মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/দ্বাত্রিংশ অধ্যায়
দ্বাত্রিংশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ শৌনক! দেবতাগণ নানাবিধ অস্ত্র গ্রহণ পূর্বক সতর্ক হইয়া অমৃত রক্ষা করিতেছেন, এমন কালে পক্ষিরাজ গরুড় অতি বেগে তথায় উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে মহাবল পরাক্রান্ত অবলোকন করিয়া সুরগণ কম্পাম্বিতকলেবর হইলেন, এবং হতবুদ্ধি হইয়া পরস্পর প্রহার করিতে লাগিলেন। অপ্রমেয়বলবীর্যসম্পন্ন, বিদ্যুৎ ও অগ্নির স্যায় উজ্জ্বলকায় বিশ্বকর্ম্মও অমৃতরক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন; তিনি মুহূর্ত্তকাল বিহারজি গরুড়ের সহিত ঘোরর সংগ্রাম করিয়া তদীয় পক্ষ, নখ ও চঞ্চু প্রহারে বিক্ষত ও মৃতকল্প হইয়া রণক্ষেত্রে পতিত হইলেন। তদনন্তর গরুড় পক্ষপন দ্বারা ধূলি প্রবাহ উদ্ধৃত করিয়া সমস্ত লোক নিরালোক ও দেবগণকে আচ্ছন্ন করিলেন। সেই ধূলিবর্ষ দ্বারা আকীর্ণ হইয়া অমৃতরক্ষক দেবগণ মোহ প্রাপ্ত ও অন্ধপ্রয় হইলেন। গরুড় এই রূপে দেবলোক অকুল করিয়া পক্ষ ও চঞ্চু প্রহার দ্বারা দেবতাদিগের শরীর বিদীর্ণ করিলেন।
অনন্তর দেবরাজ সহস্রাক্ষ পবনকে এই আজ্ঞা দিলেন, হে মারুত? তুমি কারায় এই ধূলিবর্ম অপসারিত কর, ইহা তোমার কর্ম্ম। মহাবল পবনদেব তৎক্ষণাৎ ধূলিরাশি অপসারিত করিলে অন্ধকার নিরস্ত হইল। তখন দেবগণ গরুড়কে আক্রমণ করিলেন। দেবতারা প্রহারারম্ভ করিলে, মহাবল মহাবীর্য্য বিনতানন্দন, নভোমণ্ডলমধ্যবর্তী মহামেঘের ন্যায় সর্ব্বভূতভয়ঙ্কর ঘোতর গর্জন করিতে করিতে অন্তরীক্ষে আরোহণ করিলেন। ইন্দ্রাদি দেবগণ গরুড়কে নভস্তলস্থিত অবলোকন করিয়া পট্টিশ, পরিঘ, শূল, গদা, প্রজ্বলিত ক্ষুর ও সূর্য্যরূপী চক্র ইত্যাদি বহুবিধ অস্ত্র দ্বারা তাহাকে অচ্ছিন্ন করিলেন। প্রতাপৰা গরুড়, এই রূপে সুরগণ কর্তৃক নানা অস্ত্র দ্বারা সমস্ততঃ আহত হইয়াও, ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তিনি কোনও ক্রমেই বিচলিত হইলেন না, বরং পক্ষদ্বয় ও বক্ষঃস্থল দ্বারা - বেগণকে বিক্ষিপ্ত করিতে আরম্ভ করিলেন। দেবতারা গরুড় কর্তৃক বিক্ষিপ্ত, তাড়িত ও আহত হইয়া, শোণিত বমন করিতে করিতে ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিলেন। তন্মধ্যে, সাধ্য ও গন্ধর্বগণ পূর্ব্ব দিকে, বস্ত্র ও রুদ্রগণ দক্ষিণ দিকে, আদিত্যগণ পশ্চিম দিকে, আর অশ্বিনীকুমারেরা উত্তর দিকে, পলাইলেন।
তদনন্তর গগনচর পক্ষিরাজ মহাবীর পরাক্রান্ত অশ্বক্রন্দ, রেণুক, ক্রথন, তপন, উলুক, শ্বসন, নিমিষ, প্ররুজ, পুলিন এই নব যক্ষের সহিত সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। প্রলয়কালে রুদ্রদেব যেরূপ ভয়ানক হইয়া থাকেন, তিনিও তদ্রুপ হইয়া পক্ষ, নখ ও চঞ্চুপুটের অগ্রভাগ দ্বারা তাহাদিগকে খণ্ড খণ্ড করিলেন। মহাবল মহোৎসাহ যক্ষগণ গরুড়প্রহারে সর্বাঙ্গে বিক্ষত হইয়া রুধিরধারাবর্ষী জলধরসমুহের ন্যায় আভাসমান হইল।
পরিশেষে পগরাজ সেই সমস্ত যক্ষের প্রাণসংহার করিয়া অমৃত স্থানে উপস্থিত হইলেন, দেখিলেন, অগ্নি অমৃতের চতুর্দি বেষ্টন করিয়া আছে; ঐ অগ্নির জ্বালা অতি ভয়ানক, উহা শিখাসমূহ দ্বারা নভোমণ্ডল আচ্ছন্ন করিয়া আছে; বোধ হয়, যেন প্রচণ্ড বায়ুবেগে চালিত হইয়া সূর্য্যদেবকে দগ্ধ করিতে উদ্যত হইয়াছে। তখন অমিত্রঘাতী বেগবান্ গরুড় শতাধিক অষ্ট সহস্র মুখ ধারণ করিলেন, এবং সেই সমস্ত মুখ দ্বারা বহুসংখ্যক নদী পান করিয়া, মহাবেগে পুনরাগমন পূৰ্বক, পীত নদীজল দ্বারা ঐ জ্বলন্ত অগ্নি নির্ব্বাণ করিলেন। এই রূপে অগ্নিশান্তি করিয়া তিনি তন্মধ্যে প্রবেশ করিবার ‘নিমিত্ত অতি ক্ষুদ্র কলেবর অবলম্বন করিলেন।