মতিয়া বিবি/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 ঘরে সিঁদ, ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ, অথচ ঘরের ভিতর তারামণি নাই। এইরূপ অবস্থায় তারামণি কোথায় গেল? চোরের ভয়ে তারামণি যদি ঘরের দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে ঐ চোর ঘরের ভিতর হইতে ঐ দরজা কেন বন্ধ করিয়া দিবে? তবে কি তারামণি ঐ সিঁদের মধ্য দিয়াই প্রস্থান করিয়াছে? তাহাই বা অনুমান করি কি প্রকারে? এরূপ কথাতো এ পর্য্যন্ত কখন শুনি নাই। আর যদি তারামণি কোনরূপে তাহার ঘরের ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া পলায়ন করিয়াই থাকে, তাহা হইলেই ব। এতক্ষণ পর্য্যন্ত সে পলায়িত রহিবে কেন? পূর্ব্বে মনে করিয়াছিলাম, তারামণিকে হত্যা করিয়া চোরে তাহার যথা-সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। আমার সে অনুমান যদি প্রকৃত হইত, তাহা হইলে তারামণির মৃতদেহ নিশ্চয়ই এই ঘরের কোন না কোন স্থানে প্রাপ্ত হইতাম। মনে মনে এইরূপ অনেক চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল, কিন্তু কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না!

 প্রাণের ভয়ে কোন স্থানে তারামণি যদি লুক্কায়িত থাকে, ইহা ভাবিয়া সেই গ্রামের মধ্যে ও তাহার নিকটবর্ত্তী গ্রাম সকলের মধ্যে তাহার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন স্থানেই তারামণির কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। পন্পপ অবস্থায় তখন যে আর কি কর্ত্তব্য, তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই অনুমান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কারণ, তারামণির ঘরের দ্রব্যাদির অবস্থা দেখিয়া অনুমান হইল যে, ঐ ঘরের কোন দ্রব্য কোনরূপে স্থানান্তরিত হয় নাই, যেস্থানে যে দ্রব্য যেরূপ ভাবে রক্ষিত ছিল, সেই সকল দ্রব্য সেই স্থানেই সেইরূপ ভাবে রহিয়াছে। লোহার সিন্দুক ও অপরাপর সিন্দুক বাক্স সকল যেরূপ ভাবে যেস্থানে ছিল, সেই সকল দ্রব্য সেই স্থানেই বন্ধ অবস্থায় রহিয়াছে। ঘরের ভিতর অনুসন্ধান করিয়া কোন স্থানে ঐ সকল সিন্দুক ও বাক্সের চাবিও পাইলাম না। অনুসন্ধানে তারামণিকে না পাইয়া ও ঐরূপ নানা কারণে ইহাই আমাদিগকে স্থির করিয়। লইতে হইল যে, তারামণি কোন না কোন স্থানে লুক্কায়িত আছে, দুই চারি দিবস পরে তাহাকে পাওয়া যাইবে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া তারামণির ঘরে যে সিঁদ হইয়াছে, কেবল তাহারই অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। কোন দ্রব্য অপহৃত না হইয়া কেবলমাত্র সিঁদ হইলে আমরা যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া থাকি, ইহাও সেইরূপ অনুসন্ধানে পরিণত হইল। ক্রমে ২|৩ দিবস অতীত হইয়া গেল; কিন্তু কাহার দ্বারা তারামণির ঘরে সিঁদ হইয়াছে, তাহার কিছু মাত্র অবগত হইনে পারিলাম না। প্রথম দিবসেই তারামণির ঘরে সিঁদ বন্ধ করিয়া দিতে বলিয়া আসিয়াছিলাম; কিন্ত তারামণি না থাকায় সেই সিঁদ কেহই বন্ধ করে নাই, এখন পর্য্যন্ত উহা সেইরূপ ভাবেই আছে।

 প্রথম দিবস যে ব্যক্তি থানায় আসিয়া সিঁদের সংবাদ প্রদান করিয়াছিলেন, চতুর্থ দিবসে তিনি পুনরায় থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কথার কথায় তাহার নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, এ পর্য্যন্ত তারামণি আসিয়া উপস্থিত হয় নাই; সে যে কোথায় গেল, বা তাহার ভাগ্যে যে কি ঘটিল, তাহার কিছুই এ পর্য্যন্ত কেহই অবগত হইতে পারেন লাই। আজ তিনি তারামণির ঘরের মধ্যে পুনরায় গমন করিয়াছিলেন, ঘরের মধ্যে যেন অতি অল্প পরিমাণে দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে, কিন্তু কোথা হইতে যে সেই দুর্গন্ধ আসিতেছে, তাহার কিছুই তিনি অনুমান করিতে সমর্থ হন নাই। তাঁহার বিবেচনায় ঘরের মধ্যে বা নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে হয়ত মৃত মুষিক পড়িয়া আছে, ও তাহা হইতেই এ অল্প পরিমিত দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে। তাঁহার নিকট হইতে কথায় কথায় এই কয়েকটী কথা জানিতে পারিলাম সতা, কিন্ত তিনি সেই দিবস কি নিমিত্ত যে আমার নিকট আগমন করিয়াছিলেন, তাহা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা না করিলে তিনি কহিলেন না। অন্যান্য বাজে কথার আন্দোলন করিয়া সময় অতিবাহিত করিতে লাগিলেন।

