মতিয়া বিবি/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 যে রাত্রিতে তারামণির ঘরে সিঁদ হয়, তাহার এক দিবস পরে আর একটা হত্যাকাণ্ড সংসাধিত হয়। এই হত্যার উদ্দেশ্য চুরি ছিল না, তাহার উদ্দেশ্য প্রতিহিংসা। ঐ মোকর্দ্দমার অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত না থাকিলেও উহার অবস্থা জানিতে আমার কিছুমাত্র বাকি ছিল না। আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, যিনি হত হইয়াছিলেন, তাঁহার নাম মতিয়া বিবি। এবং ইহাও অনুমিত হইয়াছিল, মতিয় বিবি কোনও সম্ভ্রান্ত মুসলমানের কন্যা ও তাঁহার পিতা জনৈক সম্ভ্রান্ত মুসলমান যুবকের হস্তে উহাকে অর্পণ করিয়াছিলেন। মতিয়া বিবির ইহ-জীবন পরিত্যাগ করিবার কারণ ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারা যায় না।

 যে দিবস তাহার মৃত্যু হয়, সেই দিবম বা তাহার পরদিবস উহার মৃতদেহ সৎকারের নিমিত্ত গোরস্থানে লইয়া যাওয়া হয়। গোরস্থানে যিনি মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া গোরের্‌ বাবস্থা করিয়া থাকেন, তিনি মতিয়া বিবির মৃতদেহ দেখিয়া উহা কবরিত করিতে দেন না। মতিয়া বিবির মৃতদেহ দেখিয়া তাঁহার অনুমান হয় যে, বিষপানই মতিয়া বিবির মৃত্যুর কারণ। কিন্তু তিনি স্ব-ইচ্ছায় বিষপান করিয়াছেন, কি বিষ প্রয়োগ করিয়া তাহায় জীবন নষ্ট করা হইয়াছে, তাহা তিনি বুঝিয়া উঠিতে পারেন না। যে সকল ব্যক্তি মতিয়া বিবিকে সেই কবর-স্থানে লইয়া গিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে মহম্মদ মসলিম নামক এর ব্যক্তি ছিলেন। ঐ মহম্মদ মসলিমই মতিয়া বিবিকে তাঁহার স্ত্রী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন। মহম্মদ মসলিমকে জিজ্ঞাসা করায়. তিনিও মতিয়া বিরির মৃত্যুর কারণ যথাযথ বলিয়াা উঠিতে পারেন না বা ইচ্ছা করিয়া বলেন না। সুতরাং বাধ্য হইয়া সেই কবরস্থানের কর্ম্মচারী এই সংবাদ নিকটবর্ত্তী থানায় প্রেরণ করেন। স্বাভাবিক মৃত্যুতে যে মরে নাই, তাহার মৃতদেহ কবরিত করিতে আদেশ দিবার ক্ষমতা সেই কর্ম্মচারীর নাই বলিয়াই, বাধ্য হইয়া এই সংবাদ তাঁহাকে থানায় প্রেরণ করিতে হয়। তিনি থানায় সংবাদ প্রদান করিলেন সত্য, কিন্তু যে পর্য্যন্ত পুলিশ আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইতে না পারে, সেই পর্য্যন্ত ঐ মৃতদেহের উপর কোনরূপ লক্ষ্য রাখিলেন না। কেবলমাত্র জনৈক ডোমের উপর এই আদেশ প্রদান করিলেন যে, “দেখিস্, এই মৃতদেহ কেহ যেন লইয়া না যায়।” ডোম আদেশ শ্রবণ করিল সত্য, কিন্তু তাহাদিগের যেরূপ স্বভাব, সেইরূপ ভাবে কার্য্য করিল। অর্থাৎ এ মৃতদেহ কিরূপ ভাবে ও কোথায় রক্ষিত হইল, তাহার দিকে ক্ষণকালের নিমিত্তও দৃষ্টি রাখিল না।

 সংবাদ পাইবামাত্র জনৈক পুলিশ কর্ম্মচারী সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও সেই স্থানের কর্ম্মচারীর নিকট সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া তাহার সহিত ঐ মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত গমন করিলেন। কিন্তু গোরস্থানে ঐ মৃতদেহ দেখিতে পাইলেন না, বা যে ব্যক্তিগণ ঐ মৃতদেহ সেই স্থানে আনয়ন করিয়াছিল, অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগের কাহাকেও সেই স্থানে পাইলেন না| যে ডোমের উপর ঐ মৃতদেহ দেখিবার আদেশ ছিল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে প্রথমতঃ ঐ মৃতদেহের একবার অনুসন্ধান করিয়া আদিল ও পরিশেষে কহিল, যাহারা ঐ মৃতদেহ আনয়ন করিয়াছিল, তাহারাই ঐ মৃতদেহ লইয়া চলিয়া গিয়াছে। যাইবার সময় আমি তাহাদিগকে নিষেধ করিয়াছিলাম, কিন্তু তাহারা আমার নিষেধ না শুনিয়া এই কথা বলিয়া চলিয়া যায় যে, “কবরাধ্যক্ষ মহাশয় আমাদিগকে ঐ মৃতদেহ এই স্থান হইতে লইয়া যাইবার আদেশ প্রদান করিয়াছেন, তাহাই লইয়া যাইতেছি।” ডোমের কথা শুনিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, সে সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা কথা বলিতেছে। কবরাধ্যক্ষ ঐ মৃতদেহের উপর নজর রাখিবার জন্য তাহাকে যে আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, সে সেই আদেশ কেবল শুনিয়াছিল মাত্র, কিন্তু কার্য্যের দিকে একবার লক্ষ্যও করে নাই। সুতরাং তাহারই অমনোযোগে যে ঐ মৃতদেহ স্থানান্তরিত হইয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

 মৃতদেহ দেখিতে না পাইয়া কবরাধ্যক্ষ সেই পুলিশ কর্ম্মচারীর সহিত উহার অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। প্রথমতঃ কবরস্থানের অন্তর্গত সমস্ত স্থান তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কোনও স্থানে ঐ মৃতদেহের চিহ্নমাত্রও দেখিতে না পাইয়া, পরিশেষে কবর-স্থানের বহির্ভাগে অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ অনুসন্ধান করিবার পর দেখিতে পাইলেন, মহম্মদ মসলিম একটী দোকানের সম্মুখে উপবেশন করিয়া ধূমপান করিতেছে। বলা বাহুল্য, মসলিমকে দেখিবামাত্রই তাঁহারা উহাকে ধৃত করিলেন। ও উহাকে মৃতদেহের কথা জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, ঐ মৃতদেহ তাহারা স্থানান্তরিত করে নাই। কবর-স্থানের মধ্যে যে স্থানে উহারা প্রথমতঃ উহাকে রাখিয়াছিল, সেই স্থানে উহা পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া আসিয়াছে ও একটু বিশ্রাম করিবার নিমিত্ত সেই স্থানে বসিয়া ধূমপান করিতেছে। যে ব্যক্তিগণ ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া আনিয়াছিল, তাহাদিগের কথা জিজ্ঞাসা করায় মসলিম কহিল, যখন তাহারা জানিতে পারিল যে, পুলিশে সংবাদ প্রেরণ করা হইয়াছে, পুলিশের অনুসন্ধান শেষ না হইলে যখন ঐ মৃতদেহ কবরিত হইতে পারিবে না, তখন তাহারা উহা ঐ স্থানে নিক্ষেপ করিয়া আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিয়াছে। মসলিমের কথা শুনিয়া কিছুই অনুমান করিতে পারিলাম না যে, সে মিথ্যা কথা কহিভেছে, কি সত্য কথা বলিতেছে। যদি তাহার কথা প্রকৃত হইবে, তাহা হইলে ঐ মৃতদেহ কোথায় গেল? আর যদি তাহার কথা অপ্রকৃতই হইবে, তাহা হইলে সে স্থির অন্তঃকরণে কবরস্থানের নিকটবর্ত্তী দোকানের সম্মুখে বসিয়া ধূমপানই বা করিবে কেন? সে সেই স্থানের কাহারও নিকট পরিচিত নহে, কোন্‌ স্থানে তাহার বাসস্থান, তাহা কাহারও বিদিত নহে, সে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করা নিতান্ত সহজ হইত না। সে যাহা হউক, তাহার কোন্ কথা প্রকৃত ও কোন্‌ কথাই বা অপ্রকৃত, তাহা জানিতে না পারিলে বিশেষ কোনরূপ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই সতা, কিন্তু মৃতদেহের সন্ধান করা নিতান্ত আবশ্যক।

 মতিয়া বিবি বিষপানে আত্মহত্যা করিলেও পুলিশের কর্ত্তব্য, তাহার যথাযথ অনুসন্ধান করা। আর যদি বিষপ্রয়োগ করাইয়া কেহ তাহাকে হত্যা করিয়া থাকে, তাহা হইলে ঐ মৃতদেহের নিতান্ত আবশ্যক। মৃতদেহ প্রাপ্ত না হইলে কাহাকেও খুনী মোকর্দ্দমায় অভিযুক্ত করা যাইতে পারে না, অথচ যখন দেখিতে পাওয়া যাইতেছে যে, মতিয়া বিবি হত হইয়াছে, তখন মৃতদেহ ব্যতীত ঐ খুনী মোকর্দ্দমা কিরূপে প্রমাণিত হইতে পারিবে?

