মেগাস্থেনীসের ভারত-বিবরণ (১৯৪৪)/৩২তম অংশ
আরিয়ান
ভারতবর্ষের সাতটি জাতি
সমগ্র ভারতবাসী প্রায় সাতটি জাতিতে বিভক্ত। ইহাদিগের মধ্যে ব্রাহ্মণগণ (Sophistai = পণ্ডিতগণ) সংখ্যায় অপর জাতি অপেক্ষা ন্যূন হইলেও মানমর্যাদায় সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ, ইহাদিগকে কোনও প্রকার দৈহিক শ্রম করিতে হয় না; কিংবা শ্রম দ্বারা ধন উপার্জন করিয়া রাজকোষে প্রদান করিতেও হয় না। রাজ্যের মঙ্গলোদ্দেশ্যে দেবতাগণের যজ্ঞ সম্পাদন ভিন্ন ইহাদিগের অবশ্যকরণীয় আর কোনও কর্তব্য নাই। যদি কোনও ব্যক্তি স্বীয় ইষ্টসিদ্ধির জন্য যজ্ঞ করিতে চাহে তবে তাহাকে ব্রাহ্মণগণ দ্বারা তাহা সম্পন্ন করাইতে হয়। অন্যথা তাহা দেবগণের প্রীতিপ্রদ হয় না। ভারতবাসিগণের মধ্যে কেবল ইহাঁরাই ভবিষ্যৎ গণনা করিতে সমর্থ। ব্রাহ্মণ ভিন্ন আর কাহারও ভবিষ্যৎ গণনা করিবার অধিকার নাই। ইহারা বৎসরের বিভিন্ন ঋতু ও রাজ্যে কোনও বিপৎপাত হইবে কিনা এতদনুরূপ বিষয়ে গণনা করিয়া থাকেন, কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের ভাগ্যগণনা করিতে তাঁহাদিগের অভিরুচি হয় না। তাহার কারণ এই যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপারের সহিত ভবিষ্যদ্গণনার কোনও সম্পর্ক নাই কিংবা এজন্য শ্রম করা তাঁহারা অগৌরবের বিষয় মনে করেন। যিনি গণনায় তিন বার ভ্রম করেন তাঁহাকে আর কোনও দণ্ড ভোগ করিতে হয় না, কেবল অবশিষ্ট জীবনের জন্য মৌনব্রত অবলম্বন করিতে হয়। যিনি এই মৌনব্রত গ্রহণ করিয়াছেন তাঁহাকে বাঙ্নিষ্পত্তি করিতে বাধ্য করিতে পারে এমন জন সংসারে নাই। [এই পণ্ডিতগণ উলঙ্গ হইয়া বিচরণ করেন। ইহাঁরা শীতকালে রৌদ্রসম্ভোগের উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত বায়ুতে বাস করেন; গ্রীষ্মকালে উত্তাপ অত্যন্ত প্রখর হইলে মাঠে ও নিম্ন ভূমিতে বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষের ছায়ায় কালাতিপাত করেন।
নেয়ার্খস বলেন, এই সকল বৃক্ষের ছায়া চতুর্দিকে পাঁচ শত ফুট বিস্তৃত, এবং উহাতে দশ সহস্র লোক স্থান পাইতে পারে। এই বৃক্ষগুলি এমন প্রকাণ্ড। তাঁহারা প্রতি ঋতুর ফল ও বৃক্ষের ত্বক্ আহার করিয়া প্রাণ ধারণ করেন; এই ত্বক্ খর্জ্জুর ফল অপেক্ষা কম সুস্বাদু ও পুষ্টিকর নহে।]
ইঁহাদিগের পরে দ্বিতীয় জাতি কৃষকগণ। ইহারা সংখ্যায় ভারতবাসীদিগের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক। ইহাদিগকে যুদ্ধার্থ অস্ত্রধারণ করিতে হয় না, কিংবা যুদ্ধের সাহায্যার্থ কোনও কার্য করিতে হয় না; কিন্তু ভূমি কর্ষণ করাই ইহাদিগের একমাত্র কর্ম। ইহারা রাজাকে ও যে সকল নগরে রাজার পরিবর্তে স্বাতন্ত্র্য (Autonomy) প্রতিষ্ঠিত তাহাদিগকে কর প্রদান করে। ভারতবাসীদিগের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ উপস্থিত হইলে সৈন্যগণের পক্ষে কৃষকদিগকে উৎপীড়িত কিংবা ক্ষেত্রউচ্ছিন্ন করিবার বিধি নাই। তাহারা প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া পরস্পরকে বধ করে আর অদূরে কৃষকগণ নিরুপদ্রবে আপন আপন কর্ম করে এবং ভূমি কর্ষণ, শন্য সংগ্রহ, বৃক্ষপল্লব ছেদন কিংবা শস্য কর্তনে নিযুক্ত থাকে।
ভারতবাসীদিগের তৃতীয় জাতি রাখাল অর্থাৎ গোপাল ও মেযপাল। ইহারা গ্রামে কিংবা নগরে বাস করে না। ইহারা যাযাবর, পর্ব্বতোপরি অবস্থান করে। ইহারাও কর প্রদান করে, তাহা গো মেষ। ইহারা পক্ষী ও বন্য পশুর জন্য দেশময় বিচরণ করে।
চতুর্থ জাতি শিল্পী ও পণ্যজীবী। ইহারা রাজভৃত্য; ইহাদিগকে শ্রমলব্ধ ধন হইতে কর প্রদান করিতে হয়; কিন্তু যাহারা যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ করে তাহাদিগকে কর দিতে হয় না, বরং তাহারা রাজকোষ হইতে বেতন পায়। নৌ-নির্মাতৃগণ এবং নদীবক্ষে নৌকাপরিচালনে নিযুক্ত নাবিকগণও এই জাতির অন্তর্ভূত।
পঞ্চম জাতি ভারতবর্যের যোদ্ধাগ্ণ। ইহারা সংখ্যায় কৃষকগণেরই নিম্নে অর্থাৎ দ্বিতীয় স্থানীয়; কিন্তু ইঁহারা যৎপরোনাস্তি স্বাধীনতা ও সুখসম্ভোগে কালযাপন করেন। ইঁহাদিগকে কেবল যুদ্ধ ও তৎসম্পর্কিত কর্ম করিতে হয়। অপরে ইঁহাদিগের অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ করে, অপরে ইঁহাদিগের জন্য অশ্ব আহরণ করে; শিবিরে অপরে ইঁহাদিগের সেবা করে. ঘোটকের পরিচর্যা করে, প্রহরণ মার্জিত করে, হস্তী পরিচালন করে, রথ সজ্জিত করে ও সারথি হইয়া রথ চালায়। আর ইঁহারা যুদ্ধ করিবার আবশ্যক হইলে যুদ্ধ করেন এবং সন্ধি স্থাপিত হইলে সুখসম্ভোগে নিমগ্ন হন। ইঁহারা রাজকোষ হইতে এমত প্রচুর বেতন প্রাপ্ত হন যে তাহাতে স্বচ্ছন্দে আপনাদিগের ও অপরের ভরণপোষণ নির্বাহিত হয়।
ষষ্ঠ জাতি পর্যবেক্ষক (Episcopoi) নামে অভিহিত ব্যক্তিগণ। গ্রামে ও নগরে কখন কি হইতেছে ইঁহারা তাহার অনুসন্ধান করেন; এবং অনুসন্ধানের ফল যে সকল রাজ্যে রাজা আছে তথায় রাজার নিকট ও যে সকল রাজ্য স্বতন্ত্র তথায় শাসনকর্তাদিগের নিকট প্রেরণ করেন। ইঁহাদিগের পক্ষে মিথ্যা সংবাদ প্রদান করিবার বিধি নাই; বস্তুত কোন ভারতবাসীই মিথ্যাকথন দোষে দোষী নহে।
সপ্তম জাতি সচিবগণ। ইঁহারা রাজাকে ও স্বতন্ত্র নগরসমূহে শাসনকর্তাদিগকে রাজকার্যে পরামর্শ প্রদান করেন। এই জাতি সংখ্যায় অল্প, কিন্তু জ্ঞানে ও ন্যায়পরায়ণতায় সর্বশ্রেষ্ঠ। ইঁহারাই মণ্ডলাধিপতি (Nomarchai), অধস্তন শাসনকর্তা, কোষাধ্যক্ষ, সেনাপতি, পোতাধ্যক্ষ, কার্যাধ্যক্ষ (Tamiai) ও কৃষিপরিদর্শক নিযুক্ত করেন।
এক জাতির সহিত অপর জাতির বিবাহ বিধিসঙ্গত নহে; যেমন, কৃষক শিল্পীদিগের মধ্যে কিংবা শিল্পী কৃষকদিগের মধ্যে বিবাহ করিতে পারে না। কাহারও পক্ষে দুই ব্যবসায় অবলম্বন করা কিংবা এক জাতি হইতে অপর জাতিতে প্রবেশ করাও বিধিসঙ্গত নহে—যেমন রাখাল কৃষক হইতে পারে না কিংবা শিল্পী রাখাল হইতে পারে না। কেবল জ্ঞানী (অর্থাৎ সন্ন্যাসী) সকল জাতির লোকেই হইতে পারে, কেননা জ্ঞানীর জীবনযাত্রা সহজসাধ্য নহে, প্রত্যুত উহা সর্বাপেক্ষা কঠিন।