন্যের পরাজয়ের পর হইতে, ভূমধ্য সাগরের পূর্ব্বকূলবর্ত্তী যে সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল, ক্রমে ক্রমে টায়রি ব্যতীত প্রায় সকল জনপদই, অলিকন্দরের অধীনতা স্বীকার করিয়া নিজের দুই চারিদিনের অস্তিত্ব রক্ষা করে। অলিকসন্দর, এই সকল প্রদেশ করতলগত করিয়া নিজের অধীনস্থ ব্যক্তিকে শাসনকার্য্যে নিযুক্ত করেন।

 অলিকসন্দরের, বিজয় লাভের পর ফিনিসিয়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতিগণ সুবর্ণ মুকুট প্রভৃতি প্রেরণ পূর্ব্বক তাঁহার সম্বর্দ্ধনা করিয়া বশ্যতা স্বীকার করেন। তাইরি নগর হইতেও সুবর্ণ মুকুট প্রভৃতি উপসংহার দ্রব্য প্রেরিত হইয়াছিল। অলিকসন্দর তাইরির লোককে সম্ভ্রমের সহিত গ্রহণ করিলেন; এবং স্বয়ং গমন করিয়া তথাকার হারকুলীসকে পূজা করিবার বাসনা বিজ্ঞাপন করেন। তাইরিবাসী ইহা অবগত হইয়া চিন্তিত হইল—তাহারা মনে করিল, অলিকসন্দার কিছু একাকী আগমন করিবেন না। আসিলে তিনি সৈন্যগণসহ আগমন করিবেন, সুতরাং একবার নগর অধিকার করিয়া আবার যে তিনি ইহা পরিত্যাগ করিবেন, ইহা কখনই সম্ভবপর নহে। তাইবাসীরা অলিকসন্দরের ইচ্ছার প্রতিকূলে দণ্ডায়মান হইল। তাহারা প্রথমে, যুদ্ধজনিত নানা প্রকার অশান্তি ভোগ করা অপেক্ষা উপর উপর বশ্যতা স্বীকারে কুণ্ঠিত হয় নাই। কিন্তু যখন প্রত্যক্ষভাবে অলিকসন্দরের অধীনে অবস্থান করিতে হইবে, তাহারা এ কথা অবগত হয়, তখন তাহারা পুরুষের মতন আপনাদের স্বাধীনতা রক্ষা করিবার জন্য প্রস্তুত হইল। অসাধারণ অধ্যবসায়ের সহিত তাইরি বাসীরা অলিকসন্দরের প্রচণ্ড আক্রমণ হইতে সুদীর্ঘ সাতমাসকাল স্বর্গীয় স্বাধীনতা রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল। এই অবরোধে, অলিকসন্দরের অভীষ্ট সাধনের জন্য দৃঢ়তা—কার্য্যসিদ্ধি বিষয়ে সন্দেহ শূন্যতা—অনন্য সাধারণ বীরত্ব প্রদর্শনে ব্যাগ্রতা, প্রভৃতি শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদক গুণ সকল অতি সুন্দররূপে বিকাশ প্রাপ্ত হইয়াছিল।

 অলিকসন্দর যখন অবগত হইলেন, যে তাইরী বাসীরা তাঁহাকে তাহাদের নগরে প্রবেশ করিতে বাধা প্রদান করিবে, এবং তাহা রক্ষা করিবার জন্যও প্রস্তুত হইতেছে, তখন তিনি কি কর্ত্তব্য ইহা নির্দ্ধারণ করিবার জন্য, তাঁহার সমাগত সেনানী ও সহচরগণকে আহ্বান করিয়া পাঠান। তাঁহারা সকলে সমবেত হইলে, অলিকসন্দর তাইরির অবস্থা বর্ণন করিয়া বলেন যে “পারসীকরা যে পর্য্যন্ত সমুদ্রের আধিপত্য করিতে থাকিবে, সে পর্য্যন্ত আমাদের মিশ্রদেশ অধিকার করিতে যাওয়া যুক্তিযুক্ত হইতে পারে না। গ্রীসের আভ্যান্তরিক অবস্থা পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে, সাইপ্রস ও মিশ্রদেশে পারসীক ক্ষমতা অক্ষুণ্ণভাবে থাকিতে দিয়া, এবং তাইরির ন্যায় সন্দিগ্ধ মিত্রকে পশ্চাতে রাখিয়া, দারার অনুসরণে দূরতর প্রদেশে গমন করাও কখনই শ্রেয়স্কর হইতে পারে না। আমরা যদি সমস্ত সৈন্যসহ ব্যাবিলন অভিমুখে গমন এবং দারার অনুসরণ করি, তাহা হইলে পারসীকরা নিশ্চয়ই সামুদ্রিক প্রদেশ সকল পুনরায় জয় করিবে। তাহারা প্রচুর সৈন্যসহ আমাদের দেশ আক্রমণ করিয়া এদেশের পরিবর্ত্তে তথায় যুদ্ধ নাটক অভিনয় করিবে। স্পার্টানরা প্রকাশ্যভাবে আমাদের সহিত যুদ্ধ করিতেছে, এথেন্সবাসীর মনের ভিতর দুর্ব্বাসনা পোষণ করিতেছে, এবং ভয়ে তাহারা আমাদের প্রতি ভক্তি দেখাইতেছে। এরূপ অবস্থায় আমরা যদি তাইরি অধিকার করিতে পারি, তাহা হইলে ফিনিসিয়া আমাদের করতলগত হইবে, ইহাদের সমস্ত নৌবল অমাদের আজ্ঞাবহ হইবে, ইহারাই পারসীক নৌশক্তির মেরুদণ্ড স্বরূপ, ইহাদের পোত সংখ্যাও বড় কম নহে; ইহাদের নগর যদি আমাদের হস্তগত হয়, তাহা হইলে ইহারা কিছু পরের জন্য বিপন্ন হইতে যাইবে না। ইহার পর সাইপ্রস, অনতিবিলম্বে বা অল্প আয়াসে আমাদের অধিকার ভুক্ত হইবে! ফিনিসীয় নৌশক্তির সাহায্যে, আমরা সামুদ্রিক আধিপত্য লাভ করিতে সমর্থ হইব। তখন মিশ্রদেশ অধিকার আমাদের সহজসাধ্য হইবে। মিশ্রদেশ বিজয়ের পর গ্রীসের বা আমাদের দেশের ভাবনা আর ভাবিতে হইবে না। তখন পারস্যের সমস্ত নৌশক্তি এবং ইউফেট্রিস পর্য্যন্ত সমস্ত দেশ, আমাদের আজ্ঞানুসারে পরিচালিত হইবে। তখন আমরা স্বচ্ছন্দক্রমে ব্যাবিলন অভিমুখে গমন করিতে পারিব, এবং আমাদের কীর্ত্তিও তখন অধিকতর বর্দ্ধিত হইবেন।”

 অলিকসন্দর তাঁহার সহচরগণকে তাঁহার ন্যায় সকল প্রকার বিপদকে তুচ্ছজ্ঞান করিতে শিক্ষিত করিয়াছিলেন—যে সকল যোদ্ধা ধর্ম্মপ্রচারক দিগের ন্যায় আংশিক ভাবে উন্মত্ত হয়, সে সৈন্য দ্বারা যে কোন দুঃসাহসিক কার্য্য সম্পূর্ণরূপে নিষ্পন্ন করিতে পারা যায়। তাহারা কার্য্যের গুরুত্বেরদিকে না দেখিয়া, প্রাণ প্রদান করিয়াও কার্যসিদ্ধির জন্য অগ্রসর হইয়া থাকে। অলিকসন্দর এইরূপ সৈন্য গঠন করিতে পারিয়া ছিলেন বলিয়াই তাহাদের সাহায্যে অদ্ভুত কার্য্য সকল সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। অলিক সন্দরের প্রস্তাব আগ্রহের সহিত সৈনিকগণ কর্ত্তৃক গৃহীত হইল। তাহারা তাইরি অভিমুখে গমন করিবার আজ্ঞালাভ ঔৎসুক্যের সহিত প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।

 ভূমধ্যসাগরের পূর্ব্বে এবং সিরিয়ার উপকূলে একটী দ্বীপে তাইরিনগর নির্ম্মিত হইয়াছিল। সে সময় সমুদ্রেরতট হইতে ইহা প্রায় অর্দ্ধমাইল দুরে অবস্থিত ছিল। এ স্থানে সমুদ্রের গভীরতা স্থানে স্থানে ১৭।১৮ফীট অপেক্ষা ন্যূন ছিলনা। পূর্ব্বে তাইরিনগর সমুদ্রের তটের উপর নির্ম্মিত হইয়াছিল, একবার সমীপবর্ত্তী নরপতির সহিত যুদ্ধ আরম্ভ হওয়াতে, তাহারা প্রাচীন নগর পরিত্যাগ করিয়া সমুদ্র পরিবেষ্টিত দ্বীপকে, উচ্চ প্রাচীরে সুদৃঢ় করিয়া নিবাস করিতে আরম্ভ করে। প্রাচীন নগরের সুবৃৎ অট্টালিকা, নগরপ্রাচীর, প্রভৃতি নষ্ট হইয়া স্তুপে পরিণত হয়। বাণিজ্যের জন্য এই নগর সেকালে অত্যস্ত সমৃদ্ধি সম্পন্ন হইয়াছিল। এবং এই জন্যই ইহারা পোত-বলেও শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিয়াছিল। ভুমধ্যসাগরের চতুর্দ্দিকে এরূপ স্থান ছিল না, যে স্থানে ইহারা গমন করিয়া পণ্যদ্রব্যের আদান প্রদান না করিয়াছিল। ইহারা যেরূপ শক্তিশালী ও সমৃদ্ধি সম্পন্ন ছিল সেইরূপ সাহসী ও স্বাধীনতাপ্রিয় ছিল। সাহসী হইলেও ইহারা নিজের বাণিজ্য অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য পরের সহিত বিপদে প্রবৃত্ত হইত না, সকলের সহিত সদ্ভাব রাখিতে চেষ্টা করিত।

 তাইরিবাসীরা যখন অলিকসন্দরকে তাহাদের নগরে প্রবেশ করিতে সম্মতি প্রদান করিলেন না, তখন তিনি সমস্ত সৈন্যসহ তাইরির সম্মুখে সমুদ্রের তটে শিবির সংস্থাপন করিলেন। সমুদ্র অতিক্রমণ এবং দুরারোহ প্রাচীর ভেদ করিয়া তাইরি অধিকার বড় সামান্য কথা নহে। শত্রু নৌবলে বলিয়ান সুতরাং অবরুদ্ধ হইলেও তাহারা অন্নাদির অভাবে অবসন্ন হইয়া পড়িবে না। অন্যলোক হইলে তাইরি বিজয় বাসনা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইতেন, কিন্তু অলিকসন্দরে তাহার বিপরীত প্রতিভাত হইল। বাধার গুরুত্ব অনুসারে তাঁহার উৎসাহ, অধ্যবশায় ক্লেশ সহিষ্ণুতা ও বর্দ্ধিত হইল। তিনি অর্দ্ধমাইল বা ক্রোশের চতুর্থাংশ সমুদ্রে সেতু প্রস্তুত করিয়া তাইরি অধিকার করিতে মনস্থ করিলেন।

 অলিকসন্দারের ইচ্ছার সহিত সেতুবন্ধন কার্য্য আরম্ভ হইল। প্রাচীন তাইরির ভগ্নস্তুপ হইতে সুবৃহৎ শীলাখণ্ড এবং অদূরবত্তী পর্ব্বত হইতে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষ সকল আনীত হইয়া সমুদ্রের উপর যোজক প্রস্তুত হইতে লাগিল। প্রথম প্রথম অনেকে আলিকসন্দরের এই কার্য্যকে বাতুলতার বিজৃম্ভণ বলিয়া উপেক্ষা প্রদর্শন করে। কিন্তু যখন, তিনি কিয়দংশ সেতু নির্ম্মাণকার্য্য সমাধা করেন, তখন তাইরিবাসীরা ঘোরতর পরাক্রমে জলে ও স্থলে উভয়পথে অলিকসন্দরের জনগণকে বাধা প্রদান করিতে আরম্ভ করে। তাহারা প্রাচীরের উপর প্রস্তর নিক্ষেপক যন্ত্র সকল সংস্থাপন করিয়া, প্রচণ্ডবেগে প্রস্তর সকল সেতু কার্য্যে নিযুক্ত লোকেদের উপর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। অলিকসন্দরও সুদীর্ঘ প্রস্তর নিক্ষেপক যন্ত্র প্রস্তুত করিয়া, তাহাদের আক্রমণের প্রতিরোধ করিতে লাগিলেন। তাইরিবাসীরা সময়ে সময়ে নৌকাযোগে আক্রমণ করিয়া শত্রুসৈন্য ব্যতিব্যাস্ত করিতে লাগিলেন। কখন তাঁহারা সুবৃহৎ নৌকায় কাষ্ঠ, তৃণ, শণ, প্রভৃতি দাহ্য পদার্থ তৈলসিক্ত করিয়া, অনুকূল বায়ুবেগে সেতুর কাছে লইয়া তাহাতে অগ্নিপ্রদান করিয়া অন্য নৌকাযোগে প্রত্যাগমন করে। অনুকূল বায়ুসংযোগে দাহ্যমান নৌকা, সেতু সংলগ্ন হইয়া প্রস্তর নিক্ষেপক যন্ত্র সকল ভষ্মীভূত করিয়া দেয়। এইরূপে তাহারা যতবাধা প্রদান করিতে লাগিল—অলিকসন্দন্দের উদ্যমও তত বৃদ্ধি পাইয়া তাঁহাকে শত্রুগণের অজেয় করিয়া তুলিল। অলিকসন্দর, বহু সংখ্যক সুত্রধর নিযুক্ত করিয়া অগণিত যন্ত্র নির্ম্মাণ করিয়া বিপুল পরাক্রমের সহিত জলেস্থলে সকল প্রকারে শত্রুগণকে আক্রমণ করিতে লাগিলেন। এই সময় সমুদ্র যেন কৃপাপরতন্ত্র হইয়া বিপন্ন তাইরিবাসীকে সাহায্য করিবার জন্য দণ্ডায়মান হইলেন। প্রবল ঝটিকায় উত্থিত তরঙ্গের আঘাতে বৃহৎ বৃহৎ প্রস্তর খণ্ড দূরে নিক্ষিপ্ত হইল—অতিক্লেশে নিবদ্ধ কাষ্ঠ সকল প্রবলতরঙ্গে সুদূরে নীত হইল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বহুদিনের পরিশ্রম বিফল হইয়া গেল। তরঙ্গের প্রবল আঘাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য অলিকসন্দর পূর্ব্ব অপেক্ষা আরো বিস্তৃত করিয়া সেতু প্রস্তুত করিলেন। ইহা আক্রমণ করিবার পক্ষেও সুবিধা জনক হইল। বিপক্ষ নিক্ষিপ্ত প্রস্তর, অস্ত্র ও অগ্নি হইতে রক্ষা করিবার জন্য গোমহিষ প্রভৃতি পশুর আদ্র চর্ম্মের অন্তরালে কারুকরগণ অবস্থান করিয়া কার্য্য করিতে লাগিল। সেতু যত নগরের নিকটবর্ত্তী হইল, পরস্পরের উদ্যম বিফল করিবার জন্য উভয় পক্ষে ঘোরতর প্রতিহিংসা পরায়ণ হইয়া, পরস্পর প্রচণ্ড পরাক্রমে আক্রমণ করিয়াছিল। অলিকসন্দর বহু সংখ্যক নৌকা সংগ্রহ করিয়া, যুদ্ধকুশল তাইরি সাংয়াত্রিকগণকে, জলপথে দ্বীপের অপর ভাগে যুদ্ধে নিযুক্ত করিয়া সেতুকার্য্য ক্ষিপ্রহস্তে প্রস্তুত করিতে লাগিলেন। তাইরিবাসীরা যখন দেখিল সেতু প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, এইবার শত্রুরা প্রাচীর ভেদ করিয়া নগর আক্রমণের চেষ্টা করিবে, এইবার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাহাদিগকে প্রবল শত্রুর সম্মুখীন হইয়া প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে হইবে, এই সঙ্কট সময়ে স্ত্রী, পুত্র, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা প্রভৃতি দেখিয়া পাছে তাহাদের হৃদয়ে কাতরতা উপস্থিত হয়; এবং পরাজিত হইলে শত্রুরনৃশংস অত্যাচার হইতে তাহাদিগকে রক্ষা করিবার জন্য; তাহারা তাহাদিগকে, তাহাদের কার্থেজ নামক উপনিবেশে প্রেরণ করিয়াছিল। দেখিতে দেখিতে সেতু দ্বীপের সহিত মিলিত হইল। তাইরিবাসীরা প্রাচীরের উপর হইতে ঘোরতর বিক্রমে অস্ত্র, শস্ত্র, প্রস্তর, প্রভৃতি নিক্ষেপ করিয়া গ্রীকগণকে আক্রমণ করিল। অলিকসন্দর, সকলের অগ্রবর্ত্তী এবং সকল প্রকার বিপদের সন্মুখীন হইয়া অদ্ভুত পরাক্রমে আক্রমণ করিলেন। অলিকসন্দরের যন্ত্র হইতে প্রস্তরাদি নিক্ষিপ্ত হইয়া তাইরিবাসীকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। যন্ত্র নিক্ষিপ্ত মুদ্‌গর আঘাতে প্রাচীরের এক স্থান ভগ্ন হইয়া পড়িল—প্রাচীর ভগ্নের সহিত তাইরিবাসীর কপাল ও ভাঙ্গিয়া পড়িল। সেই ভগ্নস্থান রক্ষা করিবার জন্য তাইরিবাসীরা যথেষ্ট চেষ্টা করিল। শতশত, সহস্র সহস্র, যোদ্ধা অকাতরে তথায় প্রাণ পরিত্যাগ, এবং শোণিত সমুদ্র প্রবাহিত করিয়াও তাহারা কোনরূপে অলিকসন্দরের প্রচণ্ড গতিরোধ করিতে সমর্থ হইল না।

 প্রাচীর ভগ্ন হইলে, যুগপৎ নৌকা ও সেতু হইতে তাইরি আক্রমণ করা হইল। এই ভীষণ সংগ্রামে অলিকসন্দর স্বয়ং সকলের অগ্রবর্ত্তী হইয়া, কে কিরূপ সাহস প্রদর্শন করেন তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া সৈন্যগণকে পরিচালনা করিতে ছিলেন। আদমিতস্ নামক তাঁহার একদল সেনানী সকল বিপদ তুচ্ছ করিয়া শত্রু মিত্র সকলের সমক্ষে অদ্ভুত কার্য্য সম্পন্ন করিয়া প্রাচীরোপরি উপস্থিত হন। প্রাচীরের উপর উঠিয়া যখন তিনি জয়শব্দে তাঁহার সহচর যোদ্ধাগণকে তাঁহার নিকট আসিবার জন্য উৎসাহিত করিতেছিলেন, সেই সময় তিনি বিপক্ষ প্রেরিত ভল্লবিদ্ধ হইয়া সেই স্থানেই সুরলোকে গমন করেন। তাঁহার এই কাপুরুষদিগের ভীতিপ্রদ ভীষণ পরিণাম দেখিয়া কাহারও হৃদয়ে কিছুমাত্র ভীতির সঞ্চার হইল না। সকলেই সেই স্পৃহনীয় স্থান অধিকার করিবার জন্য, যেন স্পর্দ্ধার সহিত পরস্পর পরস্পরকে অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। আদমিতসের পরে অলিকসন্দর স্বয়ং সেই স্থানে আরোহণ করিয়া সকলের বিস্ময় উৎপাদন করেন। পার্ব্বত্য নদীর প্রবল বেগ, বাধাপ্রাপ্ত হইলে তাহা যেরূপ ঘোরতর গর্জ্জন পুরঃসর দিঙ্মণ্ডল নিনাদিত করিতে করিতে বৃহৎ বৃহৎ উপল খণ্ডকে দূরে নিক্ষেপ করিয়া গমন করে, সেইরূপ অলিকসন্দরের সৈন্যগণ সেই ক্ষুদ্র পথ দিয়া প্রবল বেগে সমস্ত বাধা ছিন্ন ভিন্ন করিয়া তাইরি মধ্যে প্রবেশ করেন। বণিক তাইরিবাসীরা কোনরূপে স্বাধীনতা রক্ষা করিতে না পারিলেও তাঁহাদের সেই পবিত্র অবদান পরম্পরা চিরকাল মনুষ্য সমাজে আগ্রহের সহিত পঠিত ও অনুকৃত হইবে।

 অলিকসন্দরের সহিত, স্বাধীনতা সংরক্ষণ জন্য এই ঘোরতর যুদ্ধে আট হাজার তাইরিবাসী বীরলোক প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ইহা ব্যতীত দুই হাজার তাইরিয়নকে, দানব হৃদয় অলিকসন্দর কীলকবিদ্ধ পূর্ব্বক নিহত করিয়া নিজের স্বরূপের যথার্থ পরিচয় প্রদান করেন। নিজের দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিপক্ষের বিরুদ্ধে দেশবাসী সকলেরই সর্ব্বতোভাবে যত্ন করা উচিত। তাইরিয়ানরা এই ভাবে প্রণোদিত হইয়া, শত্রুর সহিত সামর্থ অনুসারে ঘোরতরযুদ্ধ করিয়াছিলেন। জয় পরাজয় অদৃষ্ট সাপেক্ষ তাঁহারা পরাজিত হইলেও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁহাদের আত্মত্যাগ কথা চিরকাল মনুষ্য সমাজে অভিনবরূপে কীর্ত্তিত হইবে। এইরূপ প্রচণ্ডতা প্রদর্শন করিয়াও অলিকসন্দরের পাশব হৃদয় পরিতৃপ্ত হইল না। তিনি প্রায় ৩০ হাজার তাইরি বাসী ও তাহাদের বেতন ভুক্ সৈনিকগণকে দাসরূপে বিক্রয় করিয়া যথেষ্ট অর্থ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

 অবরোধের প্রথম হইতে শেষ পর্য্যন্ত সময়ের মধ্যে, প্রায় ৪শত মাসিদুনিয়ান সৈন্য পঞ্চত্ব লাভ করিয়াছিল। ৩৩২ খৃঃ পূঃ শ্রাবণ মাসে তাইরি অলিকসন্দরের হস্তগত হয়। তিনি হারকুলিসের পূজা উপলক্ষে কয়েক দিন এখানে যথেষ্ট উৎসবের অনুষ্ঠান করেন। অলিসন্দর যে সময় তাইরি অবরোধে অভিনিবিষ্ট চিত্ত ছিলেন, সে সময় একজন দূত পত্রসহ দারার নিকট হইতে আগমন করেন। দারা লিখিয়াছিলেন যে তাঁহার মাতা, স্ত্রী ও সন্ততি সকল প্রত্যার্পণ করিলে তিনি দশ হাজার ট্যালাণ্ট বা বর্ত্তমান মুদ্রায় ৩ কোটি ৬৬ লক্ষ টাকা, ইউফেট্রিসের তট হইতে গ্রীসসাগর পর্য্যন্ত সমস্ত ভূভাগ প্রাপ্ত হইবেন। অধিকন্তু দারা তাঁহার কন্যা স্তাতিরাকে অলিকসন্দরের হস্তে প্রদান করিয়া বিবাহ কার্য্য সম্পন্ন করাইবেন। তাহা হইলে উভয়ে মিত্রতা পাশে আবদ্ধ হইবেন। অলিকসন্দর ইহার প্রত্যুত্তরে এরূপ মর্ম্মে লিখিয়া পাঠান “দারার নিকট তিনি অর্থ, অথবা সমস্ত রাজ্যের পরিবর্ত্তে অর্দ্ধরাজ্য মাত্র প্রাপ্তি কামনা করেন না—রাজ্য ও অর্থ সমস্তই আমার। তিনি দারার সম্পূর্ণ অনভিমতে তাঁহার কন্যাকে বিবাহ করিতে পারেন। ইহাতে দারা সম্পূর্ণ আপত্তি উত্থাপন করিলেও যে তাহা ব্যর্থ হইবে একথা বলাই বাহুল্য। যে প্রদেশ দারার হস্তচ্যুত হইয়াছে, সে প্রদেশ তিনি কেমন করিয়া অপরকে প্রদান করিবেন। দারা যদি আমার ভদ্র ব্যবহার পাইতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে তিনি স্বয়ং আমার নিকট উপস্থিত হউন।” এই পত্র যখন লিখিত হয় তখন প্রাচীন সেনানী পারমিণিও বলেন “আমি যদি অলিকসন্দর হইতাম, তাহা হইলে দারার প্রস্তাব গ্রহণ করিতাম।” বাহুবল গর্ব্বিত দ্বাবিংশ বৎসর বয়স্ক অলিকসন্দর বলেন “আমি যদি পারমিণিও হইতাম তাহইলে এরূপ করিতাম, কিন্তু আমি অলিকসন্দর বলিয়া এরূপ পত্র প্রেরণ করিলাম।” এই পত্র দারার কাছে নীত হইলে তিনি সন্ধির আশায় জলাঞ্জলি দিয়া আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।

 ইহুদিদের ইতিহাস লেখক যোসেফ, ইনি অলিকসন্দরের প্রায় তিনশত বৎসর পরে বর্ত্তমান ছিলেন। তিনি তাঁহার ইতিহাসে লিখিয়াছেন যে, অলিকসন্দর যেসময় তাইরি অবরোধ করেন; সে সময় আহার্য্য দ্রব্য সংগ্রহের জন্য যুডিয়া প্রভৃতি প্রদেশে লোক প্রেরণ করেন। প্রেরিত লোক জেরুজেলামে উপস্থিত হইলে, তথাকার ইহুদীরা “তাঁহারা পারস্যপতি দারার অধীন সুতরাং অন্নাদি প্রদান করিয়া তাহারা অলিকসন্দরের কোনরূপ সাহায্য করিতে পারে না” ইত্যাদি কহিয়া সেই লোককে তাহাদের নগর হইতে চলিয়া যাইতে আদেশ করে। সে সময় অলিকসন্দর,এই অবমাননা নীরবে সহ্য করিয়াছিলেন। এক্ষণে তাহার প্রতিশোধ গ্রহণ করিবার জন্য জেরুজেলাম অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

 তাইরি পতনের পর হইতে অলিকসন্দরের অতুল ক্ষমতা এবং প্রচণ্ডতার কথা এ সকল প্রদেশের সর্ব্বত্র প্রচারিত হইয়াছিল। ক্রুদ্ধ অলিকসন্দর, জেরুজেলাম ধ্বংস করিবার জন্য অগ্রসর হইলেন। এরূপ অবস্থায় জেরুজেলাম রক্ষা করা বড় সামান্য কথা নহে। নগরপাল ও নাগরিকেরা অলিকসন্দরের আগমন কথা শুনিয়া বিভীষিকাগ্রস্ত হইলেন। নগরপাল পুরুষার্থের উপর নির্ভর না করিয়া, দৈবের উপর নির্ভর করিয়া ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পূজা পাঠ আরম্ভ করিলেন। সেই দিন নগরপাল রাত্রে স্বপ্নে অনুজ্ঞাত হইলেন যে “অলিকসন্দরকে বাধা না দিয়া, তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিয়া সমাদরে আহ্বান করিয়া আন। নগর পথ পুষ্পময় করিয়া সুসজ্জিত কর, পুরোহিত বেশে নাগরিকগণসহ নগর হইতে বহির্গত হইয়া তাঁহার প্রত্যুত্তদ্গমন কর” এই স্বপ্ন অনুসারে নগরপাল, নগর মধ্যে উৎসবের অনুষ্ঠান করিয়া অলিকসন্দরকে আনয়ন করিবার জন্য নগর বহির্দেশে গমন করেন। অলিকসন্দর নগর ধ্বংস করিবার উদ্দেশ্যে আগমন করিতেছিলেন। ইহাদিগকে আগমন করিতে দেখিয়া, তিনি প্রধান পুরোহিতের কাছে গমন করেন; এবং যথেষ্ট সম্মান দেখাইয়া তাঁহার সম্বর্দ্ধনা করেন। পারমিণিও প্রভৃতি তাঁহার প্রধান সেনানীগণ, অকস্মাৎ তাঁহার এরূপ চরিত্র পরিবর্ত্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি বলেন, এসিয়া বিজয়ে বহির্গত হইবার পূর্ব্বে তিনি স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন, একজন ধর্ম্মযাজক, তাঁহাকে এসিয়া বিজয়ের জন্য আহ্বান করিয়া বলেন, তিনি অনায়াসে পারস্য বিজয়ে সমর্থ হইবেন এবং শ্রীভগবান তাহার সহায়তা করিবেন। স্বপ্নে দৃষ্ট ব্যক্তির সহিত ইহার কোন পার্থক্য নাই। তিনি যেরূপ পধিচ্ছদপরিধান করিয়াছিলেন, যেরূপ অঙ্গভঙ্গী দেখাইয়াছিলেন, ইহাতেও অবিকল সেই সকল প্রত্যক্ষ করিতেছি। অলিকসন্দর নাগরিকগণের সহিত মিলিত হইয়া নগরে প্রবেশ করেন। সুচতুর নগরপাল, যদি এরূপ উপায় অবলম্বন না করিতেন, তাহা হইলে জেরুজেলাম ভগ্নস্তুপে পরিণত হইত তাহাতে সন্দেহ নাই। মেসিদনপতির জেরুজেলামে গমনের কথা কোন গ্রীক গ্রন্থে বর্ণিত হয় নাই।

 জেরুজেলাম হইতে অলিকসন্দর মিশ্রদেশ অভিমুখে যাত্রা করেন। মিশ্রদেশে প্রবেশের পূর্ব্বে, তিনি গাজানামকস্থান অবরোধ করিয়া হস্তগত করেন। এই স্থান গ্রহণ জন্য তিনি যেরূপ অসাধারণ অধ্যবসায়, নির্ভীকতা, দৃঢ়তা, প্রভৃতি দেবদুলর্ভ গুণ সকল দেখাইয়াছিলেন, সে জন্য তাঁহার বীরত্ব কাহিনী চিরকাল আগ্রহের সহিত গীত হইবে। অপর পক্ষে, তিনি যেরূপ তাঁহার নারকীয় প্রবৃত্তির পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, তাহা চিরকাল ঘৃণার সহিত উপেক্ষিত হইবে। তাঁহার বীরত্ব গাথা, কলঙ্কিত হইলেও, তাহার অনুশীলনে পাপস্পর্শ করিলেও, আমরা সেই হৃদয়োন্মত্তাজনক বীরত্বকাহিনী না কহিয়া থাকিতে পারিলাম না।

