মেগাস্থেনীসের ভারত-বিবরণ (১৯৪৪)/৩৩তম অংশ

ষ্ট্রাবো

ভারতবাসিগণের সাতটি জাতি

 মেগাস্থেনীস বলেন, ভারতবর্ষের অধিবাসিগণ সাতটি জাতিতে বিভক্ত। পণ্ডিতগণ (Philosophoi) মানমর্যাদায় সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু সংখ্যায় সর্বাপেক্ষা ন্যূন। কেহ যজ্ঞ কিংবা অপর কোনও ধর্মানুষ্ঠান সম্পাদন করিতে চাহিলে ইঁহাদিগের সাহায্য গ্রহণ করেন। রাজাও ইঁহাদিগকে মহাসমিতি নামে অভিহিত প্রকাশ্য সভাতে আহ্বান করেন। তদুপলক্ষে সমুদায় পণ্ডিতগণ নববর্ষের প্রারম্ভে রাজপ্রাসাদের দ্বারদেশে রাজার সম্মুখে সমবেত হন; তখন কেহ সাধারণের হিতকর কিছু লিখিয়া থাকিলে, কিংবা শস্য ও পশু, ও রাজ্যের উন্নতিবিধায়ক কিছু পর্যবেক্ষণ করিয়া থাকিলে তাহা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেন। যদি কাহারও গণনা তিন বার মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হয় তবে তাঁহাকে যাবজ্জীবন মৌনী থাকিতে হয়, ইহাই বিধি। কিন্তু যাঁহারা হিতকর উপদেশ প্রদান করেন তাঁহারা কর ও শুল্ক হইতে অব্যাহতি পাইয়া থাকেন।

 দ্বিতীয় জাতি কৃষকগণ। ইহারা সর্বাপেক্ষা নিরীহ ও সংখ্যায় সর্বাপেক্ষা অধিক। ইহাদিগকে যুদ্ধ করিতে হয় না; ইহারা নির্ভয়ে আপন আপন কর্মে নিযুক্ত থাকে। ইহারা কখনও নগরে গমন করে না—তথাকার বিবাদ কোলাহলে যোগ দিবার জন্যও নহে, অপর উদ্দেশ্যেও নহে। সুতরাং প্রায়শই দেখা যায়, একই সময়ে একই স্থানে যোদ্ধাগণ যুদ্ধার্থ সজ্জিত হইয়াছে ও জীবনপণ করিয়া সংগ্রাম করিতেছে আর কৃষকগণ নির্বিঘ্নে ভূমিখনন ও কর্ষণ করিতেছে, কারণ সৈন্যগণই তাহাদিগের রক্ষক। সমুদায় ভূমিই রাজার। কৃষকগণ শ্রমের বিনিময়ে উৎপন্ন শস্যের চতুর্থাংশ প্রাপ্ত হয়।

 তৃতীয় জাতি পশুপালক ও ব্যধগণ। কেবল ইহারাই শিকার, পশুপালন এবং ভারবাহী পশু ক্রয় ও তাহার ব্যবসায় করিতে পারে। ইহারা দেশকে বন্যপশু ও বীজভোজী পক্ষী হইতে মুক্ত রাখে এবং তজ্জন্য রাজার নিকট হইতে শস্য প্রাপ্ত হয়। ইহারা যাযাবর, শিবিরে জীবন যাপন করে।

 পশুপালক ও ব্যাধগণের পরে চতুর্থ জাতি। শিল্পী, পণ্যজীবী ও দৈহিক শ্রমে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এই জাতিভুক্ত। ইহাদিগের মধ্যে কাহাকে কাহাকেও কর দিতে হয় ও রাজ্যের জন্য নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদন করিতে হয়। কিন্তু যাহারা অস্ত্রশস্ত্র ও নৌকা নির্মাণ করে তাহারা রাজকোষ হইতে বেতন ও আহার্য প্রাপ্ত হয়। কারণ ইহারা কেবল রাজার জন্য শ্রম করে। সেনাপতি সৈন্যদিগকে অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করেন, এবং পোতাধ্যক্ষ উপযুক্ত অর্থ লইয়া যাত্রী ও পণ্যজাত বহনের জন্য নৌকা যোগাইয়া থাকেন।

 পঞ্চম জাতি যোদ্ধাগণ। ইঁহারা যুদ্ধ ভিন্ন অপর সময়ে আলস্যে ও মদ্যপানে জীবন অতিবাহিত করেন। রাজকোষ হইতে ইঁহাদিগের ভরণপোষণের ব্যয় নির্বাহিত হয়, সুতরাং ইঁহারা আবশ্যক হইলেই যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করিতে প্রস্তুত আছেন, কারণ ইহাদিগকে স্বীয় দেহ ভিন্ন আর কিছুই সঙ্গে লইয়া যাইতে হয় না।

 ষষ্ঠ জাতি পর্যবেক্ষকগণ। ইহাদিগকে রাজ্যের সমুদায় ঘটনা অনুসন্ধান করিয়া গোপনে রাজাকে জানাইতে হয়। ইঁহারা কেহ নগরে কেহ শিবিরে স্থাপিত হন এবং উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য নগরের ও শিবিরের বারাঙ্গনাদিগকে সহায় রূপে গ্রহণ করেন। সর্বাপেক্ষা দক্ষ ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিরাই এই কর্মে নিযুক্ত হইয়া থাকেন।

 সপ্তম জাতি রাজার সচিব ও মন্ত্রিগণ। রাজ্যের সর্বোচ্চপদসমূহ, ন্যায়াধিকরণ ও দেশশাসনের সাধারণ কর্ম—সমুদায়ই ইহাদিগের হস্তে।

 এক জাতির লোক অপর জাতিতে বিবাহ করিতে পারে না কিংবা অপর জাতির ব্যবসায় অবলম্বন করিতে পারে না, এবং পণ্ডিতগণ ভিন্ন কেহই একাধিক কর্মে নিযুক্ত হইতে পারে না। পণ্ডিতগণ ধর্মনিষ্ঠ বলিয়া এই অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছেন।