মহাভারত (রাজশেখর বসু)/মৌষলপর্ব

মৌষলপর্ব

১। শাম্বের মুষল প্রসব—দ্বারকায় দুর্লক্ষণ

 বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে বললেন, যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভের পর ষট্‌ত্রিংশ বৎসরে বৃষ্ণিবংশীয়গণ[] অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পরস্পরকে বিনষ্ট করেছিলেন। জনমেজয় বললেন, কার শাপে এরূপ ঘটেছিল আপনি সবিস্তারে বলুন। বাসুদেব থাকতে তাঁরা রক্ষা পেলেন না কেন? বৈশম্পায়ন বলতে লাগলেন।—

 একদিন বিশ্বামিত্র কণ্ব ও নারদ মুনি দ্বারকায় এসেছেন দেখে সারণ[] প্রভৃতি বীরগণের কুবদ্ধি হ’ল। তাঁরা শাম্বকে স্ত্রীবেশে সজ্জিত ক’রে মুনিদের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ইনি পুত্রাভিলাষী বদ্রু[]র পত্নী; আপনারা বলুন ইনি কি প্রসব করবেন। এই প্রতারণায় মুনিগণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এই কৃষ্ণপুত্র শাম্ব একটি ঘোর লৌহমুষল প্রসব করবে। তোমরা অত্যন্ত দুর্বৃত্ত নৃশংস ও গর্বিত হয়েছ; সেই মুষলের প্রভাবে বলরাম ও কৃষ্ণ ভিন্ন যদুকুলের সকলেই বিনষ্ট হবে। হলায়ুধ সমুদ্রে দেহত্যাগ করবেন, জরা নামক এক ব্যাধ কৃষ্ণকে শরবিদ্ধ করবে। এই বলে মুনিগণ কৃষ্ণের কাছে গিয়ে অভিশাপের কথা জানালেন।

 কৃষ্ণ বৃষ্ণিবংশীয়গণকে বললেন, মুনিরা যা বলেছেন তাই হবে। এই ব’লে তিনি তাঁর ভবনে প্রবেশ করলেন, অভিশাপের প্রতিকার করতে ইচ্ছা করলেন না। পরদিন শাম্ব মুষল প্রসব করলেন। রাজা উগ্রসেন বিষণ্ণ হয়ে সেই মুষলের সূক্ষ্ম চূর্ণ করালেন, যাদবগণ তা সাগরে ফেলে দিলেন। তার পর আহুক (উগ্রসেন) বলরাম কৃষ্ণ ও বভ্রুর আদেশে নগরে এই ঘোষণা করা হ’ল—আজ থেকে এই নগরে কেউ সুরা প্রস্তুত করবে না; যে করবে তাকে সবান্ধবে জীবিত অবস্থায় শূলে দেওয়া হবে।

 বৃষ্ণি ও অন্ধকগণ সাবধানে রইলেন। এই সময়ে দেখা গেল, কৃষ্ণপিঙ্গলবর্ণ মুণ্ডিতমস্তক বিকটাকার কালপুরুষ গৃহে গৃহে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং মাঝে মাঝে অদৃশ্য হচ্ছেন। তাঁকে দেখতে পেলেই যাদবগণ শরবর্ষণ করতেন কিন্তু বিদ্ধ করতে পারতেন না। দ্বারকায় নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখা গেল; মূষিকের দল নিদ্রিত যাদবগণের নখ ও কেশ ছেদন করতে লাগল, সারস পক্ষী পেচকের এবং ছাগ শৃগালের রব করতে লাগল। গাভীর গর্ভে গর্দভ, অশ্বতরীর গর্ভে হস্তিশাবক, কুক্কুরীর গর্ভে বিড়াল এবং নকুলীর গর্ভে মূষিক উৎপন্ন হ’ল। যাদবগণ নির্লজ্জভাবে পাপকার্য করতে লাগলেন।

 একদিন ত্রয়োদশীতে অমাবস্যা দেখে কৃষ্ণ যাদবগণকে বললেন, ভারতযুদ্ধকালে এইপ্রকার দুর্নিমিত্ত দেখা গিয়েছিল, আমাদের বিনাশ আসন্ন হয়েছে। তোমরা সমুদ্রতীরস্থ প্রভাসতীর্থে যাও।

২। যাদবগণের বিনাশ

 দ্বারকায় আরও নানাপ্রকার উৎপাত দেখা গেল। কৃষ্ণবর্ণা নারী নিদ্রিত পুরাঙ্গনাদের মঙ্গলসূত্র এবং ভয়ংকর রাক্ষসগণ যাদবদের অলংকার ছত্র ধ্বজ ও কবচ হরণ করতে লাগল। কৃষ্ণের চক্র সকলের সমক্ষে আকাশে অন্তর্হিত হ’ল, দারুকের সমক্ষে অশ্বগণ কৃষ্ণের দিব্য রথ নিয়ে সাগরের উপর দিয়ে চ’লে গেল। অপ্সরারা বলরামের তালধ্বজ এবং কৃষ্ণের গড়ুরধ্বজ হরণ ক’রে উচ্চরবে বললে, যাদবগণ, প্রভাসতীর্থে চ’লে যাও।

 বৃষ্ণি ও অন্ধক মহারথগণ প্রচুর খাদ্য পেয় মাংস মদ্য নিয়ে তাঁদের পরিবারবর্গ ও সৈন্যদের সঙ্গে প্রভাসে গেলেন। সেখানে তাঁরা নারীদের সঙ্গে নিরন্তর পানভোজনে রত হলেন এবং ব্রাহ্মণের জন্য প্রস্তুত অন্নে সুরা মিশ্রিত ক’রে বানরদের খাওয়াতে লাগলেন। বলরাম সাত্যকি গদ[] বদ্রু ও কৃতবর্মা কৃষ্ণের সমক্ষেই সুরাপান করতে লাগলেন। সাত্যকি অত্যন্ত মত্ত হয়ে কৃতবর্মাকে বললেন, কোন্ ক্ষত্রিয় মৃতবৎ নিদ্রামগ্ন লোককে বধ করে? তুমি যা করেছিলে যাদবগণ তা ক্ষমা করবেন না। প্রদ্যুম্ন সাত্যকির বাক্যের সমর্থন করলেন। কৃতবর্মা ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ভূরিশ্রবা যখন ছিন্নবাহু হয়ে প্রায়োপবিষ্ট ছিলেন তখন তুমি নৃশংসভাবে তাঁকে বধ করেছিলে কেন? সাত্যকি স্যমন্তক মণি হরণ ও সত্রাজিৎ[] বধের বৃত্তান্ত বললেন। পিতার মৃত্যুর কথা শুনে সত্যভামা কৃষ্ণকে ক্রুদ্ধ করবার জন্য তাঁর ক্রোড়ে ব’সে রোদন করতে লাগলেন। সাত্যকি উঠে বললেন, সুমধ্যমা, আমি শপথ করছি, ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী ও দ্রৌপদীপুত্রগণ যেখানে গেছেন কৃতবর্মাকে সেখানে পাঠাব; এই পাপাত্মা অশ্বত্থামার সাহায্যে তাঁদের সুপ্তাবস্থায় হত্যা করেছিল। এই ব’লে তিনি খড়্‌গাঘাতে কৃতবর্মার শিরশ্ছেদ ক’রে অন্যান্য লোককেও বধ করতে লাগলেন।

 তখন ভোজ ও অন্ধকগণ সাত্যকিকে বেষ্টন ক’রে উচ্ছিষ্ট ভোজনপাত্র দিয়ে প্রহার করতে লাগলেন। কালের বিপর্যয় বুঝে কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হলেন না। রুক্মিণীপুত্র প্রদ্যুম্ন সাত্যকিকে রক্ষা করবার জন্য যুদ্ধ করতে লাগলেন, কিন্তু সাত্যকির সহিত তিনিও নিহত হলেন। তখন কৃষ্ণ এক মুষ্টি এরকা[] নিলেন, তা বজ্রতুল্য লৌহমুষলে পরিণত হ’ল। সেই মুষলের আঘাতে তিনি সম্মুখস্থ সকলকে বধ করতে লাগলেন। সেখানকার সমস্ত এরকাই মুষল হয়ে গেল; তার দ্বারা অন্ধক ভোজ বৃষ্ণি প্রভৃতি যাদবগণ পরস্পরের হত্যায় প্রবৃত্ত হলেন এবং প্রমত্ত হয়ে পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে নিপাতিত করলেন। অগ্নিতে পতিত পতঙ্গের ন্যায় সকলে মরতে লাগলেন, কারও পলায়নের বুদ্ধি হ’ল না। কৃষ্ণের সমক্ষেই প্রদ্যুম্ন শাম্ব চারুদেষ্ণ অনিরুদ্ধ গদ প্রভৃতি নিহত হলেন। তখন বভ্রু ও দারুক বললেন, ভগবান, বহু লোককে বিনষ্ট করেছেন, এখন আমরা বলরামের কাছে যাই চলুন।

৩। বলরাম ও কৃষ্ণের দেহত্যাগ

 বলরামের নিকটে এসে কৃষ্ণ দেখলেন, তিনি নির্জন স্থানে বৃক্ষমূলে ব’সে চিন্তা করছেন। কৃষ্ণ দারুককে বললেন, তুমি সত্বর হস্তিনাপুরে গিয়ে যাদবগণের নিধনসংবাদ অর্জুনকে জানাও এবং তাঁকে শীঘ্র এখানে নিয়ে এস। দারুক তখনই যাত্রা করলেন। তার পর কৃষ্ণ বভ্রুকে বললেন, তুমি নারীদের রক্ষা করতে যাও, যেন দস্যুরা তাঁদের আক্রমণ না করে। বভ্রু যাত্রার উপক্রম করতেই এক ব্যাধের মুদ্‌গর সহসা নিপতিত হয়ে তাঁর প্রাণহরণ করলে। তখন কৃষ্ণ তাঁর অগ্রজকে বললেন, আমি নারীদের রক্ষার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি, আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করুন।

 কৃষ্ণ তাঁর পিতা বসুদেবের কাছে গিয়ে বললেন, ধনঞ্জয়ের না আসা পর্যন্ত আপনি নারীদের রক্ষা করুন। বলরাম বনমধ্যে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন, আমি তাঁর কাছে যাচ্ছি। আমি কুরুপাণ্ডবযুদ্ধে এবং এখানে বহু লোকের নিধন দেখেছি। যাদবশূন্য এই পুরীতে আমি থাকতে পারব না, বনবাসী হয়ে বলরামের সঙ্গে তপস্যা করব। এই ব’লে কৃষ্ণ বসুদেবের চরণবদনা করলেন এবং নারী ও বালকদের ক্রন্দন শুনে বললেন, সব্যসাচী এখানে আসছেন, তিনি তোমাদের দুঃখমোচন করবেন।

 বনে এসে কৃষ্ণ দেখলেন, বলরাম সেখানে ব’সে আছেন, তাঁর মুখ থেকে একটি শ্বেতবর্ণ সহস্রশীর্ষ রক্তমুখ মহানাগ নির্গত হয়ে সাগরে প্রবেশ করছেন। সাগর, দিব্য নদী সকল, বাসুকি কর্কোটক তক্ষক প্রভৃতি নাগগণ, এবং স্বয়ং বরুণ প্রত্যুদ্‌গমন ক’রে স্বাগতপ্রশ্ন ও পাদ্য-অর্থ্যাদি দ্বারা সেই মহানাগের সংবর্ধনা করলেন।

 অগ্রজ বলদেবের দেহত্যাগ দেখে কৃষ্ণ সেই বনে কিছুক্ষণ বিচরণের পর ভূমিতে উপবেশন করলেন এবং গান্ধারী ও দুর্বাসার শাপের বিষয় চিন্তা করতে লাগলেন। অনন্তর তাঁর প্রয়াণকাল আগত হয়েছে এই বিবেচনায় তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাম সংযম এবং মহাযোগ আশ্রয় ক’রে শয়ান হলেন। সেই সময়ে জরা নামে এক ব্যাধ মৃগ মনে করে তাঁর পদতল শরবিদ্ধ করলে। তার পর সে নিকটে এসে যোগমগ্ন পীতাম্বর চতুর্ভুজ কৃষ্ণকে দেখে ভয়ে তাঁর চরণে পতিত হ’ল। মহাত্মা কৃষ্ণ ব্যাধকে আশ্বাস দিলেন এবং নিজ কান্তি দ্বারা আকাশ ব্যাপ্ত করে ঊর্ধ্বে স্বকীয় লোকে প্রয়াণ করলেন। দেবতা ঋষি চারণ সিদ্ধ গন্ধর্ব প্রভৃতি সেই ঈশ্বরের অর্চনা করলেন, মুনিশ্রেষ্ঠগণ ঋক্ মন্ত্র উচ্চারণ করলেন, এবং ইন্দ্র তাঁকে সানন্দে অভিনন্দিত করলেন।

৪। অর্জুনের দ্বারকায় গমন ও প্রত্যাবর্তন

 দারুক হস্তিনাপুরে গিয়ে দ্বারকার ঘটনাবলী জানালেন। ভোজ অন্ধক কুকুর ও বৃষ্ণি বংশীয় বীরগণের নিধন শুনে পাণ্ডবগণ শোকাকুল হলেন। যদুকুল ধ্বংস হয়েছে এই আশঙ্কায় অর্জুন তাঁর মাতুল বসুদেবকে দেখবার জন্য তখনই যাত্রা করলেন। দ্বারকায় উপস্থিত হয়ে তিনি দেখলেন সেই নগরী পতিহীনা রমণীর ন্যায় শ্রীহীন হয়েছে। কৃষ্ণসখা অর্জুনকে দেখে কৃষ্ণের ষোল হাজার স্ত্রী উচ্চকণ্ঠে রোদন করতে লাগলেন। অর্জুনের চক্ষু বাষ্পাকুল হ’ল, তিনি সেই পতিপুত্রহীনা নারীদের দিকে চাইতে পারলেন না, সশব্দে রোদন ক’রে ভূপতিত হলেন। রুক্মিণী সত্যভামা প্রভৃতি তাঁকে উঠিয়ে স্বর্ণময় পীঠে বসালেন এবং তাঁকে বেষ্টন ক’রে বিলাপ করতে লাগলেন।

 অনন্তর অর্জুন বসুদেবের কাছে এসে দেখলেন, তিনি পুত্রশোকে সন্তপ্ত হয়ে শুয়ে আছেন। বসুদের বললেন, অর্জুন, আমার মৃত্যু নেই; যাঁরা শত শত নৃপতি ও দৈত্যগণকে জয় করেছিলেন, সেই পুত্রদের না দেখেও আমি জীবিত আছি। যে দুজন তোমার প্রিয় শিষ্য ছিল, যারা অতিরথ ব’লে খ্যাত এবং কৃষ্ণের প্রিয়তম ছিল, সেই প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকিই বঞ্চিবংশনাশের মূল কারণ। অথবা আমি তাদের দোষ দিতে পারি না, ঋষিশাপেই আমাদের বংশ বিনষ্ট হয়েছে। তুমি ও নারদাদি মুনিগণ যাঁকে সনাতন বিষ্ণু ব’লে জানতে আমার পুত্র সেই গোবিন্দ যদুবংশের এই বিনাশ উপেক্ষা করেছেন, তিনি জ্ঞাতিদের রক্ষা করতে ইচ্ছা করেন নি। কৃষ্ণ আমাকে ব’লে গেছেন—‘আমি আর অর্জুন একই, অর্জুন দ্বারকায় এসে স্ত্রী ও বালকগণের রক্ষার ভার নেবেন এবং মৃতজনের ঔর্ধ্বদেহিক ক্রিয়া করবেন; তিনি প্রস্থান করলেই দ্বারকা সমুদ্রজলে প্লাবিত হবে। আমি বলদেবের সঙ্গে কোনও নির্জন স্থানে যোগস্থ হয়ে অন্তকালের প্রতীক্ষা করব।’

 তার পর বসুদেব বললেন, পার্থ, আমি আহার ত্যাগ করেছি, জীবনধারণে আমার ইচ্ছা নেই। কৃষ্ণের বাক্য অনুসারে এই রাজ্য, নারীগণ ও ধনরত্ন তোমাকে সমর্পণ করছি। অর্জুন বললেন, মাতুল, কৃষ্ণ ও বান্ধববিহীন এই পৃথিবী আমি দেখতে ইচ্ছা করি না। আমার ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদীর মনের অবস্থাও অনুরূপ, কারণ আমরা ছ জন একাত্মা। রাজা যুধিষ্ঠিরেরও প্রয়াণকাল উপস্থিত হয়েছে, অতএব আমি স্ত্রী বালক ও বৃদ্ধদের নিয়ে সত্বর ইন্দ্রপ্রস্থে যাব।

 পরদিন প্রভাতকালে বসুদেব যোগস্থ হয়ে স্বর্গলাভ করলেন। দেবকী ভদ্রা মদিরা ও রোহিণী পতির চিতায় আরোহণ ক’রে তাঁর সহগামিনী হলেন। অর্জুন সকলের অন্তিম কার্য সম্পন্ন করলেন এবং বলরাম ও কৃষ্ণের দেহ অন্বেষণ ক’রে এনে সৎকার করলেন। সপ্তম দিনে তিনি কৃষ্ণের ষোল হাজার পত্নী, পৌত্র বজ্র[], এবং অসংখ্য নারী বালক ও বৃদ্ধদের নিয়ে যাত্রা করলেন। রথী গজারোহী ও অশ্বারোহী অনুচরগণ এবং ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়াদি প্রজা তাঁদের সঙ্গে গেলেন। অর্জুন দ্বারকার যে যে স্থান অতিক্রম করতে লাগলেন তৎক্ষণাৎ সেই সেই স্থান সমুদ্রজলে প্লাবিত হ’ল।

 কিছু দিন পরে তাঁরা গবাদি পশু ও ধান্য সম্পন্ন পঞ্চনদ প্রদেশের এক স্থানে এলেন। সেখানকার আভীর দস্যুগণ যাদবনারীদের দেখে লুব্ধ হয়ে যষ্ঠি নিয়ে আক্রমণ করলে। অর্জুন ঈষৎ হাস্য ক’রে তাদের বললেন, যদি বাঁচতে চাও তো দূর হও, নতুবা আমার শরে ছিন্ন হয়ে সকলে মরবে। দস্যুগণ নিবৃত্ত হ’ল না দেখে অর্জুন তাঁর গাণ্ডীব নিলেন এবং অতি কষ্টে জ্যারোপণ করলেন, কিন্তু কোনও দিব্যাস্ত্র স্মরণ করতে পারলেন না। তিনি এবং সহগামী যোদ্ধারা বাধা দেবার চেষ্টা করলেও দস্যুরা নারীদের হরণ করতে লাগল, কোনও কোনও নারী স্বেচ্ছায় তাদের কাছে গেল। অর্জুনের বাণ নিঃশেষ হ’লে তিনি ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে প্রহার করতে লাগলেন, কিন্তু সেই ম্লেচ্ছ দস্যুগণ তাঁর সমক্ষেই বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয় সুন্দরীদের হরণ ক’রে নিয়ে গেল। অর্জুন তাঁর দূরদৃষ্ট দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন এবং অবশিষ্ট নারীদের নিয়ে কুরুক্ষেত্রে এলেন।

 কৃতবর্মার পুত্র এবং ভোজ নারীগণকে মার্তিকাবত নগরে এবং সাত্যকির পুত্রকে সরস্বতী নদীর নিকটস্থ প্রদেশে রেখে অর্জুন অবশিষ্ট বালক বৃদ্ধ ও রমণীগণকে ইন্দ্রপ্রস্থে আনলেন। কৃষ্ণের পৌত্র বজ্রকে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্য দিলেন। অক্রূরের পত্নীরা প্রব্রজ্যা নিলেন। কৃষ্ণের পত্নী রুক্মিণী গান্ধারী শৈব্যা হৈমবতী ও জাম্ববতী অগ্নিপ্রবেশ করলেন। সত্যভামা ও কৃষ্ণের অন্যান্য পত্নীগণ হিমালয় অতিক্রম ক’রে কলাপ গ্রামে গিয়ে কৃষ্ণের ধ্যান করতে লাগলেন। দ্বারকাবাসী পুরুষগণকে বজ্রের নিকটে রেখে অর্জুন সজলনয়নে ব্যাসদেবের আশ্রমে এলেন।

 অর্জুনকে দেখে ব্যাস বললেন, তোমাকে এমন শ্রীহীন দেখছি কেন? তোমার গাত্রে কি কেউ নখ কেশ বস্ত্রাঞ্চল বা কলসের জল দিয়েছে? তুমি কি রজস্বলাগমন বা ব্রহ্মহত্যা করেছ, না যুদ্ধে পরাজিত হয়েছ? অর্জুন দ্বারকার সমস্ত ঘটনা, কৃষ্ণ-বলরামের মৃত্যু, এবং দস্যু হস্তে তাঁর পরাজয়ের বিবরণ দিলেন। পরিশেষে তিনি বললেন, সেই পদ্মপলাশলোচন শঙ্খচক্রগদাধর শ্যামতনু চতুর্ভুজ পীতাম্বর পরমপুরুষ, যিনি আমার রথের অগ্রভাগে থাকতেন, সেই কৃষ্ণকে আমি দেখতে পাচ্ছি না; আর আমার জীবনধারণের ফল কি? তাঁর অদর্শনে আমি অবসন্ন হয়েছি, আমার শরীর ঘুরছে, আমি শান্তি পাচ্ছি না। মুনিসত্তম, বলন এখন আমার কি কর্তব্য।

 ব্যাস বললেন, কুরুশার্দূল, বঞ্চি-অন্ধক বীরগণ ব্রহ্মশাপে বিনষ্ট হয়েছেন, তাঁদের জন্য শোক ক’রো না। কৃষ্ণ জানতেন যে তাঁদের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, সেজন্য নিবারণে সমর্থ হয়েও উপেক্ষা করেছেন। তিনি পৃথিবীর ভার হরণ ক’রে দেহত্যাগ ক’রে স্বীয় ধামে গেছেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ, ভীম ও নকুল-সহদেবের সাহায্যে তুমি মহৎ দেবকার্য সাধন করেছ, যেজন্য পৃথিবীতে এসেছিলে তা সম্পন্ন ক’রে কৃতকৃত্য হয়েছ; তোমাদের কাল পূর্ণ হয়েছে, এখন প্রস্থান করাই শ্রেয়। তোমার অস্ত্রসমূহের প্রয়োজন শেষ হওয়াতেই তারা স্বস্থানে ফিরে গেছে; আবার যথাকালে তারা তোমার হস্তগত হবে।

 ব্যাসের উপদেশ শুনে অর্জুন হস্তিনাপুরে গেলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে সমস্ত ঘটনা জানালেন।

  1. যাদবগণের বিভিন্ন শাখার নাম অন্ধক ভোজ বৃষ্ণি কুকুর। কৃষ্ণ বৃষ্ণিবংশীয়।
  2. কৃষ্ণের বৈমাত্র ভ্রাতা, সুভদ্রার সহোদর।
  3. যাদব বীর বিশেষ।
  4. কৃষ্ণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা।
  5. সত্যভামার পিতা; কৃতবর্মা ও অক্রূরের প্ররোচনায় শতধন্বা এঁকে বধ করেছিলেন। বিষ্ণুপুরাণে ও হরিবংশে স্যমন্তক মণির উপাখ্যান আছে।
  6. হোগলা বা তজ্জাতীয় তৃণ।
  7. ভাগবতে আছে, ইনি কৃষ্ণের প্রপৌত্র, প্রদ্যুম্নের পৌত্র, অনিরুদ্ধের পুত্র।