মানসিংহ/দিল্লীতে উৎপাত

 ডাকিনী যোগিনী, শাঁখিনী পেতনী, গুহ্যক দানব দানা। ভৈরব রাক্ষস, বোক্কস, খোক্কস, সমরে দিলেক হানা॥ লপটে ঝপটে, দপটে রপটে, ঝড় বহে খরতর। লপ লপ লম্ফে, ঝপ ঝপ ঝম্পে, দিল্লী কাঁপে থর থর॥ টাকরে চাপড়ে, আঁচড়ে কামড়ে, মরিছে যবন সেনা। রক্তের পাঁতারে, ভৈরব সাঁতারে গগণে উঠিছে ফেণা॥ তা থই তা থই, হো হো হই হই, ভৈরব ভৈরবী নাচে। অট অট হাসে, কট মট ভাষে, মত্ত পিশাচী পিশাচে॥ তুরঙ্গ ধরিয়া, গণ্ডুষ করিয়া, মাতঙ্গ পুরিয়া গালে। সিপাহী ধরিয়া, ফেলিয়া লুফিয়া, খেলিছে তাল বেতালে॥ রথ রথি সঙ্গে, মুখে পুরি রঙ্গে, দশনে করিছে গুঁড়া। হঙ্কার ছাড়িয়া ফুঁকে উড়াইয়া, খেলিছে আবির উড়া॥ নরশিরমালা, সমর বিশালা, শোণিত তটিনী তীরে। রণজয় তালী, ঘন দিয়া কালী শৃগালী বেষ্টিত ফিরে॥ এই রূপে দানা, গণ দিল হানা, যবনে হইল দায়। ললিত বিধানে, রচিয়া মশানে, রায় গুণাকর গায়॥

এ কি ভূতগত দেশে রে। না জানি কি হবে
শেষে রে॥ উত্তম অধম, না হয় নিয়ম,
কেহ নাহি ধর্ম্ম লেশে রে। দাতা ছিল
যারা, ভিক্ষা মাগে তারা, চোর ফিরে সাধু
বেশে রে॥ যবনে ব্রাহ্মণে, সমভাবে গণে
তুল্য মূল্য গজ মেষে রে। ভারতের মন,
দেখি উচাটন, না দেখিয়া হৃষীকেশে রে॥ ধ্রু॥

 এই রূপে দিল্লীতে পড়িল মহামার। যবনের হাহাকার ভূতের হঙ্কার। ঘরে ঘরে সহরে হইল ভূতাগত। মিয়ারে কহিছে বান্দী শুন হজরত॥ বিবীরে পাইল ভূতে প্রলয় পড়িলা। পেশ বাজ ইজার ধমকে ছিঁড়াদিল। চিতপাত হয়ে বিবী হাত পা আছাড়ে। কত দোয়া দবা দিনু তবু নাহি ছাড়ে॥ শুনি মিয়া তসবী কোরাণ ফেলাইয়া। দড় বড় বড় দিলা ওঝারে লইয়া॥ ভূত ছাড়াইতে ওঝা মন্ত্র পড়ে যত। বিবী লয়ে ভূতের আনন্দ বাড়ে তত॥ অরে রে খবিস তোরে ডাকে ব্রহ্মদূত। ও তোর মাতারি তুই উহারি সে পুত। কুপী ভরি গিলাইব হারামের হাড়। ফতমা বিবীর আজ্ঞা ছাড় ছাড় ছাড়॥ ইত্যাদি অনেক মন্ত্র পড়িলেক ওঝা। মিয়া দিলা লিখিয়া তাবিজ বোঝা বোঝা। আর বিবী বান্দীরে ধরিছে আর ভূতে। ওঝারে কিলায় কেহ মুখে মুতে॥ ধূলা ঝাড়ি গুড়ি গুড়ি পলাইল ওঝা। মিয়া হৈল মিয়ানী ওঝার ঘাড়ে বোঝা॥ এই রূপে ভূতাগত হইল সহরে। হা হা কার হুহুঙ্কার প্রতি ঘরে ঘরে। শূন্য পথে সিহরথে অন্নদা রহিলা। সহরের যত অন্ন কটাক্ষে হরিলা॥ পাতশার ভাণ্ডার কি আর আর ঠাঁই। হাট ঘাট বাজারে দোকানে অন্ন নাই॥ ধান চাল মাষ মুগ ছোলা অরহর। মসূরাদি বরবটী বাটুলা মটর॥ দেধীন মাড়ুয়া কোদা চিনা ভূরা যব। জনার প্রভৃতি গম আদি আর সব॥ মৎস্য মাংস কাঁচা পাকা নানা গুড় দ্রব্য। ঘাস পাত ফুল ফল যতমত গব্য॥ কিনিতে বেচিতে কেহ কোথায় নাপায়। সবে বলে আচম্বিতে এ কি হৈল দায়॥ নগর পুড়িল দেবালয় কি এড়ায়। মিশালে বিস্তর হিন্দু ঠেকে গেল দায়॥ উপোষে উপোষে লোক হৈল মৃত প্রায়। থাকুক অন্যের কথা জল নহি পায়॥ বকরা বকরী আদি নানা জন্তু কাটি। খাইবারে সকলেতে মাস লয় বাঁটি॥ নানামতে লোক আহারের চেষ্টা পায়। হাতে হৈতে হরিয়া ভৈরবে লয়ে যায়॥ এইরূপে সপ্তাহ সহরে অন্ন নাই। ছেলে পিলে বুড়া রোগা মৈল কত ঠাঁই॥ পাতশার কাছে গিয়া উজির নাজির। সহরের উপদ্রব করিল জাহির॥ পাতশা কহেন বাবা কি কৈল গোসাঁই। সাত রোজ মোর ঘরে খানা পিনা নাই॥ মামুর হইল মোর বাবরুচি খানা। ঘরে হৈতে নিকলিতে না পারে জনানা॥ গোহাড় ইটাল ইট শূন্য হইতে পড়ে। ভূচালার মত চালা কোটা সব লড়ে॥ আন্ধারে কি কব রোজ রৌশনে আন্ধার। হুপ হাপ দুপ দাপ হুঙ্কার হাঁকার॥ দেখিতে না পাই কেবা করে ধূমধাম। সবো রোজ হাঁকে হুম হাম খুম খাম॥ যুবতী সহেলী বান্দী ধরিয়া পাছাড়ে। বেহোঁশ হইয়া তারা হাত পা আছাড়ে॥ খরিশ পাইল বলি ডাকি আনি ওঝা। লিখে দিনু গলায় তাবিজ বোঝা বোঝা॥ এমন পবিশ আর না শুনি কোথায়। তাবিজ ছিঁড়িয়া ফেলি ওঝারে কিলায়॥ ভারত কহিছে ভূতনাথের এ ভূত। খরিশের খরিশ যমের যমদূত॥