মহাভারত (রাজশেখর বসু)/উদ্‌যোগপর্ব/সঞ্জয়যানপর্যাধ্যায়

॥ সঞ্জয়যানপর্বাধ্যায়॥

৬। দ্রুপদ-পুরোহিতের দৌত্য

 দ্রুপদের পুরোহিত হস্তিনাপরে এলে ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও বিদুর তাঁর সংবর্ধনা করলেন। কুশলজিজ্ঞাসার পর পুরোহিত বললেন, আপনারা সকলেই সনাতন রাজধর্ম জানেন, তথাপি আমার বক্তব্যের অঙ্গরূপে কিছু বলব। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু একজনেরই পুত্র, পৈতৃক ধনে তাঁদের সমান অধিকার। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ তাঁদের পৈতৃক ধন পেলেন, কিন্তু পাণ্ডুপুত্রগণ পেলেন না কেন? আপনারা জানেন, দুর্যোধন তা অধিকার ক’রে রেখেছেন। তিনি পাণ্ডবগণকে যমালয়ে পাঠাবার অনেক চেষ্টা করেছেন এবং শকুনির সাহায্যে তাঁদের রাজ্য হরণ করেছেন। এই ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের কর্ম অনুমোদন ক’রে পাণ্ডবগণকে তের বৎসর নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। দ্যূতসভায় বনবাসে এবং বিরাটনগরে পাণ্ডবগণ ভার্যা সহ বহু ক্লেশ পেয়েছেন। এইসকল নির্যাতন ভুলে গিয়ে তাঁরা কৌরবগণের সঙ্গে সন্ধি করতে ইচ্ছা করেন। এখানে যে সুহৃদ্‌বর্গ রয়েছেন তাঁরা পাণ্ডবদের ও দুর্যোধনের আচরণ বিচার ক’রে ধৃতরাষ্ট্রকে অনুরোধ করুন। পাণ্ডবরা বিবাদ করতে চান না, লোকক্ষয় না ক’রেই নিজেদের প্রাপ্য চান। দুর্যোধন যে ভরসায় যুদ্ধ করতে চান তা মিথ্যা, কারণ পাণ্ডবরাই অধিকতর বলশালী। তাঁদের সাত অক্ষৌহিণী সেনা প্রস্তুত আছে, তার উপর সাত্যকি, ভীমসেন আর নকুল-সহদেব সহস্র অক্ষৌহিণীর সমান। আপনাদের পক্ষে যেমন এগার অক্ষৌহিণী আছে অপর পক্ষে তেমন অর্জুন আছেন। অর্জুন ও বাসুদেব সমস্ত সেনারই অধিক। সেনার বহুলতা, অর্জুনের বিক্রম এবং কৃষ্ণের বুদ্ধিমত্তা জেনে কোন লোক পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে? অতএব আপনারা কালক্ষেপ করবেন না, ধর্ম ও নিয়ম অনুসারে যা পাণ্ডবগণের প্রাপ্য তা দিন।

 পুরোহিতের কথা শুনে ভীষ্ম বললেন, ভাগ্যক্রমে পাণ্ডবগণ ও কৃষ্ণ কুশলে আছেন এবং ধর্মপথে থেকে সন্ধিকামনা করছেন। আপনি যা বলেছেন সবই সত্য, তবে আপনি ব্রাহ্মণ সেজন্য আপনার বাক্য অতিরিক্ত তীক্ষ্ণ। পাণ্ডবদের বহু কষ্ট দেওয়া হয়েছে এবং ধর্মানুসারে তাঁরা পিতৃধনের অধিকারী এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। অজুর্ন অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত মহারথ, স্বয়ং ইন্দ্রও যুদ্ধে তাঁর সমকক্ষ নন।

 কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বাধা দিয়ে দ্রুপদের পুরোহিতকে বললেন, ব্রাহ্মণ, যা হয়ে গেছে তা সকলেই জানে, বার বার সে কথা বলে লাভ কি? দুর্যোধনের জন্যই শকুনি দ্যূতক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরকে জয় করেছিলেন এবং যুধিষ্ঠির পণরক্ষার জন্য বনে গিয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞানুযায়ী সময়ের মধ্যে[] তিনি মূর্খের ন্যায় রাজ্য চাইতে পারেন না। দুর্যোধন ধর্মানুসারে শত্রুকে সমস্ত পৃথিবী দান করতে পারেন, কিন্তু ভয় পেয়ে পাদপরিমিত ভূমিও দেবেন না। পাণ্ডবরা যদি পৈতৃক রাজ্য চান তবে অবশিষ্ট কাল বনবাসে কাটিয়ে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন, তার পর নির্ভয়ে দুর্যোধনের ক্রোড়ে আশ্রয় নিন।

 ভীষ্ম বললেন, রাধেয়, অহংকার ক’রে লাভ কি, অর্জুন একাকী ছ জন রথীকে জয়[] করেছিলেন তা স্মরণ কর। এই ব্রাহ্মণ যা বললেন তা যদি আমরা না করি তবে অর্জুন কর্তৃক নিহত হয়ে আমরা রণভূমিতে ধূলিভক্ষণ করব।

 কর্ণকে ভৎসনা ক’রে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, শান্তনুপুত্র ভীষ্ম যা বলেছেন তা সকলের পক্ষে হিতকর। ব্রাহ্মণ, আমি চিন্তা ক’রে পাণ্ডবগণের নিকট সঞ্জয়কে পাঠাব, আপনি আজই অবিলম্বে ফিরে যান। তার পর ধৃতরাষ্ট্র দ্রুপদপুরোহিতকে সসম্মানে বিদায় দিলেন।

৭। সঞ্জয়ের দৌত্য

 ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন, তুমি উপপ্লব্য নগরে গিয়ে পাণ্ডবগণের সংবাদ নেবে এবং অজাতশত্রু যুধিষ্ঠিরকে অভিনন্দন ক’রে বলবে, ভাগ্যক্রমে তুমি বনবাস থেকে জনপদে ফিরে এসেছ। সঞ্জয়, আমি পাণ্ডবদের সূক্ষ্ম দোষও দেখতে পাই না, ক্রূরস্বভাব মন্দবুদ্ধি দুর্যোধন এবং ততোধিক ক্ষুদ্রমতি কর্ণ ভিন্ন এখানে এমন কেউ নেই যে পাণ্ডবদের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত। ভীম অর্জুন নকুল সহদেব এবং কৃষ্ণ ও সাত্যকি যাঁর অনুগত সেই যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধের পূর্বেই তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া ভাল। গুপ্তচরদের কাছে কৃষ্ণের যে পরাক্রমের কথা শুনেছি তা মনে করে আমি শান্তি পাচ্ছি না, অর্জুন ও কৃষ্ণ মিলিত হয়ে এক রথে আসবেন শুনে আমার হৃদয় কম্পিত হচ্ছে। যুধিষ্ঠির মহাতপা ও ব্রহ্মচর্যশালী, তাঁর ক্রোধকে আমি যত ভয় করি অর্জুন কৃষ্ণ প্রভৃতিকেও তত করি না। সঞ্জয়, তুমি রথারোহণে পাঞ্চালরাজের সেনানিবেশে যাও এবং যুধিষ্ঠির যাতে প্রীত হন এমন কথা ব’লো। সকলের মঙ্গল জিজ্ঞাসা ক’রে তাঁকে জানিও যে আমি শান্তিই চাই। বিপক্ষকে যা বলা উচিত, যা ভরতবংশের হিতকর, এবং যাতে যুদ্ধের প্ররোচনা না হয় এমন কথাই তুমি বলবে।

 সূতবংশীয় গবল্‌গনপুত্র সঞ্জয় উপপ্লব্য নগরে এসে যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করলেন। উভয়পক্ষের কুশল জিজ্ঞাসার পর যুধিষ্ঠির বললেন, সঞ্জয়, দীর্ঘকাল পরে কুরুবৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কুশল শুনে এবং তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ ধৃতরাষ্ট্রকেই দেখছি। তার পর যুধিষ্ঠির সকলেরই সংবাদ নিলেন, যথা—ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা কর্ণ, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, রাজপুরস্থ জননীগণ, পুত্র ও পুত্রবধূগণ, ভগিনী ভাগিনেয় ও দৌহিত্রগণ, দাসীগণ প্রভৃতি।

 সকলের কুশলসংবাদ দিয়ে সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, দুর্যোধনের কাছে সাধুপ্রকৃতি বৃদ্ধগণ আছেন, আবার পাপাত্মারাও আছে। আপনারা দুর্যোধনের কোনও অপকার করেন নি তথাপি তিনি আপনাদের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত হয়েছেন। স্থবির ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের অনুমোদন করেন না, তিনি মনস্তাপ ভোগ করছেন, সকল পাতক অপেক্ষা মিত্রদ্রোহ গুরুতর— এ কথাও ব্রাহ্মণদের কাছে শুনেছেন। অজাতশত্রু, আপনি নিজের বুদ্ধিবলে শান্তির উপায় স্থির করুন। আপনারা সকলেই ইন্দ্রতুল্য, কষ্টে পড়লেও আপনারা ভোগের জন্য ধর্ম ত্যাগ করবেন না।

 যুধিষ্ঠির বললেন, এখানে সকলেই উপস্থিত আছেন, ধৃতরাষ্ট্র যা বলেছেন তাই বল। সঞ্জয় বললেন, পঞ্চপাণ্ডব বাসুদেব সাত্যকি চেকিতান[] বিরাট পাঞ্চালরাজ ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে সম্বোধন ক’রে আমি বলছি। রাজা ধৃতরাষ্ট্র শান্তির প্রশংসা ক’রে আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন, তাঁর বাক্য আপনাদের রুচিকর হ’ক, শান্তি স্থাপিত হ’ক। মহাবলশালী পাণ্ডবগণ, হীন কর্ম করা আপনাদের উচিত নয়, শুক্ল বস্ত্রে অঞ্জনবিন্দুর ন্যায় সেই পাপ যেন আপনাদের স্পর্শ না করে। কৌরবগণকে যদি যুদ্ধে বিনষ্ট করেন তবে জ্ঞাতিবধের ফলে আপনাদের জীবন মৃত্যুর তুল্য হবে। কৃষ্ণ সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন ও চেকিতান যাঁদের সহায়, কে তাঁদের জয় করতে পারে? আবার দ্রোণ ভীষ্ম অশ্বত্থামা কৃপ কর্ণ শল্য প্রভৃতি যাঁদের পক্ষে আছেন সেই কৌরবগণকেই বা কে জয় করতে পারে? জয়ে বা পরাজয়ে আমি কোনও মঙ্গলই দেখছি না। আমি বিনীত হয়ে কৃষ্ণ ও বৃদ্ধ পাঞ্চালরাজের নিকট প্রণত হচ্ছি, সকলের মঙ্গলের জন্য আমি সন্ধির প্রার্থনা করছি। ভীষ্ম ও ধতরাষ্ট্র এই চান যে, আপনারা শান্তি স্থাপন করুন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, সঞ্জয়, আমি যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক এমন কথা তোমাকে বলি নি, তবে ভীত হচ্ছ কেন? যুদ্ধ অপেক্ষা অযুদ্ধ ভাল, যদি দারুণ কর্ম না ক’রেও অভীষ্ট বিষয় পাওয়া যায় তবে কোন মূর্খ যুদ্ধ করতে চায়? বিনা যুদ্ধে অল্প পেলেও লোকে যথেষ্ট মনে করে। প্রদীপ্ত অগ্নি যেমন ঘৃত পেয়ে তৃপ্ত হয় না, মানুষও সেইরূপে কাম্য বস্তু পেয়ে তৃপ্ত হয় না। দেখ, ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্রগণ বিপুল ভোগ্য বিষয় পেয়েও তৃপ্ত হন নি। ধৃতরাষ্ট্র সংকটে প’ড়ে পরের উপর নির্ভর করছেন, এতে তাঁর মঙ্গল হবে না। তিনি বহু ঐশ্বর্যের অধিপতি, এখন দুর্বুদ্ধি ক্রূরস্বভাব কুমন্ত্রিবেষ্টিত পুত্রের জন্য বিলাপ করছেন কেন? দুর্যোধনের স্বভাব জেনেও তিনি বিশ্বস্ত বিদুরের উপদেশ অগ্রাহ্য ক’রে অধর্মের পথে চলছেন। দুঃশাসন শকুনি আর কর্ণ—এরাই এখন লোভী দুর্যোধনের মন্ত্রী। আমরা বনবাসে গেলে ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্ররা মনে করলেন সমগ্র রাজ্যই তাঁদের হস্তগত হয়েছে। এখনও তাঁরা নিষ্কণ্টক হয়ে তা ভোগ করতে চান, এমন অবস্থায় শান্তি অসম্ভব। ভীম অর্জুন নকুল ও সহদেব জীবিত থাকতে ইন্দ্রও আমাদের ঐশ্বর্য হরণ করতে পারেন না। আমরা কত কষ্ট পেয়েছি তা তুমি জান; তোমার অনুরোধে সমস্তই ক্ষমা করতে প্রস্তুত আছি; কৌরবদের সঙ্গে পূর্বে আমাদের যে সম্বন্ধ ছিল তাও অব্যাহত থাকবে, তোমার কথা অনুসারে শান্তিও স্থাপিত হবে; কিন্তু দুর্যোধন আমাদের রাজ্য ফিরিয়ে দিন, ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্য আবার আমার হ’ক।

