ভেক মূষিকের যুদ্ধ/প্রথম স্বর্গ
ভেক মূষিকের যুদ্ধ
ভেকদিগের নাম |
|
মধু-লেহিনী। |
প্রথম স্বৰ্গ।
উর গো কবিতা-শক্তি তেজি দিব্যপুরী।
পূর গো আমার কাব্যে মোহন মাধুরী॥
বিবরিব বিগ্রহ বিষম বীর রসে।
ভুবন ভরিবে যত যোদ্ধৃগণ যশে॥
কিৰূপে মুষিকগণ মাতি রণ-রঙ্গে।
করিল ভয়াল যুদ্ধ ভেক-জাতি সঙ্গে॥
সে যুদ্ধ সামান্য নয় তুলনা কি তার।
দেবতা দানবে যুদ্ধ উপমায় ছাঁর॥
যাবৎ গণনে রবি হইবে উদিত।
তাবৎ সে কীর্ত্তি রবে জগতে বিদিত॥
একদা পড়িয়া ক্রূর বিড়ালের গ্রাসে।
পলায় মূষিক এক অনেক আয়োসে॥
ঊর্দ্ধশ্বাসে ধায় ত্রাসে গতি খরতর।
স্বেদজল বহে দেহে তৃষায় কাতর॥
এক সরসীর তীরে করিয়া প্রয়াণ।
গোঁপ ডুবাইয়া মূষা করে জল পান॥
মূষিকে সম্বোধি এক ভদ্র ভেক তথা।
শির তুলি ঘোর স্বরে কহিতেছে কথা॥
“কে হে তুমি ভিন্ন-দেশী জন্ম কোন্ কুলে?
ক্লান্ত হয়ে পড়ে কেন সরোবর কূলে?
যথা সত্য কথা কহ হইয়া নির্ভয়।
হে মূষিক নাহি দিও মিথ্য পরিচয়॥
মিত্রতার যোগ্য হও, কর তাহা ভাই।
সুখ-সরোবর মধ্যে এসে লয়ে যাই॥
প্রবেশি আমার পুরী আতিথ্য লইয়া
বিদায় হইবে পরে সানন্দ হইয়া॥
রজত সন্নিভ এই হ্রদের উপর।
আমার প্রভুত্ব, আমি ভেকের ঈশ্বর॥
পঙ্কিলের বংশধর ফুল্ল-গণ্ড নাম।
জলেশী জননী, যাঁর যমুনায় ধাম॥
তথা মম পিতা সহ পরিণয় পরে।
আবির্ভূত হই আমি তাঁহার উদরে॥
তোমার লক্ষণ সব দেখি বোধ হয়।
তুমি বীর হবে কোন রাজার তনয়॥
পরিচয় দিয়ে কর সংশয় বিচ্ছেদ।”
শুনিয়া মূষিক তারে কহিতেছে ভেদ॥
“সুর নর কি বিহঙ্গ উড়ে যত দূর।
তত দূর মম নাম আছে ভর-পূর॥
শুনহ, যদ্যপি নহে তব জ্ঞাত-সার।
মহামহিম শ্রী, শস্যহারী নামামার॥
পিষ্টকাশী পিতা মম বীর শ্রেষ্ঠ তিনি।
তাহার গেহিনী সতী শ্রীমধুলেহিনী॥
গর্ত্তপতি মহামতি জনক তাঁহার।
মহারাজ সুতা মাতা মহা অধিকার॥
মনোহর মঞ্চোপরে জনম আমার।
পুষিলেন দিয়ে নানা সুমিষ্ট আহার॥
কহ কিসে বন্ধুতা হইবে তব সহ।
উভয়ের স্বভাবেতে একতা বিরহ॥
তব পুরী পরে খেলে তরল তরঙ্গ।
মনুষ্যের দিব্য খাদ্যে পুস্ট মম অঙ্গ॥
কত যত্নে রুটী পিটা প্রস্তুত করিয়া।
লুকাইয় রাখে নর হাঁড়িতে ভরিয়া॥
সুধার মাংশের বড়া, কোফ্তা কুরকেট।
ইলিসের ডিম ভাজা, রোহিতের পেট॥
সন্দেশ মিঠাই নানা মোরব্বা আচার।
ক্ষীর ছানা পনীর প্রভৃতি উপহার॥
দেবের দুর্ল্লভ ভোগ কত শত আর।
কত কষ্টে গুপ্ত করে ভয়েতে আমার॥
