ভেক মূষিকের যুদ্ধ/দ্বিতীয় স্বর্গ

দ্বিতীয় স্বৰ্গ।

 পূর্ব্বদিগে পদ্মপাণি প্রকাশিলে উষা।
মূষারাজ সভায় আইল যত মূষা॥
উঠিলেন পিস্টকাশী শোকাচ্ছন্ন মনে।
সম্বোধিয়া কহিছেন সভাগত গণে॥
“হারাধন শস্যহারী শোকে প্রাণ দহে।
সকলের শোক ইথে, শুদ্ধ মন নহে॥

বীরবর তিন পুত্র জন্মেছিল মম।
একে একে মম অগ্রে গ্রাসিলেক যম॥
জ্যেষ্ঠ পুত্র পুরীর অন্তরে বস্যে ছিল।
ভয়াল বিড়াল বেটা তাহারে খাইল॥
মধ্যম কুমারে নাশে সর্ব্বনেশে কল।
হা করিয়া ছিল দুষ্ট, মুখে রেখে ফল॥
লাফ দিয়ে প্রবেশিবে ভিতরে যেমন।
চাপাকলে বাপা মোর হইল নিধন॥
হা হা পুত্র প্রিয়তম সর্ব্বগুণধর।
কি ক্ষণে কলের স্বষ্টি কর‍্যেছিল নর॥
অবশেষে ছিল মাত্র কনিষ্ঠ নন্দন।
আমার অন্ধের নড়ী, দরিদ্রের ধন॥
তোমাদের আশা ভরসার সেই স্থল।
পালিত পরম যত্নে মূষিক মণ্ডল॥
ফুল্ল-গণ্ড ভেক তারে ডুবাইল জলে।
মরিল আমার যাদু, সে বেটার ছলে॥
সাজ, সাজ, সাজ সবে, দেহ প্রতিফল।
মারহ মণ্ডুক রাজে, মার ভেক দল॥”
 রাজবাক্য শুনি সবে গৰ্জ্জিল বিক্রমে।
ধরিল সমর সজ্জা যথা রীতি ক্রমে॥

বেদানা সীমের খোসা হইল বিনামা।
মরা বিহঙ্গের পক্ষে বিরচিল জাম॥
পতিঙ্গের চাক্তি ঢালে সুশোভিত পিট।
বাদামের খোলা হলো মাথার কিরীট॥
ছুঁচের বল্লম হাতে করে ঝক্‌মক্‌।
সাজিল মূষিক সেনা, দৃশ্য ভয়ানক॥
মহা গগুগোল উঠে ভেক সন্নিধানে।
নিকটে কিসের গোল কেহ নাহি জানে॥
জল ছেড়ে দল বেঁধে উঠে গিয়া পড়ে।
জিজ্ঞাসিল কোন্‌ শক্র সিংহনাদ ছাড়ে॥
এমন সময় তথা এলে এক বীর।
শ্রীভাণ্ড-বিহারী নাম মূষিক সুধীর॥
পিষ্টকাশী রাজদূত, সেই মহোদয়।
বিপক্ষেরে ডাকি বীর রাজ-আজ্ঞা কয়॥
“অরে রে ভেকের দল শুনরে সকলে।
আসিছে মূষিক সেনা সংগ্রামের স্থলে॥
মাতিয়াছে রণ মদে দিবে প্রতিফল।
প্রতি অঙ্গে নানা অস্ত্র করে ঝলমল॥
তোদের নির্দ্দয় রাজা ফুল্ল-গণ্ড যেই।
আমাদের যুবরাজে মারিয়াছে সেই॥

ভাগ্যহীন রাজপুত্র, পতিত চাতরে।
এখনো তাঁহার অঙ্গ ভাসে সরোবয়ে॥
 এই কথা বলি বীর করিল প্রস্থান।
শুনিয়া ভেকের দল ক্রোধে কম্পবান॥
গর্ব্বে ফুলে, কিন্তু সবে চিন্তিত অন্তর।
রাজার অধিক নিন্দা করে পরস্পর॥
দেখিয়া এভাব তবে ফুল্ল-গণ্ড রায়।
স্বীয় দোষোদ্ধারে কহে মণ্ডূক সভায়॥
 “শুন শুন মিত্রগণ আমার বচন।
আমি কেন সে মূষিকে করিব নিধন?
কখন মরিল মুষা, নহি অবগত।
আপনার দোষে সেই হইল নিহত॥
বৃথা অভিমানী ছিল মূষিক কুমার।
আপনি আইল জলে পাড়িতে সাঁতার॥
আমাদের বিদ্যা তাহা জানিবে কেমনে?
মরিল নির্বোধ শিশু সেইত কারণে॥
অকারণে রাগ করে উন্দূরের দল।
অনর্থ আমারে চাহে দিতে প্রতিফল॥
যেমন চতুর শত্রু আসিয়াছে রেগে।
তেমনি দেখাও শক্তি, যাবে তারা ভেগে॥

আমি তার পন্থা বলি শুন সর্ব্বজন।
নিশ্চয় হইবে জয়, লয় মম মন॥
যথা উচ্চতর অতি সরোবর তীর।
স্থিরভাবে নীচে তার সুগভীর নীর॥
ধারে ধারে থাক সবে হয়ে সাবধান।
আসুক শত্রুর সেনা বরষিয়া বাণ॥
অনন্তর সন্নিকট যখন হইবে।
নিজ নিজ সম-যোদ্ধা বাছিয়া লইবে॥
প্রতি জন এক এক ধরিয়া উন্দূরে।
সরোবর লক্ষ্য করি ফেলে দিবে দূরে॥
এমনি ধরিয়ে জোরে ফেলাইবে জলে।
ঘূরিতে ঘূরিতে যেন মরে হ্রদতলে॥
ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ হইবেক তায়।
শত পাকে ঘূরিবেক সরোবর কায়॥
জয় লাভে যুদ্ধক্ষেত্রে ধাইবে সকলে।
নিশান উড়ায়ে দিবে সংগ্রামের স্থলে॥”
 এত বলি ফুল্প-গণ্ড বসে সিংহাসনে।
কথা শুনি দ্বিগুণ মাতিল ভেকগণে॥
সবুজ পোষাক পরে যতেক প্লবঙ্গ।
শৈবাল সাজোয়া দিয়ে ঢাকিলেক অঙ্গ॥

পাতাড়ীর পাতা ঢালে শোভে পৃষ্ঠদেশ।
কোথা কে দেখেছে হেন সংগ্রামের বেশ?
শুক্তি শম্বূকের নানা টোপর সুন্দর।
ঝক্‌মক্‌ ভানুকরে করে নিরন্তর॥
ভয়ানক শূল অস্ত্র নল খাগড়ার।
ছাইল গগন ঘন কানন আকার॥
এইৰূপে সাজিয়া উঠিল ভেকগণ।
অস্ত্র দেখাইয়ে চাহে মুষা স্থানে রণ॥