মতিয়া বিবি/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
হত্যাকারী যাহা ভাবিয়া তারামণির মৃতদেহ লোহার সিন্দুকের ভিতর বন্ধ করিয়া তাহার চাবি সহিত প্রস্থান করিয়াছিল, তাহা হইল না; তারামণির মৃতদেহ পরিশেষে বাহির হইয়া পড়িল। আর আমরাও মনে মনে যাহা ভাবিয়া বা যেরূপ অনুমান করিয়া এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইতেছি, তাহাও যে কার্য্যে পরিণত হইবে, তাহাও অনুমান করা যাইতে গারে না। যাহা হউক, এখন হত্যা মোকর্দ্দমার অনুসন্ধানে আমাদিগকে লিপ্ত হইতে হইল। এরূপ মোকর্দ্দমার অনুসন্ধান করিতে হইলে সর্ব্ব প্রথমে অপহৃত মালের তালিকা আমরা প্রস্তত করিয়া থাকি। তাহার পর কি উপায় অবলম্বন করিলে ঐ সকল অপহৃত দ্রব্য আমরা পুনরায় প্রাপ্ত হইতে পারি, তাহারই চেষ্টা দেখিয়া থাকি। কিন্তু বর্তমানক্ষেত্রে আমাদিগকে সে উপায় পরিত্যাগ করিতে হইল। কারণ, তারামণির ঘর হইতে কি কি দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহার তালিকা আমরা সেই সময় প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইলাম না। কেবল এইমাত্র জানিতে পারিলাম যে, তারামণির অঙ্গে সময় সময় বালা, তাগা ও হার প্রভৃতি কয়েকখানি অলঙ্কার পরিহিত থাকিত এবং যে রাত্রিতে তাহার ঘরে সিঁদ হইয়াছে, তাহার পূর্ব্ব দিবস ঐ কয়েকখানি অলঙ্কার তাহার অঙ্গে পরিহিত ছিল, তাহাও কেহ কেহ দেখিয়াছে। সুতরাং কেবলমাত্র ঐ কয়খানি অলঙ্কারের উপর নির্ভর করিয়া আমাদিগকে এখন ঐ অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইতে হইল।
অপহৃত অলঙ্কার কয়েকখানির অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম সত্য; কিন্ত কোন স্থানে তাহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। অলঙ্কারের অনুসন্ধান ব্যতীত আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে সকল বিষয় আমাদিগের কর্ণগোচর হইতে লাগিল, তাহারও আনুপূর্ব্বিক অনুসন্ধান সঙ্গে সঙ্গে শেষ করিতে লাগিলাম, কিন্তু আসল মোকর্দ্দমা সম্বন্ধীয় কোন কথাই কোনরূপ প্রাপ্ত হইলাম না। এইরূপে ক্রমে ক্রমে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল।
যে স্থানে তারামণি বাস করিত, তাহার অনতিদূরে একটা বাগান আছে, ঐ বাগানের ভিতর ঘাঁটবাধান একটা পুষ্করিণীও আছে। ঐ পুষ্করিণীর জল অনেকটা ভাল বলিয়া নিকটবর্ত্তী দরিদ্র লোকজন ঐ পুষ্করিণীর জলই প্রায় ব্যবহার করিয়া থাকে। এক দিবস আমি ঐ পুষ্করিণীর বাঁধাঘাটের এক পার্শ্বে বসিয়া রহিয়াছি, সন্ধ্যাকালীন তিমিরে আমাকে প্রায় আবৃত করিয়া সেই স্থানে লুক্কায়িত ভাবে রাখিয়াছে, এইরূপ সময়ে দুইটী কলসী কক্ষে দুইটী স্ত্রীলোক জল লইবার মানসে আস্তে আস্তে ঐ পুষ্করিণীতে অবতরণ করিল। উহাদিগের মধ্যে একটী স্ত্রীলোক অপর স্ত্রীলোকটীকে কহিল, “ভাই! সে পয়সা কয়টা দিলি নে?”
২য় স্ত্রীলোক। না ভাই, এখন পর্য্যন্ত যোগাড় করিয়া উঠিতে পারি নাই। যেমন হাতে হইবে, অমনি দিব, চাইতে হইবে না।
১ম স্ত্রীলোক। ইহার আগেও তো বলিয়াছিলে যে, দুই এক দিবসের মধ্যেই তুমি কোথায় পয়সা পাইবে, ও উহা পাইবামাত্রই আমার দেনা মিটাইয়া দিবে।
২য় স্ত্রীলোক। বলিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু ভাই, সে পয়সা পাই নাই। আমাদিগের বাড়ীতে দুইজন ভদ্রলোক আসিয়া কয়েক দিবসের নিমিত্ত বাসা লইয়াছিল, তাহাদিগের নিকট হইতেই পয়সা পাওয়ার কথা ছিল, তাই তোমাকে বলিয়াছিলাম, ঐ পয়সা পাইলেই তোমাকে দিব।
১ম স্ত্রীলোক। তবে কি তাহাদিগের নিকট হইতে এখনও পয়সা পাও নাই?