 গাজা ভূমধ্যসাগরের পূর্ব্ব উপকূলে, সিরিয়া দেশে সেকালে ইহা বাণিজ্যের জন্য প্রচুর ধনধান্যে পরিপূর্ণ ছিল। যে মরুভূমি মিশ্র ও সিরিয়া দেশের মধ্যভাগে অবস্থিত। গাজা তাহারই পার্শ্বে নির্ম্মিত হইয়াছিল। অলিকসন্দর গাজার নিকটবর্ত্তী হইলে, কোন উপায় অনুসারে ইহা হস্তগত করিবেন, সে বিষয় কর্ম্মচারীদের সহিত পরামর্শ করেন। গাজা, উচ্চভূমির উপর সংস্থাপিত এবং দুরাক্রম্য প্রাচীর পরিবেষ্টিত হওয়াতে ইহা বিপক্ষের দুরাধর্ষ হইয়াছে। যান্ত্রিকগণ, গাজার অবস্থা উত্তমরূপে পর্য্যবেক্ষণ করিয়া অভিমতি প্রদান করেন যে, বলপূর্ব্বক প্রাচীর অধিকার করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। অলিকসন্দর, অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করিয়া থাকেন। তিনি যন্ত্রপরিচালকদিগের নিকট হইতে এরূপ উত্তর প্রাপ্ত হওয়াতে, তাঁহার অধ্যবসায় ও উৎসাহ, যেন সহস্র গুণে বাড়িয়া উঠিল। যে স্থান সর্ব্বাপেক্ষা কঠিন ও বিপদজনক; অলিকসন্দর সেই স্থান হইতে নগর আক্রমণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। ইহাতে সফলতার সহিত তাঁহার শত্রুগণ হৃদয়ে ঘোরতর নৈরাশ্য উপস্থিত হইবে, এবং তাঁহাদের কীর্ত্তিও চতুর্দ্দিকে সুপ্রসারিত হইবে। এই আশায় উৎসাহিত হইয়া, অলিকসন্দর নগরের দক্ষিণদিকে মৃত্তিকা স্তুপাকার করিয়া প্রাচীরসম উচ্চ করিলেন। এই স্তুপের উপর তাইরি হইতে আগত প্রাচীর ধ্বংসী বৃহৎ বৃহৎ যন্ত্র সকল স্থাপন করিয়া নগর আক্রমণে প্রবৃত্ত হইলেন।

 দারার, বেতিস নামক একজন খোজা, এসময় গাজার শাসনকর্ত্তা ছিলেন। তিনি অন্যান্য শাসনকর্ত্তার উদাহরণ অনুসরণ না করিয়া, পুরুষেরন্যায় পৌরুষ দেখাইয়া প্রচণ্ডপরাক্রমে অলিকসন্দরের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইলেন। অলিকসন্দর, নগর আক্রমণে প্রবৃত্ত হইলে, বেতিস তাঁহার নব নিযুক্ত আরব সৈনিকগণ সহ উন্নত প্রাচীর হইতে নিম্নস্থ মাসিদনদিগকে ঘোরতর বিক্রমে আক্রণ করিতে লাগিলেন—তাহারা এ আক্রমণ বেগ কোনরূপে সহ্য করিতে সমর্থ হইল না। মৃত্তিকাস্তুপ হইতে যে যেদিকে পাইল সে সেই দিকে পলায়ণ করিয়া প্রাণ রক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হইল। প্রজ্বলিত মসাল হস্তে আরবগণ যন্ত্র সকল ভষ্মীভূত করিবার উপক্রম করিল। অলিকসন্দর, মেসিদনদিগের পলায়ণ এবং আরবদিগের অতিসাহস দেখিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। তিনি সকলের অগ্রবর্ত্তী হইয়া, সকলকে উৎসাহিত করিয়া, শত্রুগণকে ঘোরতররূপে আক্রমণ করিলেন। এই সময় তিনি শত্রু নিক্ষিপ্ত ভীষণ ভল্লাঘাতে আহত হন—ইহাতে তাঁহাকে অনেকদিন কষ্ট পাইতে হইয়াছিল। স্তুপ সকল আরো উন্নত করিয়া, অলিকসন্দর আরো ঘোরতর বিক্রমে নগরের উপর অস্ত্র, প্রস্তর, মুদ্গর প্রভৃতি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।—স্থানে স্থানে প্রাচীরের নিম্নস্থ বালুকা খনন করিয়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। বেতিস পরিচালিত গাজার সৈনিকগণও কোনরূপে উৎসাহহীন না হইয়া, ঘোরতররূপে প্রতিক্ষণ শত্রু সৈন্যের উপর মুসলধারে প্রস্তরাদি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। বালুকা খনন করায় স্থানে স্থানে প্রাচীর ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গেল, মাসিদনেরা সেই স্থান দিয়া নগর আক্রমণ করিবার জন্য বিশেষ চেষ্ঠা করিল, কিন্তু গাজাবাসীর বাহুবলের কাছে, এইরূপ তিনবার চেষ্টা বিফল হইয়া গিয়াছিল। কোনরূপে নগর অধিকারে কৃতকার্য্য হইতে না পারিলে, অলিকসন্দর প্রাচীরের আরো বহুস্থান ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন, কতকগুলি সৈন্য রজ্জু আরোহিণী যোগে প্রাচীর আরোহণ করিয়া আক্রমণ করিল, অপর সৈন্যসহ অলিকসন্দর স্বয়ং ভগ্নস্থান দিয়া প্রবেশ করিয়া প্রচণ্ডবেগে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। নিওপ্তলিমস্ নামক একজন সহচর যোদ্ধা, সর্ব্বাগ্রে প্রাচীরে আরোহণ করিয়া শত্রুগণকে আক্রমণ করিলেন। তাঁহার উদাহরণে অনুপ্রাণিত হইয়া বহুসংখ্যক যোদ্ধা, প্রাচীর অতিক্রমণ করিয়া নগরমধ্যে প্রবেশ করেন। ইহারা নগর দ্বার উদ্ঘাটন করিয়াদিলে, দলে দলে অলিকসন্দরের সৈন্যগণ ঘোরতররূপে গাজাবাসীকে আক্রমণ করিতে লাগিলেন। গাজাবাসী যখন দেখিলেন, নগর রক্ষার আর কোন উপায় নাই, তখন তাঁহারা পরাধীন হইয়া জীবনরক্ষা করা অপেক্ষা, যে যথায় ছিল তিনি একাকী হউন, বা দলবদ্ধ অবস্থায় হউন, সেই অবস্থায় অবস্থান করিয়া অটল অচলের ন্যায় শত্রুগণকে অভ্যর্থনা করিবারজন্য অসি হস্তে দাঁড়াইয়া রহিলেন। এইবার যে যুদ্ধ হইল তাহা বর্ণনার অতীত বিষয়। গাজাবাসীরা অদ্ভুত কার্য্য সম্পন্ন করিয়া, অম্লানবদনে সুরলোকে গমন করিল। তাহারা নশ্বর শরীরের পরিবর্ত্তে, অক্ষয়কীর্ত্তি অর্জ্জন করিলেও—প্রভুভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইলেও, নিষ্ঠুর হৃদয় অলিকসন্দরের সহানুভূতি লাভে সমর্থ হয় নাই। দুই মাসকালব্যাপী এই ঘোরতর অবরোধে ১০ হাজার ত্রিকালস্মরণীয় গাজাবাসীযোদ্ধা বীরলোক প্রাপ্ত হইলেন; তাহাদের অনাথা স্ত্রীপুত্রগণ অলিকসন্দরের আজ্ঞায় দাসরূপে বিক্রীত হইয়াছিল। মহাবীর বেতিসের শোচনীয় পরিণাম স্মরণ করিলে শরীর শিহরিয়া উঠে—তাঁহার চির নূতন অপুর্ব্ব আত্মত্যাগ কাহিনী চিরকালই পতিত জনগণ হৃদয়ে বল সঞ্চার করিবে। যুদ্ধকালে বেতিসের শরীর হইতে, অজস্র শোণিতধারা নির্গত হইলেও, তিনি যেন অধিকতর পরাক্রমের সহিত তাহাদের সর্ব্বস্ব লুণ্ঠনকারী শত্রুগণকে আক্রমণ করিলেন। তাঁহার প্রচণ্ড শাণিত খড়্গাঘাতে বহু সংখ্যক শত্রু প্রাণত্যাগ করিলেও যখন তিনি আরো অধিক সংখ্যক শত্রু কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইলেন; যখন তাঁহার খড়্গ ও বর্ম্ম অব্যবহার্য্য হইয়া পড়িল, তখন তিনি কোনরূপে বন্দী হইয়া অলিকসন্দর সমীপে নীত হন। অলিকসন্দর, তাঁহা অপেক্ষা উন্নত হৃদয় বেতিসকে প্রাপ্ত হইয়া ভ্রুকুটী পূর্ব্বক কহিলেন, “তুমি যেরূপ মৃত্যুর আকঙ্খা কর, তাহাই তোমার হইবে। অসীমযন্ত্রনা ভোগেরজন্য প্রস্তুত হও।” বীরবর বেতিস, এরূপ নিকৃষ্ট পশুর সহিত আলাপ করা পাপজনক বিবেচনা করিয়া, যেন ঘৃণাপূর্ণচক্ষুতে চাহিয়া তাহার উত্তর প্রদান করিলেন। অলিকসন্দর, তাঁহার পার্শ্বস্থ সহচর উদ্দেশ্যে বলিয়েন, “তুমি ইহার অবাধ্যতা পরিপূর্ণ স্তব্ধতা লক্ষ্য করিলে? একে কি হাঁটু গাড়িয়া বসিতে দেখিয়াছ? ইহার একটিও বশ্যতা সূচক কথা শুনিয়াছ? ইহার মুকত্ব আমি দূর করিব। যদি কোন কথাও না বাহির হয়, তাহা হইলেও যন্ত্রনাসূচক ধ্বনি, ইহার মুখ হইতে আমি বাহির করিব।” হোমার ভক্ত পাপ অলিকসন্দরের উপায় উদ্ভাবন করিতে বিলম্ব হইল না। তাঁহার পূর্ব্বপুরুষ এচিলিস, হেক্টারের দেহ রথে বাঁধিয়া যেরূপ ট্রয়ের চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিয়াছিলেন, সেইরূপ তিনি মহাপ্রাণ বেতিসের পদতলে কীলক বিদ্ধ করিয়া, তাহাতে রজ্জু বদ্ধ করিয়া, রথে বাঁধিয়া দ্রুতবেগে অশ্ব সঞ্চালন করিয়া গাজা প্রদক্ষিণ করিয়াছিলেন। অলিকসন্দরের এই নিষ্ঠুরতা এচিলিয়সকেও অতিক্রমণ করিয়া ছিল; শেষোক্ত হেক্টরের মৃতদেহ টানিয়া ছিলেন, অলিকসন্দর জীবিত বেতিসকে টানিয়া নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন।

 অলিকসন্দর গাজা পরাজয় করিয়া, অতি দ্রুতগতিতে মিশ্রদেশ অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন—এ দেশের পারসীক কর্ম্মচারীরা, গ্রেণিকস, ইসস্, তাইরি, গাজা প্রভৃতির পরিণাম কথা শুনিয়া, নিজেদের কর্ত্তব্য ভুলিয়া গেল, তাহারা ধনজন লইয়া অলিকসন্দরের সরণাপন্ন হইল। কুর্ত্তিয়স্ বলেন, দারার একটী কর্ম্মচারী ৮ শত ট্যালাণ্ট অর্থাৎ ২৯ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা প্রদান করিয়া অলিকসন্দরের প্রীতিভাজন হইতে চেষ্টা করে। সংসারে প্রায় দুই শ্রেণীর লোক দেখিতে পাওয়া যায়। এক শ্রেণীর লোক নিজেদের শোণিতপাত দেখিয়া, ক্রোধোন্মত্ত হইয়া যুদ্ধ করিয়া থাকেন। অপরে, অপরের শোণিতপাত দেখিয়া ভয়বিহ্বল হইয়া রণস্থল পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। মিশ্রদেশের পারসীক কর্ম্মচারীরা, অপরের বিপদ দেখিয়া মুহ্যমান
লাইসিমেকসের প্রস্তুত মুদ্রা
 এমন রূপে অলিকসন্দর
১৫ পৃষ্ঠা


হারসুস পদক
রোমক সময়ে হারকুলিসরূপে অলিকসন্দর
হইলেন, নিজের বিপদ দূর করিবার শক্তি তাঁহাদের অন্তর্হৃত হইল।

 অলিকসন্দর, মিশ্রদেশের প্রধান নগর,নীলনদ তটবর্ত্তী মেমফিসে গমন করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন।—এ স্থানে গমন পথে সূর্য্যনগর বা গ্রীক হিলিওপলিস তাঁহার অধিকারভুক্ত হইল। মেমফিসে গমন করিয়া, তিনি দেবপূজা ও নানাপ্রকার উৎসবের অনুষ্ঠান করিলেন। এস্থান হইতে পুনঃপ্রত্যাগমন করিয়া অলিকসন্দর বর্ত্তমান আলেকজেন্দ্রিয়ার ২শত ২০ মাইল দূরে এমনের মন্দির দর্শন করিতে গমন করেন। এ স্থানে গমনাগমনকালে তাহাকে বালুকা সমুদ্র মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ পাইতে হইয়াছিল। কিন্তু তিনি তাঁহার ভশুাদৃষ্ট বশতঃ রাস্তার সমস্ত ক্লেশ অতিক্রমণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। অলিকসন্দর, তিনি কাহার পুত্র ইহা জানিবার জন্য ধন্না দেন। এখানকার প্রধান পুরোহিত অলিকসন্দরকে সম্মানিত করিবার জন্য “ওপিদিয়ম” অর্থাৎ “হে পুত্র” বলিয়া সম্বোধন করেন, তাঁহার উচ্চারণ ঠিক না হওয়াতে তাহা “ও পি দিয়স্” অর্থাৎ “হে দেব পুত্র” এইরূপ শ্রুত হইয়াছিল। অলিকসন্দারের অভীষ্ট সিদ্ধ হইল, পুরোহিতের ভ্রম, তাঁহার কীর্ত্তিবর্দ্ধন করিল, তিনি এইরূপ বিবেচনা করিতে লাগিলেন। পুরোহিতকে যথেষ্ট ধনরত্ন দিয়া অলিকসন্দর পুনরায় মেমফিসে আগমন করিয়াছিলেন। নির্ব্বিঘ্নে বালুকা সমুদ্র উত্তীর্ণ হইতে পারায়, তাঁহার গর্ব্ব, ও সৈনিকগণ মধ্যে প্রতিপত্তি, বিশেষরূপে বর্দ্ধিত হইয়াছিল। মিশ্রদেশে অবস্থান কালে তিনি বর্ত্তমান আলেকজেন্দ্রিয়া নগরের ভিত্তি স্থাপন করেন। প্রাচী ও পশ্চিম দেশের মধ্যবর্ত্তী হওয়াতে, সেকালে ইহা বাণিজ্য বিষয়ে বিশেষ প্রধান্য লাভ করিয়াছিল। অলিকসন্দরের মৃত্যুর পরই তাঁহার সাম্রাজ্য নষ্ট হইয়া গিয়াছিল, তাঁহার বিষয় স্মরণ করিয়া দেয় এরূপ কোন কীর্ত্তিও বিদ্যমান ছিল না; একমাত্র অলেকজেন্দ্রিয়া এখন বর্ত্তমান থাকিয়া পুরাতত্ত্ব জিজ্ঞাসুর কাছে তাঁহার নাম স্মরণ করিয়া দেয়। খৃষ্টের জন্মগ্রহণের ৩৩১ বৎসর পূর্ব্বে বসন্তকালে অলিকসন্দর মিশ্রদেশ পরিত্যাগ করিয়া আবার তাইরি নগরে উপস্থিত হন। ইনি এক্ষণে এসিয়া মাইনর, যুদিয়া এবং মিশ্রদেশের অদ্বিতীয় অধিশ্বর। অল্প সময় এবং অল্প বয়সের ভিতর, একজন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী নরপতিররাজ্য, তিনি অধ্যবসায় দৃঢ়তা, যুদ্ধস্থলে নির্ভীকতা, প্রভৃতি পুরুষজনোচিৎগুণে ভূষিত হওয়াতে অধিকার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