 সঞ্জয় বললেন, অজাতশত্রু, কৌরবগণ যদি আপনাকে রাজ্যের ভাগ না দেন তবে অন্ধক ও বৃষ্ণিদের রাজ্যে[] আপনাদের ভিক্ষা করাও শ্রেয়, কিন্তু যুদ্ধ ক’রে রাজ্যলাভ উচিত হবে না। মানুষের জীবন অল্পকালস্থায়ী দুঃখময় ও অস্থির; যুদ্ধ করা আপনার যশের অনুরূপ নয়, অতএব আপনি পাপজনক যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হ’ন। জনার্দন সাত্যকি ও দ্রুপদ প্রভৃতি রাজারা চিরকালই আপনার অনুগত, এঁদের সাহায্যে পূর্বেই আপনি যুদ্ধ করে দুর্যোধনের দর্প চূর্ণ করতে পারতেন। কিন্তু বহু বৎসর বনে বাস করে বিপক্ষের শক্তি বাড়িয়ে এবং স্বপক্ষের শক্তি ক্ষয় ক’রে এখন যুদ্ধ করতে চাচ্ছেন কেন? আপনার পক্ষে ক্ষমাই ভাল, ভোগের ইচ্ছা ভাল নয়, ভীষ্ম দ্রোণ দুর্যোধন প্রভৃতিকে বধ ক’রে রাজ্য পেয়ে আপনার কি সুখ হবে? যদি আপনার অমাত্যবর্গই আপনাকে যুদ্ধে উৎসাহিত করেন, তবে তাঁদের হাতে সর্বস্ব দিয়ে আপনি সরে যান, স্বর্গের পথ থেকে ভ্রষ্ট হবেন না।

 যুধিষ্ঠির বললেন, সঞ্জয়, আমি ধর্ম করছি কি অধর্ম করছি তা জেনে আমার নিন্দা ক’রো। আপৎকালে ধর্মের পরিবর্তন হয়, বিদ্বান লোকে বুদ্ধিবলে কর্তব্য নির্ণয় করেন। কিন্তু বিপন্ন না হলে পরধর্ম আশ্রয় করা নিন্দনীয়, যদি আমরা তা ক’রে থাকি তবে আমাদের দোষ দিও। আমি পিতৃপিতামহের পথেই চলি। যদি সাম নীতি বর্জন করি (সন্ধিতে অসম্মত হই) তবে আমি নিন্দনীয় হব; যুদ্ধের উদ্‌যোগ ক’রে যদি ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম পালন না করি (যুদ্ধে বিরত হই) তা হ’লেও আমার দোষ হবে! মহাযশা বাসুদেব উভয়পক্ষের শুভার্থী, ইনিই বলুন আমাদের কর্তব্য কি।

