মেগাস্থেনীসের ভারত-বিবরণ (১৯৪৪)/২৯তম অংশ

স্ট্রাবো

অবাস্তব জাতিসমূহ[]

 কিন্তু উপাখ্যান বর্ণনায় প্রবৃত্ত হইয়া তিনি বলিতেছেন যে (ভারতে) পঞ্চবিঘস্ত, এমন কি ত্রিবিঘস্ত দীর্ঘ মানুষ আছে; তাহাদিগের মধ্যে কাহারও কাহারও নাক নাই, কেবল মুখের উপরে দুইটি রন্ধ্র আছে। তাহারা তদ্দ্বারা নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করে। ত্রিবিঘস্ত জাতির সহিত সারসেরা যুদ্ধ করে (হোমরও এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন), তিতির পক্ষীও যুদ্ধ করে, এগুলি রাজহংসের ন্যায় বৃহৎ।[] ইহারা সারসদিগের ডিম্ব সংগ্রহ করিয়া বিনষ্ট করে, কারণ সারসেরা ইহাদিগেরই দেশে ডিম্ব প্রসব করে; এজন্য আর কোথায়ও সারসের ডিম্ব ও শাবক দৃষ্ট হয় না। এদেশে প্রায়শ সারস আহত হয় ও দেহে নিবদ্ধ ধাতবাস্ত্রের সূক্ষ্মাগ্র লইয়া পলায়ন করে। কর্ণপ্রাবরণ (Enoctokoitai) বনমানুষ ও অন্যান্য রাক্ষসের বৃত্তান্তও এইরূপ।[] বনমানুষগুলিকে

চন্দ্রগুপ্তের নিকটে আনিতে পারা যায় নাই, কারণ তাহারা অন্নজল পরিত্যাগ করিয়া আত্মহত্যা করে। ইহাদিগের পায়ের গোড়ালি সম্মুখের দিকে, পাতা ও আঙ্গুলগুলি পশ্চাদ্দিকে।[] কয়েকটা মুখবিহীন মানুষ আনীত হইয়াছিল, তাহারা শান্ত ছিল। তাহারা গঙ্গার উৎপত্তি

বশে চক্রে মহাতেজা দণ্ডকাংশ্চ মহাবলঃ।
সাগরদ্বীপবাসাংশ্চ নৃপতীন্ ম্লেচ্ছযোনিজান্।
নিষাদান্ পুরুষাদাংশ্চ কর্ণপ্রাবরণানপি।
যে চ কালমৃখা নাম নররাক্ষসযোনয়ঃ॥

সভাপর্ব্ব। ৩১শ অধ্যায়, ৬৬/৬৭ শ্লোক। 

 ভারতবর্ষে আপামর সাধারণের বিশ্বাস এই যে বর্বর জাতির কর্ণ অত্যন্ত বৃহৎ; এজন্য কর্ণপ্রাবরণ, কর্ণিক, লম্বকর্ণ, মহাকর্ণ, উষ্ট্রকর্ণ, ওষ্ঠকর্ণ, পাণিকর্ণ প্রভৃতি নাম দৃষ্ট হয়।

ক্ষুরকর্ণী চতুষ্কণী কর্ণপ্রাবরণা তথা।
চতুষ্পথনিকেতা চ গোকর্ণী মহিষাননা॥
খরকর্ণী মহাকর্ণী ভেরীস্বনমহাস্বনা।

* * *

নৌকর্ণী মুখকর্ণীচ বশিরা মন্থিনী তথা”

শল্য পর্ব্ব। ৪৬ম অধ্যায়। 

অন্ধ্রাংস্তালবানংশ্চৈব কলিঙ্গান্ উষ্ট্রকর্ণিকান্।

সভাপর্ব্ব ৩১ম অধ্যায় 

কর্ণপ্রাবরণাশ্চৈব বহবন্তত্র ভারত।

ঐ। ৫ম অধ্যায়। 
স্থলে বাস করে। তাহারা দগ্ধ মাংসের ঘ্রাণ ও ফলপুষ্পের সুগন্ধ গ্রহণ করিয়া প্রাণধারণ করে; কারণ তাহাদিগের মুখ নাই। তৎপরিবর্তে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণের রন্ধ্র আছে। তাহারা দুর্গন্ধ দ্রব্য হইতে অতিশয় ক্লেশ পায়। এজন্য তাহাদিগের পক্ষে জীবনরক্ষা করা বড়ই কঠিন, বিশেষত শিবিরে।[]

 অন্যান্য অলৌকিক বিষয়ের প্রসঙ্গে পণ্ডিতগণ তাঁহাকে একপাদ (Okupodas) জাতির কথা বলিয়াছিলেন, ইহারা ঘোটক অপেক্ষাও দ্রুতগামী।[] তাঁহারা কর্ণপ্রাবরণগণের (Enoctokoitai) উপাখ্যানও উল্লেখ করিয়াছিলেন। ইহাদিগের কর্ণ পদ পর্য্যন্ত বিলম্বিত, সুতরাং

করালা: পিঙ্গলাঃ রৌদ্রাঃ শৈলদন্তা রজস্বলাঃ।
জটিলা দীর্ঘসক্থাশ্চ পঞ্চপাদা মহোদরাঃ।।
পশ্চাদঙ্গুলয়ো রুক্ষা বিরূপা ভৈরবস্বনাঃ।
ঘণ্টাজালাববদ্ধাশ্চ নীলকণ্ঠা বিভীষণাঃ।।
সপুত্রদারাঃ সুক্ররাঃ সুদুধর্সা সুনিঘৃর্ণাঃ।
বিবিধানিচ রূপাণি তত্রাশ্যন্ত রক্ষসাম্॥

সৌপ্তিকপর্ব্ব ৮ম অধ্যায়। 
১২৯-১৩২ শ্লোক। 
ইহারা তাহাতে শয়ন করিয়া থাকে; এবং ইহারা এমন বলবান্

যে বৃক্ষ উৎপাটিত ও ধনুর্গুণ ছিন্ন করিতে পারে। অপর এক জাতির নাম একাক্ষ: (Monommatoi), তাহাদিগের কর্ণ কুকুরের কর্ণের মত এবং চক্ষু একটি মাত্র—ললাটের মধ্যভাগে অবস্থিত, তাহারা ঊর্ধ্বকেশ, তাহাদিগের বক্ষ রোমশ।[] আর এক জাতি নাসাবিহীন, তাহারা সর্ব্বভুক্, আমভোজী, স্বল্পজীবী, বার্ধক্যের পূর্বেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাহাদিগের মুখের উপরিভাগ (অর্থাৎ ওষ্ঠ) (অধর অপেক্ষা) অনেক অধিক প্রসারিত। সহস্রবর্ষজীবী[] উত্তরকুরুদিগের (Hyperboreans)

একপাদাংশ্চ তত্রাহমপশ্যং দ্বারিবারিতান্।
রাজানো বলিমাদায় নানাবর্ণাননেকশঃ।

সভাপর্ব্ব ৫১ম অধ্যায়, ১৭/১৮ শ্লোক। 

রামায়ণ ও হরিবংশেও একপাদ জাতির উল্লেখ আছে। ‘একচরণ' নামও দৃষ্ট হয়।

সম্বন্ধে তাঁহারা সিমোনিডীস, পিণ্ডার ও অন্যান্য উপাখ্যান-লেখকগণের ন্যায়ই বর্ণনা প্রদান করিয়াছেন। টিমাগেনীস বলেন, (এদেশে) তাম্ররেণুর বৃষ্টি হয়, (লোকে) উহা সংগ্রহ করে; ইহা কাল্পনিক উপাখ্যান। মেগাস্থেনীস বলেন, অনেক নদীতে স্বর্ণরেণু প্রবাহিত হয় এবং ইহার এক ভাগ রাজস্ব রূপে রাজাকে প্রদত্ত হয়। ইহা অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য, কারণ ইবীরিয়া দেশেও এই প্রকার দৃষ্ট হয়।

দেবলোকচ্যুতা: সবে জায়ন্তে ত্ত্র মানবাঃ।
শুক্লাভিজনসম্পন্নাঃ সর্বে সুপ্রিয়দর্শনাঃ॥
এবমেবানুরূপঞ্চ চক্রবাকসনং বিভো।
নিরাময়াশ্চ তে লোকা নিত্যং মুদিতমানসঃ॥
দশবর্ষ সহস্রাণি দশবর্ষশতানি চ।
জীবস্তি তে মহারাজ ন চান্যোনং জহত্যুতঃ॥

 ভীষ্মপর্ব। ৭ম অধ্যায়, ৭, ১০, ১১ শ্লোক। উত্তরকুরুগণের এই বর্ণনার সহিত পিণ্ডাররচিত Hyperborean দিগের বর্ণনার ঐক্য আছে—

With braids of golden bays entwined
Their soft resplendent locks they bind,
And feast in bliss the genial hour;
Nor foul disease, nor wasting age,
Visit the sacred race; nor wars they wage,
Nor toil for wealth or power.

 10th Pythian Ode; translated by A. Moore (quoted by McCrindle.)

 [এই অংশের পাদটীকাগুলি ডাঃ শোরানবেকের; সংস্কৃত শ্লোকগুলি তাঁহার নির্দেশানুসারে অনুবাদক কর্তৃক সংগৃহীত।]

  1. ষ্ট্রাবো (২।১।৯।৭০ পূঃ) বলেন—“ডীমখস ও মেগাস্থেনীস একেবারেই বিশ্বাসের অযোগ্য। ইঁহারা নানা অলৌকিক জাতির উপাখ্যান রচনা করিয়াছেন। কোন জাতির কর্ণ এত বৃহৎ যে তাহাতে শয়ন করা যায়, কোনটির মুখ নাই, কোনটি নাসাবর্জিত, কোনটি একচক্ষু, কোনটির পদ উর্ণনাভের পদের ন্যায়, কোনটির আঙ্গুল পশ্চাদ্দিকে। বামন ও সারসের যুদ্ধ সম্বন্ধে হোমরের যে আখ্যায়িকা আছে ইঁহারা তাহার পুনরুক্তি করিয়াছেন। ইঁহারা বলেন যে এই বামনেরা ত্রিবিঘস্ত দীর্ঘ ছিল। স্বর্ণখননকারী পিপীলিকা, কীলকাকার মস্তকবিশিষ্ট নরপশু (Pans), সশৃঙ্গ গো ও হরিণ উদরসাৎ করে, এই প্রকার অজগর—ইত্যাদি অনেক উপাখ্যান ইঁহারা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন; অথচ এরাটস্থেনীস বলেন, ইঁহারাই এই সকল বিষয়ে একে অন্যকে মিথ্যাবাদী বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।”
  2. ক্টাসিয়সও (ভারতবিবরণ। ১১) বলেন, বামনজাতি ভারত-বর্ষবাসী। ভারতবাসীদিগের মতে এই বামনেরা কিরাত জাতি, তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণ এই যে কিরাত বলিতেই বামন বুঝায়। প্রবাদ এই যে তাহারা গূধ্র ও গরুড়ের (ঈগলের) সহিত যুদ্ধ করে, এজন্য বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের একটি নাম কিরাতাশী[১]। কিরাতগণ মঙ্গোলীয় জাতি, এজন্য ভারতবর্ষীয়েরা ইহাদিগকে মঙ্গোলীয় জাতির ন্যায় বর্ণনা করিতে যাইয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কদর্যতা অত্যন্ত বাড়াইয়া তুলিয়াছে। ‘মুখ-বিহীন’ প্রভৃতি অভিধানের ইহাই মূল।— Schwanbeck.
    ^১ আদিপর্ব্বের ২৮ অধ্যায়ে গরুড়ের প্রতি বিনতার উক্তি—

    সমুদ্রকুক্ষাবেকান্তে নিষাদালয়মুত্তমম্।
    নিষাদানাং সহস্রাণি তান্ ভুক্ত্বাঽমৃতমানয়॥

  3. Enoctokoitai—ইহাদিগের কর্ণ এত বৃহৎ যে তাহাতে শয়ন করা যায়। মহাভারতোক্ত কর্ণপ্রাবরণ জাতি।
  4. ক্টীসিয়স এবং বীটোও এই জাতির উল্লেখ করিয়াছেন। ইহারা Antipodes নামে ঈথিয়পীয়গণের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছিল। ভারতীয় মহাকাব্যে ইহা “পশ্চাদঙ্গুলয়ঃ” নামে পরিচিত।

    তত্রাদৃশ্যন্ত রক্ষাংসি পিশাচাশ্চ পৃথগ্- বিধাঃ।
    খাদস্তো নরমাংসানি পিবন্তঃ শোনিতানিচ!!

  5. মুখবিহীন জাতির উল্লেখ ভারতীয় গ্রন্থে দৃষ্ট হয় না। সংস্কৃত সাহিত্যে বর্ণরজাতিসমূহ সর্ব্বভক্ষ, বিশ্বভোজন, মাংসভক্ষক, আমিযাশী, পিশিতাশী, ক্রব্যাদ, আমভোজী প্রভৃতি আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে।
  6. একপাদ জাতি কিরাতগণের এক শাখা। ক্টীসিয়সও ইহাদিগের বর্ণনা করিয়াছেন, কিন্তু তিনি ইহাদিগকে “ছায়াপদ” গণের সহিত এক মনে করিয়া ভ্রমে পড়িয়াছেন।

    দ্ব্যক্ষাংপ্রক্ষান্ ললাটাক্ষান্নানাদিগ্ভ্যঃ সমাগতান্।
    ঔষীকানস্ত্নাসাংশ্চ রোমকান পুরুষদিকান।;

  7. এস্থলে মেগাস্থেনীস যেগুলি একজাতির লক্ষণ বলিয়া নির্দ্দেশ করিতেছেন, ভারতবর্ষীয়দিগের মতে সেগুলি বিভিন্ন জাতির লক্ষণ। Monommatos=একাক্ষঃ বা একবিলোচনঃ। Orthochaitos =ঊর্ধ্বকেশঃ। Metopophthalmos = ললাটাক্ষঃ, ইহারা ভারতীয় Cyclopes.

    দিদেশ রাক্ষসীস্তত্র রক্ষণে রাক্ষসাধিপঃ।
    প্রাসাসিশূলপরশুমুদ্‌গরালাতধারিণী॥
    দ্বাক্ষীং ত্র্যক্ষীং ললাটাক্ষীং দীর্ঘজিহ্বামজিহ্বিকাম্।
    ত্রিস্তনীমেকপাদাঞ্চ ত্রিজটামেকলোচনাম্॥
    এতাশ্চান্যাশ্চ দীপ্তাক্ষ্যঃ করভোৎকটমূর্দ্ধজাঃ।
    পরিবার্যাসতে সীতাং দিবারাত্রমতন্দ্রিতা।।

    বনপর্ব, ২৭৯ম অধ্যায়। ৪৪-৪৬ শ্লোক। 
  8. উত্তরকুরুগণের কাহিনী অতিপ্রাচীনকালে ভারতবর্ষ হইতে গ্রীসে নীত হইয়াছিল। মেগাস্থেনীস ইহা অবগত ছিলেন; সুতরাং তিনি তাহাদিগকে Hyperborean নামে অভিহিত করিয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়াছেন।