বৃথায় আয়াস, আর বৃথায় প্রয়াস।
তখনি আস্বাদ লই, হল্যে অভিলাষ॥
যেৰূপ চতুর ইথে সেৰূপ সংগ্রামে।
কত শত বীর কাঁপে শস্যহারী নামে॥
রণে ভঙ্গ দিয়ে কভু যাই নাই ভেগে।
এক মনে এক ধ্যানে রণে যাই লেগে॥
আমার অপেক্ষা অতি দীর্ঘদেহী নর।
কিন্তু আমি কখন করিনে তারে ডর॥
শয্যাপরে সুখভরে নিদ্রা যায় যবে।
চুপিসাড়ে গুড়ি গুড়ি যাই আমি তবে॥
কর পল্লবেতে কিম্বা পদাঙ্গুলি ধরি।
বসাইয়া দিয়ে দন্ত লহুজারী করি॥
এমনি চালাকি তায় আমার জাহের।
ঘুমাইয়া থাকে নর পায় নাকো টের॥
তথাপিও আমাদের শক্র বহুতর।
তাহাদের অত্যাচারে সর্ব্বদা কাতর॥
বিড়াল পেচক এরা কালান্তের কাল।
থাবায় দাবায় সব উন্দুরের পাল॥
বিকল করেছে তাহে ফাঁদ আর কল।
দিন দিন জ্ঞাতি গোত্র মারে দল দল॥
শব্দ নাই প্রাণ নাই স্তব্ধ ভাবে চলে।
লুকাইয় থাকে যম খাদ্য রাখি কলে॥
সবে বটে আমাদের ভয়ানক অরি।
সব চেয়ে বিড়াল শক্ররে ভয় করি॥
অন্ধকারে পলাইলে রক্ষ তবু নাই।
ঘোরতর আঁধারে ধরিয়া মারে ভাই॥
সে যা হোক, জলজাত গাছড়া ভক্ষণে।
জীবন ধারণ বল করিল কেমনে॥
নয়ন না তৃপ্ত হবে দেখি লাল মূলা।
আর আর অনর্থক খাদ্য কত গুলা॥
এ সকল ভেকদের খাদ্য প্রিয়তর।
অতিশয় ঘৃণা করে মূষিক নিকর॥
এৰূপে মুষিক যদি কচিল বচন।
উত্তরে কহিছে তবে মণ্ডূক রাজন॥
“ভাল হে বিদেশী, কর আহারের জাঁক।
আমাদের বিধি শুদ্ধ দেন নাই ডাক॥
স্থলে জলে কেলি করি নাচিয়া বেড়াই।
দুই ভূতে বাস, নানা খাদ্য তাহে পাই॥
কিন্তু যদি আশ্চর্য্য দেখিতে ইচ্ছ। হয়।
এসো লয়ে যাই হ্রদে, কিছু নাই ভয়॥
উঠিয়া আমার কাঁধে বস্যো স্থিরভাবে।
চলহ আমার পুরী, নানা ভোজ্য পাবে॥
এত বলি পিঠপাতি দিল ভেক পাড়ে।
লাফ দিয়ে উন্দুর উঠিল তার ঘাড়ে॥
দুই বাহু পসারিয়া জড়াইয়া ধরে।
চলিল মূষিকরাজ সুখ সরোবরে॥
বিচিত্র রসেতে পূর্ণ উল্লাসিত মনে।
কত বাঁক ছাড়াইয়া চলিল সঘনে॥
সমুদ্রের কূলে যেন বন্দর সকল।
দেখি মূষিকের হয় নয়ন সফল॥
তরল তরঙ্গোপরে যখন চলিল।
উঠিল শরীরে তার সে নীল সলিল॥
তখন হৃদয়ে তার উপজিল ভয়।
যুগল নয়ন পথে অশ্রুধার বয়॥
ছিঁড়ে ফেলে চিকুর, চঞ্চল পদদ্বয়।
দুরু দুরু করে বুক, জীবন সংশয়॥
প্রকট সংকট ভাবি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
বিফলে বাসনা আর ফিরে যেতে পাড়ে॥
লাঙ্গুলে করিয়া হাল বৃথা ঝিঁকে মারে।