 এইরূপে কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইয়া গেলে, আমি তাঁহাকে সেই দিবস আমার নিকট আসিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম ও তাহার উত্তরে জানিতে পারিলাম ঘে, তারামণি যে বাড়ীতে বাস করিত, তাহা তাঁহার নিজের; এ বাড়ীর সহিত তারামণির কেবলমাত্র ভাঁড়া দিয়া বাস করা ব্যতিরেকে আর কোন সংশ্রব ছিল না। ভাড়াও সে নিয়মিতরূপ প্রদান করিত না, এখন পর্য্যন্ত প্রাক এক বৎসরের ভাঁড়া তাহার নিকট বাকী আছে। এরূপ অবস্থায় তারামণির যে সকল দ্রব্যাদি আছে, তাহা তিনি গ্রহণ করিতে সমর্থ কি না; কারণ, তারামণি এখন পর্য্যন্ত ফিরিয়া আইসে নাই। আসিবে কি না, তাহারও এখন পর্য্যন্ত স্থিরতা নাই। বিশেষ যদি কোন কারণে তাহার মৃত্যুই হইয়া থাকে, তাহা হইলে সে আর কোথা হইতে ফিরিয়া আসিবে? আর বদি ফিরিয়াই আইসে, তাহা হইলে সে তাহার দ্রব্যাদি তাঁহার নিকট হইতে অনায়াসেই গ্রহণ করিতে পারিবে। ঐ ঘর হইতে তারামণির দ্রব্যাদি স্থানান্তরিত না করিলে অপর কোন ব্যক্তিকে ঐ ঘর ভাড়া দেওয়া যাইতে পারে ন।

 বাড়িওয়ালার কথা শুনিয়া তাঁহার অভিসন্ধি যে কি, তাহা অনুমান করিতে উত্তমরূপে সমর্থ হইলাম। এতদিন পর্য্যন্ত তারামণি যখন প্রত্যাগমন করে নাই, তখন তারামণির প্রত্যাগমনের সম্ভাবনা নিতান্তই অল্প। তারামণি প্রত্যাগমন না করিলে ঐ সকল দ্রব্য আর কেহই তাঁহার নিকট হইতে চাহিবে না; সুতরাং আর কাহাকেও উহা প্রত্যর্পণ করিতে হইবে না, তারামণির সমস্ত বিষয় তাঁহার নিজেরই হইয়া যাইবে।

 বাড়িওয়ালার কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম “তারামণি এখন পর্য্যন্ত প্রত্যাগমন করে নাই, প্রত্যাগমন করিবে কি না, তাহারও এখন কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। যদি আর সে প্রতাগমন না করে, তাহা হইলে তাহার পরিত্যক্ত দ্রব্যাদির সহিত আপনার কোনরূপ সংশ্রব আছে বলিয়া আমার অনুমান্ হয় না। কারণ, ঐ সকল দ্রব্যের অধিকারী হইবেন—গবর্ণমেণ্ট। গবর্ণমেণ্টের পক্ষ হইতে আমি ঐ সকল দ্রব্য লইয়া আসিব, তাহা হইলেই আপনার ঘর খালি হইয়া যাইবে, তখন আপনি অনায়াসেই এ ঘর অপরকে ভাড়া দিতে পারিবেন। তারামণি প্রতাগমন না করিলে বা তাহার কোন ওয়ারিস্‌ আসিয়া ঐ সকল দ্রব্য গ্রহণ না করিলে, যখন উহা বিক্রয় করিয়া উহার মূল্য গবর্ণমেণ্ট গ্রহণ করিবেন, সেই সময় আপনার ঘর-ভাড়ার নিমিত্ত যাহা কিছু পাওনা আছে, তাহা আপনি প্রাপ্ত হইবেন। তদ্ব্যতীত তারামণি যদি অপর আর কাহার নিকট কোনরূপ ঋণগ্রস্তা থাকেন, তাহা হইলেও তাহার ঋণ পরিশোধ করিয়া দেওয়া যাইবে।

 আমার কথা শুনিয়া বাঁড়িওয়ালা আর কোন কথা কহিতে সাহসী হইলেন না। আমি তাঁহাকে বলিয়া দিলাম, যদি সময় পাই, তাহা হইলে অদ্যই নতুবা কল্য প্রাতঃকালে আমি ঐ স্থানে গমন করিয়া তাহার সিন্দুক, বাক্স প্রভৃতি সমস্ত খুলিয়া দেখিব, তাহার কি কি দ্রব্যাদি আছে। আর ঐ সকল দ্রব্যের একটা তালিকা আপনাদিগের সকলের সম্মুখে প্রস্তুত করিয়া, সমস্ত দ্রব্য আমি থানায় উঠাইয়া আনিব। তাহা হইলেই আপনার ঘর খালি হইয়া যাইবে।

 আমার কথা শুনিয়া বাড়িওয়ালা আর কোনরূপ দ্বিরুক্তি করিতে সাহসী না হইয়া, আস্তে আস্তে থানা হইতে প্রস্থান করিলেন।