মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/আজগরপর্বাধ্যায়
॥আজগরপর্বাধ্যায়॥
৩৭। অজগর, ভীম ও যুধিষ্ঠির
গন্ধমাদন পর্বতে কুবেরের উদ্যানে পঞ্চপাণ্ডব চার বৎসর সুখে বাস করলেন। তার পূর্বেই তাঁরা ছ বৎসর বনবাসে কাটিয়েছিলেন। একদিন ভীম অর্জুন নকুল সহদেব যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আপনার প্রতিজ্ঞা রক্ষা ও প্রীতির জন্যই আমরা দুর্যোধনকে মারতে যাই নি, মান পরিহার ক’রে সুখভোগে বঞ্চিত হয়ে বনে বিচরণ করছি। আমাদের বনবাসের একাদশ বৎসর চলছে, পরে এক বৎসর দূরদেশে অজ্ঞাতবাস করলে দুর্যোধন জানতে পারবে না। এখন এখানে নিশ্চেষ্ট হয়ে না থেকে ভবিষ্যতে শত্রুজয়ের জন্য আমাদের প্রস্তুত হওয়া উচিত।
যুধিষ্ঠির গন্ধমাদন পর্বত ছেড়ে যেতে সম্মত হলেন। ঘটোৎকচ অনুচরবর্গের সঙ্গে এসে তাঁদের সকলকে বহন করে নিয়ে চললেন। লোমশ দেবলোকে ফিরে গেলেন। পাণ্ডবগণ বৃষপর্বার আশ্রমে এক রাত্রি এবং বদরিকায় এক মাস বাস ক’রে কিরাতরাজ সুবাহুর দেশে উপস্থিত হলেন। সেখান থেকে ইন্দ্রসেন ও অন্যান্য ভৃত্য, পাচক, সারথি ও রথ প্রভৃতি সঙ্গে নিয়ে এবং ঘটোৎকচকে বিদায় দিয়ে তাঁরা যমুনার উৎপত্তিস্থানের নিকট বিশাখযূপ নামক বনে এলেন। এই মনোহর বনে তাঁরা এক বৎসর মৃগয়া করে কাটালেন।
একদিন ভীমসেন মৃগ বরাহ মহিষ বধ ক’রে বনে বিচরণ করছিলেন এমন সময় এক পর্বতকন্দরবাসী হরিদ্বর্ণ চিত্রিতদেহ মহাকায় সর্প তাঁকে বেষ্টন ক’রে ধরলে। অজগরের স্পর্শে ভীমের সংজ্ঞালোপ হ’ল, মহাবলশালী হয়েও তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না। ভীম বললেন, ভুজগশ্রেষ্ঠ, তুমি কে? আমি ধর্মরাজের ভ্রাতা ভীমসেন, অযুত হস্তীর সমান বলবান, আমাকে কি করে বশে আনলে? ভীমের দুই বাহু মুক্ত এবং তাঁর দেহ বেষ্টিত ক’রে অজগর বললে, তোমার পূর্বপুরুষ রাজর্ষি নহুষের নাম শুনে থাকবে, আমি সেই নহুষ[১] অগস্ত্যের শাপে সর্প হয়েছি। আমি বহুকাল ক্ষুধার্ত হয়ে আছি, আজ ভাগ্যক্রমে তোমাকে ভক্ষ্যরূপে পেয়েছি। ভীম বললেন, নিজের প্রাণের জন্য আমি ভাবছি না, আমার মৃত্যু হ’লে আমার ভ্রাতারা শোকে বিহ্বল ও নিরূদ্যম হবেন। রাজ্যের লোভে আমি ধর্মপরায়ণ অগ্রজকে কটুকথা বলে পীড়া দিয়েছি। আমার মৃত্যুতে হয়তো সর্বাস্ত্রবিৎ ধীমান অর্জুন বিষাদগ্রস্ত হবেন না, কিন্তু মাতা কুন্তী ও নকুল-সহদেব অত্যন্ত শোক পাবেন।
সহসা নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখে যুধিষ্ঠির ভীত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ভীম কোথায়। দ্রৌপদী বললেন, তিনি বহুক্ষণ পূর্বে মৃগয়া করতে গেছেন। যুধিষ্ঠির ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে ভীমের অন্বেষণে চললেন। মৃগয়ার চিহ্ন অনুসরণ করে তিনি এক পর্বতকন্দরে এসে দেখলেন, এক মহাকায় সর্প ভীমকে বেষ্টন ক’রে রয়েছে, তাঁর নড়বার শক্তি নেই। ভীমের কাছে সব কথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, অমিতবিক্রম সর্প, আমার ভ্রাতাকে ছেড়ে দিন, আপনাকে অন্য ভক্ষ্য দেব। সর্প বললে, এই রাজপুত্রকে আমি মুখের কাছে পেয়েছি, এই আমার ভক্ষ্য। তুমি চ’লে যাও, নয়তো কাল তোমাকেও খাব। কিন্তু তুমি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পার তবে তোমার ভ্রাতাকে ছেড়ে দেব। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি ইচ্ছামত প্রশ্ন করুন, আমি তার উত্তর দেব।
সর্প বললে, তোমার বাক্য শুনে মনে হচ্ছে তুমি অতি বুদ্ধিমান। বল—ব্রাহ্মণ কে? জ্ঞাতব্য কি? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, সত্য দান ক্ষমা সচ্চরিত্র অহিংসা তপস্যা ও দয়া যাঁর আছে তিনিই ব্রাহ্মণ। সুখদুঃখহীন পরব্রহ্ম, যাঁকে লাভ করলে শোক থাকে না, তিনিই জ্ঞাতব্য। সর্প বললে, শূদ্রদের মধ্যেও তো ওইসব গুণ থাকতে পারে; আর, এমন কাকেও দেখা যায় না যিনি সুখদুঃখের অতীত। যুধিষ্ঠির বললেন, যে শূদ্রে ওইসব লক্ষণ থাকে তিনি শূদ্র নন, ব্রাহ্মণ; যে ব্রাহ্মণে থাকে না তিনি ব্রাহ্মণ নন, তাঁকে শূদ্র বলাই উচিত। আর আপনি যাই মনে করুন, সুখদুঃখাতীত ব্রহ্ম আছেন এই আমার মত। সর্প বললে, যদি গুণানুসারেই ব্রাহ্মণ হয় তবে যে পর্যন্ত কেউ গুণযুক্ত না হয় সে পর্যন্ত সে জাতিতে ব্রাহ্মণ নয়। যুধিষ্ঠির বললেন, মহাসর্প, আমি মনে করি সকল বর্ণেই সংকরত্ব আছে, সেজন্য মানুষের জাতিনির্ণয় দুঃসাধ্য।
যুধিষ্ঠিরের উত্তর শনে সর্প প্রীত হয়ে ভীমকে মুক্তি দিলে। তার পর তার সঙ্গে নানাবিধ দার্শনিক আলাপ ক’রে যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান, সর্বজ্ঞ, স্বর্গবাসীও ছিলেন, তবে আপনার এ দশা হ’ল কেন? সর্পরূপী নহুষ বললেন, আমি দেবলোকে অভিমানে মত্ত হয়ে বিমানে বিচরণ করতাম, ব্রহ্মর্ষি দেবতা গন্ধর্ব প্রভৃতি সকলেই আমাকে কর দিতেন। এক সহস্র ব্রহ্মর্ষি আমার শিবিকা বহন করতেন। একদিন অগস্ত্য যখন আমার বাহন ছিলেন তখন আমি পা দিয়ে তাঁর মস্তক স্পর্শ করি। তাঁর অভিশাপে আমি সর্প হয়ে অধোমুখে পতিত হলাম। তামার প্রার্থনায় তিনি বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তোমাকে শাপমুক্ত করবেন। এই কথা ব’লে নহুষ অজগরের রূপ ত্যাগ ক’রে দিব্যদেহে স্বর্গারোহণ করলেন। যুধিষ্ঠির ভীম ও ধৌম্য তাঁদের আশ্রমে ফিরে গেলেন।
- ↑ নহুষের পূর্বকথা উদ্যোগপর্ব ৪-পরিচ্ছেদে আছে।