 তাইরিতে অবস্থান কালে, অলিকসন্দর, দীর্ঘকাল ব্যাপী উৎসবের অনুষ্ঠান করেন। ইহাতে তাঁহার নিকটবর্ত্তী সামন্তনরপতিগণ আহুত হইলেন। নৃত্য,গীত, নাটক অভিনয়, ব্যায়াম, মৃগয়া প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হইয়া এই উৎসবকে সকলের প্রীতিপ্রদ করিয়াছিল। সমস্ত সৈন্য নানাপ্রকার ভোজ্যে আপ্যায়িত হইল, তাহারা অতীত ক্লেশের কথা ভুলিয়া গেল। তাহারা যেন নূতন প্রাণে নূতন উদ্যমে অধিকতর বিপদের সম্মুখীন হইবার জন্য প্রস্তুত হইল। কয়েক সপ্তাহের উৎসবের পর, অলিকসন্দর আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইলেন।

 দারা, ইসস্ ক্ষেত্রে পরাজিত হইয়া ইউফেণ্ট্রিসের পরপারে গমন করিয়া নিজেকে বিপদমুক্ত বিবেচনা করিলেন। তিনি তাঁহার সাম্রাজ্যের অভ্যন্তর প্রদেশে গমন করিয়া নূতন উদ্যমে নুতনসৈন্যসংগ্রহ করিতে লাগিলেন। তাঁহার পশ্চিমদেশীয় সৈন্যগণ অলিকসন্দরের কাছে পরাজিত হইয়া বিভীষিকাগ্রস্ত হইয়াছে। সেসকল সৈন্য লইয়া যুদ্ধ শুভজনক হইবে না বিবেচনা করিয়া, দারা তাঁহার রাজ্যের পূর্ব্ব প্রান্ত হইতে অধিকাংশ সৈন্য সংগ্রহ করেন। ব্যাক্ত্রিয়া, বর্ত্তমান আফগানিস্থান, বেলুচিস্থান, প্রভৃতি প্রদেশ হইতে বহুসংখ্যক বুদ্ধপ্রিয় জাতি, অলিকসন্দরের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য দাদার পতাকার নিয়ে সমবেত হন। আমাদের অনেক ভারতীয় রাজা ও স্বতঃ প্রবৃত্ত হইয়া, দারার সহায়তার জন্য গমন করিয়াছিলেন। দারা এই নানাদেশীয় লোকসমষ্টি লইয়া, অলিকসন্দরের সহিত পুনরায় বাহুবল পরীক্ষা করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। দারার এই লোকসমষ্টি সম্বন্ধে কৃর্ত্তিয়স বলেন, ইহার মধ্যে ২ লক্ষ পদাতিক এবং ৪৫ হাজার অশ্বারোহী ছিল, এরিয়ানের মতে ১ লক্ষ পদাতিক এবং ৪০ হাজার অশ্বারোহী, যষ্টিনের মতে ৪ লক্ষ পদাতিক ১ লক্ষ অশ্বারোহী, ডিওডোরসের মতে ৮ লক্ষ পদাতিক ২ লক্ষ অশ্বারোহী এবং প্লুটার্ক বলেন, মোটে দশ লক্ষ সৈনিকসহ দারা যুদ্ধ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর তাঁহার বলোদৃপ্ত বাহিনী লইয়া, দারার অনুসরণ করিবার জন্য ফিনিসীয়া হইতে বহির্গত হইলেন। একাদশ দিবস তিনি পথ অতিক্রমণ করিয়া, শ্রাবণ মাসে ইউফেট্রিসের তটদেশে থাপাসকস নামক স্থানে উপস্থিত হন। দারা, নদীরপারঘাট রক্ষা করিবার জন্য দুইহাজার গ্রীক এবং এক সহস্র পারসীক অশ্বারোহী, মাজিয়স নামক একজন কর্ম্মচারীর অধীনতার প্রদান করিয়া প্রেরণ করেন। কাপুরুষ কর্ম্মচারী, অলিকসন্দরের আগমনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়াই প্রাণভয়ে পলায়ন করিল। নদী উত্তীর্ণ হইবার সময় বাধা প্রাপ্ত হইবেন ভাবিয়া, অলিকসন্দর সেতু প্রস্তুত করিতে ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। যখন তিনি শুনিলেন, পারসীক কর্ম্মচারী তাহার কর্ত্তব্য ভুলিয়া চলিয়া গিয়াছে; তখন তিনি বিনা বাধায় দুইটি নৌকার পোল প্রস্তুত করিয়া সমস্ত সৈন্যসহ নদীর অপর পারে গমন করেন। এ স্থান হইতে তিনি সরল পথে ব্যাবিলনে গমন না করিয়া, বক্রপথে তদভিমুখে গমন করেন। শেষোক্ত পথ, অপেক্ষাকৃতশীতল তৃণশষ্প পরিপূর্ণ এবং খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ পক্ষেও সুবিধাজনক। গমনকালে দারার কতকগুলি গুপ্তচর তাঁহার হস্তে পতিত হয়। তাহাদের মুখে শুনিলেন যে, দারা পূর্ব্বাপেক্ষা প্রচুর সৈন্য লইয়া খরবেগ তাইগ্রিসের তটে অলিকসন্দরকে বাধা দিবার জন্য অবস্থান করিতেছেন। একথা অবগত হইয়া মাসিদনপতি দ্রুতগতিতে তদভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, এস্থানে দারা বা ইহা রক্ষা করিবার জন্য কোন সৈন্যও উপস্থিত নাই। স্বদেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক পুরুষগণ, বিদেশী শত্রুর আগমন পথে বাধা না দিলেও, তাইগ্রিস কিন্তু বিদেশী শত্রুর ভয়ে ভীত না হইয়া, প্রবলবেগে অলিকসন্দরের প্রতিকুল আচরণ করেন—তাইগ্রিস যদি ইহার উপর স্বদেশভক্তের সাহায্য পাইত, তাহা হইলে অলিসন্দরকে এস্থানে বড় কম ক্লেশ পাইতে হইত না। ইহা উত্তীর্ণ হইয়া অলিকসন্দর এ স্থানে সৈন্যগণকে কএকদিন বিশ্রাম করিতে অবকাশ প্রদান করেন। এখানে অবস্থান কালে (২০শে সেপ্টেম্বর ৩৩১ খৃঃ পূঃ) কার্ত্তিক মাসে প্রায় পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ হইয়াছিল। গ্রহণ উপলক্ষে অলিকসন্দর, চন্দ, সূর্য্য, ও পৃথিবী উপলক্ষে বলি প্রদান করিয়াছিলেন। “এই গ্রহণ অলিকসন্দর ও মেসিদনবাসীর পক্ষে শুভজনক, এবং এই মাসেই অলিকসন্দর অতুলনীয় বিজয়লাভে সমর্থ হইবেন” এইরূপ কহিয়া জ্যোতিষি তাঁহাকে উৎসাহিত করেন। অলিকসন্দর বিলম্ব না করিয়া দারার উদ্দেশ্যে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। দিবস চতুষ্টয় গমন করিবার পর, তাঁহার চর আসিয়া সংবাদ দিল “শত্রু অশ্বারোহী দূরে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে কিন্তু তাহাদের সংখ্যা অনুমান করা যাইতেছে না।” অলিকসন্দর, তাঁহার কতকগুলি সহচর সৈন্যসহ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিলেন। অবশিষ্ট সৈন্যকে তিনি ধীরে ধীরে আসিতে আদেশ দেন। অলিকসন্দরকে দ্রুতবেগে আগমন করিতে দেখিয়া, দারার সৈন্যগণ সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া শীঘ্রগতিতে গমন করে। তাহাদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি যাহাদের ঘোটক দ্রুত গমনে অসমর্থ হইয়াছিল, তাহারা অলিকসন্দরের হস্তে পতিত হয়। তাহাদের মুখে অলিকসন্দর অবগত হইলেন যে, দারা অনতিদূরে অবস্থান করিতেছেন। তাঁহার সহিত ভারতবর্ষ, আফগানিস্থান—বেলুচিস্থান খোরাসান, বলখ, বোখারা প্রভৃতি প্রদেশের যুদ্ধপ্রিয় জাতিগণ অবস্থান করিতেছে। বিভিন্নদেশীয় যে সকল সৈন্য, সেনানীগণ পরিচালনা করিতেছেন, তাহারা তাঁহাদের নামও উল্লেখ করিল। এই সকল সৈন্য ব্যতীত দারার পক্ষে ১৫টা হাতী ভারতবর্ষ হইতে যুদ্ধের জন্য আগমন করিয়াছিল। এই বিপুল বাহিনী লইয়া দারা গাউগামেলা (উষ্ট্রগৃহ) নামক স্থানের প্রান্তরে অবস্থান করিতেছিলেন। এ স্থান হইতে আরবেলা, ৬৯ মাইল দুরে অবস্থিত হইলেও দারাসহ অলিকসন্দরের এই সংগ্রাম আরবেলার যুদ্ধ বলিয়া ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে।

 অলিকসন্দর বন্দীদ্বয়ের মুখে দারার অবস্থা অবগত হইয়া সৈন্যগণকে সেই স্থানে চার দিন বিশ্রাম করিতে অবকাশ প্রদান করেন। তিনি, শিবির সকল পরিখা পরিবেষ্টিত করিয়া তাহাতে তাঁহাদের সমস্ত মালপত্র এবং যাহারা যুদ্ধ করিতে অসমর্থ হইয়াছিল তাহাদিগকে রাখিয়া দিলেন। পঞ্চম দিবসের রাত্র তিনটার সময় শত্রু উদ্দেশে যাত্রা করিলেন—সৈন্যগণ যুদ্ধোপযোগী অস্ত্র শস্ত্র ব্যতীত আর কোন দ্রব্য গ্রহণ করিতে অনুজ্ঞাত হইল না। অলিকসন্দর মনে করিয়াছিলেন যে, সূর্য্যোদয়ের সহিত শত্রুকে আক্রমণ করিবেন। তাঁহার হিসাবে ভুল হইয়াছিল। সূর্য্যোদয়কালে তিনি একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ের উপর উপস্থিত হইলেন। এস্থানে তিনি তাঁহার সেনানীগণের সহিত মিলিত হইয়া এই ক্ষণেই পারসীকগণকে আক্রমণ করা উচিত, অথবা এখানে বিশ্রাম করিয়া পরে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন, এতদ্বিয়ষক পরামর্শ করেন। পার্মিণিও বলেন এস্থানে অবস্থান করিয়া স্থানের অবস্থা ভাল করিয়া দেখিতে হইবে, যদি শত্রুগণ কোন স্থানে গর্ভখনন করিয়া তাহার উপর তৃণাচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়া থাকে, অথবা স্থানে স্থানে লুকাইয়া খোঁটা পুতিয়া থাকে এ সকল, এবং শত্রুর ব্যুহরচনা প্রভৃতি ভাল করিয়া দেখিতে হইবে। পার্মিণিওর পরামর্শ গৃহীত হইল—সৈন্য সকল এস্থানে অবস্থান করিল, অলিকসন্দর তাঁহার কতক সহচর সৈন্যসহ যে স্থানে তিনি যুদ্ধ করিবেন, সেই স্থান পুংঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরিদর্শন করিয়া প্রত্যাগমন করিলেন। আবার সেই সকল সেনানীকে সমাবত করিয়া তিনি বলিলেন, “আপনাদিগকে যুদ্ধ করিবার জন্য আমাকে উৎসাহিত করিতে হইবে না—আপনারা স্বীয় স্বীয় শৌর্য্য এবং যে সকল অতিসাহস কার্য্য করিয়াছেন, তাহাতেই আপনারা মদমত্ত আছেন—আপনাদের এখন কর্ত্তব্য,আপনাদের অধীনস্থ প্রত্যেক লোককে কর্ত্তব্য পরিপালনে দৃঢ়ব্রত করিবেন। প্রত্যেক অশ্বারোহী ও পদাতিক সেনাপতি, আপন আপন দলের প্রত্যেক সেনাকে যেন যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেন। সকলের যেন ইহা স্মরণ থাকে যে, পূর্ব্বের যুদ্ধ, সিরিয়া, মিশ্র, প্রভৃতি প্রদেশ জয় করিবার জন্য অভিনীত হইয়াছিল। বর্ত্তমান যুদ্ধ সমগ্র এসিরার জন্য অনুষ্ঠিত হইবে। কে একছত্রী সম্রাট হইবে, এই যুদ্ধে তাহা নির্ণিত হইবে। বেশী কথায় সৈন্যগণকে উৎসাহিত করিতে হইবে না, ইতিপূর্ব্বেই তাহারা সাহসের যথেষ্ট পরিচয় প্রদান করিয়াছে; স্বভাবতঃই তাহারা সাহসী, এখন দেখিতে হইবে, যুদ্ধের সঙ্কট সময়ে যেন তাহারা বিশৃঙ্খল হইয়া না পড়ে। যখন নিস্তব্ধ থাকিবার দরকার হইবে; সে সময় যেন তাহারা মৌলাবলম্বন করিয়া থাকে। আর যখন সিংহনাদ করিবার আবশ্যক হইবে, তখন যেন সকলে সমস্বরে শব্দ করিয়া শত্রুগণকে সম্মোহিত করিয়া ফেলে। যুদ্ধকালে তাঁহার আজ্ঞা সেনানী ও সৈন্যগণ মধ্যে যাহাতে শীঘ্র প্রচারিত হয়, সে বিষয় বিশেষ মন দিতে কহেন। যদি সমষ্ঠিও ব্যক্তিগতভাবে কর্ত্তব্য পরিপালনে শিথিলতা প্রকাশ পায়, তাহা হইলে বিপদঘনীভূত হইয়া থাকে, আর প্রত্যেকে যদি ব্যক্তিগত ও সমষ্টি ভাবে জয় লাভের জন্য আপনার সমস্ত উদ্যম বিনিযোগ করেন, তাহা হইলে কাহার সাধ্য তাহাকে পরাজয় করে? এইরূপ নানা প্রকার উৎসাহপূর্ণ বাক্য বলিয়া অলিকসন্দর সৈন্যগণকে ভোজন ও বিশ্রাম করিতে আদেশ করেন।

 এস্থান হইতে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে দারা অবস্থান করিতেছিলেন। তিনি অলিকসন্দরের আগমন সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া রহিলেন—পাছে শত্রু রাত্রিতে আক্রমণ করে এই আশঙ্কায় সৈন্যগণ সমস্ত রাত্রি যুদ্ধসজ্জায় কোলাহল করিয়া অতিবাহিত করে।

