মতিয়া বিবি/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
যে দিবস বাড়িওয়ালা আমার থানায় আসিয়াছিলেন, সে দিবস তারামণির গৃহে গমন করিবার সময় কোনরূপেই করিয়া উঠিতে পারিলাম না। পর দিবস প্রত্যূষেই গিয়া সেই স্থানে স্থানীয় দুই তিনজন ভদ্রলোককে ডাকাইয়া তারামণির ঘরের দরজা খুলিয়া সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। বাড়িওয়ালা থানায় গিয়া পূর্ব দিবস যাহা বলিয়া আসিয়াছিল, সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াই জানিতে পারিলাম যে, তাহার কথা প্রকৃত; ঘরের মধ্য হইতে কেমন একটা অল্প অল্প দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে। কোথা হইতে ঐ দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত ঐ ঘরের মধ্যে পুনরায় উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম; কিন্ত কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। ঘরের মধ্যস্থিত সিন্দুক বাক্সগুলি বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিবার কালীন, লোহার সিন্দুকের গাত্রে ছুই চারিটী ক্ষুদ্র পিপীলিকা দেখিতে পাইলাম। আরও বোধ হইল, ঐ দুর্গন্ধ যেন সেই লোহার সিন্দুকের নিকটেই অধিক পরিমাণে বোধ হইতেছে।
লোহার সিন্দুকের এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে এক ভয়ানক চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল, ক্রমে ভয়েরও সঞ্চার হইতে লাগিল। কেন যে ভয় হইল, তাহা আমিই ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না, পাঠকগণকে বুঝাইব কি প্রকারে?
এখন স্থির হইল, সর্ব্বাগ্রে ঐ লোহার সিন্দুক খুলিয়া দেখা। অনুসন্ধান করিয়া লোহার সিন্দুকের চাবি পাওয়া যায় নাই; সুতরাং অন্য উপায়ে ঐ লোহার সিন্দুক খুলিবার বা উহা ভাঙ্গিবার চেষ্টা দেখিতে হইল। জানিতে পারিলাম, অনতিদূরে জনৈক লোহার সিন্দুক নির্ম্মাতার একটী কারখানা আছে। সুতরাং তাহাকে ডাকাইতে হইল। তিনি আসিয়া প্রথমতঃ ঐ সিন্দুক খুলিবার নিমিত্ত বিশেষরূপ চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কোনরূপে কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া, পরিশেষে কয়েকটা লোহার খিল বা “নেচি” কাটিয়া ঐ দিন্দুকের ডালা খুলিয়া দিল।
তালাটী স্থানান্তরিত করিয়া দেখিলাম—সর্ব্বনাশ! ইতিপূর্ব্বে মনে যাহা ভাবিয়াছিলাম, দেখিলাম ঠিক তাহাই ঘটয়াছে। ঐ সিন্দুকের মধ্যে তারামণির মৃতদেহ রহিয়াছে। ঐ মৃতদেহ ভয়ানক পচিয়া গিয়াছে, ও তাহা হইতে অতিশয় দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতকগুলি পিপীলিকা কেবল উহার স্থানে স্থানে কাটিয়া খাইয়া ফেলিয়াছে। নিতান্ত সঙ্কীর্ণ স্থানের মধ্যে ঐ মৃতদেহ রক্ষিত আছে; কিন্তু উহার হস্ত পদ প্রভৃতির কোন স্থান কোনরূপে বন্ধন করিয়া রাখা হয় নাই। মৃতদেহ অতিশয় পচিয়া গিয়াছে এবং উহার মুখ দেখিয়াও বেশ চিনিতে পারা যাইতেছে না যে, উহা তারামণির মৃতদেহ কি না।
যেরূপ অবস্থায় তারামণিকে পাওয়া গেল, তাহা দেখিয়া এখন সহজেই অনুমিত হইল যে, কোন দস্যু তারামণির ঘরের দেওয়ালে সিঁদ দিয়া এ ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া তারামণিকে হত্যা করিয়া তাহার যথা-সর্ব্বস্ব অপহরণ পূর্ব্বক তারামণির মৃতদেহটীকে ঐ লোহার সিন্দুকের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া এবং ঐ সিন্দুকের চাঁবি লইয়া পুনরায় সেই সিঁদের মধ্য দিয়া বহির্গত হইয়া গিয়াছে।
এখন যাহা অনুমিত হইল তাহা সত্য; কিন্তু এখন কর্ত্তব্য কি?
পাঠকগণ বলিয়া বসিবেন, এখনকার কর্ত্তব্য কি, তাহা একটী পঞ্চমবর্ষীয় বালকও অনায়াসে বুঝিতে পারে। এখন পুলিসের কর্ত্তবা, যে দস্যুর দ্বারা এই ভয়ানক কার্য্য সাধিত হইয়াছে, অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে ধৃত করা ও যাহাতে দোষীর উপযুক্ত দণ্ড হয়, তাহার উপায় করা।
কথাটা যেরূপ সহজ, কার্য্যটা ততদূর সহজ নহে। গভীর অন্ধকারের মধ্যে আপনার শরীর আবৃত করিয়া যে দস্যু তারামণির গৃহে সিঁদ দিল, ও অপরের অলক্ষিতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই ঘরের একমাত্র অধিকারিণীকে হত্যা করিয়া নির্ব্বিবাদে বাহির হইয়া চলিয়া গেল, এখন বলুন দেখি তাহার অনুসন্ধান কিরূপে হইতে পারে? যাহাকে কেহ দেখিল না, যাহার কথা কেহ শুনিল না, অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করা ও হত্যাপরাধে তাহাকে দণ্ডিত করা, কিরূপ দুরূহ কার্য্য; তাহা অনুমান করিয়াই স্থির করা যায় না। কার্য্যে পরিণত করা একেবারে অসম্ভব হইলেও, সেই অসম্ভবকে আমাদিগকে সম্ভরপর করিয়া লইতে হইবে। ইহা অপেক্ষা অসম্ভব বিষয় আর কি হইতে পারে?
