মতিয়া বিবি/প্রথম পরিচ্ছেদ

মতিয়া বিবি।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 এক দিবস অতি প্রত্যুষে আমি আমার থানার আফিসে বসিয়া নিয়মিত দৈনিক কার্য্য সমাপন করিতেছি, এইরূপ সময় এক ব্যক্তি থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও আমাকে সন্মুখে দেখিতে পাইয়াই কহিলেন,“মহাশয়, আমার একটী প্রজার ঘরে সিঁদ হইয়াছে। এই সংবাদ প্রদান করিবার মানসে আমি আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।”

 আমি। সিঁদ হইয়াছে? কাহার ঘরে সিঁদ হইয়াছে?

 আগন্তুক। আমার বাড়ীতে সন্নিকটে আমার একখানি ভাড়াটিয়া বাড়ী আছে। ঐ বাড়ীতে তারামণি নাম্নী একটী স্ত্রীলোক বাস করে। ঐ তারামণির ঘরেই সিঁদ হইয়াছে।

 আমি। এই সংবাদ প্রদান করিতে তারামণি আসে নাই কেন?

 আগন্তুক। যে ঘরে সিঁদ হইয়াছে, তারামণি সেই ঘরে শয়ন করিত। তাহার ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ আছে; কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করিয়া তারামণির কোনরূপ উত্তর না পাইয়া, আমিই আপনাকে সংবাদ দিতে আসিয়াছি।

 আমি। সিঁদটী আপনি স্বচক্ষে দেখিয়াছেন কি? ঐ ঘরের কোন্ স্থানে ও কি প্রকার সিঁদ?

 আগন্তুক। যে ঘরে তারামণি শয়ন করেন, সেই ঘরের পশ্চাৎ দিকের দেওয়ালের মাটি কাটিয়া এক প্রকাণ্ড সিঁদ দিয়াছে। ঐ সিঁদ আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি।

 সংবাদদাতার এই কথা শুনিয়া সেই সময় আমার মনে যে কিরূপ চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহা পাঠকগণ কিছুমাত্র অনুমান করিয়া উঠিতে পারিতেছেন কি? আমার মনে হইল, চোরে সিঁদ দিয়া কেবলমাত্র তারামণির মূল্যবান দ্রব্যাদি অপহরণ করিয়া লইয়া যায় নাই, সেই সঙ্গে তারামণিকেও শমন-সদনে প্রেরণ করিয়া গিয়াছে। নতুবা যে ঘরে তারামণি শয়ন করিয়াছিল, যে ঘরের দরজা তারামণি ভিতর হইতে বদ্ধ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিল, সেই ঘরেই সিঁদ হইয়াছে, অথচ এখন পর্য্যন্ত তারামণির কোনরূপ সন্ধান নাই কেন? কিন্তু ঘরের দরজা তারামণি যেরূপ ভাবে ভিতর হইতে বদ্ধ করিয়া শয়ন করিয়াছিল, ঠিক সেইরূপ ভাবেই ভিতর হইতে বদ্ধ আছে। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেই দেখিতে পাইব, হয় তারামণি তাহার বিছানার উপর, না হয় ঘরের মেজের উপর মৃত অবস্থায় পড়িয়া আছে।

 মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, আর কালবিলম্ব করিলাম না। সেই সংবাদদাতার সঙ্গে তৎক্ষণাৎ থানা হইয়া বহির্গত হইলাম। তারামণি যে বাড়ীতে বাস করিতে, সেই বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, উহা একখানি খোলার ঘর, কিন্তু উহার পোঁতা বেশ উঁচু। ঐ একখানি ঘর লইয়াই একখানি বাড়ী। ঐ ঘরের সম্মুখে একটী বারান্দা আছে মাত্র। রন্ধনাদি ঐ বারান্দার এক পার্শ্বেই হইয়া থাকে। ঐ ঘরখানি প্রাচীর অথবা অপর কোনরূপ আবরণের দ্বারা বেষ্টিত নহে, উহার চতুষ্পার্শ্বই খোলা। চতুষ্পার্শ্ব হইতেই ঐ ঘরের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হওয়া যায়। ঐ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিবার কেবল একটীমাত্র দরজা, উহা এখন পর্য্যন্ত ভিতর হইতে বদ্ধ আছে। ঐ দরজায় সামান্য একটু ধাক্কা দিয়া দেখিলাম, কিন্তু উহা সহজে খুলিল না। ঐ ঘরখানি চতুর্দ্দিক উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম, উহার পশ্চাদ্ভাগের পোঁতার গায়ে, বেড়ার নীচে একটী প্রকাণ্ড সিঁদ কাটা রহিয়াছে। সদাসর্বদা যেরূপ পরিমাণের সিঁদ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার অপেক্ষা এই সিঁদের পরিমাণ একটু বড়। উহার মধ্য দিয়া ছোট বড় সকল প্রকার মনুষ্যই ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ ও ঘর হইতে বহির্গত হইতে পারে। খুব বড় বড় সিন্দুক, বাক্স, পেঁটরা প্রভৃতি অনায়াসেই উহা দিয়া বাহির করিয়া লওয়া যায়।