 কৃষ্ণ বললেন, আমি দুই পক্ষেরই হিতাকাঙ্ক্ষী এবং শান্তি ভিন্ন আর কিছুর উপদেশ দিতে চাই না। যুধিষ্ঠির তাঁর শান্তিপ্রিয়তা দেখিয়েছেন, কিন্তু ধতরাষ্ট্র আর তাঁর পুত্ররা লোভী, অতএব কলহের বৃদ্ধি হবেই। যুধিষ্ঠির ক্ষত্রধর্ম অনুসারে নিজের রাজ্য উদ্ধারের জন্য উৎসাহী হয়েছেন, এতে তাঁর ধর্মলোপ হবে কেন? পাণ্ডবরা যদি এমন কোনও উপায় জানতেন যাতে কৌরবদের বধ না ক’রে রাজ্যলাভ করা যায় তবে এঁরা ভীমসেনকে দমন ক’রেও সেই উপায় অবলম্বন করতেন। পৈতৃক ক্ষত্রধর্ম অনুসারে যুদ্ধ করতে গিয়ে যদি ভাগ্যদোষে এঁদের মৃত্যু হয় তাও প্রশংসনীয় হবে। সঞ্জয়, তুমিই বল, ক্ষত্রিয় রাজাদের পক্ষে যুদ্ধ করা ধর্মসম্মত কিনা। দস্যুবধ করলে পুণ্য হয়, অধর্মজ্ঞ কৌরবগণ দস্যুবৃত্তিই অবলম্বন করেছেন। লোকদৃষ্টির অগোচরে বা প্রকাশ্যভাবে সবলে যে পরের ধন হরণ করে সে চোর। দুর্যোধনের সঙ্গে চোরের কি পার্থক্য আছে? পাণ্ডবগণের প্রিয়া ভার্যা দ্রৌপদীকে যখন দ্যূতসভায় আনা হয়েছিল তখন ভীষ্মাদি কিছুই বলেন নি, ধৃতরাষ্ট্রও বারণ করেন নি। দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীকে শ্বশুরদের সমক্ষে টেনে নিয়ে এল তখন বিদুর ভিন্ন কেউ তাঁর রক্ষক ছিলেন না, সমবেত রাজারা কোনও প্রতিবাদ করতে পারলেন না। সঞ্জয়, দ্যূতসভায় যা ঘটেছিল তা ভুলে গিয়ে তুমি এখন পাণ্ডবদের উপদেশ দিচ্ছ! পাণ্ডবদের অনিষ্ট না ক’রে যদি আমি শান্তি স্থাপন করতে পারি তবে আমার পক্ষে তা পুণ্যকর্ম হবে। আমি নীতিশাস্ত্র অনুসারে ধর্ম সম্মত অহিংস উপদেশ দেব, কিন্তু কৌরবগণ কি তা বিবেচনা করবেন? তাঁরা কি আমার সম্মান রক্ষা করবেন? পাণ্ডবগণ শান্তিকামী, যুদ্ধ করতেও সমর্থ, এই বুঝে তুমি ধৃতরাষ্ট্রকে আমাদের মত যথাযথ জানিও।

 সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, আমাকে এখন গমনের অনুমতি দিন। আমি আবেগবশে কিছু অন্যায় বলি নি তো? জনাদন, ভীমার্জন, নকুল-সহদেব, সাত্যকি, চৌকতান, সকলকেই অভিবাদন করে আমি বিদায় চাচ্ছি। আপনারা সুখে থাকুন, আমাকে প্রসন্ননয়নে দেখুন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, সঞ্জয়, তুমি প্রিয়ভাষী বিশ্বস্ত দূত, কটুবাক্যেও ক্রুদ্ধ হও না, কৌরব পাণ্ডব উভয়পক্ষই তোমাকে মধ্যস্থ মনে করেন, পূর্বে তুমি ধনঞ্জয়ের অভিন্নহৃদয় সখা ছিলে। তুমি এখন যেতে পার। হস্তিনাপুরের বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতগণকে, দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে, এবং বৃদ্ধ অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে আমার অভিবাদন জানিও। গন্ধর্বতুল্য প্রিয়দর্শন অস্ত্রবিশারদ অশ্বত্থামা, মূর্খ শঠ দুর্যোধন, তার তুল্যই মূর্খ দুষ্টস্বভাব দুঃশাসন, যুদ্ধবিমুখ ধার্মিক বৈশ্যাপত্র যুযুৎসু, মহাধনুর্ধর ভূরিশ্রবা ও শল্য, অদ্বিতীয় অক্ষপটু মিথ্যাবুদ্ধি গান্ধাররাজ শকুনি, যিনি পাণ্ডবদের জয় করতে চান এবং দুর্যোধনাদিকে মুগ্ধ করে রেখেছেন সেই কর্ণ, অগাধবুদ্ধি দীর্ঘদর্শী বিদুর যিনি আমাদের পিতামাতার তুল্য মাননীয় শুভার্থী ও উপদেষ্টা; এবং যাঁরা বৃদ্ধা, রাজভার্যা বা আমাদের পুত্রবধূ স্থানীয়া, তাঁদের সকলকে কুশলজিজ্ঞাসা ক’রো। তুমি অন্তঃপুরে গিয়ে কল্যাণীয়া কুমারীগণকে আলিঙ্গন ক’রে জানিও যে আমি আশীর্বাদ করছি তারা অনুকূল পতি লাভ করুক। বেশ্যা দাসদাসী খঞ্জ ও কুব্‌জদের, এবং অন্ধ ও বধির শিল্পীদের অনাময় জিজ্ঞাসা ক’রো। যে সকল ব্রাহ্মণ আমার নিকট বৃত্তি পেতেন তাঁদের জন্য দুর্যোধনকে ব’লো। ভীষ্মের চরণে আমার প্রণাম জানিয়ে ব’লো, পিতামহ, যাতে আপনার সকল পৌত্র প্রীতিযুক্ত হয়ে জীবিত থাকে সেই চেষ্টা করুন। দুর্যোধনকে ব’লো, নরশ্রেষ্ঠ, পরদ্রব্যে লোভ ক’রো না, আমরা শান্তিই চাই, তুমি রাজ্যের একটি প্রদেশ আমাদের দাও। অথবা আমাদের পাঁচ ভ্রাতাকে পাঁচটি গ্রাম দাও—কুশস্থল বৃকস্থল মাকন্দী বারণাবত এবং আর একটি, তা হ’লেই বিবাদের অবসান হবে। সঞ্জয়, আমি সন্ধি বা যুদ্ধ উভয়ের জন্য প্রস্তুত, মৃদু বা দারূণ দুই কার্যেই সমর্থ।

 যুধিষ্ঠিরের নিকট বিদায় নিয়ে সঞ্জয় সত্বর ধৃতরাষ্ট্রের কাছে ফিরে এসে বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, আপনি পুত্রের বশবর্তী হয়ে পাণ্ডবদের রাজ্য ভোগ করতে চাচ্ছেন এতে আপনার পৃথিবীব্যাপী অখ্যাতি হয়েছে। আপনার দোষেই কুরু পাণ্ডবদের বিরোধ ঘটেছে, যদি যুধিষ্ঠিরকে তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে না দেন তবে অগ্নি যেমন শুষ্ক তৃণ দগ্ধ করে সেইরূপ অর্জুন কৌরবগণকে ধ্বংস করবেন। আপনি অবিশ্বস্ত লোকদের মতে চলছেন, বিশ্বস্ত লোকদের বর্জন করেছেন; আপনার এমন শক্তি নেই যে এই বিশাল রাজ্য রক্ষা করতে পারেন। আমি রথের বেগে শ্রান্ত হয়েছি, আজ্ঞা দিন এখন শয়ন করতে যাই। বুধিষ্ঠির যা বলেছেন কাল প্রভাতে আপনাকে জানাব।

  1. কর্ণ বলতে চান যে, অজ্ঞাতবাসের কাল উত্তীর্ণ হবার আগেই পাণ্ডবগণ আত্মপ্রকাশ করেছেন সেজন্য তাঁদের আবার বার বৎসর বনবাসে থাকতে হবে।
  2. গোহরণকালে।
  3. যাদব যোদ্ধা বিশেষ।
  4. যাদবগণের দেশে।