মহাভারত (রাজশেখর বসু)/স্বর্গারোহণপর্ব

স্বর্গারোহণপর্ব

১। যুধিষ্ঠিরের নরকদর্শন

 জনমেজয় বৈশম্পায়নকে বললেন, মহর্ষি ব্যাসের প্রসাদে আপনি সর্বজ্ঞতা লাভ করেছেন, আমার পূর্বপিতামহগণ স্বর্গে গিয়ে কোন্ স্থানে রইলেন তা শুনতে ইচ্ছা করি। বৈশম্পায়ন বলতে লাগলেন।—

 যুধিষ্ঠির স্বর্গে গিয়ে দেখলেন, দুর্যোধন সূর্যের ন্যায় প্রভান্বিত হয়ে দেবগণ ও সাধুগণের মধ্যে ব’সে আছেন। ধর্মরাজ ক্রুদ্ধ হয়ে উচ্চস্বরে বললেন, আমি দুর্যোধনের সঙ্গে বাস করব না; যে লোক পাঞ্চালীকে সভামধ্যে নিগৃহীত করেছিল, যার জন্য আমরা মহাবনে বহু কষ্ট ভোগ করেছি এবং যুদ্ধে বহু সুহৃৎ ও বান্ধব বিনষ্ট করেছি, সেই লোভী অদূরদর্শী দুর্যোধনকে দেখতে চাই না, আমি আমার ভ্রাতাদের কাছে যাব। নারদ সহাস্যে বললেন, মহারাজ, এমন কথা ব’লো না, স্বর্গে বাস করলে বিরোধ থাকে না; স্বর্গবাসী সকলেই দুর্যোধনকে সম্মান করেন। ইনি ক্ষত্রধর্মানুসারে যুদ্ধে নিজ দেহ উৎসর্গ ক’রে বীরলোক লাভ করেছেন, মহাভয় উপস্থিত হ’লেও ইনি কখনও ভীত হন নি। তোমরা পূর্বে যে কষ্ট পেয়েছিলে তা এখন ভুলে যাও, বৈরভাব ত্যাগ করে দুর্যোধনের সঙ্গে মিলিত হও।

 যুধিষ্ঠির বললেন, যার জন্য পৃথিবী উৎসন্ন হয়েছে এবং আমরা প্রতিশোধ নেবার জন্য ক্রোধে দগ্ধ হয়েছি, সেই অধর্মাচারী পাপী সুহৃদ্‌দ্রোহী দুর্যোধনের যদি এই গতি হয় তবে আমার মহাপ্রাণ মহাব্রত সত্যপ্রতিজ্ঞ ভ্রাতারা কোথায় গেছেন? কর্ণ ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত্যকি বিরাট দ্রুপদ শিখণ্ডী অভিমন্যু দ্রৌপদীপুত্রগণ প্রভৃতি কোন্ লোকে গেছেন? আমি তাঁদের দেখতে ইচ্ছা করি। দেবর্ষি, সেই মহারথগণ কি স্বর্গবাসের অধিকার পান নি? তাঁরা যদি এখানে না থাকেন তবে আমিও থাকব না। আমার ভ্রাতারা যেখানে আছেন সেই স্থানই আমার স্বর্গ।

 দেবগণ বললেন, বৎস, যদি তাঁদের কাছে যাবার ইচ্ছা থাকে তো যাও, বিলম্ব ক’রো না। এই ব’লে তাঁরা এক দেবদূতকে আদেশ দিলেন, যুধিষ্ঠিরকে তাঁর আত্মীয়-সুহৃদ্‌গণের নিকটে নিয়ে যাও। দেবদূত অগ্রবর্তী হয়ে পাপীরা যে পথে যায় সেই পথ দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে চললেন। সেই পথ তমসাবৃত, পাপীদের গন্ধযুক্ত, মাংসশোণিতের কর্দম অস্থি কেশ ও মৃতদেহে আচ্ছন্ন, এবং মশক মক্ষিকা কৃমি কীট ও ভল্লুকাদি হিংস্র প্রাণীতে সমাকীর্ণ। চতুর্দিকে অগ্নি জ্বলছে; লৌহমুখ কাক, সূচীমুখ গৃধ্র এবং পর্বতাকার প্রেতগণ ঘুরে বেড়াচ্ছে: মেদরুধিরলিপ্ত ছিন্নবাহু ছিন্নপাদ ছিন্নোেদর মৃতদেহ সর্বত্র পড়ে আছে। সেই পূতিগন্ধময় লোমহর্ষকর পথে যেতে যেতে যুধিষ্ঠির তপ্তজলপূর্ণ দুর্গম নদী, তীক্ষ্ণক্ষুরসমাকীর্ণ অসিপত্রবন, তপ্ততৈলপপূর্ণ লৌহকুম্ভ, তীক্ষ্ণকণ্টকময় শাল্মলী বৃক্ষ প্রভৃতি, এবং পাপীদের যন্ত্রণাভোগ দেখলেন। তিনি দেবদূতকে প্রশ্ন করলেন, এই পথ দিয়ে আর কত দূর যেতে হবে? আমার ভ্রাতারা কোথায়?

 দেবদূত বললেন, মহারাজ, আপনি শ্রান্ত হ’লেই দেবগণের আদেশ অনুসারে আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। মনঃকষ্টে ও দুর্গন্ধে গীড়িত হয়ে যুধিষ্ঠির প্রত্যাবর্তনের উপক্রম করলেন। তখন তিনি এই করুণ বাক্য শুনলেন—হে ধর্মপুত্র রাজর্ষি, দয়া ক’রে মুহূর্তকাল থাকুন। আপনার আগমনে সুগন্ধ পবিত্র বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে, দীর্ঘকাল পরে আপনাকে দেখে আমরা সুখী হয়েছি, আমাদের যাতনাও নিবৃত্ত হয়েছে। দয়ালু যুধিষ্ঠির বার বার এইরূপ বাক্য শুনে প্রশ্ন করলেন, আপনারা কে, কেন এখানে আছেন? তখন চারিদিক হাতে উচ্চকণ্ঠে উত্তর এল—আমি কর্ণ, আমি ভীমসেন, আমি অর্জুন, আমি নকুল, আমি সহদেব, আমি ধৃষ্টদ্যুম্ন, আমি দ্রৌপদী, আমরা দ্রৌপদীপুত্র। যুধিষ্ঠির ভাবতে লাগলেন, দৈব এ কি করেছেন! কোন পাপের ফলে এঁরা এই পাপগন্ধময় নিদারুণ স্থানে আছেন? আমি সুপ্ত না জাগরিত, চেতন না অচেতন? এ কি আমার মনের বিকার না বিভ্রম? যুধিষ্ঠির দুঃখ ও দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল হলেন এবং ক্রুদ্ধকণ্ঠে দেবদূতকে বললেন, তুমি যাঁদের দূত তাঁদের কাছে গিয়ে বল যে আমি ফিরে যাব না এখানেই থাকব, আমাকে পেয়ে আমার ভ্রাতারা সুখী হয়েছেন। দেবদূত ফিরে গিয়ে ইন্দ্রকে যুধিষ্ঠিরের বাক্য জানালেন।

 কিছুক্ষণ পরে ইন্দ্রাদি দেবগণ ও ধর্ম যুধিষ্ঠিরের কাছে এলেন। সহসা অন্ধকার দূর হ’ল, বৈতরণী নদী, লৌহকুম্ভ, কণ্টকময় শাল্মলী বৃক্ষ প্রভৃতি এবং বিকৃত শরীর সকল অদৃশ্য হ’ল, পাপীদের আর্তনাদ আর শোনা গেল না, শীতল সুগন্ধ পবিত্র বায়ু বইতে লাগল। সুরপতি ইন্দ্র বললেন, মহাবাহু যুধিষ্ঠির, দেবগণ তোমার উপর প্রীত হয়েছেন, তুমি আমাদের সঙ্গে এস। ক্রুদ্ধ হয়ো না, সকল রাজাকেই নরক দর্শন করতে হয়। সকল মানুষেরই পাপপুণ্য থাকে; যার পাপের ভাগ অধিক এবং পুণ্য অল্প সে প্রথমে স্বর্গ ভোগ ক’রে পরে নরকে যায়; যার পুণ্য অধিক এবং পাপ অল্প সে প্রথমে নরক ও পরে স্বর্গ ভোগ করে। তুমি দ্রোণকে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে প্রতারিত করেছিলে, তাই আমি তোমাকে ছলক্রমে নরক দেখিয়েছি। তোমার ভ্রাতারা এবং দ্রৌপদীও ছলক্রমে নরকভোগ করেছেন। তোমার পক্ষে যে সকল রাজা নিহত হয়েছিলেন তাঁরা সকলেই স্বর্গে এসেছেন। যাঁর জন্য তুমি পরিতাপ কর সেই কর্ণও পরমসিদ্ধি লাভ করেছেন। তুমি পূর্বে কষ্টভোগ করেছ, এখন শোকশূন্য নিরাময় হয়ে আমার সঙ্গে বিহার কর। এই ত্রিলোকপাবনী দেবনদী আকাশগঙ্গায় স্নান ক’রে মানুষভাব থেকে মুক্ত হও।

 মূর্তিমান ধর্ম তাঁর পুত্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, বৎস, এই তৃতীয় বার তোমাকে আমি পরীক্ষা করেছি, তোমাকে বিচলিত করা অসাধ্য। তোমরা কেউ নরকভোগের যোগ্য নও, তুমি যা দেখেছ তা ইন্দ্রের মায়া। তার পর যুধিষ্ঠির আকাশগঙ্গায় স্নান ক’রে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করলেন এবং দিব্য দেহ ধারণ ক’রে যেখানে পাণ্ডব ও ধার্তরাষ্ট্রগণ ক্রোধশূন্য হয়ে সুখে অবস্থান করছিলেন সেখানে গেলেন।

২। কুরুপাণ্ডবাদির স্বর্গলাভ

 যুধিষ্ঠির কুরুপাণ্ডবগণের নিকটে এসে দেখলেন, গোবিন্দ ব্রাহ্মী তনু ধারণ ক’রে দীপ্যমান হয়ে বিরাজ করছেন, তাঁর চক্র প্রভৃতি ঘোর অস্ত্রসমূহ পুরুষমূর্তিতে তাঁর নিকটে রয়েছে, অর্জুন তাঁকে উপাসনা করছেন। যুধিষ্ঠিরকে দেখে কৃষ্ণার্জুন যথাবিধি অভিবাদন করলেন। তার পর যুধিষ্ঠির অন্যান্য স্থানে গিয়ে দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণ, মরুদ্‌গণবেষ্টিত ভীমসেন, অশ্বিদ্বয়ের নিকটে নকুল-সহদেব, এবং সূর্যের ন্যায় প্রভাশালিনী কমল-উৎপলের মাল্যধারিণী পাঞ্চালীকে দেখলেন।

 ইন্দ্র বললেন, এই দ্রৌপদী অযোনিজা লক্ষ্মী, শূলপাণি তোমাদের প্রীতির নিমিত্ত এঁকে সৃষ্টি করেছিলেন। এই পাঁচ জন গন্ধর্ব তোমাদের পুত্ররূপে এঁর গর্ভে জন্মেছিলেন। এই গন্ধর্বরাজ ধৃতরাষ্ট্রকে দেখ, ইনিই তোমার জ্যেষ্ঠতাত ছিলেন। এই সূর্যতুল্য বীর তোমার অগ্রজ কর্ণ। বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয় মহারথগণ, সাত্যকি প্রভৃতি ভোজবংশীয় বীরগণ, এবং সুভদ্রাপুত্র চন্দ্রকান্তি অভিমন্যু—এঁরা সকলেই দেবগণের মধ্যে রয়েছেন। এই দেখ তোমার পিতা পাণ্ডু ও মাতা কুন্তী-মাদ্রী, এঁরা বিমানযোগে সর্বদা আমার কাছে আসেন। বসুগণের মধ্যে ভীষ্ম এবং বৃহস্পতির পার্শ্বে তোমার গুরু দ্রোণকে দেখ। অন্যান্য রাজা ও যোদ্ধারা গন্ধর্ব যক্ষ ও সাধুগণের সঙ্গে রয়েছেন।

 জনমেজয় প্রশ্ন করলেন, দ্বিজোত্তম, আপনি যাঁদের কথা বললেন তাঁরা কত কাল স্বর্গবাস করেছিলেন? কর্মফলভোগ শেষ হ’লে তাঁরা কোন্ গতি পেয়েছিলেন? বৈশম্পায়ন বললেন, অগাধবুদ্ধি সর্বজ্ঞ ব্যাসদেবের নিকট আমি যেমন শুনেছি তাই বলছি।—ভীষ্ম বসুগণে, দ্রোণ বৃহস্পতির শরীরে, কৃতবর্মা মরুদ্‌গণে, প্রদ্যুম্ন সনৎকুমারে, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী কুবেরলোকে, পাণ্ডু কুন্তী ও মাদ্রী ইন্দ্রলোকে, এবং বিরাট দ্রুপদ ভুরিশ্রবা উগ্রসেন কংস অক্রূর বসুদেব শাম্ব প্রভৃতি বিশ্বদেবগণে প্রবেশ করেছেন। চন্দ্রপুত্র বর্চা অভিমন্যু রূপে জন্মেছিলেন, তিনি চন্দ্রলোকে গেছেন। কর্ণ সূর্যের, শকুনি দ্বাপরের, এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন পাবকের শরীরে গেছেন। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা রাক্ষসের অংশে জন্মেছিলেন, তাঁরা অস্ত্রাঘাতে পূত হয়ে স্বর্গলাভ করেছেন। বিদুর ও যুধিষ্ঠির ধর্মে লীন হয়েছেন। বলরামরূপী ভগবান অনন্তদেব রসাতলে প্রবেশ করেছেন। দেবদেব নারায়ণের অংশে যিনি জন্মেছিলেন সেই বাসুদেব নারায়ণের সহিত যুক্ত হয়েছেন। তাঁর ষোল হাজার পত্নী কালক্রমে সরস্বতী নদীতে প্রাণত্যাগ ক’রে অপ্সরার রূপে নারায়ণের কাছে গেছেন। ঘটোৎকচ প্রভৃতি দেবলোক ও রাক্ষসলোক লাভ করেছেন। কর্মফলভোগ শেষ হ’লে এঁদের অনেকে সংসারে প্রত্যাবর্তন করবেন।


 রাজা জনমেজয় বৈশম্পায়নের মুখে মহাভারতকথা শুনে অতিশয় বিস্মিত হলেন। তাঁর যজ্ঞ সমাপ্ত হ’ল, সর্পগণের মুক্তিতে আস্তীক মুনি প্রীত হলেন। ব্রাহ্মণগণ দক্ষিণা পেয়ে তুষ্ট হয়ে চ’লে গেলেন, নিমন্ত্রিত রাজারাও প্রস্থান করলেন। তার পর জনমেজয় যজ্ঞস্থান তক্ষশিলা থেকে হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন।

৩। মহাভারত-মাহাত্ম্য

 নৈমিষারণ্যের দ্বিজগণকে সৌতি বললেন, আপনাদের আদেশে আমি পবিত্র মহাভারতকথা কীর্তন করেছি। ভগবান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন-রচিত এই ইতিহাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়ন কর্তৃক জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে কথিত হয়েছিল। যিনি পর্বে পর্বে এই গ্রন্থ পাঠ ক’রে শোনান তিনি পাপমুক্ত হয়ে ব্রহ্মলাভ করেন। যিনি সমাহিত হয়ে এই বেদতুল্য সমগ্র মহাভারত শোনেন তিনি ব্রহ্মহত্যাদি কোটি কোটি পাপ থেকে মুক্ত হন। যিনি শ্রাদ্ধকালে এর কিছু অংশও ব্রাহ্মণদের শোনান তাঁর পিতৃগণ অক্ষয় অন্ন ও পানীয় লাভ করেন। ভরতবংশীয়গণের মহৎ জন্মকথা এতে বর্ণিত হয়েছে এই কারণে এবং মহত্ত্ব ও ভারবত্ত্বের জন্য একে মহাভারত বলা হয়। অষ্টাদশ পুরাণ, সমস্ত ধর্মশাস্ত্র ও বেদ-বেদাঙ্গ এক দিকে, এবং কেবল মহাভারত আর এক দিকে। পুরাণপ্রণেতা এবং বেদসমুদ্রের মন্থনকর্তা ব্যাস ঋষির সিংহনাদ এই মহাভারত; তিন বৎসরে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বর্গ এতে বর্ণিত হয়েছে। যা মহাভারতে আছে তা অন্যত্র থাকতে পারে, যা এতে নেই তা আর কোথাও নেই। জয়-নামক এই ইতিহাস মোক্ষার্থী ব্রাহ্মণ ও রাজাদের শোনা উচিত। মহাভারত শুনলে স্বর্গকামীর স্বর্গ, জয়কামীর জয়, এবং গর্ভিণীর পুত্র বা বহুভাগ্যবতী কন্যা লাভ হয়। সমুদ্র ও হিমালয় যেমন রত্ননিধি নামে খ্যাত, মহাভারতও সেইরূপ।

 যাঁর গৃহে এই গ্রন্থ থাকে, জয় তাঁর হস্তগত। বেদে রামায়ণে ও মহাভারতে আদি অন্ত ও মধ্যে সর্বত্র হরিকথা কীর্তিত হয়েছে। সূর্যোদয়ে যেমন তমোরাশি বিনষ্ট হয়, মহাভারত শুনলে সেইরূপ কায়িক বাচিক ও মানসিক সমস্ত পাপ দূর হয়।

- সমাপ্ত -