ভেক মূষিকের যুদ্ধ/তৃতীয় স্বর্গ

তৃতীয় স্বর্গ।


মালঝাঁপ।

দুই দল, মহাবল, ধরাতল, কাঁপে।
থর থর, খরতর, যুড়ি শর, চাপে॥
ঝল মল, কি উজ্জ্বল, সুবিমল, অস্ত্র।
সেনাগণ, সুশোভন, সন্নহন, বস্ত্র॥
প্লবঙ্গক, ভয়ানক, মক মক, শব্দ।
মূষাগণ, বিঘোষণ, ত্রিভুবন, স্তব্ধ॥
তড়াগের, ধারে ঢের, মণ্ডূকের, তাম্বু।
শেহালার, ডেরা তার, খাগ্‌ড়ার, বাম্বু॥

আগে তার, আগুসার, সার সার, যোদ্ধা।
উর্দ্ধশির, রণবীর, অতি ধীর, বোদ্ধা॥
রহিলেক, যত ভেক, হয়ে এক, পংক্তি।
হুহুঙ্কার, চীৎকার, যত যার, শক্তি।
ছেয়ে মাঠ, মূষা ঠাট, কাট কাট, শোরে।
মহা জাঁক, ডাক হাঁক, রহে থাক, ধোরে॥
রণশৃঙ্গ, হল্যো ভৃঙ্গ, নহে রিঙ্গ, কাযে।
কি আহব, মহোৎসব, ভোঁ ভোঁ রব, বাজে
শুনি রব, সুভৈরব, মাতে সব, শুদ্ধ।
দ্রুত বেগে, যায় রেগে, গেল লেগে, যুদ্ধ॥

পয়ার।


 নিনাদক নামে ভেক দৃশ্য ভয়ঙ্কর।
লাফ দিয়া আগে ভাগে পড়ে বীরবর॥
ছাড়িল বিষম শূল দ্বিতীয় অশনি।
পড়িল লেহন-সার বীর চুড়ামণি॥
বয়সে কিশোর অতি ছিল মূষ-সুত।
সংগ্রামে কেশরিপ্রায়, নানা গুণযুত॥
যশো লাভ লোভে বীর সকলের আগে।
দাঁড়াইয়া ছিল, মাতি নব অনুরাগে॥

বজ্রের সমান শূল ছাড়ে নিনাদক।
চর্ম্ম বর্ম্ম ভেদ করি পশিল ফলক॥
হাহাকার করি মূষা পড়ে ধরাতল।
ধূলায় লুটায় তার সুচারু কুন্তল॥
দেখিয়া জ্ঞাতির গতি বীর গর্ত্তপতি।
বিপর্য্যয় গদা হস্তে নিল মহামতি॥
পঙ্কজের শিরোপরি করিল আঘাত।
এক ঘায়ে হলো ভেক ধরায় প্রপাত॥
কালের কবলে সেই হারাইল জ্ঞান।
রুধিরের স্রোতে প্রাণ করিল প্রয়াণ॥
শরাসনে কলম্বিক যুড়ি তীক্ষ্ম তীর।
ভাণ্ড-বিহারির বক্ষ লক্ষ্য করি বীর॥
ছাড়িল দুর্জয় শর যমের দোসর।
মরিলেন শ্রীভাণ্ড-বিহারী বীরবর॥
দেখি ক্রোধে ক্ষুরদন্ত হইল অস্থির।
তিন শরে কেটে ফেলে কলম্বীর শির॥
আর বার অস্ত্র যুড়ি গৰ্জ্জিয়া ছাড়িল।
বড়্‌বড়িয়ার মাথা কাটিয়া পড়িল॥
অভিমানী ছিল এই ভেকের নন্দন।
আপনার গুণ গানে রত অনুক্ষণ॥