 সিঁদের নিকট গমন করিয়া তাহার মধ্য দিয়া ঘরের ভিতরের অবস্থা যদি কিছু দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার চেষ্টা করিলাম; কিন্তু ঘরের মধ্যে অন্ধকার বলিয়া বোধ হইতে লাগিল, কিছুই দেখিতে পাইলাম না। তখন অনন্যোপায় হইয়া ঐ ঘরের দরজা ভাঙ্গিয়া ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিতে হইল। জানিতে পারিলাম, ঐ পাড়ার মধ্যে একজন ছুতারের বাস; নিজে ঐ ঘরের দরজা ভাঙ্গিবার চেষ্টা না করিয়া সেই ছুতারকে ডাকাইয়া পাঠাইলাম। সে আসিয়া প্রথমে ঐ দরজার অবস্থা স্বচক্ষে দর্শন করিয়া, তাহার বাড়ী হইতে একখানি ছোট ও পাতলা হাত-করাত আনিয়া ঐ দরজার দুই পাটির মধ্যে দিয়া কোনরূপ প্রবেশ করাইয়া দিল ও ভিতরে যে কাষ্ঠ-খিলের দ্বারা ঐ দরজা আবদ্ধ ছিল, তাহা আস্তে আস্তে কাটিয়া ফেলিল। দরজা খুলিয়া গেল। নিতান্ত সোৎসুক অন্তঃকরণে আমি ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। প্রবেশ করিবার সময় মনে করিয়াছিলাম যে, প্রবেশ করিবামাত্র তারামণির মৃতদেহ ঐ ঘরের ভিতর দেখিতে পাইব, কিন্তু ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া তাহা দেখিতে পাইলাম না। ঘরের ভিতর একপার্শ্বে একখানি তক্তাপোষ, তাহার উপর শয়ন করিবার একটী বিছানা বিছান রহিয়াছে। বিছানার অবস্থা দেখিয়া অনুমান হয়, উহার উপর কেহ শয়ন করিয়াছিল, কিন্তু এখন তাহার উপর কেহই নাই। ঐ তক্তাপোষের নীচে অনুসন্ধান করিয়াও কাহাকে দেখিতে পাইলাম না। ঐ তক্তাপোষের সন্নিকটে একটী লোহার সিন্দুক আছে দেখিলাম। সিন্দুকটী নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে; দেখিয়া অনুমান হয়, উহার ওজন বোধ হয় পাঁচ মণের কম হইবে না। সিন্দুকটী নাড়িয়া দেখিলাম, দেখিলাম উহা বদ্ধ আছে। ঐ ঘরের অপর পার্শ্বে কয়েকটী বাক্স, কতকগুলি পিত্তল কাঁসার তৈজস ও কয়েকটী হাঁড়ি প্রভৃতি আছে। বাক্স কয়েকটী বদ্ধ অবস্থায় পাইলাম। পিত্তল কাঁসার তৈজস ইত্যাদি দেখিয়া উহার একটীও স্থানান্তরিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইল না। ঘরের সমস্ত দ্রব্য পূর্ব্ব যেরূপ ভাবে রক্ষিত ছিল, ঠিক যেন সেইরূপ ভাবেই রক্ষিত আছে বলিয়া অনুমান হইল। কিন্তু জীবিত অবস্থায় বা মৃত অবস্থায় তারামণিকে ঐ ঘরের মধ্যে কোনস্থানেই পাইলাম না।

 চোরে তারামণির ঘরে সিঁদ কাটিয়াছে। ঐ সিঁদের মধ্য দিয়া কোন মনুষ্য যে গমনাগমন করিয়াছে, তাহার প্রমাণ সেই স্থানের মৃত্তিকোপরিস্থিত মনুষ্যের পদচিহ্ণ প্রদান করিতেছে। অথচ ঘরের ভিতর অবস্থা দেখিয়া অনুমান হইতেছে না যে, ঐ ঘরের কোন দ্রব্য স্থানান্তরিত বা অপহৃত হইয়াছে। আমার যে অনুমান হইতেছে, তাহা প্রকৃত কি না, তারামণি ব্যতীত আর কেহই এ কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ নহে; কিন্তু তারামণি উপস্থিত নাই। সেই স্থানের সমবেত প্রতিবেশীবর্গের মধ্যে কেহই বলিতে পারে না যে, তারামণি কোথায়। কিন্তু এ কথা সকলেই বলে যে, তারামণির কিছু অর্থ ও অলঙ্কার আছে; অলঙ্কার পত্র বন্ধক রাখিয়া, টাকাকড়ি ধার দিয়া সে বেশ দশ টাকা উপার্জ্জনও করিয়া থাকে।