 পার্মিণিও, পারসীক সৈন্যের সংখ্যার আধিক্য দেখিয়া অলিকসন্দরের কাছে রাত্রিকালে শত্রু আক্রমণ করিবার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রত্যুত্তরে অলিকসন্দর বলেন “অন্ধকারের সাহায্যে চুরি করিয়া আমি জয়লাভ কারতে ইচ্ছা করি না।” অলিকসন্দর বুঝিয়াছিলেন, রাত্রি যুদ্ধে অপেক্ষাকৃত প্রস্তুত ও অপ্রস্তুত উভয়পক্ষেরই বিপদাপন্ন হইবার সম্ভাবনা আছে। এরূপ যুদ্ধে শক্তিশালী ও অনেক সময় দুর্ব্বলের হস্তে এবং দুর্ব্বল ও শক্তিশালীর হস্তে নিগৃহীত হইয়াথাকে, রাত্রিযুদ্ধে দারা পরাজিত হইলে ও পুনরায় তিনি যুদ্ধ করিবার জন্য উৎসাহিত হইতে পারেন। দুর্ব্বল ব্যক্তিই রাত্রি যুদ্ধের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে বিবেচনা করিয়া আলিকসন্দর এরূপ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন নাই। বিশেষতঃ যে স্থানে যুদ্ধানল ঘোরতররূপে প্রজ্বলিত হইয়া থাকে, যে স্থানে গমন সর্ব্বাপেক্ষা বিপদজনক, যে স্থানে নিষ্কাশিত তরবারির চাক্‌চিক্যে চক্ষু ঝলসিয়া উঠে, এবং তাহার ভীষণ প্রহারে যে স্থান আকুলিত হইয়া উঠে, অলিকসন্দর সেই ভীষণ স্থানে গমন করিয়া নিজের অতি মানুষ বীরত্ব দেখাইতে স্বভাবতঃই শিক্ষিত; রাত্রিযুদ্ধে তাঁহার উদাহরণ সৈন্যগণ মধ্যে অনুক্রামিত হইয়া, তাহাদিগকে যুদ্ধ দুর্ম্মদ করিবার সম্ভাবনা খুব কম, তাই তিনি অন্ধকারের সাহায্যে চোরের মতন, চুরি করিয়া জয়লাভ করিতে ইচ্ছুক হন নাই।

 আবার প্রাতঃকাল হইল, সূর্য্যদেবও আবার আকাশে উদিত হইলেন। সমস্তজগৎ জাগরিত হইল, অলিকসন্দর এখনও নিদ্রিত।—পারমিণিও রাজশিবিরে গমন করিয়া তাঁহাকে জাগরিত করিয়া বলিলেন; পারসীকগণ যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হইতেছে। আমাদের সৈন্যগণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতে আজ্ঞা প্রদান করুন। আপনি আজ এত নিদ্রা যাইতেছেন কেন? অলিকসন্দর হাসিয়া বলিলেন “আপনি আমাদিগকে সমরবিজয়ী বলিয়া অবগত হউন, আর আমাদিগকে, দেশ হইতে দেশান্তর অতিক্রমণ করিতে হইবে না, দারা যুদ্ধের জন্য আমাদের সম্মুখে অবস্থান করিতেছে?”

 অলিকসন্দর, অতি প্রসন্ন চিত্তে সৈন্যগণ মধ্যে উপস্থিত হইলেন, তাঁহার আনন্দপূর্ণ মুখশ্রী দেখিয়া সৈন্যগণ মধ্যে এরূপ দৃঢ় ধারণা বদ্ধমূল হইল, যেন বিজয়শ্রী তাহাদের করতলগত হইয়াছে। অলিকসন্দর তাঁহার সৈন্যগণকে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসারে যুদ্ধের জন্য সজ্জিত করিলেন। তাঁহার দক্ষিণ পক্ষের শেষভাগে তাঁহার সহচর অশ্বারোহীগণ আট ভাগে বিভক্ত হইয়া ফিলটের অধীনতায় অবস্থান করিল—পারমিণিও পুত্র নিকানর এবং ক্রিতিরস যথাক্রমে পাদাতিক সেনার দক্ষিণ ও বামভাগে অবস্থান করিলেন। বামভাগে থেসিলীয় এবং সম্মিলিত গ্রীক অশ্বারোহীগণ রক্ষিত হয়। অলিকসন্দর দক্ষিণ এবং পারমিণিও বামভাগে অবস্থান করিয়া সৈন্য পরিচালনা করেন। অলিকসন্দর ৭ হাজার অশ্বারোহী আর ৪০ হাজার পদাতিক সৈন্য লইয়া দারার সম্মুখীন হইয়া যুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন! তিনি বুঝিয়াছিলেন কোন গতিকে প্রধান সেনানীকে নিহত বা যুদ্ধস্থল হইতে বিতাড়িত করিতে সমর্থ হইলে বিজয় লাভ করিতে আর বিলম্ব হয় না। তাই তিনি দারার সৈন্যের দিকে লক্ষ্য না করিয়া তাঁহাকে পরাস্ত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন।

 পারস্যপতি তাঁহার বামভাগের শেষের দিকে ব্যাক্ত্রিয়া দেশীয় অশ্বারোহী, তারপর দানস্, (কাস্পীয়ান সাগরের পূর্ব্ব দেশবর্ত্তী জনগণ) আরচোটিয়ান, (আফগান ও বেলুচীস্থানের মধ্যবর্ত্তী) তারপর পারসীক অশ্বারোহী ও কেডুসিয়ান, (কাস্পীয়ানের দক্ষিণ পশ্চিমদিক্ বাসী) দক্ষিণ দিকে সিরিয়া, মোসপটমিয়ার অধিবাসী, পার্থিয়ান, (থোরাসনবাসী) প্রভৃতি জনপদবাসী অবস্থান করিতেছিল। মধ্যবর্ত্তী দারার সম্মুখে নানাপ্রকার আয়ুধ সম্পন্ন রথ এবং ১৫টা হস্তী অলিকসন্দরের প্রতিস্পর্দ্ধী হইয়া দণ্ডায়মান হইয়াছিল।

 যখন উভয় সৈন্য পরস্পরের নিকটবর্ত্তী হইল—যখন দারার সৈন্যগণের স্বর্ণময় আভরণের চাক্‌চিক্য নয়নগোচর হইল, তখন অলিকসন্দর তাঁহার সৈন্যগণকে পরিচালনা করিয়া বক্রভাবে দ্রুতবেগে গমন করিয়া দারার বামভাগ আক্রমণ করেন—অলিকসন্দর ইতিপূর্ব্বে যুদ্ধস্থলে হস্তীর উপস্থিতি কখন প্রত্যক্ষ করেন নাই, বোধ হয় সেই জন্য ঠিক সম্মুখ আক্রমণ না করিয়া তিনি একটু বাঁকা হইয়া আক্রমণ করিলেন। দারা ও তাঁহার সৈন্যগণকে সামনা সামনি গমন করিতে আদেশ দিলেন। অলিকসন্দর যখন যুদ্ধ শকটের জন্য পরিস্কৃত ভূমির পার্শ্ব দিয়া আগমন করিতে লাগিলেন, তখন দারা, তাঁহার বাম ভাগের সম্মুখভাগে যে সকল ব্যাক্ত্রিয়া ও শক দেশীয় সৈন্য ছিল, তাহাদিগকে শত্রুর দক্ষিণ দিক আক্রমণ করিতে প্রেরণ করিলেন। যে সকল গ্রীকসেনা ইহাদিগের আক্রমণ রোধ করিবার জন্য প্রেরিত হইল, তাহারা ইহাদিগের বেগ কোনরূপে সহন করিতে সমর্থ হইল না—গ্রীকসেনার সাহায্যের জন্য অন্য সেনা ধাবিত হইল। তাহারা উভয়ে মিলিত হইয়া কোনরূপে স্থান রক্ষা করিতে সক্ষম হইল। অস্ত্রদ্বারা সুরক্ষিত শকটসমূহ, অলিকসন্দরের অভিমুখে প্রেরিত হইল। গ্রীক লেখকেরা বলেন, ইহাদের চালকগণ অলিকসন্দর সৈন্যের দীর্ঘ বর্ষার এবং অস্ত্রাঘাতে অকর্ম্মণ্য হইয়া পড়ে। সুতরাং কোন কাযেই আসে নাই। যে কয়েকখান ব্যুহভেদ করিতে সমর্থ হইয়াছিল তাহারা অশ্বপাল প্রভৃতি কর্ত্তৃক ধৃত হইয়াছিল। এই যুদ্ধে হস্তী সৈন্যের কার্য্য সম্বন্ধে কোনরূপ উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না। অলিকসন্দর, তাঁহার দক্ষিণ পক্ষের সৈন্যসহ দারার সৈন্যের প্রথমশ্রেণী ভেদ করিয়া প্রবেশ করিলেন, দারা যে দিকে তাঁহার বিশ্বস্ত বাহিনীসহ অবস্থান করিতেছিলেন। তিনি প্রচণ্ড পরাক্রমে সেই দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। পারসীক সৈন্য ভেদ করিয়া তাহাদিগকে বিভক্ত করিয়া ফেলিলেন—পারসীক অশ্বারোহী অল্প স্থানে বহু সংখ্যক অবস্থান করাতে তাহারা শত্রুদের উপর সুবিধামত অস্ত্র প্রয়োগ করিতে পারিল না। অথচ তাহারা মেসিদনদের দীর্ঘ বর্ষার প্রভাবে জর্জ্জরিত হইয়া পড়িল। অলিকসন্দর সেনানী অরিত্রাস, দারার বামভাগে বিপুল পরাক্রমের সহিত আক্রমণ করিলেন। ইহাতে সৈন্যগণ অধিকতর বিশৃঙ্খল হইয়া পড়িল। কুর্ত্তিয়স্ ও ডিওডোরস্ বলেন, দারা খুব উৎসাহ ও ধৈর্য্যের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন। এরিয়ান বলেন, “দারা প্রথম হইতেই বিভীষিকাগ্রস্ত হইয়াছিলেন তিনিই সর্ব্বপ্রথমে রণে ভঙ্গদিয়া পলায়নে প্রবৃত্ত হন”।

 অলিকসন্দর এ ভাগে বিজয় প্রাপ্ত হইলেন বটে, কিন্তু অন্য ভাগের অবস্থা খুব সঙ্কটজনক হইয়াছিল। তাঁহার বাম ভাগ, শত্রুসৈন্যের দারুণ আক্রমণে কম্পিত হইয়া পড়িয়াছিল। বিজয়শ্রী দারার পক্ষ অবলম্বন করিবার উপক্রম করিয়াছিলেন। যুদ্ধনিপুণ পারমিণিও বারংবার সাহায্যপ্রার্থী হইয়া অলিকসন্দরের কাছে লোক প্রেরণ করিল। অলিকসন্দর তাঁহাকে সাহায্য করিতে না পারিলেও বলিয়া পাঠাইলেন বিজয়শ্রী আমাকে আলিঙ্গন করিয়াছেন, দারা যুদ্ধস্থল পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছে, কিয়ৎক্ষণ যুদ্ধস্থলে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করিতে পারিলেই, কার্য্যসিদ্ধি হইবে। অলিকসন্দরের অনুমান ঠিক হইল। দারার সৈন্যের বিজয় লাভের উপক্রমকালে, দারার পলায়ন বার্ত্তা প্রচারিত হইল। যাহারা শত্রুসৈন্য বিত্রাসিত করিয়া যুদ্ধ করিতেছিল, তাহারা বিভীষিকাগ্রস্ত হইল! যাহারা বেগে অগ্রসর হইয়া শত্রুগণকে পশ্চাদপদ করিতেছিল, তাহারা পলায়নে প্রবৃত্ত হইল!

 অলিকসন্দরের সৈন্য যখন বিভক্ত হইয়া পড়ে; সেই সময় আমাদের ভারতীয় এবং পারসীক সৈন্য তাহাদের মধ্যদেশ ভেদ করিয়া শত্রুর পশ্চাদভাগে গমন করিয়া ঘোরতর যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করে।—তাহাদের প্রচণ্ড আক্রমণে মেসিদন সৈন্য সম্পূর্ণ পরাস্ত হইয়া হতবীর্য্য হইয়া পড়ে।—বিজেতার হস্তে মেসিদনদের সমস্ত লুণ্ঠিত দ্রব্য পতিত হইল। যাহারা বন্দী হইয়া অবস্থান করিতেছিল তাহারা মুক্ত হইল। অলিকসন্দরের নিকট এই পরাজয়, এবং মালপত্র ভারতবাসীর হস্তে পতিত হইবার কথা নীত হইলে, তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন “আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করিতে পারিলে শত্রুগণের মালপত্রের সহিত আমাদের মালপত্র পুনঃপ্রাপ্ত হইব। সে দিকে এ সময় সাহায্য পাঠাইয়া কদাচ দুর্ব্বল হওয়া উচিত নহে—এখন পুরুষের মতন যুদ্ধ করিয়া মানসম্ভ্রম বজায় রাখুন।”

 কাপুরুষ দারার পলায়নে সমস্ত বিশৃঙ্খল হইয়া পড়িল। যাহারা শত্রুগণকে নির্জ্জিত করিয়া তাহাদের বন্দীগণকে মুক্ত করিয়াছিল, যাহারা নিরাতঙ্ক হইয়া শত্রুগণের হৃদয়ে ঘোরতর আতঙ্কের সঞ্চার করিয়াছিল, যাহারা শত্রুগণের বহু ক্লেশে সঞ্চিত, যথাসর্ব্বস্ব হস্তগত করিতে সক্ষম হইয়াছিল; তাহারা এক্ষণে পরাজিত আতঙ্কিত ও মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে লাগিল। দারার পলায়ন বার্ত্তা প্রচারিত হইলে, সমস্ত সৈন্য ঘৃণিতভাবে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল—এখন যুদ্ধস্থল পরিত্যাগ বিষয়ে যেন পরস্পর পরস্পরকে স্পর্দ্ধা করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল— এখন মিত্র ও গমন পথে কোনরূপ বাথা প্রদান করিতে উদ্যত হইলে,সেও শত্রুরূপে নিহত হইল। এই লোক সমষ্টির কাপুরুষের ন্যায় পলায়ন কালে এরূপ ধুলিজাল উত্থিত হইয়াছিল যে, সম্মুখের লোক তাহাদের কণ্ঠোত্থিত কাতরতা ব্যঞ্জক স্বরে, এবং অশ্বের কষাঘাত শব্দে অনুমিত হইয়াছিল।

 মেষপালক পশুগণকে, অথবা ব্যাঘ্র যেরূপ কুরঙ্গযুথকে বিতাড়িত করিয়া থাকে, অলিকসন্দর সেইরূপ দারার পতঙ্গ পালের ন্যায় সৈন্যগণের অনুসরণ করিয়াছিলেন। এই অনুসরণকালে, অলিকসন্দরের সৈন্যগণ এতঅধিক সংখ্যক হত্যা করিয়াছিল যে, তাহাতে তাহাদের শাণিত অস্ত্র ধার রহিত এবং হস্ত অবসন্ন হইয়াছিল। এই লোকক্ষয়কর যুদ্ধে এরিয়ান বলেন, ৩ লক্ষ পারস্যবাসী নিহত হইয়াছি। তার পর আরো অনেক লোককে বন্দী করিয়া পরে হত্যা করা হয়। কুর্ত্তিয়াস্ ও ও ডিওডোরস্ বলেন যথাক্রমে ৪০ হাজার এবং ৯০ হাজার পারসীক সৈন্য নিহত হইয়াছিল। এই যুদ্ধে অলিকসন্দরের, এরিয়ান বলেন, ১শত, কুর্ত্তিয়স্ ৩শত এবংডিওডোরস বলেন ৫শত মাসিদন ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছিল। খৃঃপূঃ অঃ ৩৩১ সেপ্টেম্বরমাসে পারস্য সাম্রাজ্যের রাজলক্ষ্মী দারাকে পরিত্যাগ করেন।