দিবা নিশি ৰড়্‌ বড়্‌ করণ কারণ।
শ্রীবড়্‌ বড়িয়া নাম বিখ্যাত ভুবন॥
ক্ষুর দন্ত অস্ত্র তার ঢুকিল উদরে।
মরিল ভেকের চূড়া কিছু কাল পরে॥
বন্ধুর বিয়োগ দেখি বীর মৃণালাশী।
ক্রোধ ভরে যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রবেশিল আসি॥
হস্তে করি নিল এক প্রকাণ্ড কঙ্কর।
ভীমের করেতে যেন শোভিল শেখর॥
ঘূরাইয়া প্রহারিল গর্ত্তপতি বুকে।
অধৈর্য্য হইল মূষা রক্ত উঠে মুখে॥
প্রস্থানেতে গর্ত্তপতি ছিলেন নিপুণ।
আসন্ন কালেতে আর কোথা থাকে গুণ?
ললাট লিখন বল খণ্ডিতে কে পারে?
জীবন ত্যজিল বীর কঙ্কর প্রহারে॥
গর্ত্তপতি-মৃত্যু শোকে হইয়া বিধুর।
দ্বিতীয় লেহনসার নামে এক শূর॥
মৃণালাশী বক্ষে মারে খরতর শর।
গর্ত্তপতি পার্শ্বে ভেক ত্যজে কলেবর॥
পুনরায় মূষাসুত বাণ বৃষ্টি করে।
ভাগিল ভেকের ভাগ ভয়ার্ত্ত অন্তরে॥

সরো প্রিয় নামে তথা আইল প্লবঙ্গ।
ক্ষণ পরে শরে তার জর জর অঙ্গ॥
রণে পটু নহে ভেক ভোজনে চতুর।
পলাইল হ্রদ তটে হয়ে ভয়াতুর॥
লাফ দিয়া যেমন পড়িল গিয়া পাড়ে।
অমনি লেহনসার চড়ে তার ঘাড়ে॥
পাশ দিয়া প্রহার করিল তার পেটে।
এক চোটে নাড়ীভুঁড়ী সব গেল কেটে॥
রুধির বহিল সেই সরোবর জলে।
জয় জয় শব্দে মূষা বাহুড়িয় চলে॥
ভেকগণ ভঙ্গ দেখি ভর্ৎসিয়া ভীষণ।
ভল্ল-ভাজি এলো যুদ্ধে ভেক এক জন॥
শৈবালক নাম তার শেহালায় বাস।
মারিল মোদক-চোরে অস্ত্র চন্দ্রহাস॥
ফাফর হইল মূষা মুখে ছুটে ফেণা।
মেটাই চুরির বুদ্ধি হেথা খাটিবে না॥
সে দিন চুরির ধন ছিল মতিচুর।
ভেক অস্ত্রে পেট কেটে পড়িল প্রচুর॥
মোদক-চোরের মৃত্যু করিয়া ঈক্ষণ।
অগ্রসর হল্যো আসি বীর এক জন॥

তড়িতের ন্যায় তার গতি খরতর।
সেহেতু তড়িদ্গতি খ্যাত শূরবর॥
সলিল-বিলাস নামে তরুণ মণ্ডূক।
মূষার বিক্রম দেখি কাঁপে ধুক ধুক॥
পাতাড়ীর ঢালে দেহ করি আচ্ছাদন।
রণভূমি ত্যজি করে দূরে পলায়ন॥
পশ্চাতে তড়িৎ ছুটে তড়িতের প্রায়।
দুই ভিতে ভাগে ভেক দেখিয়া তাহায়॥
আখুবংশে তড়িতের তুল্য নাহি আর।
পরিপুষ্ট দেহ তার করি মাংসাহার॥
হ্রদ তটে সলিল-বিলাস বক্ষোপরে।
প্রহারিল প্রহরণ ঝন ঝন স্বরে॥
জীবন তেজিল ভেক করি ছট্‌ফট্‌।
রুধিরে ভাসিয়ে গেল সরসীর তট॥
সেই কালে পঙ্কে শুয়ে ছিল তার ভাই।
পঙ্কশায়ী নাম তার কোলাকুলে চাঁই॥
অন্তরেতে প্রজ্বলিত ভ্রাতৃশোক তাপ।
পঙ্ক থেকে উঠে বীর দিয়ে এক লাফ॥
প্রকাণ্ড কোলায় দেখি পলায় তড়িৎ।
লাফে লাফে পঙ্কশায়ী চলিল ত্বরিত॥

ছাড়িল পাষাণ খণ্ড, লণ্ড ভণ্ড শির।
নাসারন্ধ্র পথে হল্যো মস্তিষ্ক বাহির॥
জয় জয় শব্দ উঠে ভেকের শিবিরে।
নন্দ মঙ্গলধ্বনি করে ফিরে ফিরে॥


লঘু ত্রিপদী।

শুনি জয়-নাদ, গুণি পরমাদ,
কহেন মূষিকরাজ।
এক বেটা পেঁকো, করে গেল ভেকো,
ছি ছি এত বড় লাজ॥
শুনিয়ে রাজার, বাক্য এপ্রকার,
মূষিক ভোগবিলাসী।
যুড়ি দুই কর, হয়ে অগ্রসর,
প্রণমিল হাসি হাসি॥
দিয়ে হুহুঙ্কার, করি মার মার,
বরিষে নারাচ জাল।
সমুখে যে ছিল, সকলে বিন্ধিল,
মরে ভেক পালে পাল॥
লশুনাশী নাম, এক গুণধাম,
ছিলেন সবার আগে।

গাত্র গন্ধে তার, কাছে থাকা ভার,
দেখিয়া পলায় নাগে॥
ঘনাইল কাল নারাচ বিশাল
পশিল হৃদয় মাঝে।
মরে লশুনাশী, শ্রীভোগ বিলাসী,
নিবেদিল মূষারগঞ্জে॥
কর্দ্দমজ বীর, শোকেতে অস্থির,
লশুনাশী মৃত্যু হেতু।
ঘোষিল ভীষণ, প্রলয়ে যেমন,
মহাকাল বৃষকেতু॥
লাফে লাফে গিয়া, ধরে আকৰ্ষিয়া,
মূষিক মঞ্চ-নিবাসে।
ধরিয়া তাহায়, হ্রদে লয়ে যায়,
অচেতন মূষা ত্রাসে॥
ঘন ঘন জলে, ডুব মারি চলে,
নিশ্বাস হইল রোধ।
মারিয়া উন্দূরে,  শোক গেল দূরে,
দিল ভাল প্রতিশোধ॥
হোথায় সংগ্রামে, শস্যহারী নামে,
আর এক ধনুৰ্দ্ধর।

যাহার কারণ, হয় এই রণ,
বিক্রমে তাঁরি দোসর॥
মলগামী ভেকে, মারিলেক টেঁকে,
বিষম বল্লম এক।
মরে মলগামী, শুনি ভেকস্বামী,
রোদন করে অনেক॥
দেখি প্লুত-গতি, অতি ক্রুদ্ধমতি,
ডুব মারি সরোবরে।
দুই হাতে ঠাসি, নীয়ে পঙ্করাশি,
উঠে গিয়ে তীরোপরে॥
মূষা প্রতি টাঁক, করি বর্ষে পাঁক,
ছাইল বদন তার।
পূর্ণ শশধরে, আচ্ছাদন করে,
যেন জলধর হার॥
হল্যো দৃষ্টিহীন, সমর প্রবীণ,
মূষিকের চূড়ামণি।
প্রকাণ্ড পাষাণ, ধরি একখান,
ঘুরায়ে ছাড়ে অমনি॥
দৃশ্য ভয়ঙ্কর, যেমন শেখর,
মেদিনী কাঁপিল ভারে।