২য় স্ত্রীলোক। না ভাই পাই নাই, পাইবার আর আশাও নাই।
১ম স্ত্রীলোক। কেন? পাইবার আশা নাই কেন, তাহারা কি দিবে না বলিয়াছে?
২য় স্ত্রীলোক। আমাদিগের ঘর ভাড়া প্রভৃতি একটী পয়সাও না দিয়া তাহারা হঠাৎ কোথায় চলিয়া গিয়াছে।
১ম স্ত্রীলোক। যাইবার সময় বলিয়া যায় নাই?
২য় স্ত্রীলোক। না ভাই, বলিয়াও যায় নাই বা একটী পয়সা দিয়াও যায় নাই।
১ম স্ত্রীলোক। তাহা হইলে তো দেখিতেছি যে, তাহারা খুব ভদ্রলোক।
২য় স্ত্রীলোক। কলিকাতায় ভদ্র বা অভদ্রলোক হঠাৎ চিনিয়া লওয়া বড়ই শক্ত। তাহাদিগের পোষাক পরিচ্ছদে ও কথাবার্ত্তায় আমরা তাহাদিগকে ভদ্রলোকই স্থির করিয়া লইয়াছিলাম। কিন্ত এখন দেখিতেছি, তাহারা ভদ্রলোক নহে। যে ঘরের ভাড়া না দিয়া চোরের মত রাত্রিকালে হঠাৎ চলিয়া যায়, তাহাদিগকে ভদ্রলোক বলিব কি প্রকারে?
উভয় স্ত্রীলোকদ্বয় এইরূপে কথা কহিতে কহিতে আপনাপন কলসী জলে পূর্ণ করিয়া লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। উহাদিগের ঐ কথা শুনিয়া আমিও মনে ভাবিলাম, এই স্ত্রীলোকদ্বয় যখন এই স্থানে জল লইতে আসিয়াছে, তখন তাহাদিগের বাসস্থান যে এই স্থান হইতে বহুদূরে, তাহা বোধ হয় না। আর দুইটী অপরিচিত লোক এই স্থানে আসিয়া বাসা লইয়াছিল, অথচ কাহাকেও কিছু না বলিয়া হঠাৎ তাহারা এই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, ইহাও নিতান্ত সন্দেহের বিষয়। বিশেষ একথা আমরা ইতিপূর্ব্বে কিছুমাত্র অবগত হইতে পারি নাই। যাহা হউক, এখন দেখিতে হইবে যে, উহারা কোন্ বাড়ীতে আসিয়া কয়দিবস কাল অতিবাহিত করিয়াছিল, ও কোন্ দিবসই বা হঠাৎ এই স্থান পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমিও সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিলাম, ও দূর হইতে ঐ স্ত্রীলোকদ্বয়ের অনুসরণ আরম্ভ করিলাম। কিছুদূর একত্রে গমন করিবার পর, দুইটী স্ত্রীলোক দুইটী স্বতন্ত্র পথ অবলম্বন করিয়া গমন করিতে লাগিল। আমিও প্রথম স্ত্রীলোকটার পশ্চাদ্গমন না করিয়া দ্বিতীয় স্ত্রীলোকটীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম ও দেখিলাম, ঐ স্ত্রীলোকটী কোন বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করে। এইরূপ উপায়ে ঐ স্ত্রীলোকটীর বাড়ী দেখিয়া লইয়া, সেই রাত্রিতে আমিও সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। কারণ মনে করিলাম, এই অনুসন্ধান রাত্রিকালে আরম্ভ করা কোনক্রমেই কর্ত্তব্য নহে।
পরদিবস প্রত্যূষে আমি ঐ বাড়ীতে পুনরায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। এই বাড়ীটি তারামণির বাড়ী হইতে বহুদূরবর্তী ছিল না, একটু দূর হইলেও সেই পাড়ার মধো। সেই স্থানে গমন করিয়া জানিতে পারিলাম, উহা কেশব কৈবর্ত্ত নামক একজনের বাসগৃহ। কেশব তাহার পরিবার-সহিত ঐ বাড়ীর একখানি ঘরে বাস করে, ও অপর একখানি বাহিরের ঘর প্রায়ই খালি থাকে, সময় সময় কেহ ঐ ঘর ভাড়া লইলে তাহাও সে দিয়া থাকে। আরও জানিতে পারিলাম, যে রাত্রিতে তারামণির ঘরে সিঁদ কাটিয়া তারামণিকে হত্যাপূর্ব্বক তাহার মূল্যবান দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে, তাহার প্রায় ১০|১২ দিবস পূর্ব্ব হইতে কেশব কৈবর্ত্তের বাড়ী দুই ব্যক্তি ভাড়া লইয়াছিল, ও সেই স্থানেই বাস করিতেছিল। যে দিবস তারামণির গৃহে সিঁদ হইয়াছে জানিতে পারা গিয়াছে, সেই দিবস হইতে তাহাদিগকে সেই স্থানে আর কেহ দেখিতে পায় নাই। তাহারা যে কোথায় গিয়াছে, তাহা কেশব কৈবর্ত্ত বা অপর কেহ কিছুই বলিতে পারে না। ঐ স্থান পরিত্যাগ করিবার সময় তাহারা কাহাকেও কোন কথা বলিয়া যায় নাই, বা ঐ ঘরের ভাড়া প্রভৃতি কিছুই তাহারা কেশবকে দিয়া যায় নাই। তাহারা যে কে, কোথা হইতে আসিয়া ঐ স্থানে বাস করিতেছিল, বা কি কার্য্য করিয়া দিনযাপন করিত, তাহা কেহই কিছু বলিতে পারিল না। কেবল এইমাত্র জানিতে পারা গেল যে, তাহারা বলিত, বড়বাজারে তাহাদিগের কাপড়ের দোকান আছে; কিন্ত পীড়ার জুল্ম তাহারা বহুলোকের অধিকৃত বড়বাজার পরিত্যাগ করিয়া এই নির্জ্জন স্থানে বাস করিতেছে। সময় সময় তাহারা দিনমানে বাহির হইয়াও যাইত। যাইবার সময় জিজ্ঞাসা করিলে, তাহারা কহিত যে, তাহারা তাহাদিগের বড়বাজারের কাপড়ের দোকানে গমন করিতেছে। প্রকৃতপক্ষে তাহারা যে কি করিত, তাহা সেই স্থানের কেহই অবগত ছিল না। অধিকাংশ দিবসের দিবাভাগেই তাহারা প্রায়ই বাহিরে গমন করিত না, ঘরের মধ্যে থাকিয়াই সময় অতিবাহিত করিত। সময় সময় দুই একটা পশ্চিমদেশীয় লোক তাহাদিগের নিকট আগমন করিত। যাহারা আগমন করিত, তাহাদিগকে দেখিয়া অনুমান হইভ, উহাদিগের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই আছে। কিন্তু তাহাদিগের সংখ্যা খুব অধিক ছিল না; ঐ দুইব্যক্তি যত দিবস ঐ স্থানে ছিল, তাহার মধ্যে বোধ হয়, চারিজনের অধিক লোককে কেহ সেই স্থানে দেখে নাই।
কেশব ও তাহার পরিবারবর্গের নিকট এই সকল বিষয় অবগত হইয়া, আমাদিগের মনে মনে বেশ অনুমান হইল যে, তারামপির হত্যাকাণ্ডে ইহারা স্বতঃ বা পরতঃ যেরূপ ভাবেই হউক, লিপ্ত আছে। সুতরাং তাহাদিগকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা এখন আমাদিগের নিতান্ত কর্ত্তব্য কর্ম্মের মধ্যে পরিণত হইল; কিন্তু কি উপায় অবলম্বন করিলে ঐ সকল ব্যক্তির অনুসন্ধান করিতে সমর্থ হইব, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই অনুমান করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
কেশব কৈবর্ত্ত ও তাহার পরিবারবর্গ ও পাড়ার অপরাপর বাক্তিগণ যাহারা তাহাদিগকে দেখিয়াছিল, তাহাদিগের নিকট হইতে ঐ সকল ব্যক্তির হুলিয়া বা দৈহিক বিবরণ যতদূর সম্ভব সংগ্রহপূর্ব্বক লিপিবদ্ধ করিয়া লইলাম। ঐ সকল বিবরণ পাঠকগণের সুখপাঠ্য নহে বলিয়া এই স্থানে প্রদত্ত হইল না।
পূর্ব্ববর্ণিত ছয়জন ব্যক্তির দৈহিক বিবরণ যতদূর সম্ভব অবগত হইয়া মনে করিলাম, বহুদর্শী কর্ম্মচারিগণের সহিত এখন একবার পরামর্শ করার প্রয়োজন উপস্থিত হইয়াছে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, আমার সহিত যে সকল কর্ম্মচারী সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, তাহাদিগকে, ও আমার জানিত যে সকল অপরাপর কর্ম্মচারী এই সহরের চোর বদমায়েসদিগের নিকট উত্তমরূপে পরিচিত, এক স্থানে সমবেত করিয়া, ঐ অজানিত ছয় ব্যক্তি সম্বদ্ধে উত্তমরূপে আলোচনা করা হইল। কর্ম্মাচারিগণের মধ্যে ঐ প্রকার আকৃতি ও প্রকৃতির লোক, ও যাহাদিগের দ্বার ঐরূপ কার্য্য সম্পন্ন হইবার সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা, তাহাদিগের একটী তালিকা প্রস্তুত করিলাম। বলা বাহুল্য, ঐ তালিকার মধ্যে যে সকল ব্যক্তির নাম স্থান পাইল, তাহাদিগের প্রত্যেকের দ্বারাই এইরূপ কার্য্য অনায়াসেই সম্পন্ন হইতে পারে।
এখন আমাদিগের প্রধান কার্য্য হইল, অনুসন্ধান করিয়া আমাদিগের তালিকার লিখিত ব্যক্তিগণকে বাহির করা ও কেশব কৈবর্ত্ত ও তাহার পরিবারবর্গকে দেখান যে, ঐ ব্যক্তিগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি তাহাদিগের বাড়ীতে কখন আসিয়াছিল কি না।