 এসিয়াবাসীর পরাজয়ে, ইয়ুরোপীয়েরা তাহাদিগকে কাপুরুষ—স্ত্রী প্রকৃতি সম্পন্ন, ভীরু, ইত্যাদি বিশেষণে অভিহিত করিয়া থাকেন। বাস্তবিক পক্ষে একটু ভাল করিয়া দেখিলে ইহাতে তাহাদের ভীরুতা বা কাপুরুষতা কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। তাহারা যাহার জন্য যুদ্ধ করিতে আসিয়াছে, সে যদি রণস্থল পরিত্যাগ করিয়া যায়; তাহা হইলে তাহার প্রজাগণের রণস্থল পরিত্যাগে দোষ কি? প্রজাগণের সহিত রাজার শত্রুর কোন প্রকার বিদ্বেষ থাকিতে পারে না। এইজন্য রাজতন্ত্রের প্রজা, শত্রুর প্রতিকূলাচরণ না করিলেও তাহারা দোষাবহ হইতে পারে না। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের প্রজার পক্ষে স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। প্রজাতন্ত্রের সেনা পরাজিত হইলে সে দেশের সমস্ত প্রজার, শত্রুর বিরুদ্ধে খড়্গপাণি হওয়া উচিৎ। অহারা নিজের দেশের নিজেরা রক্ষক; তাই প্রজা সমষ্টির সর্ব্বতোভাবে শত্রুর প্রতিকূল আচরণ করা উচিৎ, তাহা না করিলে তাহারা পাপভাগী হইয়া থাকে।

 যুদ্ধের পর অলিকসন্দর, দ্রুতবেগে দারার পশ্চাৎ অনুসরণ করিতে লাগিনেন। যতক্ষণ পর্য্যন্ত দিবালোক ছিল, ততক্ষণ পর্য্যন্ত তাঁহারা গমন করিতে বিরত হইলেন না। পার্ম্মিণিও তাঁহার সৈন্য সহ শত্রুর পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। তিনি পারসীকদের শিবিরে যে সকল অর্থ ও অন্যান্য দ্রব্য ছিল, সেই সকল দ্রব্য সহিত হস্তী উষ্ট্র প্রভৃতির অধিকার করেন। অলিকসন্দর লাইকস নদীর তটে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিয়া; দারার উদ্দেশে মধ্যরাত্রে আবার দ্রুতবেগে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। দারা, আরবেলাতে অবস্থান না করিয়া, পলায়ন করিয়া ছিলেন, তাই অলিকসন্দর এ স্থানে দারার সন্ধান পাইলেন না। দারাকে হস্তগত করিতে না পারিলেও অলিকসন্দর দারার ধনরত্ন এবং তাঁহার রথ দ্বিতীয়বার হস্তগত করেন।

 অলিকসন্দর ব্যাবিলন অভিমুখে আবার গমন করিতে লাগিলে।—ব্যাবিলনের যখন নিকটবর্ত্তী হইলেন; তখন সৈন্যগণকে যুদ্ধ সজ্জায় সজ্জিত করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। অলিকসন্দরকে আগমন করিতে দেখিয়া সপুরোহিত শাসনকর্ত্তা ব্যাবিলন বাসীকে সঙ্গে লইয়া অলিকসন্দরের প্রত্যুগমন করেন। অলিকসন্দর বিনা বাধায় নগর, দুর্গ ও প্রচুর পরিমাণে ধনরত্ন প্রাপ্ত হইলেন। নগরে প্রবেশ করিয়া তিনি, যে সকল মন্দির জ্যারাক্‌সাস ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছিলেন; তাহা পুর্ণনির্ম্মাণ করিতে আদেশ দেন। এ স্থানে অবস্থানকালে তিনি সৈন্যগণকে প্রচুর অর্থ পারিতোষিক প্রদান করেন। প্রত্যেক মাসিদন অশ্বারোহী ৩৬০ টাকা, গ্রীক অশ্বারোহী ৩শত, মেসিদন পদাতিক ১২০ টাকা, এবং অন্য পদাতিক দুইমাসের বেতন পুরস্কার স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়াছিল। এস্থান হইতে অলিকসন্দর ২০ দিনে গমন করিয়া সুসানগর অধিকার করেন। জারেকসস্ গ্রীস হইতে যে সকল দেবমুর্ত্তি এবং অন্যান্য দ্রব্য জয় করিয়া আনিয়া ছিলেন; অলিকসন্দর সেসকল দ্রব্য হস্তগত করিয়া আবার গ্রীস দেশে প্রেরণ করেন। সময় প্রভাবে অদ্য যে লুণ্ঠিত হইতেছে; কল্য সে তাহাকে লুণ্ঠন করিয়া স্বীয়দ্রব্য পুনরায় গ্রহণ করিয়াছে, ইতিহাসে এরূপ উদাহরণ নিতান্ত বিরল নহে। বহুদিনের পর, গ্রীস আপনার সম্পত্তি উদ্ধার করিতে পারিয়া কৃত কৃতার্থ হইয়াছিল একথা বলাই বাহুল্য। এ সকল দ্রব্য ছাড়া ১৮ কোটি টাকার স্বর্ণ রৌপ্য প্রভৃতি বহুমুল্য দ্রব্য অলিকসন্দর প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

 সুসাহইতে অলিকসন্দার পথিমধ্যস্থ প্রদেশসকল অল্প আয়াসে হস্তগত করিলেন। পার্ব্বত্য প্রদেশে যাহারা তাঁহার গমনে বাধা প্রদান করিল, তাহাদিগকে তিনি ছলে, বলে, কৌশলে, ধ্বংস করিয়া পারস্যের রাজধানী ইস্তাকর, বা তক্তইজামসেদ, (গ্রীকদের কাছে পারসি পলিস নামে অভিহিত হয়) অভিমুখে গমন করেন। পাছে পারসীক সৈন্য রাজভাণ্ডার লুণ্ঠন করে এই আশঙ্কায় তিনি অতি দ্রুতগতিতে গমন করিয়া নগর অধিকার করেন। অলিকসন্দর এ স্থানে বর্ব্বরতার পরাকাষ্ঠা প্রকাশ করেন। পার্মিনিও প্রভৃতি অভিজ্ঞ সেনানী কর্ত্তৃক তিনি নিষিদ্ধ হইলেও, একটা বেশ্যার কথায় এই সমৃদ্ধিশালী জনপদ অগ্নিযোগে একেবারে ভস্মসাৎ করিয়া ফেলেন। অলিকসন্দর, তাঁহার নেশার ঝোঁক কাটিয়া গেলে ইহার জন্য যথেষ্ট অনুশোচনা করেন! এই স্থানে তিনি বহুমুল্য দ্রব্য ব্যতীত ১২ হাজার টালাণ্ট বা ৪৩ কোটি ৫০ লক্ষের ও বেশী টাকা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

 পারসিপলিস পরিত্যাগ করিয়া, অলিকসন্দর দ্রুতবেগে উত্তরাভিমুখে দারার অন্বেষণে গমন করিতে লাগিল। অলিকসন্দর যেরূপ দ্রুতবেগে নদ,নদী, পর্ব্বত, বন, মরুভূমি, অতিক্রমণ করিয়াছিলেন তাহা ভাবিলে বিস্ময়াপন্ন হইতে হয়। দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রিতেও তিনি, অকাতরে গমন করিয়াছিলেন। অনেক সময় বিশ্রাম, নিদ্রা, এমন কি উপযুক্ত পরিমাণে ভোজনও, প্রাপ্ত হন নাই। যে পর্য্যন্ত না তিনি অভিষ্ট সিদ্ধ করিয়া ছিলেন, সে পর্য্যন্ত তাঁহার অন্য কোন চিন্তা ছিল না। প্লুটার্কবলেন অলিকসন্দর ১১দিনের ভিতর ৩৯০ মাইল অতিক্রমণ করিয়াছিলেন।

 দারার শেষদৃশ্য অতিব শোচনীয়, তিনি শত্রুর ভয়ে, নিজের দেশে গোপনভাবে স্থান হইতে স্থানান্তরে পলায়ন করিয়াছিলেন।—তাঁহার কর্ম্মচারীরা একে একে তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া শত্রুপক্ষকে আশ্রয় করিয়াছিল। যখন তিনি ঘোরতর বিপদের সময় আত্মীয় বন্ধুবান্ধব বিহীন হইয়া দীনবেশে নির্ব্বাশিতের ন্যায় অবস্থান করিতে ছিলেন; তখন তিনি নিজের বিশ্বাসঘাতক কর্ম্মচারী কর্ত্তৃক অবরুদ্ধ হইয়া অবশেষে তাহাদেরই হাতে নিহত হন। গ্রীক ঐতিহাসিকেরা বলেন, অলিকসন্দর অসীম ক্লেশ স্বীকার করিয়া গমন করিলেও, দারাকে জীবিত অবস্থায় দেখিতে পান নাই। তিনি উপস্থিত হইয়া দেগিলেন,বহুঅক্ষহিনীর পরিচালক, পারস্য সাম্রাজের নিয়ন্তা—নানাজাতির অধীশ্বর, দারা একমাত্র প্রভুভক্ত কুকুর কর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া অনাথের ন্যায় ভূমিতলে চিরনিদ্রায় অভিভূত হইয়া রহিয়াছেন। অলিকসন্দর অত্যন্ত কঠোর হৃদয় হইলেও, তিনি তাঁহার সমান শতসহস্র মনুষ্য হত্যার কারণ স্বরূপ হইলেও,দারার এ দৃশ্য দেখিয়া তিনি স্থির থাকিতে পারিলেন না—তিনি কোমল মতি বালকের ন্যায় মুক্তকণ্ঠে রোদন করিয়া নিজের পাপের লঘুতা সম্পাদন করিয়াছিলেন। দারা পঞ্চাশ বৎসর বয়ক্রমে অল্পদিন রাজ্যভোগের পর ৩৩০ খৃঃ পূঃ জুলাই মাসে ইহলীলা সম্বরণ করেন। অলিকসন্দর, দারার শব অধিকার করিয়া তাঁহার সৎকারের ব্যবস্থা করিয়া মহত্তের পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন। পারসিপলিসের যে সমাধিক্ষেত্রে তাঁহার পূর্ব্বপুরুষগণ সমাহিত হইয়া ছিলেন, অলিকসন্দর দারাকেও তাঁহার পদোচিৎ রাজ সম্মানের সহিত সমাহিত করিতে আদেশ প্রদান করেন।

 এ সময় অলিকসন্দরের চরিত্র যথেষ্ট পরিমাণে পরিবর্ত্তিত হইয়াছিল। তাঁহার মদ্যপানের মাত্রা যথেষ্ট বাড়িয়া গিয়াছিল, তিন শতেরও অধিক পরিমাণে সুন্দরী তাঁহার পরিচর্য্যা করিত, সমস্ত রাত্রি নৃত্য-গীতে অতিবাহিত হইত, ব্রহ্মচর্য্যবিহীন হওয়াতে তিনি এখন হইতে তোষামদ প্রিয়, দুর্ব্বল হৃদয়, উদ্ধত স্বভাব, হইয়াছিলেন।

 অলিকসন্দরের সৈন্যগণ এ স্থান হইতে গৃহে প্রত্যাগমনের জন্য অনেক অনুরোধ প্রার্থনা করিয়াছিল। তিনি তাহাদিগকে নিরস্ত করিয়া ব্যাক্ত্রিয়া অভিমুখে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। পথে স্থানে স্থানে তিনি যে বাধা প্রাপ্ত হন নাই এরূপ নহে; কিন্তু সে সকল বাধা তাঁহার দুর্জ্জয় ইচ্ছার কাছে পরাভূত হইয়াছিল।

 অলিকসন্দর, যে সময় ব্যাক্ত্রিয়া অভিমুখে গমন করেন, সে সময় তাঁহাকে হত্যা করিবার জন্য একটা ষড়যন্ত্র হইয়াছিল। এই ষড়যন্ত্রে পার্মিণিও পুত্ত্র ফিলট, কতদুর লিপ্ত ছিলেন তাহা ভালরূপ জানা না গেলেও, তাহাকে জীবন প্রদান করিতে হইয়াছিল। ষড়যন্ত্রে দুষ্ট না হইলেও প্রকাশ্যভাবে ফিলট, অলিকসন্দরের কার্য্যের সমালোচনা করিতেন, তিনি ও তাঁহার, পিতা পার্ম্মিণিও তাঁহার এ সৌভাগ্যের কারণ, ইত্যাদি নানাপ্রকার কথায় শ্লাঘা প্রকাশ করিতেন। কোন পত্রে তিনি, অলিকসন্দর সম্বন্ধে লিখিয়াছিলেন, “যে নিজেকে যুপিটারের পুত্ত্র বলিয়া মনে করে, তাহার আজ্ঞাধীনে যে অবস্থান করে সে ব্যক্তি দয়ার পাত্র সন্দেহ নাই”। এই কথা তাঁহার শত্রুপক্ষীয়, অলিকসন্দরকে অবগত করাইলে; তিনি যে সবিশেষ ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন সে বিষয় সন্দেহ নাই। অলিকসন্দর, প্রথমে ফিলটকে ক্ষমা করিয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার শত্রুর প্ররোচনায় পরে তিনি নিহত হইয়াছিলেন। পার্ম্মিণিও, এ সময় সৈন্য সহ দূরতর প্রদেশে অবস্থান করিতে ছিলেন। তিনিও যে দোষী তাহা প্রমাণ করিতে বিলম্ব হইল না। যে হেতু তিনি ফিলটের পিতা, এবং কোনপত্রে পুত্রত্কে লিখিয়া ছিলেন যে “তুমি নিজেকে খুব সাবধানে রক্ষা করিবে”। ইহাতে প্রতিপন্ন হইতেছে যে তিনিও পুত্ত্রের সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। পার্ম্মিণিওকে হত্যা করিবার জন্য, তাঁহার একজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে, অলিকসন্দর প্রেরণ করিলেন। বন্ধু, বন্ধুকে হত্যা করিবার জন্য অতি শীঘ্রগতিতে তাঁহার কাছে উপস্থিত হইয়া, অলিকসন্দরের পত্র প্রদান করেন। ইহা পাঠকালে তিনি, পাপিষ্ঠের অস্ত্রাঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হন।