অধুনা সে ভার, মূষা দশ বার,
তুলিতেও নাহি পারে॥
যেৰূপ কলিতে, মানবাবলীতে,
বলের হয়েছে হ্ৰাস।
সেইৰূপ প্রায়, শক্তি ক্ষয় পায়,
উন্দূর বংশ সকাশ॥
সেইত পাতর, পর্ব্বত দোসর,
মলগামী পদে পড়ে।
ভগ্ন পদ লয়ে, সভয় হৃদয়ে,
পলাইল উভরড়ে॥
জয়মদে মাতি, ফুলাইয়া ছাতি,
নাচে বীর শস্যহারী।
তার নৃত্য দেখে, বিপর্য্যয় ডেকে,
উঠে ভেক অধিকারী॥
শুনি সেই রব, এলো এক প্লব,
শ্রীকট্‌কটিয়া নাম।
শস্যহারী বক্ষ, করি সুক্ষ্ম লক্ষ্য,
মারে বাণ গুণগ্রাম॥
কট্‌ কট্‌ স্বরে, প্রকট সমরে,
বিকট হুঙ্কার করে।

ক্ষণেক যুঝিয়া, ঝুঁজিয়া যুঁজিয়া,
মূষাদেহে রক্ত ঝরে॥
প্রাণের আঁধার, রুধিরের ধার,
ঝরিয়া হইল শেষ।
পড়ে শস্যহারী, শরীর বিস্তারি,
লণ্ড ভণ্ড কেশ বেশ॥
একি পরমাদ, হয়ে ভগ্ন-পাদ,
মহানস-প্রিয় বীর।
ত্যজি রণস্থল, গিয়া মহাবল,
লুকাইল স্বশরীর॥
পগারের ঝোড়ে, নিবিড় নিওড়ে,
গোপন করিল কায়।
মণ্ডূক প্রধান, না পায়ে সন্ধান,
নিজ দলে ফিরে যায়॥

পয়ার।

এইৰূপে দুই দলে ঘোর যুদ্ধ হয়।
নিপাত হইল তাহে বহু সৈন্যচয়॥
রুধিরের স্রোত বহে সংগ্রামের স্থলে।
খাদ্যলোভে পিপীলিকা সারি সারি চলে॥

গৃধিনী আকারে ফিরে তেলাপোকাগণ।
বৃশ্চিক কবন্ধ প্রায় করয়ে ভ্রমণ॥
দুই দলে সেনাপতি মরিলে প্রচুর।
সমরে প্রবিষ্ট দুই রাজা বাহাদুর॥
এক দিগে গদা হস্তে পিষ্টকাশী শূর।
অন্যদিগে ফুল্লগগু ভেকের ঠাকুর॥
হইল বিষম যুদ্ধ একই প্রহর।
দুই মত্ত হস্তি যেন কানন ভিতর॥
অবশেষে পিষ্টকাশী স্থির লক্ষ্য করি।
মারিল দুর্জ্জয় গদা ভেক গুল্‌ফোপরি॥
দুর্য্যোধন উরুভঙ্গ করে যেন ভীম।
পলাইয়া যায় বীর যাতনা অসীম॥
সর্পাকারে রুধিরের ধারা তাহে পড়ে।
পিছে পিছে মূষারাজ ধায় উভরড়ে॥
ভগ্ন অৰ্দ্ধ পদ ঝুলে পশ্চাতে রাজার।
অচল হইল ভেক শক্তি নাহি আর॥
উৰ্দ্ধমুখ করি রাজা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।
প্রাণ পরিহার করে সরোবরে পাড়ে॥

ভঙ্গ ত্রিপদী।

ভেকরাজ পাইলে অত্যয়,
তাঁর পুরে মহ শোকোদয়।
অনিবার হাহাকার, বিগলিত অশ্রুধার,
সকলের কাতর হৃদয়॥
কাঁদে যত ভেক রাজ-দারা,
চক্ষে বহে শত শত ধারা।
ভঙ্গ সব রাগ রঙ্গ, পঙ্কেতে লোটায় অঙ্গ,
দিবানিশি হয়ে জ্ঞানহারা॥
রাজজ্ঞাতি ছিল যত ভেক,
সবে গেল, বাকি মাত্র এক।
শ্রীমেঘ-বল্লভ নাম, বহুবিধ গুণধাম,
সিংহাসনে প্রাপ্ত অভিষেক॥
সমরেতে নহেন নিপুণ,
জপ তপে যত তাঁর গুণ।
দুর্ব্বল শরীর তাঁর, বহুকষ্টে গুণাধার,
মৃত রাজ-চাপে দিল গুণ॥
দূরে হত্যে করিয়া সন্ধান,
বরষিল খাগ্‌ড়ার বাণ।

