মেগাস্থেনীসের ভারত-বিবরণ (১৯৪৪)/৩৪তম অংশ

ষ্ট্রাবো

শাসনপ্রণালী

ঘোটক ও হস্তী ব্যবহার

 শাসনকর্তৃগণের মধ্যে কেহ কেহ ক্রয়-বিক্রয়ের স্থানে কেহ কেহ নগরে এবং কেহ কেহ শিবিরে প্রতিষ্ঠিত। কেহ কেহ নদীসমূহ পর্যবেক্ষণ করেন ও ঈজিপ্ট দেশের মত ভূমি পরিমাপ করেন। যাহাতে সকলেই সমভাবে জল প্রাপ্ত হয় এতদুদ্দেশ্যে যে সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পয়ঃপ্রণালী দ্বারা বৃহত্তর প্রণালী হইতে জলধারা আনীত হয় ইঁহারা সেগুলির তত্ত্বাবধান করেন। এই সকল পয়ঃপ্রণালী ইচ্ছানুরূপ বন্ধ করা যায়। ইঁহারা শিকারীদিগের উপর কর্তৃত্ব করেন, এবং যে যেমন উপযুক্ত তাহাকে সেইরূপ পুরষ্কৃত বা দণ্ডিত করেন। ইঁহারা কর সংগ্রহ করেন, এবং ভূমি সম্বন্ধীয় যাবতীয় কার্য—যথা, কাঠুরিয়া, সূত্রধর, কর্মকার ও খনি-খননকারীদিগের কার্য—পরিদর্শন করেন। ইঁহারা পথ নির্মাণ করেন ও প্রতি দশ ষ্টাডিয়ম (অর্থাৎ এক ক্রোশ) অন্তর এক একটি স্তম্ভ স্থাপন করেন; তাহাতে পথের দূরত্ব ও শাখাপথগুলি বুঝিতে পারা যায়।

 নগরের শাসনকর্তৃগণ ছয় দলে বিভক্ত; এক এক দলে পাঁচ জন লোক। প্রথম দল শ্রমজাতশিল্প পর্যবেক্ষণ করেন। দ্বিতীয় দল বিদেশাগত ব্যক্তিগণের সৎকার করেন। ইঁহারা তাহাদিগকে বাসগৃহ প্রদান করেন ও তাহারা কিরূপ জীবনযাপন করে ভৃত্যগণের সাহায্যে তাহার উপর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। তাহারা স্বদেশে প্রত্যাগমন করিতে চাহিলে ইঁহারা সঙ্গে গমন করেন; কাহারও মৃত্যু হইলে তাহার সম্পত্তি (তাহার আত্মীয়গণের নিকট) পাঠাইয়া দেন। তাহারা পীড়িত হইলে ইঁহারা তাহাদিগের সেবাশুশ্রূষা করেন ও মৃত্যুমুখে পতিত হইলে তাহাদিগকে মৃত্তিকায় প্রোথিত করেন। তৃতীয় দল, কোথায় কিরূপে কাহারও জন্ম বা মৃত্যু হইল তাহা অনুসন্ধান করেন; শুধু কর ধার্যকরণের উদ্দেশ্যে নহে, কিন্তু উচ্চ নীচ কাহারও জন্ম বা মৃত্যু অজ্ঞাত না থাকে এই অভিপ্রায়ে। চতুর্থ দল ব্যবসায় বাণিজ্য পর্যবেক্ষণ করেন। ইঁহারা তৌল ও পরিমাণ পরিদর্শন করেন এবং প্রত্যেক ঋতুর শস্য যাহাতে প্রকাশ্য ভাবে বিক্রীত হয় তৎপ্রতি দৃষ্টি রাখেন। দ্বিগুণ শুল্ক প্রদান না করিলে কেহই একাধিক বস্তুর ব্যবসায় করিতে পারে না। পঞ্চম দল সূক্ষ্ম বা যন্ত্রোৎপন্ন শিল্পের তত্ত্বাবধান করেন এবং এগুলি প্রকাশ্য ঘোষণা দ্বারা [] বিক্রয় করেন। নূতন দ্রব্য এক– স্থানে ও পুরাতন দ্রব্য অপর স্থানে বিক্রীত হয়; উভয়কে মিশ্রিত করিলে অর্থদণ্ড হইয়া থাকে। সর্বশেষে, যষ্ঠ দল সেই সকল ব্যক্তিকে লইয়া গঠিত যাঁহারা বিক্রীত পণ্যের মূল্যের দশমাংশ সংগ্রহ করেন। যে এই শুল্ক প্রদানে প্রবঞ্চনা করে তাহার দণ্ড মৃত্যু। স্বতন্ত্র ভাবে এই সমুদায় দল এই সকল কার্য করিয়া থাকেন। মিলিত ভাবে ইঁহারা আপন আপন বিশেষ কর্ম ভিন্ন রাজ্যের সাধারণ কার্যও সম্পাদন করেন; যেমন রাজকীয় হর্ম্যগুলি সংস্কৃত অবস্থায় রক্ষা করা, পণ্যদ্রব্যের মূল্যনির্ধারণ এবং ক্রয়বিক্রয়ের স্থান, বন্দর ও দেবমন্দিরসমূহের তত্ত্বাবধান।

 নগরের শাসনকর্তৃগণের পরে তৃতীয় এক দল রাজপুরুষ আছেন ইঁহারা সৈন্য সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য নির্বাহ করেন। ইঁহারাও পাঁচ পাঁচ জন করিয়া ছয় দলে বিভক্ত। এক দল পোতাধ্যক্ষের সহিত ও আর এক দল বলীবর্দ যুগগুলির তত্ত্বাবধায়কের সহিত মিলিত হইয়া কার্য করিবার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হন। বলীবর্দ যুগগুলি যুদ্ধের যন্ত্র বা অস্ত্রশস্ত্র, সৈন্যগণের আহার্য, গবাদির জন্য ঘাস ও বুদ্ধের অন্যান্য উপকরণ বহণ করে। ইঁহারা ভেরীবাদক ও ঘণ্টাবাহক ভৃত্য যোগাইয়া থাকেন। ইঁহারা অশ্বের পরিচারক, যন্ত্রনির্মাতা ও তাহাদিগের সহযোগীও সংগ্রহ করেন। ইঁহারা ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে ঘাস সংগ্রহের জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন এবং এই কার্য যাহাতে সত্বর ও নিরাপদে সম্পন্ন হয় দণ্ড ও পুরস্কার দ্বারা তাহার ব্যবস্থা করেন। তৃতীয় দল পদাতিক সৈন্যের, চতুর্থ দল অশ্বারোহীদিগের, পঞ্চম দল রথের ও ষষ্ঠ দল হস্তীসকলের তত্ত্বাবধান করেন। রাজকীয় অশ্বশালা ও হস্তীশালা আছে, রাজকীয় অস্ত্রাগারও আছে, তাহাতে প্রত্যেক সৈন্যকে অস্ত্রশস্ত্র প্রত্যর্পণ করিতে হয়। এইরূপে হস্তী ও অশ্বও প্রত্যর্পণ করিতে হয়। ভারতবাসীরা বল্গা ব্যতীতই হস্তী চালায়। যুদ্ধযাত্রাকালে বলীবর্দগুলি রথ টানে, ঘোটকগুলিকে গলদেশে রজ্জুবদ্ধ করিয়া লইয়া যাওয়া হয়, নতুবা রথ টানিলে তাহাদিগের পদে ক্ষত ও তেজ খর্ব হইতে পারে। প্রত্যেক রথে সারথির পার্শ্বে দুই জন যোদ্ধা দণ্ডায়মান থাকে। হস্তিপৃষ্ঠে চারি জন লোক থাকে, এক জন মাহুত, অবশিষ্ট তিন জন তীর বর্ষণ করে।


  1. গ্রীক apo syssemoy—by public notice (McCr.); with official stamp, রাজকীয় মুদ্রাঙ্কিত করিয়া (V. A. Smith)। ইনি বলেন, চাণক্যের গ্রন্থে পণ্যদ্রব্য মুদ্রাঙ্কিত করিবার অনুজ্ঞা আছে!