 ক্লিতস, অলিকসন্দরের একজন বিশ্বস্ত সেনানী। ইনি গ্রানিকস যুদ্ধে, নিজের প্রাণপরিত্যাগ সম্ভাবনা সত্বেও, অলিকসন্দরের প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন। পার্ম্মিণিওর মৃত্যুর পর,ইহাকে অলিকসন্দর কোন এক প্রদেশের শাসনকর্ত্তা পদে নিযুক্ত করিয়া প্রেরণ করেন। গমন করিবার পূর্ব্বে, অলিকসন্দর তাঁহার সম্মানের জন্য নৈশভোজের অনুষ্ঠান করেন— ভোজনকালে প্রচুর পরিমাণে সুরা ব্যবহৃত হইয়াছিল। এরূপ স্থলে অলিকসন্দর, নিজের বীরত্ব কাহিনী কীর্ত্তন করিয়া, নিজের উৎকর্ষ, এবং পিতা ফিলিপের অপকর্ষতা বুঝাইয়া দিতেন। বৃদ্ধ ক্লিতস, ফিলিপের অধীনতায় কার্য্য করিয়াছিলেন, তিনি তাঁহাদের অতীত যুদ্ধের কথা অস্পষ্ট স্বরে কহিতে ছিলেন—অলিকসন্দর যখন জিজ্ঞাসা করিলেন কি বলিতেছ? তখন কোন উত্তর পাওয়া গেল না সকলেই নির্ব্বাক। ক্লিতস এখন মদ্যের ঝোঁকে আরো উচ্চস্বরে ফিলিপের প্রশংসা করিয়া বলিলেন, “সে সময় ফিলিপের সমকক্ষ কেহই ছিলনা।”ইহাতে যুবকদল প্রতিবাদ করিয়া, অলিকসন্দরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করিতে লাগিল। ক্লিতস, আরো উত্তেজিত হইয়া ফিলিপের, সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সেনানী পারমিনিওর গুণ কীর্ত্তন করিয়া, তাঁহার হত্যা সম্বন্ধে বিচারের উপর দোষারোপ করেন। অলিকসন্দরের ধৈর্য্য লোপ হইল। তিনি আসন হইতে উত্থান করিয়া তীব্র ভর্ৎসনায় তাঁহাকে তিরস্কার করিলেন। ক্লিতস, তাঁহার বাহু প্রসারণ করিয়া বলিলেন, “এই সেই বাহু, যে বাহু গ্রেণিকসে আপনার জীবন রক্ষা করিয়াছিল। বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী, আপনার হস্তে কিরূপ পুরস্কার ও কৃতজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়, তাহা পারমিনিওর অদৃষ্টে বেশ প্রকাশ পাইতেছে।” এই কথা শুনিয়া অলিকসন্দর, জ্বলন্ত অগ্নির ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিলেন, এবং তাঁহাকে স্থান পরিত্যাগ করিবার আদেশ দিলেন। তাঁহার আদেশ প্রতিপালিত হইল—গমনকালে ক্লিতস বলিলেন, “যে সত্য কথা বলে, এরূপ স্বাধীনচেতাকে কোনরূপেই তাঁহার নিকট বসিতে দেওয়া উচিত হয় না, এখন বর্ব্বর ও কৃতদাসদের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করাই তাঁহার পক্ষে যুক্তিযুক্ত। তাহারা, আপনার পারসীক কটিবন্ধন এবং সুন্দর পরিচ্ছদ দেখিয়া প্রশংসাবাদ করিয়া কৃতকৃতার্থ হইবে।” এই কথা শুনিয়া অলিকসন্দর, প্রহার করিবার জন্য দণ্ডও উত্তোলন করিলেন। পার্শ্ববর্ত্তী লোকেরা, অলিকসন্দরকে ধরিয়া ফেলিল, এবং অপরে ক্লিতসকে ধরিয়া অপর গৃহে লইয়া গেল। মদ্যপানে উন্মত্ত ক্লিতস, পুনরায় অন্য দ্বার দিয়া আসিয়া আবার অলিকসন্দরকে অবমাননা করিতে লাগিলেন। তখন তিনি তাহার উদ্দেশে অস্ত্র নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, “যাও ফিলিপ ও পারমিনিওর সহিত মিলিত হওগে।”

 অনেকেই অলিকসন্দরের এরূপ দুর্ব্ব্যবহারে বিরক্ত হইলেন। কেহ যে তাঁহাকে এ সময় গুপ্তভাবে হত্যাকরে নাই, ইহা তাঁহার শুভাদৃষ্ট বলিতে হইবে। মেসিদনরা উৎপীড়িত হইলে, তাহাদের রাজাকেও দণ্ড দিতে আলস্য প্রকাশ করে না। অলিকসন্দরের ঠিক পূর্ব্ববর্ত্তী, মেসিদনের আট জন রাজার মধ্যে, দুইজন স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইয়াছিলেন। এক জন যুদ্ধক্ষেত্রে আর অপর পাঁচজন অকস্মাৎ ঘাতক হস্তে প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। পারসীকগণকে পরাজয় করিলেও, অলিকসন্দর পারসীক বিলাসীতার কাছে পরাজিত হইয়াছিলেন—মানুষ বিলাসী হইলে দুর্ব্বল হৃদয় হইয়া পড়ে, সকল সময়ে কর্ত্তব্য স্থির করিতে সমর্থ হয় না। ধীরে ধীরে এই সকল লক্ষণ, অলিকসন্দরে বেশ লক্ষিত হইয়াছিল। ফিলটের ঘটনার পর হইতে; অলিকসন্দর একজনের হস্তে সমস্ত সহচরসৈন্যের ভার না দিয়া, বিভক্ত করিয়া দিলেন, এবং নিজেকে রক্ষা করিবার পক্ষেও মনোযোগ দেন।

 অলিকসন্দর, কখন চিরতুষারাবৃত পর্ব্বত, কখন নিবিড় অরণ্য, কখন সুপ্রশস্ত স্রোতস্বতী, কখন বা সুবিস্তৃত মরুভূমি, অবলীলাক্রমে উত্তীর্ণ হইয়া; দেশের পর দেশ, আক্রমণ করিয়া অধিকার করিতে লাগিলেন। যে স্থানে তিনি বাধা প্রাপ্ত হইলেন, সে স্থান তাঁহার ক্রোধানলে ভষ্মীভূত হইয়া গেল—সমরকন্দের নিকটবর্ত্তী কোন স্থলে উপস্থিত হইলে, সেখানকার লোকেরা তাঁহার লোকের উপর কিছু অত্যাচার করে। ইহাতে সে স্থানের বহুসংখ্যক লোককে প্রাণ বিসর্জ্জন দিতে হইয়াছিল। যাহারা নিজেদের স্থানের দুর্গমতার উপর নির্ভর করিয়া অলিকসন্দরের প্রতিপক্ষতা অবলম্বন করিল, তাহারা অবশেষে নিজেদের ভ্রম বুঝিতে পারিয়া অধীনতা স্বীকার করিয়া রক্ষা পাইল—যাহারা, অলিকসন্দর বহুদূরে অবস্থান করিতেছেন অবগত হইয়া তাঁহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহানল প্রজ্জ্বলিত করে, তাহাদিগকে পশ্চাৎ নিজেদের শরীর হইতে প্রচুর পরিমাণে রুধির ধারা প্রদান করিয়া, সে অনল নির্ব্বাপন করিতে হইয়াছিল। যুদ্ধ বিষয়ে, তাঁহার দুরাধর্ষ ইচ্ছা, তাঁহার সেনানী ও সৈনিকগণ মধ্যে অনুক্রামিত হইয়া, তাহা-দিগকে দুরাক্রম্য করিয়াছিল। তাহারা সর্ব্বত্র জয়যুক্ত হওয়াতে, ঘোরতর ভয়ঙ্কর যুদ্ধেও জয়লাভ না করিয়া তাহারা প্রত্যাবর্ত্তন করিতে ঘৃণা বোধ করিত। মধ্য এসিয়ায় নিকটবর্ত্তী, সে সকল প্রদেশের জনগণ অপেক্ষা,মাসিদনেরা অধিক বলশালী নাহইলেও,তাহাদের নামের প্রতাপে শত্রু হস্ত হইতে অস্ত্র শস্ত্র নিপতিত হইয়াছিল। দরিদ্র গৃহস্থের সর্ব্ব প্রথম ধন সঞ্চয় করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু কোন রূপে সেই মিতাচারী গৃহস্থের, একবার ধন সঞ্চিত হইলে, তারপর খুব শীঘ্র সে অনায়াসে যেরূপ বিপুল ধনের অধীশ্বর হয়। ঠিক সেইরূপ, কোন দুর্ব্বল জাতি সর্ব্বপ্রথমে ঘোরতর অধ্যবসায় সহকারে, শত্রু হৃদয়ে, তাহাদের রণবিষয়িণী প্রচণ্ডতা, কোনরূপে দৃঢ়াঙ্কিত করিতে সমর্থ হইলে, উত্তরোত্তর তাহাদের কার্য্য সকল অনায়াস সাধ্য হইয়া থাকে। জয়শ্রীর প্রথম প্রতিষ্ঠা, সুকঠিন হইলেও, ভক্ত, প্রাণের বিনিময়ে তাহা সম্পাদনে অগ্রসর হন বলিয়াই, কার্য্যে সফলতা লাভ করিয়া থাকেন। গ্রেণিকস, প্রভৃতি যুদ্ধে দারুন বিক্রম দেখাইয়া, প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া, এ সকল স্থানবাসী তাঁহার নামের প্রতাপে পরাজিত হইয়াছিল।

 অলিকসন্দরের অতুল সমৃদ্ধি লাভের সহিত, গ্রীস দেশ হইতে তিনি নানাশ্রেণীর লোককে আমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া সভা পরিপূর্ণ করিতে লাগিলেন। তাহাদিগের মধ্যে গ্রন্থকার, কবি, দার্শনিকদের সংখ্যাও বড় কম ছিল না। দেবপুত্র অলিকসন্দর, পারসীক আচার ব্যবহারের খুব পক্ষপাতী হইয়াছিলেন। পারসীকেরা ভূমিস্পর্শ করিয়া সম্রাটকে অভিবাদন করে—তাঁহার “স্বদেশবাসী মাসিদনেরা, তাঁহাকে সহচর, ফিলিপ পুত্র, ও রাজা বিবেচনা করিয়া, তাহাদের স্বদেশী প্রথায় সম্মান দেখাইয়া থাকে। দেবপুত্রের ইহা ভাল লাগিল না। তাঁহার ইচ্ছা, মেসিদনরা, পারসীক প্রথা অনুকরণ করিয়া, ভূমি স্পর্শ করিয়া অভিবাদন করুক। কএক জন গ্রীক পণ্ডিত, তাঁহার অভিপ্রায় অনুমোদন করিয়া তাঁহাকে পরিতুষ্ট করেন। আরিস্ততল অন্তে বাসী, স্বাধীনচেতা কালীস্থানী, ইহার বিরুদ্ধে অভিমতি প্রকাশ করিয়া বলেন, দেবতাকে যেরূপ ভাবে অভিবাদন করা হয়, অলিমফিয়ার পুত্রকে সেরূপভাবে কখনই অভিবাদ করা যাইতে পারে না। অধিকাংশ মেসিদনও গ্রীকবাসী, কালীস্থানীর কথা, প্রকাশ্য কিছু না কহিয়া মনে মনে অনুমোদন করিল। দেবপুত্র, মেসিদনদের মনের ভাব বুঝিয়া এবিষয় আর বেশী আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না। এক দিন অলিকসন্দর, তাঁহার সহচর ও সমাগত গ্রীকগণসহ মদ্যপানে প্রবৃত্ত হইলে,তিনি সুরাপান করিয়া সুবর্ণময়পান পাত্র, পার্শ্ববর্ত্তীকে পান করিতে প্রদান করিলেন; তিনি পূর্ব্বনিয়ম অনুসারে, পান করিয়া, অলিকসন্দরকে পারসীক প্রথায় অভিবাদন করেন, তিনি ও তাহাকে চুম্বন করিয়া সম্বর্দ্ধনা করেন। এইরূপ ক্রমে ক্রমে অভিনীত হইয়া, যখন কালীস্থানীর সময় উপস্থিত হইল, তিনি ভূমি স্পর্শ পূর্ব্বক অভিবাদন না করিয়া, অলিকসন্দরকে চুম্বন করিতে অগ্রসর হন। সে সময় দেবপুত্র, অন্যের সহিত আলাপ করিতেছিলেন, কালীস্থানী কিরূপ অভিবাদন করিলেন, তাহা লক্ষ্য করিতে পারেন নাই,যখন অবগত হইলেন, কালীস্থানী অভিবাদন করেন নাই, তখন তিনি তাঁহাকে চুম্বন করিবার অধিকার হইতে বিচ্যুত করেন। ইহাতে কালীস্থানী বলিয়া উঠিলেন, “আমার একটি মাত্র চুম্বনের ক্ষতি হইল।”

 ইহা বলিয়া তিনি, অলিকসন্দরের প্রতি তাচ্ছল্য প্রকাশ করেন। ইনি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, যথেচ্ছাচারী নরপতিকে, কিরূপ চক্ষে দেখিতেন, তাহা ফিলটের সহিত তাঁহার যে আলাপ হইয়াছিল; তাহাতে বেশ প্রকাশ পাইয়া থাকে। এক সময় ফিলট, কালীস্থানীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন যে, আপনি আমাকে সত্য করিয়া বলুন এথেন্স বাসীরা কাহাকে বিশেষ সম্মানে গৌরবান্বিত করিয়া থাকে। তিনি প্রত্যুত্তরে বলিলেন “হারমোদিঅস এবং অরিস্থজিতন”—ইঁহারা, দুইজন অত্যাচারীর মধ্যে, একজনকে যম ভবনে প্রেরণ করিয়া দেশকে অত্যাচার মুক্ত করিয়াছিলেন। ফিলট পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন “এখন যদি কেহ, কোন অত্যাচারীকে হত্যা করে, তাহা হইলে আপনি তাহাকে গ্রীসের কোন দেশে, পলায়ন করিয়া যাইতে পরামর্শ দেন।” পুনরায় প্রত্যুত্তরে বলিলেন, “গ্রীসের মধ্যে যদি কোন দেশ, নির্ব্বাসিতকে রক্ষা করিতে পারে, তবে সে এথেন্স—কারণ ইতিপূর্ব্বে এথেন্সই দুরাত্মা অত্যাচারীর নিধন কর্ত্তাকে রক্ষা করিয়া, যুদ্ধ সমুদ্রে অবগাহণ করিতেও পশ্চাদপদ হয় নাই।” ইনি অলিকসন্দরকে এক সময় বলিয়াছিলেন, “অলিকসন্দর, তোমার দ্বারা আমার সন্মান বর্দ্ধিত হইবে না, কিন্তু আমারদ্বারা তোমার কীর্ত্তি, মনুষ্য সমাজে ঘোষিত হইবে।” বলাবাহুল্য অলিকসন্দরের বর্ত্তমান অবস্থায়, কালীস্থানীর ন্যায় স্বাধীনচেতা স্পষ্টবাদী পুরুষ ভাল লাগিল না—তাঁহাকে অলিকসন্দরের বিদ্বেষ-বহ্নিতে জীবন প্রদান করিতে হইয়াছিল।

 এই সময় অলিকসন্দরের জীবন নাশের জন্য তাঁহার যুবক কর্ম্মচারীরা একবার চেষ্টা করিয়াছিল। ফিলিপের সময় সম্ভ্রান্ত লোকের পুত্ত্রগণ, রাজবাটীতে অবস্থান করিয়া, রাজসভার আদব কায়দা শিক্ষা করিত—রাজার শরীর রক্ষা করিত, এবং গৃহকার্য্য বিষয়ক আদেশ পালন করিত। এক সময় অলিকসন্দর, মৃগয়া করিতে গমন করিলে, একটা বন্য বরাহ, অলিকসন্দর অভিমুখে দ্রুতবেগে আগমন করে। যুবক মনে করিয়াছিল, বরাহের আগমন অলিকসন্দর টের পান নাই। তাই সে ভল্লাঘাতে বরাহ হত্যা করে। এই অপরাধে সে প্রহৃত হইল, তাহার নিকট যে ঘোড়া ছিল, তাহাও কাড়িয়া লওয়া হইল। ইহাতে সে অত্যন্ত মর্ম্মাহত হয়, ইহার প্রতিশোধ লইবার জন্য, সে তাহার অন্য সহচর সহ মিলিত হইল। অলিকসন্দর যখন শয়ন করিয়া থাকিবেন, সেই সময় তাঁহাকে হত্যা করা হইবে এইরূপ স্থির হইল।

 যে রাত্রে হত্যা করা হইবে, সে রাত্রে অলিকসন্দর শয়ন করিলেন না। একজন স্ত্রী, সময় সময় আবিষ্ট হইয়া যাহা বলিত অনেক সময় তাহা সত্যে পরিণত হইত, অলিকসন্দর তাহার কথায় নিবারিত হইয়া, মদ্যাদি পান করিয়া রাত্রি যাপন করেন।

 প্রভাতে একজন লোক তাঁহাকে ষড়যন্ত্রের কথা নিবেদন করিল। যে যে লিপ্ত ছিল তাহারা সকলে বন্দী হইল। হারমোলেয়স দোষ স্বীকার করিয়া বলিল “কোন স্বাধীনপুরুষ, ইহার দাম্ভিকতা আর সহ্য করিতে পারে না—ইনি অন্যায় করিয়া ফেলটকে নিহত করিয়াছেন—নির্দ্দোষ পার্ম্মিণিও এবং অন্যান্য পুরুষগণকে হত্যা করিয়া বিচারাসন কলঙ্কিত করিয়াছেন—মদ্যপানে উন্মত্ত হইয়া ক্লিতসকে বধ করিয়াছেন—ইনি স্বজাতীর পরিচ্ছদ পরিত্যাগ করিয়া, বিজাতীয় পরিচ্ছদে অঙ্গ আচ্ছাদিত করিতেছেন—ইনি বিদেশী অভিবাদন প্রথা প্রবর্ত্তন করিবার সঙ্কল্প করিতেছেন—ইঁহার প্রবর্ত্তিত পানোৎসবের ফলে লোক সকল অলস ও নিদ্রালু হইয়া পড়িয়াছে। এরূপ অবস্থায় আমি আমার স্বদেশবাসীকে রক্ষা করিবার জন্য এরূপকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি।” বলা বাহুল্য যাহারা এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তাহারা উৎকট যন্ত্রনাভোগ করিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছিল।

 এ সময় অলিকসন্দরের নিকট, ইয়ুরোপীয় সিথিয়ানদের নিকট হইতে দূত আসিয়া তাহাদের অধীনতা জ্ঞাপন করে। কৃষ্ণসাগরের উপকূলবাসীদের রাজ্য এবং স্ত্রীরাজ্য আক্রমণ করিবার জন্য তিনি দূতগণ কর্ত্তৃক অনুরুদ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি তাহাদিগকে সময়ান্তরে আক্রমণ করিবেন; বর্ত্তমান সময়ে তিনি ভারতবিজয়ের জন্য অত্যন্ত উৎসুক হইয়াছেন, ইত্যাদি কহিয়া তাহাদিগকে বিদায় প্রদান করেন।

 সম্পূর্ণ ব্যক্ত্রিয়া অধীনে আনয়ন করিতে, অলিকসন্দরকে বড় কমউদ্বেগ পাইতে হয় নাই। সহজে তাহারা দাসত্ব পাশে আবদ্ধ হইতে স্বীকৃত হয় নাই—সামন্ত নরপতিগণ যে যথায় আশ্রয় পাইল, সে তথায় গমন করিয়া স্বাধীনতা রক্ষা করিতে লাগিল। যাহারা তাহাতে কৃতকার্য্য হইতে পরিল না, তাহারা অলিকসন্দরের বশ্যতা স্বীকার করিল। অক্ষয় রথী বা অজয়রথী নামক একজন নরপতি দুর্ভেদ্য গিরিদুর্গে স্ত্রী পুত্র পরিজন সহ অবস্থান করেন। যে সকল সোগোডবাসী, অলিকসন্দরকে তুচ্ছ বোধ করিয়া এই স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ছিলেন—এস্থান, অলিকসন্দরের হস্তগত হইলে, তাহাদের আশ্রয় গ্রহণ করিবার আর কোন স্থান ছিল না—এই জন্য অলিকসন্দর এই দুর্ভেদ্য দুর্গ অধিকার করিবার জন্য প্রাণপণে যত্ন করিতে লাগিলেন। দুর্গবাসীরা প্রচুরপরিমাণে খাদ্যদ্রব্য, ইহার মধ্যে সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিল, সুতরাং অনাহারে মরিবার ভয়ে আত্মসমর্পণের কোন সম্ভাবনা ছিল না। দারুণ শীতে সর্ব্বত্র তুষার পতিত হওয়াতে সেই অতি উচ্চ দুর্গম পর্ব্বত অধিকতর দুর্গম হইয়াছিল। অলিকসন্দর বাহ্লীকগণকে বহু সুবিধা দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়া আত্মসমর্পণের জন্য আদেশ করিলেন। তাহারা তাঁহাকে বিদ্রুপ করিয়া উত্তর দিল, আপনি পক্ষধর সৈন্য আনয়ন করুন, অন্যথা ইহা হস্তগত হইবে না। এই বিদ্রূপে অলিকসন্দরের সমস্ত শক্তি উত্তেজিত হইল। যে কোনরূপে হউক, ইহা গ্রহণ করিবার জন্য তিনি বদ্ধপরিকর হইলেন। অলিকসন্দর, দুর্গম পর্ব্বত আরোহণে সুনিপুন সৈন্যগণকে সমবেত করিয়া বলিলেন, যিনি ইহাতে সর্ব্ব প্রথম আরোহণ করিতে সমর্থ হইবে, তিনি ১২ টালাণ্ট অর্থাৎ প্রায় ৪৪ হাজার টাকা, ২য় ব্যক্তি দ্বিতীয়, তৃতীয় ব্যক্তি তৃতীয়, পুরস্কার এবং এইঅনুপাতে শেষ ব্যক্তি প্রায় ৫০০০ টাকা প্রাপ্ত হইবে। এই পুরস্কারের কথা শুনিয়া মেসিদনদের আগ্রহ বাড়িয়া উঠিল। ইহা কার্য্যে পরিণত করিবার জন্য প্রায় তিনশত ব্যক্তি প্রস্তুত হইল—তাহারা গভীর রাত্রে যে স্থান অত্যন্ত দুরারোহ—যে স্থানে শত্রু আরোহণের কোন সম্ভাবনা নাই, অলিকসন্দরের অদ্ভুত কর্ম্মা সৈনিকগণ—শিবিরের রজ্জু বন্ধনের লৌহকীলক ও রজ্জু লইয়া সেই দুরারোহ স্থানে উঠিবার জন্য প্রস্তুত হইল। কোন স্থানে কঠিন বরফ পাইল, কোন স্থানে মৃত্তিকা পাইল, তাহারা সেই সেই স্থানে পেরেক বিঁধিয়া তাহাতে দড়ি বাঁধিয়া ধীরে ধীরে পর্ব্বতের উপর উঠিতে আরম্ভ করিল। এইরূপে উঠিবার সময় তিরিশজন সৈনিক পড়িয়া গিয়া জীবন পরিত্যাগ করে। দেখিতে দেখিতে সূর্য্যদেবের উদয়ের সহিত, তাহারা পর্ব্বতের শিখরদেশে উপস্থিত হইয়া বিজয় পতাকা সঞ্চালন করিতে লাগিল। তাহাদিগকে উপরিভাগ অধিকার করিতে দেখিয়া, অলিকসন্দর, দুর্গের দ্বারদেশে দূত পাঠাইয়া বাহ্লীকগণকে বলিলেন, ঐ দেখ, পক্ষধর সৈনিকগণ তোমাদের উপরিভাগ অধিকার করিয়াছে, আর নিচেও সৈন্যগণ অস্ত্রপাণি হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, তোমরা এখনও আত্মসমর্পণ করিলে রক্ষিত হইবে। দুর্গমবাসীরা সৈন্য দেখিয়া একেবারে বিভীষিকাগ্রস্ত হইয়া পড়িল—শত্রুর সংখ্যা জানিবার শক্তি তাহাদের অন্তর্হৃত হইল—তাহারা মনে করিল দুর্গ শত্রুপূর্ণ হইয়াছে, এরূপ অবস্থায় যুদ্ধ করা বিড়ম্বনামাত্র। এই যুদ্ধে অলিকসন্দরের হস্তে যাহারা পতিত হইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে রসনা [বা রক্ষনা] নাম্নী রাজকন্যা সমধিক উল্লেখ যোগ্যা—দারার মহিষী ব্যতিত তাঁহার মতন সুন্দরী সে কালে আর কেহ ছিল না। অলিকসন্দর কালক্রমে তাঁহার পাণিপীড়ন করিয়াছিলেন।

 বাহ্লীক বিজয়ের পর অলিকসন্দর পরাইতকালী (পার্ব্বতীয়?) দেররাজ্য আক্রমণ করিলেন। অক্‌সস নদীর তটবর্ত্তী পার্ব্বত্য প্রদেশে ইহারা অবস্থান করিত। সম্ভবতঃ ইহারা তক্ষবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজাদের একটি শাখা—তাহারা পার্ব্বত্যদুর্গে অবস্থান করিয়া দৃঢ়তার সহিত আপনাদের স্বাধীনতা রক্ষা করিবার জন্য প্রস্তুত হইল। ইহারা যে গিরিদুর্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন তাহা গ্রীকদের কাছে চেরিনী বা চারুনীর পর্ব্বত নামে উল্লিখিত হইয়াছে। এই দুর্গে এ দেশের নরপতি ব্যতীত অন্যান্য অনেক নৃপতি আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। এই চারু-নীরপর্ব্বত উচ্চতায় প্রায় ২০ এবং পরিধিতে প্রায় ৬০ ষ্টেড হইবে। এক জন লোকের গমনোপযোগী একমাত্র পথ, ইহার পাদদেশে প্রায় চতুর্দ্দিক গভীর নদী বেষ্টিত হওয়াতে ইহার দুর্গমতাকে আরো অধিক পরিমাণে বর্দ্ধিত করিয়াছে। অলিকসন্দর ইহার দুর্গমতা দেখিয়া ইহাকে অধীনে আনয়ন করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন—তিনি এই পর্ব্বতজাত বৃহৎ বৃহৎ দেবদারু বৃক্ষ সকল ছেদন করাইয়া, তাহার সাহায্যে এই নদীতে সেতু প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলেন,একদল দিবাভাগে অপরদল রাত্রিকালে, কার্য্য করাতে এই কার্য্য দ্রুতবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল। অলিকসন্দরের সেনাদল, এইরূপে অতিকষ্টে সেতু প্রস্তুত করিয়া পর্ব্বতের উপর উঠিয়া চারু-নীরবাসীকে আক্রমণ করিতে লাগিল। মাসিদনেরা,শত্রুর আক্রমণ বোধ করিবারজন্য,যে প্রাচীর প্রস্তুত করিয়াছিলেন, তাহার অন্তরালে অবস্থান করিয়া, তাহারা তীর ছুঁড়িতে লাগিল, শর দুর্গমধ্যে নিপতিত হওয়াতে, গ্রীকেরা বলেন, দুর্গবাসীরা তাহাদের কোন অনিষ্ট করিতে না পারায়, ভয় বিহ্বল হইয়া, অলিকসন্দরের নিকট দূত প্ররণ করে। মেসিদনপতি, তাহাদের প্রার্থনা অনুসারে বাহ্লীকপতি অজয়রথীকে তাহাদের কাছে প্রেরণ করেন। অজয়রথী, অবরুদ্ধ যোদ্ধাগণকে বলেন, অলিকসন্দরের বিজয়বাহিণীর কাছে ইহা কখনই অপরাজিত থাকিবেনা—ইহার রক্ষা ব্যর্থ হইয়া যাইবে; এরূপ অবস্থায় তাঁহার সহিত মিলিত হইয়া অধীনতা স্বীকার করিলে সকল দিক রক্ষা পাইবে—তিনি বড় ভাল লোক ইত্যাদি কহিয়া স্বীয়দলভুক্ত করিয়াছিলেন। অলিকসন্দর, উত্তম রাজনীতিকের ন্যায় চারু-নীরের অধিশ্বরের সহিত সদ্ব্যবহার করিয়া তাঁহাকে সসম্মানে স্বীয় অধিকারে অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন। তিনি প্রচুরপরিমাণে ভোজনদ্রব্য প্রদান করিয়া, তাঁহার খাদ্যদ্রব্যের অভাব দূর করিয়াছিলেন।

 আমরা যে সময়ের কথা কহিতেছি, সে সময়, বর্ত্তমান আফগানিস্থান—বলখ-বোখারা, সমরকন্দ, প্রভৃতি প্রদেশ হিন্দুরাজন্যবর্গ কর্ত্তৃক শাসিত হইত। এ সকল প্রদেশের অধিবাসী ও রাজন্য বর্গের সহিত ভারতীয় নৃপতি ও অধীবাসী পরস্পর অপরিচিত ছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। তাঁহারা পরস্পর তীর্থযাত্রা বাণিজ্য ও বিবাহ সম্বন্ধে অনেক সময় একতা সূত্রে আবদ্ধ থাকিতেন। বর্ত্তমাণকালেও অনেক হিন্দু, তীর্থযাত্রা উপলক্ষে বলখ, প্রভৃতি স্থান পরিদর্শন করিতে গমন করিয়া থাকেন। সে দেশে এরূপ জনপদ নাই, যথায় বর্ত্তমানকালেও হিন্দু বণিকেরা পণদ্রব্য আদান প্রদান করিতে গমন না করিয়া থাকেন।

 ভারতবর্ষে অলিকসন্দরের আগনন করিবার বহুপূর্ব্বেই, তাঁহার বিজয়বার্ত্তা বর্ত্তমান ভারতের সীমান্ত প্রদেশে উপস্থিত ইইয়াছিল। ইহা ব্যতীত যে সকল ব্যক্তি অলিকসন্দরের অত্যাচারে উৎপীড়িত হইয়া, ভারতে আশ্রয় লইয়া ছিল; তাহাদের মুখেও সেকালের ভারতবাসীরা অলিকসন্দরের কথা অবগত হইয়াছিলেন।

 অলিকসন্দর, বহ্লীক বিজয়ের পর তাঁহার সৈন্যগণকে বলিয়াছিলেন, “এতদিনের পর আমাদের যুদ্ধশ্রমের অবসান হইল। এক্ষণে আমরা ভারতবর্ষে গমন করিয়া,তথাকার শ্রমবিমুখ লোকেদের নিকট হইতে, অগণিত ধনরত্ন লুণ্ঠন করিতে সমর্থ হইব।” ইত্যাদি বলিয়া তিনি সৈন্যগণকে প্রলোভিত করিয়া ভারতবর্ষাভি মুখে আনয়ন করিয়াছিলেন। ভারতবর্ষে, সাধারণতঃ তিনি কিরূপভাবে অভ্যর্থিত হইয়াছিলেন—ভারতবাসীরা এই ইয়ুরোপীয় দস্যুর করালকবল হইতে, কিরূপে আপনাদের স্বাধীনতা, আত্ম-মর্য্যাদা প্রভৃতি রক্ষা করিয়া ছিলেন; সেই সকল পবিত্রকাহিনী অগ্রে বর্ণিত হইবে।