সম্ভব হউক আর অসম্ভব হউক; মনের ইচ্ছা কার্য্যে পরিণত করিবার আশা থাকুক আর নাই থাকুক, এই অসম্ভব কার্য্য সম্ভবে পরিণত করিবার চেষ্টা আমাদিগকে দেখিতেই হইবে। যে কার্য্যের নিমিত্ত বেতন গ্রহণ করিয়া থাকি, পারি আর না পারি, সেই কার্য্য যাহাতে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়, তাহার চেষ্টা আমাদিগকে করিতেই হইবে। সুতরাং এই মোকর্দ্দমার কিনারা হইবার কোনরূপ আশা না থাকিলেও, ঐ অনুসন্ধানে বাধ্য হইয়া আমাদিগকে নিযুক্ত হইতে হইল।
মৃতদেহ সেই লোহার সিন্দুক হইতে বাহির করিলাম। পচিয়া নিতান্ত বিকৃতভাব ধারণ করিলেও, পরীক্ষার নিমিত্ত উহা ডাক্তারখানায় প্রেরিত হইল। আমরা উপরি উপরি যতদূর দেখিলাম, তাহাতে ঐ মৃতদেহের উপর কোনরূপ অস্ত্রাঘাতের বা অপর কোনরূপ চিহ্ণ বা জখম দেখিতে পাইলাম না। পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম, তারামণির কিছু অর্থাদি অলঙ্কার পত্র আছে, তদ্ব্যতীত কিছু কিছু বন্ধকী কারবারও করিয়া থাকে। কিন্তু লোহার সিন্দুকের ভিতর তাহার কোনরূপ চিহ্ণ দেখিতে পাইলাম না। এক তারামণির মৃতদেহ ও তাহার পরিহিত একখানি বস্ত্র ভিন্ন লোহার সিন্দুকের মধ্যে আর কিছুই ছিল না।
যাহার ঘরে লোহার সিন্দুক আছে, তাহার মূল্যবান দ্রব্যাদি সে সেই লোহার সিন্দুকের ভিতরই রাখিয়া থাকে। আর মূল্যবান দ্রব্যাদি ঘরে না থাকিলেও যে লোহার সিন্দুকের ভিতর কিছুই থাকে না, তাহাও একেবারে অসম্ভব। সুতরাং তারামণির লোহার সিন্দুকের অবস্থা দেখিয়া স্বভাবতই আমাদিগের মনে করিতে হইল যে, উহার ভিতর যাহা ছিল, তাহার সমস্তই দস্যুগণ অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, না হয়, স্থানান্তরে রাখিয়া দিয়াছে; নতুবা লোহার সিন্দুকের ভিতর কোনরূপ দ্রব্যের চিহ্ণমাত্রও নাই কেন? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ঐ ঘরের ভিতর অপরাপর যে সকল সিন্দুক বাক্স ছিল, তাহাও খুলিয়া দেখিতে ইচ্ছা করিলাম। অপর চাবির দ্বারা যে যে বাক্স প্রভৃতি খুলিতে পারিলাম, তাহা খুলিয়া ফেলিলাম; আর যাহা খুলিতে পারিলাম না; তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম। ঐ সকল বাক্সের আভ্যন্তরীণ অবস্থা দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, ঐ সকল বাক্স দস্যু কর্ত্তৃক খোলা হইয়াছিল, কিন্তু উহার মধ্যস্থিত বস্ত্র প্রভৃতি যে কিছু অপহৃত হইয়াছে, তাহা রোধ হইল না, কিন্তু কোনটীর ভিতর অর্থ বা কোনরূপ অলঙ্কার দৃষ্টিগোচর হইল না। তারামণি ঐ সকল বাক্স ও সিন্দুক প্রভৃতির ভিতর যদি কোনরূপ অলঙ্কার বা নগদ অর্থ রাখিয়া থাকে, তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে।
পাড়ার অনেকেই কহিল, তারামণির অঙ্গে বালা, তাগা, হার প্রভৃতি কয়েকখানি সুবর্ণনির্ম্মিত অলঙ্কার প্রায়ই থাকিত। কিন্তু মৃতদেহের শরীরে অলঙ্কারের কোনরূপ চিহ্ণ না দেখিয়া সহজেই অনুমান করিতে হইল যে, তারামণিকে হত্যা করিবার কারণ আর কিছুই নহে, কেবল তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করা। আরও মনে করিলাম, হয়তো এই কার্য্য তারামণির কোন পরিচিত লোকের দ্বারা হইয়া থাকিবে। তারামণির দ্রব্যাদি কেবলমাত্র অপহরণ করিয়া চলিয়া গেলে, পশ্চাৎ তারামণি তাহাদিগের নাম বলিয়া দেয়, এই ভয়েই তাহারা তারামণিকে হত্যা করিয়া গিয়াছে। এবং যাহাতে সহজে এ কথা প্রকাশিত হইয়া না পড়ে, এই নিমিত্ত তাহারা তারামণির মৃতদেহ লোহার সিন্দুকে বন্ধ করিয়া রাখিয়া গিয়াছে। তাহারা ভাবিয়াছিল, চাবি না পাইলে ঐ সিন্দুক সহজে কেহ খুলিবে না, সুতরাং তারামণির অবস্থাও কেহ অবগত হইতে পারিবে না।