গগন ভরিল তার ব্যর্থ হাহাকারে॥
মৃতপ্রায় হয়ে বীর জলের উপরে।
এইৰূপে কাঁদিতে লাগিল আর্ত্তস্বরে॥
“হায় কেন মাটীখেয়ে আইলাম জলে।
অসাধ্য সাধিতে গেলে এই দশা ফলে॥
কোন পুরুষেতে মম, স্থলছাড়া নয়।
হায় বিধি কি কুবুদ্ধি হইল উদয়॥
শুনিয়াছি এইৰূপে ভুলায়ে সীতারে।
লয়ে গেল দশানন জলধির পারে॥
যেই দসা জানকীর জলধি উপর।
আমার সেৰূপ, ভয়ে কাপি থর থর॥
যা হবার হবে তাই, তাহে খেদ নাই।
কোন মতে ভেকপুরে গেলে রক্ষা পাই॥”
এইৰূপে মূষা যবে করিছে রোদন।
কাল আসি অন্য মূর্ত্তি করিল ধারণ॥
পানী গোখুরার কুলে জাত এক বীর।
অকস্মাৎ জল হত্যে হইল বাহির॥
লোহিত নয়ন দুটা ঘুরায় সঘনে।
ফুলিল বুকের পাটা খাদ্য দরশনে॥
তীর বেগে ধায় রেগে প্রবাহ উপর।
ভয়ে ভীত ভ্রান্তচিত ভেক ভূমীশ্বর॥
উন্দুরে ফেলায়ে দূরে ডূবমারে জলে।
সাপ দেখে, বাপ ডেকে, তনু ঢেকে চলে॥
বিশ্বাসঘাতক ভেক যারে কাঁধে করি।
বন্ধু বলি যেতে ছিল আপন নগরী॥
সে যত সাঁতারু তাহা জানে সর্ব্বলোকে।
নাকানী চোবানী খায়, পেটে জল ঢোকে॥
চরণে রাখিয়া ভার বৃথা চাহে ত্রাণ।
ডুবে তার উঠে বীর, শ্বাস-গত প্রাণ॥
আঁকু বাঁকু করে আখু ডুবে তার উঠে।
অসাড় হইল অঙ্গ মুখে রক্ত ছুটে॥
নিরাশয় নীরাশয়ে হইয়া ফাঁফর।
মৃত্যুকালে কহে মূষা, ক্রোধে গর গর॥
“অরে রে বিশ্বাসঘাতী রাজ দুরাচার।
করিলি আমার প্রতি এই কুব্যাভার॥
ইহার উচিত ফল পাবি অচিরাৎ।
ফেলে পলাইলি দুষ্ট করে জলসাৎ॥
স্থলোপরি শক্তি তোর নাহি মম সম।
জলে জারি জুরি, তোর চাতুর বিষম॥
ভো দেবতাগণ! সাক্ষী তোমরা সকল।
কোথারে উন্দুরসেনা দিস্ প্রতিফল॥”
এই কথা বলে বীর ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস।
সেই সঙ্গে প্রাণ তার ত্যজে দেহ বাস॥
হেন কালে ফুলময় সেই হ্রদ তীরে।
ভ্রমণ কারণ মৃদু সায়াহ্ন সমীরে॥
আইল লেহন-সার বয়সে কিশোর।
দেখে যুবরাজ মরে করি ঘোর শোর॥
দূর দূরান্তরে ছুটে তাহার চীৎকার।
উন্দুরের পুরে উঠে মহা হাহাকার॥
গভীর শোকের নীরে ভাসিল সকলে।
বিবর ভরিল সব নয়নের জলে॥
শস্যহারী প্রিয়তমা শোকে অচেতন।
আলু থালু কেশ বেশ, ধরায় শয়ন॥
পুরনারী শস্যহারি গুণ ব্যাখ্যা করি।
বিনাইয়া কাঁদে সবে দিবস শর্ব্বরী॥
একে শোকস্বরে পূর্ণ মুষিক মণ্ডল।
তাহে ক্রোধে তর্জে গর্জে সেনানী সকল॥
ঘরে ঘরে ধেয়ে যেয়ে রাজ দূতগণ।
প্রভাতে যাইতে বলে রাজার সদন॥