 পুলিশ কর্ম্মচারী এইরূপ অবস্থা দৃষ্টে নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া এইরূপ মনে করিলেন যে, মসলিম নিতান্ত মিথ্যাকথা কহিতেছে। তাহার সমভিব্যাহারী ব্যক্তিগণ ঐ মৃতদেহ লইয়া প্রস্থান করিয়াছে ও পুলিশের চক্ষে ধূলি প্রদান করিবার মানসে মসলিম সেই স্থানে উপস্থিত আছে। সুতরাং ঐ সমস্ত ব্যক্তির বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগকে বাহির করাই এখন নিতান্ত প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। মসলিমকে জিজ্ঞাসা করায় মসলিম নিতান্ত সরলান্তঃকরণে ঐ সকল ব্যক্তিগণের নাম ও ঠিকানা পুলিশ কর্ম্মচারীকে বলিয়া দিল ও কহিল, যদি আবশ্যক হয়, তাহা হইলে সে নিজে গিয়া উহাদিগকে দেখাইয়া দিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নহে।

 কার্য্যেতে মসলিম করিলও তাহাই। ঐ পুলিশ কর্ম্মচারী ও গোরস্থানের কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া যে সকল ব্যক্তি মতিয়া বিবির মৃতদেহ কবরস্থলে আনিয়াছিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই দেখাইয়া দিল। পুলিশ কর্ম্মচারী তাহাদিগের প্রত্যেককেই পৃথক্ পৃথকরূপে জিজ্ঞাসা করিলেন ও প্রত্যেকের নিকট হইতেই একই প্রকারের উত্তর পাইয়া আরও বিস্মিত হইলেন। সকলেই কহিল–তাহারা ঐ মৃতদেহ কবরস্থানে রাখিয়া চলিয়া আসিয়াছে; তাহার পর যে কি হইয়াছে, তাহা তাহারা অবগত নহে। কবর-স্থানের কর্ম্মচারী ও পুলিশ কর্ম্মচারী উভয়েই মৃতদেহের এইরূপ হঠাৎ অন্তর্ধান দেখিয়া, বিশেষরূপ চিন্তিত ও আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। নিতান্ত অল্প সময়ের মধ্যে এইরপে যে একটা মনুষ্যের মৃতদেহ অন্তর্হিত হইয়া গেল, ইহা বড়ই আশ্চর্য্য। শৃগাল কুক্কুরে সহজে যে ঐ মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিতে পারিবে, তাহাও বোধ হয় না। মৃতদেহের এইরূপ অদ্ভূত অন্তর্ধানের কথা তিনি আর গোপন রাখিতে পারিলেন না। এই সংবাদ তখন তাঁহার উর্দ্ধতন কর্ম্মচারীর নিকট প্রেরণ করিতে হইল। উর্দ্ধতন কর্মচারীর আদেশ অনুযায়ী আরও কয়েকজন কর্ম্মচারী আসিয়া এই অনুসন্ধানে যোগদান করিলেন। কেহ মতিয়া বিবির মৃতদেহের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, কেহ বা অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, ঐ মতিয়া বিবি কে, কাহার স্ত্রী, বাসস্থান কোথায় ও তাহার মৃত্যুর কারণই বা কি? মসলিম মতিয়া বিবিকে তাহার স্ত্রী পরিচয়ে কবরস্থানে লইয়া গিয়াছিল। এখনও সে তাহাকে আপন স্ত্রী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতে লাগিল, কিন্তু তাহাদিগের প্রকৃত থাকিবার স্থান যে কোথায়, তাহা কিন্তু কাহাকেও কহিল না বা দেখাইল না। একস্থানের একটী খালি ঘর দেখাইয়া দিয়া কহিল, ঐ স্থানে তাহারা বাস করিত; কিন্তু ঐ ঘরের মধ্যে বাসোপযোগী কোনও দ্রব্যই পরিলক্ষিত হইল না, বা নিকটবর্ত্তী কোনও ব্যক্তিই বলিতে পারিল না যে, তাহারা ঐ স্থানে বাস করিত।