মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/জতুগৃহপর্বাধ্যায়
॥জতুগৃহপর্বাধ্যায়॥
২৬। বারণাবত—জতুগৃহদাহ
পাণ্ডবদের বিনাশের জন্য দুর্যোধন তাঁর মাতুল সুবলপত্র শকুনি ও কর্ণের সঙ্গে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, পিতা, পুরবাসিগণ আপনাকে আর ভীষ্মকে অনাদর ক’রে যুধিষ্ঠিরকেই রাজা করতে চায়। আপনি অন্ধ ব’লে রাজ্য পান নি, পাণ্ডু পেয়েছিলেন। কিন্তু পাণ্ডুব পুত্ররাই যদি বংশানুক্রমে রাজ্য পায় তবে আমাদের বংশ অবজ্ঞাত হয়ে থাকবে। আপনি কৌশল ক’রে পাণ্ডবদের বারণাবতে নির্বাসিত করুন, তা হ’লে আমাদের আর ভয় থাকবে না।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পাণ্ডু যেমন প্রজাদের প্রিয় ছিলেন যুধিষ্ঠিরও সেইরূপ হয়েছেন, তাঁর সহায়ও আছে, তাঁকে আমরা কি করে নির্বাসিত করতে পারি? ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর কৃপ তা সমর্থন করবেন না। দুর্যোধন বললেন, আমি অর্থ আর সম্মান দিয়ে প্রজাদের বশ করেছি, অমাত্যগণ এবং ধনাগারও আমাদের হাতে। ভীষ্মের কোনও পক্ষপাত নেই, অশ্বত্থামা আমাদের পক্ষে আছেন, দ্রোণও পুত্রের অনুসরণ করবেন, কৃপও তাঁর ভাগিনেয়কে ত্যাগ করবেন না। বিদুর আমাদের অর্থে পুষ্ট হয়েও গোপনে পাণ্ডবদের পক্ষপাতী, কিন্তু তিনি একলা আমাদের বাধা দিতে পারবেন না। আপনি আজই পঞ্চপাণ্ডব আর কুন্তীকে বারণাবতে পাঠান।
ধৃতরাষ্ট্রের উপদেশ অনুসারে কয়েকজন মন্ত্রী পাণ্ডবদের কাছে গিয়ে বললেন, বারণাবত অতি মনোরম নগর, সেখানে পশুপতির উৎসব উপলক্ষ্যে এখন বহু লোকের সমাগম হয়েছে। এইপ্রকার বর্ণনা শুনে পাণ্ডবদের সেখানে যাবার ইচ্ছা হল। ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের বললেন, বৎসগণ, আমি শুনেছি যে বারণাবত অতি রমণীয় নগর, তোমরা সেখানে উৎসব দেখে এবং ব্রাহ্মণ ও গায়কদের ধনদান ক’রে কিছুকাল আনন্দে কাটিয়ে এস। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের অভিপ্রায় এবং নিজের অসহায় অবস্থা বুঝে সম্মত হলেন এবং ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতির আশীর্বাদ নিয়ে মাতা ও ভ্রাতাদের সঙ্গে যাত্রা করলেন।
দুর্যোধন অতিশয় হৃষ্ট হলেন এবং পুরোচন নামক এক মন্ত্রীর হাত ধ’রে তাঁকে গোপনে বললেন, তুমি ভিন্ন আমার বিশ্বাসী সহায় কেউ নেই, তুমি দ্রুতগামী রথে আজই বারণাবতে যাও এবং শণ, সর্জরস (ধুনা) প্রভৃতি দিয়ে একটি চতুঃশাল (চকমিলান) সুসজ্জিত গৃহ নির্মাণ করাও। মৃত্তিকার সঙ্গে প্রচুর ঘৃত তৈল বসা জতু (গালা) মিশিয়ে তার দেওয়ালে লেপ দেবে এবং চতুর্দিকে কাষ্ঠ তৈল প্রভৃতি দাহ্য পদার্থ এমন ক’রে রাখবে যাতে পাণ্ডবরা বুঝতে না পারে। তুমি সমাদর ক’রে পাণ্ডবদের সেখানে বাসের জন্য নিয়ে যাবে এবং উত্তম আসন শয্যা যান প্রভৃতি দেবে। কিছুকাল পরে যখন তারা নিশ্চিতমনে নিদ্রামগ্ন থাকবে তখন দ্বারদেশে অগ্নিদান করবে। পুরোচন তখনই দুর্যোধনের আদেশ পালন করতে বারণাবতে গেলেন।
