মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায়

ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।

উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, পক্ষিরাজ অত্যুজ্জ্বল স্বর্ণময় কলেবর ধারণ করিয়া অগ্নিমধ্যে প্রবেশ করিলেন, এবং অমৃতসমীপে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, ক্ষুরের ন্যায় তীক্ষ্ণধার এক লৌহময় চক্র অবিশ্রামে তচ্চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করিতেছে। দেবতারা, ঐ অগ্নিতুল্য সূর্য্যসমপ্রভ ভয়ঙ্কর যন্ত্র নির্মাণ করিয়া, অমৃতহরণকারীদিগের ছেদনার্থে নিযোজিত রাখিয়াছিলেন। গরুড় তৎক্ষণাৎ অঙ্গসঙ্কোচ করিয়! অরমধ্যবর্তী স্থান দ্বারা তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন, এবং দেখিতে পাইলেন, মহাবীর্য, মহাঘোর, সদা ক্রুদ্ধ, অতি বেগবান, অনিমিষনয়ন দুই প্রকাণ্ড সর্প অমৃত রক্ষা করিতেছে। উহাদের উভয়েরই শরীর অতি প্রদীপ্ত অনলের ন্যায় উজ্জ্বল, বিদ্যুতের ন্যায় জিহ্বা, চক্ষু অনবরত বিষ উদগার করিতেছে। তাহাদের মধ্যে এক সর্পও যাহার প্রাতি দৃষ্টিপাত করে, সে তৎক্ষণাৎ ভস্মসাৎ হইয়া যায়। বিনতানন্দন, তাহাদের চক্ষুতে ধূলি প্রক্ষেপ করিয়া উভয়কেই অন্ধ করিলেন, এবং অলক্ষিত হইয়া নভোমণ্ডল হইতে তাড়ন ও প্রহার দ্বারা তাঁহাদের কলেবর খণ্ড খণ্ড করিয়া অমৃতকুম্ভ গ্রহণ পূর্বক অতি বেগে উড্ডীন হইলেন, এবং স্বয়ং অমৃত পান না করিয়া তথা হইতে বহির্গমন পূর্ব্বক সূর্য্য প্রভা আচ্ছন্ন করিয়া অপরিশ্রান্ত চিত্তে প্রস্থান করিলেন।

 বিনতানন্দন বিহগরাজ অমৃত গ্রহণ পূর্ব্বক আকাশপথে গমন করিতে করিতে নারায়ণের সাক্ষাৎকার লাভ করিলেন। তিনি তার এইরূপ অলৌকিক ক্রিয়া ও লোভবিরহ দর্শনে পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়া কহিলেন, হে বিহগ! প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে অভিলষিত বর প্রদান করিব। গরুড় কহিলেন, আমি তোমার উপরে থাকিবার বাসনা করি। ইহা কহিয়া পুনর্বার নারায়ণকে কহিলেন, আর ইহাও বর দাও, যেন আমি অমৃত পান না করিয়াও অজর ও অমর হই। নারায়ণ তথাস্তু বলিলেন। গরুড় এই রূপে নারায়ণসন্নিধান হইতে বরদ্বয় প্রতিগ্রহ করিয়া কহিলেন, ভগবন্! তুমিও প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে বর দিব। বিষ্ণু মহাবল বিহগরাজের নিকট, তুমি আমার বাহন ইও, এই প্রার্থনা করিলেন, এবং উপরে থাকিবার বর সিদ্ধ করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে ধ্বজ করিয়া রাখিলেন। গরুড় তথাস্তু বলিয়া বায়ুসম বেগে প্রস্থান করিলেন।

 দেবরাজ ইন্দ্র, এই রূপে গরুড়কে অমৃত গ্রহণ পূর্বক বিমানপণে প্রস্থান করিতে দেখিয়া, ক্রোধভরে বজ্র প্রহার করিলেন। তিনি বজ দ্বারা তাড়িত হইয়া হাস্যমুখে মধুর বচনে ইন্দ্রকে কহিলেন, “দেখ, এই বজ্রের আঘাতে আমার কিঞ্চিন্মাত্রও ব্যথা বোধ হয় নাই, কিন্তু যে মুনির অস্থিতে বজ্র নির্শিত হইয়াছে, তাহার ও বর্জ্যের ও তোমার মানরক্ষার্থে একটি পক্ষ পরিত্যাগ করিতেছি, তুমি ইহার অন্ত পাইবে না, ইহা কহিয়া পক্ষ পরিত্যাগ করিলেন। সকল প্রাণী ঐ পরিত্যক্ত পক্ষ অতি সুন্দর দেখিয়া হৃষ্ট হইয়া তাহার নাম সুপর্ণ[১]রাখিলেন। দেবরাজ এই মহৎ আশ্চর্য্য দেখিয়া মনে মনে স্থির করিলেন, এই পক্ষী অবশ্যই মহাপ্রাণী হইবেক, তখন তাঁহাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, অহে বিহগরাজ! আমি তোমার অদ্ভুত বল বিক্রম জানিতে ও চির কালের নিমিত্ত তোমার সহিত মৈত্রী স্থাপন করিতে বাসনা করি।

 গরুড় যে পক্ষ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, বজ্রপ্রহার প্রভাবে তাহা তিন খণ্ডে বিভক্ত হইলে, এক এক খণ্ড হইতে ময়ুর, নকুল ও দ্বিমুখ পক্ষী, এই তিন সপসংহারকারীর উৎপত্তি সুইল।

  1. সু সুন্দর পর্ণ পক্ষ, যাহার পক্ষ দেখিতে অতি সুন্দর।