মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/পঞ্চম অধ্যায়
পঞ্চম অধ্যায়—পৌলোমপর্ব্ব
শৌনক কহিলেন, হে সূতপুত্র! তোমার পিতা, মর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন সমীপে, সমস্ত পুরাণ ও আদ্যোপান্ত ভারত অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, তুমিও সেই সমস্ত অধ্যয়ন করিয়াছ, সন্দেহ নাই। পুরাণে সমুদায় অলৌকিক কথা ও সমস্ত আদিবংশের বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে; তন্মধ্যে প্রথমতঃ আমি ভূগুবংশের বৃত্তান্ত শুনিতে বাসনা করি। তুমি সেই কথা কীর্ত্তন কর, আমরা অবহিত চিত্তে শ্রবণ করিব।
এই রূপে আদিষ্ট হইয়া তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া সূতপুত্র উগ্রশ্রবাঃ নিবেদন করিলেন, বৈশম্পায়ন প্রভৃতি মহানুভাব দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ পুর্ব কালে সম্যক রূপে যাহা অধ্যয়ন ও কীর্ত্তন করিয়াছিলেন, আমার পিতা যাহা অধ্যয়ন করেন, এবং পরে আমি তাঁহার নিকট যাহা অধ্যয়ন করিয়াছি, সেই সমস্ত কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।
ভৃগুবংশ ইন্দ্রাদি সমস্ত দেবগণের ও অশেষ ঋষিকুলের পূজনীয়; পুরাণে সেই বিখ্যাত বংশের যেরূপ বর্ণনা আছে, তাহা আমি যথাৎ কীর্ত্তন করিতেছি। সর্বলোকপিতামহ ব্রহ্ম। বরুণের যজ্ঞ করিতেছিলেম; আমরা শুনিয়াছি, ভগবান্ ভৃগু সেই যজ্ঞীয় অগ্নি হইতে উৎপন্ন হন। ভৃগুর পুত্র চ্যবন, চ্যবনের পুজ পরমধাৰ্মিক প্রমতি; ঘৃতাচীর গর্ভে প্রমতির রুক নামে এক পুত্র জন্মেম। প্রমদ্বরাগর্ভে রুরুর শুনকনামা পুত্র জন্মিলেন। তিনিই তোমার স্কুলের প্রধান পুরুষ। তিনি ধার্ম্মিক, বেদপারগ, তপস্বী, যশস্বী, শাস্ত্রজ্ঞ, ব্রহ্মজ্ঞ, সত্যবাদী, ও জিতেন্দ্রিয় ছিলেন।
শৌনক কহিলেন, হে সূতপুত্র। মহাত্মা ভৃগুনন্দন চ্যবন নামে বিখ্যাত হইলেন কেন, তুমি তাহার সবিশেষ বর্ণন কর।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, ভগবান্ ভৃগুর পুলোম নামে ভুবনবিখ্যাতা প্রেয়সী ধর্মপত্নী ছিলেন। তাঁহার সহযোগে পুলোমা গর্ভবতী হইলেন। এক দিবস, পরমধাম্মিক ভৃগু স্নানার্থ নিষ্ক্রান্ত হইলে, পুলোমা নামে এক রাক্ষস তদীয় আশ্রমে উপস্থিত হইল। সে আশ্রমপ্রবেশানন্তর পরমসুন্দরী ভৃগুপত্নীকে নয়নগোচর করিয়া কামাস্টি ও বিচেতন হইল। চাকদর্শনা পুলোমা তপোবনসুলভ ফল মূলাদি দ্বারা সেই অভ্যাগত রাক্ষসের যথোচিত অতিথিসৎকার করিলেন। রাক্ষস মন্মথশর প্রহারে। নিতান্ত কাতর হইয়া, এই কামিনীকে হরণ করিব, এই নিশ্চয় করিয়া অত্যন্ত হৃষ্টচিত্ত হইল। পুলোমা অগ্রে ঐ চারুহাসিনী কন্যাকে, মমেয়ং ভার্য্যা, বলিয়া বরণ করিয়াছিল, পশ্চাৎ তাঁহার পিতা তাঁহাকে শাস্ত্রবিধানানুসারে ভৃগুকে প্রদান করেন। এই অবমাননা অনুক্ষণ তাহার হৃদয়ে জাগরূক ছিল। এক্ষণে সে অবসর পাইয়া হরণ করিবার মানস করিল।
রাক্ষস এই রূপে পুলোমাহরণে কৃতসঙ্কল্প হইয়া অগ্নিগৃহে প্রবেশ করিল, এবং প্রজ্জ্বলিত হুতাশনসন্নিধানে দণ্ডায়মান হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, হে পাবক! তুমি দেবতাদিগের মুখ, তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, যথার্থ বল, এই কামিনী কাহার ভার্য্যা? আমি এই বরবর্ণিনীকে অগ্রে পত্নীত্বে বরণ করিয়াছিলাম, পরে ইহার পিতা অধর্ম্মকারী ভৃগুকে দান করেন। অতএব এই নির্জনবাসিনী নিতস্বিনী যদি ভৃগুর ভার্য্যা হয় বল, ইহাকে আমি আশ্রম হইতে হরণ করিবার মানস করিয়াছি। ভৃগু যে, আমার পূর্ধবৃত। রূপবতী ভার্য্যাকে গ্রহণ করিয়াছে, সেই ক্রোধানল অদ্যপি আমার হৃদয় দাহ করিতেছে।
দুরাত্মা রাক্ষস জলিত অগ্নিকে এইরূপ আমন্ত্রণ করিয়া, ভৃগুভার্যা বিষয়ে সন্দিহান হইয়া, বারংবার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, হৈ হুতাশন! তুমি সর্ব কাল সর্ব ভূতের অন্তরে পুণ্যপাপের সাক্ষিস্বরূপ অবস্থিত আছ; অতএব জিজ্ঞাসা করিতেছি, যথার্থ বল, পাপকারী ভৃগু আমার যে পূর্ববৃতা কন্যাকে অপহরণ করিয়াছিল, এই সেই কামিনী তামার ভার্য্যা কি না? তোমার নিকট ইহার তত্ত্বার্থ শ্রবণ করিয়া তোমার সমক্ষেই ভূগুভার্য্যাকে অশ্রম হইতে হরণ করিব।
রাক্ষসের এইরূপ জিজ্ঞাসা শুনিয়া, অগ্নি তাতান্ত দুঃখিত হইলেন, এবং এক পক্ষে মিথ্য! কখন, পক্ষান্তরে ভৃগুশাপ, উভয় ভয়ে ভীত হইয়া অনুদ্ধত স্বরে কহিলেন, হে দানরনন্দন! তুমি পূর্বে ইহাকে বরণ করিয়াছিলে, যথার্থ বটে, কিন্তু তৎকালে তোমার মন্ত্র প্রয়োগ ও বিধি পূর্বক বরণ করা হয় নাই। ইহার পিতা সৎপাত্র লোভক্রান্ত হইয়া ভৃগুকে দান করিয়াছেন, তোমাকে দেন নাই। মহর্ষি ভৃগুও বেদদৃষ্ট বিধি ও পরম্পরাগত প্রণালী: অনুসারে আমাকে সাক্ষী করিয়া ইহার পাণিগ্রহণ করিয়াছেন। তথাপি তুমি পূর্বে বরণ করিয়াছিলে, এই নিমিত্ত ইনি তোমারই ভার্য্যা। আমি মিথ্যা কহিতে পারি না, লোকে কোন কালে মিথ্যার আদর নাই।