ঠেকি পিষ্টকাশী ঢাল,  ধরাতলে শর জাল,
ভেঙ্গে পড়ে শত শত খান॥
দেখি মণ্ডূকের মন্দগতি,
হাস্য করে মূষিকের পতি।
তাঁহার ইঙ্গিত পেয়ে, এলো এক বীর ধেয়ে,
সূচীমুখ নাম মহামতি॥
বয়সেতে নিতান্তু কিশোর,
কিন্তু বলবীর্য্যে নাহি ওর।
কুলের তিলক শিশু, ধনুকে যুড়িয়া ইষু,
মার মার শব্দ করে ঘোর॥
দ্বিতীয় কুমার[১] প্রায় বীর,
তেজঃপুঞ্জ প্রফুল্ল শরীর।
মহাদম্ভে নিজ গুণ, ব্যাখ্যা করি পুনঃপুন,
উপনীত সরোবর তীর॥
কহে “ওরে ছার শক্র দল!
কোথা গেলি পলায়ে সকল?
আজ্‌ সব বিনাশিব, ভেক কুল না রাখিব,
নির্ভেক করিব ধরাতল॥”

ইহা বলি নামিল সলিলে,
তরঙ্গ উঠিল সেই বিলে।
দেখি ব্রহ্মা খিন্ন হয়ে, আকাশ বিমানে রয়ে,
যুক্তি করে দেব সহ মিলে॥

দীর্ঘ ত্রিপদী।

কহে ব্রহ্মা “একি দায়, অকালে প্রলয় প্রায়,
রুধির সমুদ্র সমুদ্ভব।
শব দেহ স্তূপে স্তূপে, দৃশ্য গিরি শ্রেণীৰূপে,
অসম্ভব অদ্ভূত আহব॥
এক দিবসের রণে, হেন কাণ্ড ত্রিভুবনে,
কভু না দেখিল কোন জনে।
বহুদিনে হেন ভাব, হয়েছিল আবির্ভাব,
দাশরথি দশানন রণে॥
অসিত বরণধর, সূচীমুখ বীরবর,
সূচী শরে ছাইছে গগন।
সরোবরে পড়ে শর, ভেক দলে হাহাস্বর,
তরঙ্গ বহিছে ঘন ঘন॥
হেন অনুভব হয়, ভেক জাতি হবে ক্ষয়,
কোন মতে নাহি দেখি ত্রাণ।

কি দেখহ দেবগণ! মম সৃষ্টি সংহরণ,
ইহাতে আমারি অপমান॥
যদ্যপি তোমরা কেহ, কৃপা দৃষ্টি নাহি দেহ,
ভেককুল হইবে নির্ম্মূল।
অতএব বাক্য ধর, কেহ হয়ে অগ্রসর,
সেই পক্ষে হও অনুকুল॥
সাজ গো চামুণ্ডা রঙ্গে! দল বল লয়ে সঙ্গে,
মূষিকের দর্পচূর্ণ কর।
তব চন্দ্রহাস ধারে, কভু কি থাকিতে পারে,
বর্ব্বরের গর্ব্ব ফহোরতর॥
অথবা হে ষড়ানন! দেবসেনা বিমোহন,
ভেক প্রতি করুণা প্রকাশ।
নিপাতিয়ে সূচীমুখে, রক্ষা কর মৃত্যুমুখে,
নিপতিত মণ্ডূক সঙ্কাশ॥”

পয়ার।

এত বলি বসে বিধি হয়ে খিন্নমতি।
উত্তরে কহিছে তবে দেব সেনাপতি॥
 “অবধান কর দেব আমার বচন।
এই যুদ্ধে অগ্রসর হবে কোন্‌ জন?

