মেরী কার্পেণ্টার/মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় ও ডাক্তার টকার্‌ম্যান্‌

মহাত্মা রাজা রামমােহন রায়

ডাক্তার টকারম্যান্।

“ক্ষণমিহ সজ্জনসঙ্গতিরেকা

ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা।”

ই মহাজনবাক্য মেরী কার্পেণ্টারের জীবনে সম্যক্‌-রূপে প্রতিফলিত হইয়াছিল। তিনি পরার্থে আত্ম-বিসর্জ্জনে প্রস্তুত হইয়াছিলেন বটে; কিন্তু, কোন্ পথাবলম্বন করিলে শ্রেয়ঃ হইবে, তাহা তখনও অবধারণ করিতে পারেন নাই। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া মহাদুশ্চিন্তার মধ্যে দিন অতি-বাহিত করিতে লাগিলেন।

 পর বৎসরে (১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে) প্রাতঃস্মরণীয় মহাত্মা রাজা রামমােহন রায় এবং আমেরিকার জন-মহাত্মা রাজা
রামমােহন রায়।
হিতৈষী ডাক্তার টকারম্যান্ (Philanthrophist Dr. Tuckerman) ইংলণ্ডে গমন করেন। এই দুই মহাপুরুষের সংসর্গে আসিয়া তাঁহার কার্যকারিণী শক্তি বিকাশ প্রাপ্ত হইল। এই দুই মহাত্মা তাঁহার জীবনের গতি দুই দিকে ফিরাইয়া দিলেন। রাজা রামমােহন রায় ভারতের দিকে তাঁহার মনােযােগ আকর্ষণ করেন এবং ডাক্তার টকারম্যান্ অসহায় দরিদ্র অজ্ঞান বালকবালিকাদিগের সেবার জন্য তাঁহাকে বিশেষরূপে অনুপ্রাণিত করেন। গত জীবনের শিক্ষা, ধর্ম্ম-বিশ্বাস, দৃঢ়চরিত্র তাঁহাকে এই দুই কার্যের জন্য এই নবীন বয়সেই প্রস্তুত করিয়াছিল। অজ্ঞানতিমিরাচ্ছন্ন ভারতের সেই শোচনীয় দিনে রাজা রামমােহন রায় সত্যের জন্য যে প্রকার কষ্ট সহ করেন এবং যেরূপে সকল প্রকার কুসংস্কার, বাধা-বিঘ্ন ছিন্ন করিয়া ইংলণ্ডে গমন করেন, তাহাতে মেরী কার্পেটারের হৃদয় তাঁহার প্রতি গভীর-শ্রদ্ধাবনত হয়। রাজার ধর্ম্ম-বিশ্বাস, অপূর্ব্ব স্বার্থত্যাগ মেরী কার্পেণ্টারের হৃদয়ে ভারতের দুঃখ দূর করিবার ইচ্ছা জাগরিত করিয়া দেয়। ইহার ত্রিশ বৎসর পরে তিনি ভারতবর্ষে আসিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। রাজার মৃত্যুর পর মেরী কার্পেণ্টার্ রাজার সম্বন্ধে একটী অতি গভীরভাবপূর্ণ কবিতা রচনা করেন। রাজার নশ্বর দেহকে যখন ষ্টেপলটন্-সমাধিমন্দিরে প্রােথিত করা হয়, তখন ডাক্তার্ কার্পেণ্টার্ সেই কবিতাটি পাঠ করেন।

"Thy nation sat in darkness, for the night
Of pagan gloom was o’er it. Thou wast born
’Midst superstition’s ignorance forlorn;
Yet in thy breast there glowed a heavenly light

Of purest truth and love; and to thy s ght
Appeared the day-star of approaching morn.
What ardent zeal did then thy life adorn,
From deep degrading guilt to lead aright
Thy fallen people; to direct their view
To that bless’d Sun of Righteousness, whence beams
Guidance to all that seek itfaithfultrue;
To call them to the saviour’s living streams.
The cities of the East have heard thy voice:
‘Nations, behold your God! Rejoice, rejoice!’
Far from thy native clime a sea-girt land
Sits thron’d among the nations; in the breasts
Or all her sons immortal freedom rests;
And of her patriots many a holy band
Have sought to rouse the world from the command
Of that debasing Tyrant who detests
The reign of truth and love. At their behests
The slave is free! and Superstition’s hand
Sinks powerless. Hitherward thy steps were bent
To seek free commune with each kindred soul,
Whose highest powers are ever willing lent
To free their race from Folly’s dark control.
To our blest isle thou didst with transport come:
Here thou hast found thy last, thy silent home,
Bright hopes of inmortality were given
To guide thy dubious footsteps, and to cheer
Thine earthly pilgrimage. How firm and clear
Arose thy faiththat as the Lord hath risen,

So all His followers shall meet in heaven!
Thou art gone from us; but thy memory, dear
To all that knew thee, fades not: still we hear
And see thee yet as with us; ne’er are riven
The bands of Christian love! Thy mortal frame
With us is laid in holy silent rest;
Thy spirit is immortal, and thy name
Shall by thy countrymen be ever blest.
E’en from the tomb thy words with power shall rise,
Shall touch their hearts and bear them to the skies.

 রামমােহন রায়, পৃথিবীর মনীষীদিগের মধ্যে অনন্যসাধা-রণ, ভারতের গৌরবস্থল—বঙ্গের প্রাতঃস্মরণীয় মহাজন। তিনি ভারতের অতি দুঃসময়েই পৃথিবীতে আসিয়াছিলেন। কি ধর্ম্মনীতি, কি সমাজতত্ত্ব, কি রাজনীতি, রাজনীতি,—এমন বিষয় ছিল না—যাহার সংস্কার-কল্পে তাঁহাকে হস্তক্ষেপ করিতে হয় নাই। এমন সর্ব্বতােমুখী প্রতিভা লইয়া অতি অল্প লােকই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। এমন সর্ব্বদেশ ও সর্ব্ব-লােক-মান্য মহাপুরুষের গুণাকৃষ্ট হওয়া কুমারী মেরী কার্পেণ্টারের মত কোমল-হৃদয় পরােপকারিণী রমণীর পক্ষে স্বাভাবিক। মেরী কার্পেণ্টার রাজার নিকট হইতে বহু সদুপদেশ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন এবং “মানবের হিতকর কার্য্য করাই যে, পরমেশ্বরের যথার্থ উপাসনা” তাহা রাজার চরিত্রে বিশেষরূপে উপলব্ধি করিয়াছিলেন এবং রাজার চরিত্রকে আদর্শ করিয়াই আপনাকে কর্ম্ম-সমুদ্রে ভাসাইয়া দিয়াছিলেন। তিনি রাজার প্রতি তাঁহার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রগাঢ় ভক্তির নিদর্শনস্বরূপ রামমােহন রায়ের একখানি জীবন-বৃত্ত লিখিয়াছিলেন। মেরী কার্পেণ্টার্ প্রণীত জীবন-বৃত্ত খানি না থাকিলে আমরা রাজার সম্বন্ধে অনেক বিষয়ে অজ্ঞ থাকিতাম।

 ডাক্তার্ টকারম্যান্ ইংলণ্ডে আসিয়া ডাক্তার কার্পেণ্টারের গৃহে অতিথি হয়েন। মেরী ডাক্তার্ টকারম্যান।কার্পেণ্টার্ ডাক্তার্ টকারম্যানের সহিত একদিন কোন দরিদ্র পল্লীর মধ্য দিয়া গমন করিতেছিলেন, এমন সময় একটী অতি দরিদ্র অপরিচ্ছন্ন বালককে তাঁহাদের সম্মুখ দিয়া দৌড়িয়া পলায়ন করিতে দেখিলেন। ডাক্তার টকারম্যান্ বলিলেন,—“এই বালকের পশ্চাদনুসরণ করিয়া ইহার বাসস্থান পর্যবেক্ষণ করিতে হইবে।” তখন তাঁহার এই উপদেশ যদিও কার্যে পরিণত হয় নাই, কিন্তু এই বাক্য মেরী কার্পেণ্টারের হৃদয়ে বিদ্ধ হইয়া গেল, এবং তদবধি জীবনের একটী গুরুতর কর্তব্যের প্রতি মনােযােগ দেওয়া হইতেছে না, এই চিন্তা তাঁহাকে যাতনা দিতে লাগিল। এই চিন্তাই তাঁহার প্রাণে নব আকাঙ্ক্ষা, নব প্রতিজ্ঞা আনয়ন করে। ইহার ৩৬ বৎসর পরেও তিনি এই ঘটনাকে তাঁহার জীবনের এক শুভ মুহূর্ত্ত বলিয়া স্মরণ করিতেন। তৎপরে ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে ডাক্তার টকারম্যানের উপদেশ-মতে দরিদ্র ব্যক্তিদিগের গৃহ পরিদর্শন করিবার জন্য “ওয়ার্কিং এণ্ড ভিজিটিং সোসাইটী"(Working and Visiting Society) নামে এক সমিতি স্থাপিত হয়। ইহার সভ্যেরা কয়েকটি জেলা নির্দিষ্ট করিয়া লইলেন এবং তন্মধ্যস্থিত দরিদ্র-দিগের নৈতিক এবং আর্থিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। মেরী কার্পেণ্টার্ ইহার সেক্রেটারি হইলেন। তিনি কুড়ি বৎসরের অধিক কাল ইহার সেক্রেটারি ছিলেন। যখন প্রত্যেক সভ্য কয়েকটি স্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া লইলেন, তখন মেরী কার্পেটার্ দরিদ্র-তম এবং অপকৃষ্টতম স্থানগুলি পরিদর্শন করিবার ভার নিজের উপর লইলেন। এই কার্য্যে তিনি নিম্নশ্রেণীর সমুদয় অবস্থা সম্পূর্ণরূপে অবগত হন। এই ব্যক্তিদিগের জঘন্য অবস্থা কত সময় তাঁহার মনে ঘৃণা এবং বিরক্তি সঞ্চার করিত, কত বাধা সম্মুখে উপস্থিত হইত; কিন্তু, তিনি এ সকলই জয় করিয়া কর্ত্তব্য পথে স্থির রহিলেন। প্রায় দেড় বৎসর-পরে তাঁহার কার্য্যের সুফল ফলিল। তাঁহার পরিশ্রম কিঞ্চিৎ সার্থক হইল। এই সময়ের মধ্যেই কত ব্যক্তি অসাধুতা এবং পানাসক্তি পরিত্যাগ করিয়া ঈশ্বরপরায়ণ হইয়াছিল, কত বালকবালিকা পাপ-পঙ্ক হইতে উথিত হইয়া নীতিমান্ হইয়া ছিল। এই কার্য ব্যতীত তিনি একটী দৈনিক বিদ্যালয় এবং রবিবাসরীয় বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন।