মেরী কার্পেণ্টার/জন্ম ও শৈশব শিক্ষা

জন্ম ও শৈশব শিক্ষা।

মেরী কার্পেণ্টার ১৮০৭ খৃষ্টাব্দে ৩রা এলে ইংলণ্ডের অন্তর্গত এক্সিটার্ (Exeter) নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা ডাক্তার ল্যাণ্ট কার্পেণ্টার্ (Dr. Lant Carpenter) এই নগরের ধর্মাচার্য্য ছিলেন। তাঁহার মাতাও অতিশয় ধর্ম্মশীলা নারী ছিলেন। পিতা মাতা হইতেই তিনি তাঁহার ধর্ম প্রবণা প্রকৃতি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। শৈশব ও শিক্ষা। অসাধারণ স্মরণ-শক্তি এবং প্রখরা বুদ্ধি থাকাতে, শৈশবে তাঁহার বিদ্যাশিক্ষা অতি সহজসাধ্য এবং দ্রুত হইয়াছিল। পরজীবনের কার্য্যকুশলতা এবং জগতের প্রয়ােজনে নিযুক্ত হইবার আকাঙ্ক্ষার অঙ্কুর অতি শৈশবেই দেখা গিয়াছিল। তিনি দুই বৎসর বয়সে যখন পিতার সহিত ভ্রমণে বহির্গত হইতেন, তখন ক্ষেত্রে কৃষকদিগকে পরিশ্রমে নিযুক্ত দেখিয়া শৈশবের আধ আধ ভাষায় বলিতেন “I want to be useful, I want to be useful” অর্থাৎ আমি কাজের লােক হইতে চাই; পিতা যতক্ষণ না তাঁহাকে কোন কার্য্য করিতে দিতেন, ততক্ষণ শান্ত হইতেন না। তিন বৎসর বয়সেই ধর্ম্মভাব তাঁহার হৃদয়ে অতি আশ্চর্য্যরূপে অঙ্কুরিত হইয়াছিল। বাল্যকালেই পিতার পরােপকারপ্রবৃত্তি পূর্ণরূপে তাঁহার হৃদয় অধিকার করিয়াছিল। তিনি বার বৎসর বয়সে তাঁহার পিতার রবিবাসরীয় বিদ্যালয়ে বালকবালিকাদিগকে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন; এই অল্প বয়সেই বালকবালিকাদিগের উপর আশ্চর্য্য প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন। এক দিকে যেরূপ পিতার কার্য্যে সহায়তা করিতে আরম্ভ করেন, অন্য দিকে স্কুলে লাটিন্ ও গ্রীক্ ভাষা এবং গণিত,প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা অধ্যয়ন করিতে থাকেন; ভূবিদ্যা এবং বিজ্ঞানের সহজ তত্ত্বগুলিও এই বয়সেই আয়ত্ত করিয়া ফেলিয়াছিলেন। তাঁহার সহাধ্যায়ী মহাত্মা ডাক্তার্ মার্টিনো (Dr. Martineau) বলিয়াছেন,—“আমি সর্ব্বপ্রথমে যখন কুমারী কার্পেণ্টারকে দেখি; তখন তাঁহার বয়স বার বৎসর। এই অল্প বয়সেই তাঁহার গাম্ভীর্য্য এবং ধীরতা দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হই। তাঁহার সম্মুখে আসিলেই নিজেকে কত হীন মনে হইত; যখন তাহার সহিত কথা বলিতাম, তখন নিজের জ্ঞানের অল্পতা বুঝিতে পারিতাম।”

 ১৮১৭ খৃষ্টাব্দে তাঁহার পিতা ব্রিষ্টল্ নগরে স্থানান্তরিত হন। শৈশবের ক্রীড়াভূমি এক্সিটার পরি-ত্যাগ করিতে তাঁহার তরুণ হৃদয়ে অতি আঘাত লাগিয়াছিল; কিন্তু, এই ব্রিষ্টল্ নগরেই তাঁহার পর-জীবনের মহৎ কার্য্যাবলীর সূচনা হয়। ১৮২৭ খৃষ্টাব্দে তিনি কয়েকটি বালিকার শিক্ষাকার্যের ভার লইয়া শিক্ষয়িত্রীর কার্য্য। ওয়াইট্ দ্বীপে গমন করেন। তৎপরে বিদেশ-ভ্রমণে বহির্গত হন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়া তিনি তাঁহার পিতার স্থাপিত বিদ্যালয়ে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন। এই কার্য্যে তাঁহার মাতা ও ভগিনী তাঁহাকে সাহায্য করেন। পূর্ব্বে তাঁহার পিতাই এই বিদ্যালয়ে প্রধানতঃ শিক্ষা দিতেন; কিন্তু, এই সময় হইতে তিনি শিক্ষকতা পরিত্যাগ করিয়া ধর্ম্মাচার্য্যের কার্য্যেই সম্পূর্ণরূপে নিযুক্ত হন। তৎপরে ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে মেরী কার্পেণ্টার্ রবিবাসরীয় বিদ্যালয়ের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টের পদ গ্রহণ করিলেন। এই সময়ে তাঁহার ছাত্রদের তত্ত্বাবধান উপলক্ষে তাহাদের গৃহে গমন করিয়া, এই সকল দরিদ্র এবং অজ্ঞান বালকদিগের দুর্দশা উপলব্ধি করেন। ঈশ্বর তাঁহাকে যে মহৎ কার্য্যের জন্য এ জগতে প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহার ভাব এখন হইতে তাঁহার প্রাণে উদিত হয়। পাপে, তাপে, দারিদ্র্যে নিপীড়িত স্বদেশবাসীর দুঃখ দূর করিতে তিনি কৃতসঙ্কল্পা হন। তাহাদের অজ্ঞান-অন্ধকারাচ্ছন্ন শােচনীয় অবস্থা তাঁহার কোমল প্রাণকে বিগলিত করে। তিনি তাঁহার জীবনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেন এবং সর্ব্বশক্তিমান্ পরমেশ্বরের নিকট বল ভিক্ষা করিয়া পরার্থে আত্মবিসৰ্জন করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। কিন্তু কি ভাবে পরের জন্য আত্মােৎসর্গ করিবেন, কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে, কি কার্য্য করিলে, তাঁহার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে, তাহা তখনও দেখিতে পান নাই; তথাপি সঙ্কল্প পরিত্যাগ করেন নাই। ঈশ্বরই তাঁহার পথ প্রদর্শন করিবেন, এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া তিনি প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। মেরী কার্পেণ্টারের চরিত্রে এই একটি প্রধান গুণ ছিল যে, যাহা একবার মহৎ বলিয়া, সত্য বলিয়া ধরিতেন, শত বাধা, বিপত্তি তাহা হইতে তাঁহাকে বিচলিত করিতে পারিত না। আত্মােৎসর্গের এই ভাবকে সবল করিবার জন্য তিনি এই সময়ে মহৎ জীবনাবলী অধ্যয়ন করেন। ঈশ্বর তাঁহার প্রার্থনা আশ্চর্য্যরূপে পূর্ণ করিলেন এবং জীবনের কার্য্য দেখাইয়া দিলেন।