কাহারো না সাধ্য হবে হইতে সহায়।
এযুদ্ধ সামান্য নহে প্রলয়ের প্রায়॥
এক এক মূষাবীর অগ্নি অবতার।
প্রবেশি সমর ক্ষেত্রে করে মহামার॥
আমাদের সকলের শ্রেষ্ঠ দেবরাজ।
মূষিকে নিবৃত্ত করা তাঁহারই কাজ॥”
 কুমারের কথা শুনি মরালবাহন।
বাসবেরে ইঙ্গিত করেন সেই ক্ষণ॥
সাজিলেন দেবরাজ মেঘগণ সঙ্গে।
বহে উনপঞ্চাশ পবন নানা রঙ্গে॥
ঐরাবতে থাকি ইন্দ্র মূষা লক্ষ্য করি।
ছাড়িল বিষম বজ্র দেব গুৰু স্মরি॥
চমকে চপলা বালা করি চক্‌ মক্‌।
উঠিল ভেকের পুরে শব্দ মক্‌মক্‌॥
কাঁপিল উন্দূর সেনা কুলিশ নির্ঘোষে।
তথাপিও ভেক প্রতি ধায় রোষে রোষে॥
দেখিয়ে সে ভাব সুচিন্তিত দেবগণ।
হেনকালে দেখ সবে দৈব নিবন্ধন॥
জলদের আগমনে ছাড়ি সরোবর।
উঠিলেক এক জাতি, ভেক-হিতকর॥

সুকঠিন বর্ম্মধর বজ্রের সমান।
লাগিলে বিপক্ষ বাণ হয় খান খান॥
কুর্ম্মাকৃতি কলেবর বক্রভাবে চলে।
চারিদিগে সুখর নখর অস্ত্রছলে॥
যোড়া যোড়া কাঁচী শোভে মুখের দুপাশে।
স্বভাবতঃ মাংসোপরি অস্থি পরকাশে॥
প্রতিপদে, পদে পদে গ্রন্থি বহুতর।
বক্ষস্থলে শোভে চক্ষু কৃষ্ণ নিভাধর॥
আঁটা সাঁটা গাঁটা গোঁটা দৃঢ় দেহ ধারি।
দুই পাশে অণছে দশ চরণ বিস্তারি॥
দুই দিগে দুই মুখ দৃশ্য শোভাকর।
কর্কট নামেতে খ্যাত পৃথিবী ভিতর॥
দেবলোকে যোগ্য নাম অবশ্যই আছে।
জীবের বিকৃত নাম আমাদেরি কাছে॥
এবেশে কর্কট সেনা উঠি চারি ভিতে।
ঘেরিল উন্দূর দলে ভেকদের হিতে॥
দাড়ায় দাড়ায় ধরে আখুর শরীর।
ল্যাজকাটা হয়ে ছুটে কত শত বীর॥
কেহ বা হারায়ে পদ পলাতে না পারে।
গড়া গড়ি যায় সেই সরোবর ধারে॥

স্তূপে স্তূপে অস্ত্র শস্ত্র পড়ে যথা তথা।
পলায় মূষিক দল, মুখে নাহি কথা॥
ভয়েতে বাড়িল ভয় ভেবাচেকা হয়ে।
ভঙ্গ দিয়ে যায় নিজ নিজ প্রাণ লয়ে॥
কেহ কেহ শ্রান্ত হয়ে গর্ত্ত অন্বেষিয়া।
নিমিষে ঢুকিয়া তায় রহে লুকাইয়া॥
হেনকালে অস্তাচলে চলিল তপন।
ঘোরতর তিমিরে পূরিল ত্রিভুবন।
এইৰূপে এক দিনে এহেন সমর।
সম্ভূত সমাপ্ত হলো বর্ণিতে বিস্তর॥
বিধির নির্বন্ধ ইহা কে খণ্ডিতে পারে।
পাত্র ভেদে এইৰূপ ঘটে এসংসারে॥

সমাপ্তোয়ং গ্রন্থঃ।

  1. কার্ত্তিকেয়