বুদ্ধিমান বিদুর দুর্যোধনের ভাবভঙ্গী দেখে তাঁর দুষ্ট অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছিলেন। বিদুর ও যুধিষ্ঠির দুজনেই ম্লেচ্ছভাষা জানতেন। যুধিষ্ঠিরের যাত্রাকালে বিদুর অন্যের অবোধ্য ম্লেচ্ছভাষায় তাঁকে বললেন, শত্রুর অভিসন্ধি যে জানে সে যেন বিপদ থেকে নিস্তারের উপায় করে। লৌহ ভিন্ন অন্য অস্ত্রেও প্রাণনাশ হয়। অগ্নিতে শুষ্ক বন দগ্ধ হয় কিন্তু গর্তবাসীর হানি হয় না। মানুষ শজারুর ন্যায় গর্তপথে পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। যে লোক নক্ষত্র দ্বারা দিঙ্নির্ণয় করতে পারে এবং পথ চিনে রাখে সে নিজেকে এবং আরও পাঁচজনকে বাঁচাতে পারে। যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, বুঝেছি।
পথে যেতে যেতে কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন, বিদুর তোমাকে অবোধ্য ভাষায় কি বললেন আর তুমিও বুঝেছি বললে, এর অর্থ কি? যুধিষ্ঠির বললেন, বিদুরের কথার অর্থ—আমাদের ঘরে আগুন লাগবে, পালাবার জন্য সকল পথই যেন আমরা চিনে রাখি।
পাণ্ডবগণ বারণাবতে এলে সেখানকার প্রজারা জয়ধ্বনি ক’রে সংবর্ধনা করলে, তাঁরাও ব্রাহ্মণাদি চতুবর্ণের অধিবাসীর গৃহে গিয়ে দেখা করলেন। পুরোচন মহাসমাদরে তাঁদের এক বাসভবনে নিয়ে গেলেন এবং আহার শয্যা প্রভৃতির ব্যবস্থা করলেন। সেখানে দশ রাত্রি বাসের পর তিনি পাণ্ডবদের অন্য এক ভবনে নিয়ে গেলেন, তার নাম ‘শিব’, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা অশিব। যুধিষ্ঠির সেখানে গিয়ে ঘৃত বসা ও লাক্ষার গন্ধ পেয়ে ভীমকে বললেন, নিপুণ শিল্পীরা এই গৃহ আগ্নেয় পদার্থ দিয়ে প্রস্তুত করেছে, পাপী পুরোচন আমাদের দগ্ধ করতে চায়। ভীম বললেন, যদি মনে করেন এখানে অগ্নিভয় আছে তবে পূর্বের বাসস্থানেই চলুন। যুধিষ্ঠিব তাতে সম্মত হলেন না, বললেন, আমরা সন্দেহ করছি জানলে পুরোচন বলপ্রয়োগ ক’রে আমাদের দগ্ধ করবে। যদি পালিয়ে যাই তবে দুর্যোধনের চরেরা আমাদের হত্যা করবে। আমরা মৃগয়ার ছলে এই দেশের সর্বত্র বিচরণ করে পথ জেনে রাখব এবং এই জতুগৃহের ভূমিতে গর্ত ক’রে তার ভিতরে বাস করব, আমাদের নিঃশ্বাসের শব্দও কেউ শুনতে পাবে না।
সেই সময়ে একটি লোক এসে নির্জনে পাণ্ডবদের বললে, আমি খনন কার্যে নিপুণ, বিদুর আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনাদের যাত্রার পূর্বে তিনি ম্লেচ্ছভাষায় যুধিষ্ঠিরকে সতর্ক করেছিলেন তা আমি জানি, এই আমার বিশ্বস্ততার প্রমাণ। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর রাত্রিতে পুরোচন এই গৃহের দ্বারে আগুন দেবে। এখন আমাকে কি করতে হবে বলুন। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি বিদুরের তুল্যই আমার হিতার্থী, অগ্নিদাহ থেকে আমাদের রক্ষা কর। দুর্যোধনের আদেশে পুরোচন এই ভবনে অনেক অস্ত্র এনে রেখেছে, এখান থেকে পলায়ন করা দুঃসাধ্য। তুমি গোপনে আমাদের রক্ষার উপায় কর। খনক পরিখায় ও গৃহমধ্যে গর্ত ক’রে এক বৃহৎ সুরঙ্গ প্রস্তুত করলে এবং তার প্রবেশের পথে কপাট লাগিয়ে ভূমির সমান করে দিলে, যাতে কেউ বুঝতে না পারে। পুরোচন গৃহের দ্বারদেশেই বাস করতেন সেজন্য সুরঙ্গের মুখ আবৃত করা হ’ল। পাণ্ডবরা দিবসে এক বন থেকে অন্য বনে মৃগয়া করতেন এবং রাত্রিকালে সশস্ত্র ও সতর্ক হয়ে সুরঙ্গের মধ্যে বাস করতেন।
এইরূপে এক বৎসর অতীত হ’লে পুরোচন স্থির করলেন যে পাণ্ডবদের মনে কোনও সন্দেহ নেই। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের বললেন, এখন আমাদের পলায়নের সময় এসেছে, আমরা অন্ধকারে আগুন দিয়ে পুরোচনকে দগ্ধ করব এবং অন্য ছ জনকে এখানে রেখে চ’লে যাব। একদিন কুন্তী ব্রাহ্মণভোজন করালেন, অনেক স্ত্রীলোকও এল, তারা যথেচ্ছ পানভোজন করে রাত্রিতে চ’লে গেল। এক নিষাদ-স্ত্রী তার পাঁচ পুত্রকে নিয়ে খেতে এসেছিল, সে পুত্রদের সঙ্গে প্রচুর মদ্যপান ক’রে মৃতপ্রায় হয়ে গৃহমধ্যেই নিদ্রামগ্ন হ’ল। সকলে সুষুপ্ত হ’লে ভীম পুরোচনের শয়নগৃহে, জতুগৃহের দ্বারে এবং চতুর্দিকে আগুন লাগিয়ে দিলেন। পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী সুরঙ্গে প্রবেশ করলেন। প্রবল বায়ুতে জতুগৃহের সর্বদিক জ্বলে উঠল, অগ্নির উত্তাপে ও শব্দে নগরবাসীরা জেগে উঠে বলতে লাগল পাপিষ্ঠ পুরোচন দুর্যোধনের আদেশে এই গৃহদাহ ক’রে পাণ্ডবদের বধ করেছে। দুর্বদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক, যিনি নির্দোষ পাণ্ডবগণকে শত্রুর ন্যায় হত্যা করিয়েছেন। ভাগ্যক্রমে পাপাত্মা পুরোচনও পুড়ে মরেছে। বারণাবতবাসীরা জ্বলন্ত জতুগৃহের চতুর্দিকে থেকে এইরূপে বিলাপ করে রাত্রিযাপন করলে।
পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী অলক্ষিত হয়ে সুরঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এলেন। নিদ্রার ব্যাঘাতে এবং ভয়ে তাঁরা চলতে পারলেন না। মহাবল ভীমসেন কুন্তীকে কাঁধে এবং নকুল-সহদেবকে কোলে নিয়ে যুধিষ্ঠির অর্জুনের হাত ধ’রে বেগে চললেন। বিদুরের একজন বিশ্বস্ত অনুচর গঙ্গার তীরে একটি বায়ুবেগসহ যন্ত্রযুক্ত পতাকাশোভিত নৌকা[১] রেখেছিল। পাণ্ডবগণকে গঙ্গার অপর পারে এনে বিদুরের অনুচর জয়োচ্চারণ করে চ’লে গেল।
নৌকা থেকে নেমে পাণ্ডবরা নক্ষত্র দেখে পথনির্ণয় করে দক্ষিণ দিকে যেতে লাগলেন। দুর্গম দীর্ঘ পথ অতিক্রম ক’রে পরদিন সন্ধ্যাকালে তাঁরা হিংস্রপ্রাণিসমাকুল ঘোর অরণ্যে উপস্থিত হলেন। কুন্তী প্রভৃতি সকলে তৃষ্ণায় কাতর হওয়ায় ভীম পদ্মপুটে এবং উত্তরীয় ভিজিয়ে জল নিয়ে এলেন। সকলে ক্লান্ত হয়ে ভূমিতে নিদ্রামগ্ন হলেন, কেবল ভীম জেগে থেকে নানাপ্রকার চিন্তা করতে লাগলেন।
রাত্রি প্রভাত হ’লে বারণাবতবাসীরা আগুন নিবিয়ে দেখলে পুরোচন পড়ে মরেছেন। পাণ্ডবদের খুঁজতে খুঁজতে তারা নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রের দগ্ধ দেহ পেয়ে স্থির করলে যে কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডব নিহত হয়েছেন। তারা সুরঙ্গ দেখতে পেলে না, কারণ খনক তা মাটি দিয়ে ভরিয়েছিল। হস্তিনাপুরে সংবাদ গেলে ধৃতরাষ্ট্র বহু বিলাপ করলেন এবং কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরাদির অন্ত্যেষ্টির জন্য বারণাবতে লোক পাঠালেন। তার পর জ্ঞাতিগণের সঙ্গে ভীষ্ম ও সপুত্র ধৃতরাষ্ট নিরাভরণ হয়ে একবস্ত্রে গঙ্গায় গিয়ে তর্পণ করলেন। সকলে রোদন করতে লাগলেন, কেবল বিদুর অধিক শোক প্রকাশ করলেন না।
- ↑ ‘সর্ববাতসহাং নাবং যন্ত্রযুক্তাং পতাকিনীম্’।