য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র/একাদশ পত্র
একাদশ পত্র
আমরা এখন লন্ডন ত্যাগ করে এসেছি। লন্ডনের জনসমুদ্রে জোয়ার ভাঁটা খেলে তা জানো? বসন্তের আরম্ভ থেকে গর্মির কিছুদিন পর্যন্ত লন্ডনের জোয়ার-season। এই সময়ে লন্ডন উৎসবে পূর্ণ থাকে— থিয়েটার, নাচ, গান, প্রকাশ্য ও পারিবারিক ‘বল’, আমোদ-প্রমোদে চার দিক ঘেঁষাঘেঁষি ঠেসাঠেসি। ধনী লোকদের বিলাসিনী মেয়েরা রাতকে দিন করে তোলে। আজ তাদের নাচের নেমন্তন্ন, কাল ডিনারের নেমন্তন্ন, পরশু থিয়েটরে যেতে হবে, তরশু রাত্তিরে ম্যাডাম প্যাটির গান শুনতে যেতে হবে— দিনের চেয়ে রাত্তিরের ব্যস্ত ভাব। সুকুমারী মহিলা, যাঁরা দু পা চললে হাঁপিয়ে পড়েন, দুটো কাজ করলে চোখ উলটে চৌকিতে এলিয়ে পড়েন, একটু গরম হলে অবসন্ন হয়ে পাখার বাতাস খেয়ে খেয়ে সারা হন, যাঁদের সুখশান্তির জন্য শত শত মহিলা-সেবকেরা দিন রাত্রি প্রাণপণ করছেন— চৌকিটা সরিয়ে দেওয়া, প্লেটটা এগিয়ে দেওয়া, দরজাটা খুলে দেওয়া, মাংসটা কেটে দেওয়া, পাখাটা কুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি উপায়ে যাতে কুসুমসকুমারতনু অবলাদের তিলমাত্র শ্রম স্বীকার না করতে হয় তার চেষ্টা করছেন, তাঁরা রাত্তিরের পর রাত্তির নটা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত গ্যাসের ও মানুষের নিশ্বাসে গরম ঘরের মধ্যে অবিশ্রান্ত নৃত্য করছেন; সে আবার আমাদের দেশের মতো অলস নড়ে চড়ে বেড়ানো বাই-নাচের মতো নয়, অনবরত ঘুরে ঘুরে দৌড়ে বেড়ানো। একে শ্যাম্পেনের তরঙ্গ মাথায় গিয়ে আবর্ত তুলেছে, তাতে আবার এই অবিশ্রাম ঘুরপাক, এতে মহা মহা জোয়ান পুরুষের মাথা ঘোরবার কথা (পুরুষদের আবার দু রকম মাথা ঘোরে, শ্যাম্পেন ও ঘুরপাকে বাইরের মাথা ও পার্শ্বস্থ সুন্দরী সহনর্তকীর মধুর হাসির প্রভাবে ভিতরের মাথা ঘুরে যায়) এ রকম স্থলে ললিত। বালিকারা কিরকম করে টিকে থাকেন আমি তাই ভাবি— এ পরিশ্রমটা তাঁদের নিজে করতে হয়, কোনো মহিলাভক্ত পুরুষ তাঁদের হয়ে নেচে দেয় না। এই তো গেল আমোদ-প্রমোদ— তা ছাড়া এই সময়ে পার্ল্যামেণ্টের অধিবেশন হয়, ব্যাণ্ডের একতান স্বর, নাচের পদশব্দ, ডিনারটেবিলের হাস্যালাপধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে একটা political কোলাহল লন্ডনের প্রাসাদারণ্য ধ্বনিত করতে থাকে। আমরা নির্জীব পররাজ্যবাসী জাতি, এখানকার political উত্তেজনা না দেখলে হয়তো বুঝতে পারি নে। রক্ষণশীল ও উন্নতিশীল দলভুক্তরা প্রতি রাত্রের পার্ল্যামেণ্টের রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধের বিবরণ কী আগ্রহের সঙ্গে পড়তে থাকে (এমন-কি দোকানদার ও গাড়োয়ান পর্যন্ত), এক-একটা রাজনৈতিক প্রশ্ন নিয়ে কত সভার সৃষ্টি হয় ও কত তুমুল সংগ্রাম বাধে, conservative ও liberalরা দুই পক্ষেই দুই পক্ষের দুর্বল স্থান কী যত্নের সঙ্গে দিনরাত্রি অনুসন্ধান ও আক্রমণ করছে —সে ভাব আমাদের উত্তেজনাশূন্য ঝিমন্ত দেশে দুই প্রহরের রৌদ্রে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে হাই তুলতে তুলতে কল্পনা করা একেবারে অসম্ভব। seasonএর সময় লন্ডন এই রকম নানা প্রকার উত্তেজনায় সরগরম থাকে। তার পরে আবার ভাঁটা পড়তে আরম্ভ হয়, লন্ডনের কৃষ্ণপক্ষ আসে। তখন লন্ডনের আমোদ কোলাহল বন্ধ হয়ে যায়, লোকজন চলে যায়, কেবল অল্পস্বল্প লোক, যাদের শক্তি নেই বা দরকার আছে, বা বাইরে যাবার ইচ্ছে নেই, তারাই লন্ডনে পড়ে থাকে। যখন লন্ডনে season নয় তখন লন্ডন থেকে চলে যাওয়া একটা fashion। আমি একটা বইয়ে (Sketches and Travels in London: Thackeray) পড়েছিলুম যে, এক পরিবার বাড়ির সুমুখে দরজা জানলা সব বন্ধ করে বাড়ির পেছন দিকের ঘরে লুকিয়ে-চুরিয়ে বাস করত, তার কারণ, অন্য লোকেরা তা হলে মনে করবে যে seasonএর সঙ্গে সঙ্গে তারা লন্ডন ছেড়ে চলে গেছে। season ফুরিয়ে গেলে লন্ডনে মুখ দেখাতে হয়তো অনেকের লজ্জা করে, সুতরাং লন্ডন শূন্যপ্রায় হয়ে আসে। South Kensington বাগানে যাও— ফিতে, টুপি, পালক, রেশম, পশম ও গাল-রঙ-করা-মুখের সমষ্টিরা চোখ ঝলসে প্রজাপতির ঝাঁকের মতো বাগান আলো করে বেড়াচ্ছে না; মহা মহা সুন্দরীরা অশ্ব ও রথের উপর থেকে পদাতিকদের প্রতি কটাক্ষের শতন্ত্রী বর্ষণ করছেন না; কুঞ্জচ্ছায়ায় প্রণয়ীযুগল ফুস্ ফুস্ করে কথা কইতে কইতে আপনাদের তুলনায় পৃথিবীর আর-সকল লোককে হতভাগ্য মনে করছে না; বাগান তেমনি সবুজ আছে, সেখেনে তেমনি ফুল ফুটছে, কিন্তু তার জীবন্ত শ্রী চলে গিয়েছে। গাড়ি ঘোড়া লোকজনের হিজিবিজি ঘুচে গিয়ে লন্ডনটা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সম্প্রতি লন্ডনের season ভেঙে গেছে, আমরাও লন্ডন ছেড়ে Tunbridge Wells বলে একটা পাড়াগাঁর মতো জায়গায় এসেছি। অনেক দিনের পর পাড়াগাঁয়ের বাতাস খেয়ে বাঁচা গেল। লন্ডনের বাতাসের মতো বাতাস কোথাও দেখলুম না। হাজার হাজার chimney অর্থাৎ ধূমপ্রণালী থেকে অবিশ্রান্ত পাথুরে কয়লার ধোঁওয়া ও কয়লার গুঁড়ো উড়ে উড়ে লন্ডনের বাতাসের হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করেছে। দু দণ্ড লন্ডনের রাস্তায় বেড়িয়ে এসে হাত ধুলে সে হাত-ধোওয়া জলে বোধ করি কালীর কাজ করা যায়, কয়লার গুঁড়োয় বাতাস এমন ভরপুর। নিশ্বাসের সঙ্গে অবিশ্রান্ত কয়লার গুঁড়ো টেনে মাথায় এক-স্তর কয়লা জমে যায়; মাথার ঘিয়ে ও কয়লার গুঁড়োয় মাথাটাও বোধ হয় অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক দিনের পরে এখানকার সূক্ষ্ম বাতাস টেনে লন্ডনের ভারগ্রস্ত বাতাসের প্রভেদ বুঝতে পারছি। Tunbridge Wells অনেক দিন থেকে তার লৌহপদার্থ মিশ্রিত স্বাস্থ্যকর উৎসের জন্যে বিখ্যাত। এই উৎসের জল খাবার জন্যে এখানে অনেক যাত্রীর সমাগম হয়। আমরা এখেনে এসে কল্পনা করলেম— উৎসটা না জানি কী সুন্দর দৃশ্য হবে—চার দিকে পাহাড় পর্বত গাছপালা থাকবে, ‘সারসমরালকুলকূজিত কনককমলকুমুদকহলারবিকসিত সরোবর’ ‘কোকিলকূজন’ ‘মলয়বীজন’ ‘ভ্রমরগুঞ্জন’ দেখতে ও শুনতে পাব, ও অবশেষে এই মনোরম স্থানে বসন্তসখা পঞ্চশরের প্রহার খেয়ে ও এক ঘটি জল খেয়ে বাড়ি ফিরে আসব! ও হরি! গিয়ে দেখি, একটা হাটের মধ্যে একটা ছোটে। গর্ভ পাথর দিয়ে বাঁধানো, সেখেনে একটু একটু করে জল উঠছে, একটা বুড়ি একটা কাঁচের গেলাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে!— একটা বুড়ি!— একটি গজেন্দ্রগমনা বিম্বৌষ্ঠী কম্বুকণ্ঠী শুকচঞ্চুনাসা কেশরীমধ্যা কোকিলভাষিণী মধুরহাসিনী বিলাসিনী ষোড়শী নলিনীপত্রের ঠোঙা হাতে করে দাঁড়িয়ে নেই (‘ঠোঙা’ কথাটা বড়ো গ্রাম্য হয়ে পড়ল, ওর সংস্কৃতটা কী?) একটা গাউন-জুতো-পরা বুড়ি এক এক পেনি নিয়ে কাঁচের গেলাসে করে জল বিতরণ করছে ও অবসর-মতে একটা খবরের কাগজে গত রাত্রের পার্লামেণ্টের সংবাদ পড়ছে। চার দিকে দোকান বাজার, গাছপালার কোনো সম্পর্ক নেই; সুমুখেই একটা কশাইয়ের দোকান, সেখেনে নানা চতুষ্পদ ও দ্বিপদের মধ্যে ‘হংসমরালকুলের’ ডানা-ছাড়ানো মৃতদেহ দড়িতে ঝুলছে; এই-সব দেখে আমার মন এমন চটে উঠল যে আমার কোনো মতে বিশ্বাস হল না যে, এ জল খেলে আমার কোনো প্রকার রোগ নিবারণ হবে বা শরীরের কোনো প্রকার উন্নতি হবে।
Tunbridge Wells কতকটা পাড়াগাঁয়ের মতো। এটা একটা পাহাড়ে জায়গা। এখেনে এসে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। এখানকার আকাশ মুখ-গোঁ-করা নয়, বাড়িগুলো অনাতিথ্যভাবসূচক নয়, পথিকদের মুখ ঘোরতর ব্যস্তভাবময় নয়, রাস্তাগুলো ঘর্ঘরধ্বনিত পাষাণহৃদয় নয়। আসল শহরটা খুব ছোটো, দু পা বেরোলেই গাছপালা মাঠ জঙ্গল দেখতে পাওয়া যায়। শহরটা অবিশ্যি কতকটা লন্ডনের ছাঁচে গড়া। বাড়িগুলো লন্ডনের মতো থামবারন্দা-শূন্য, ঢালু-ছাত-ওয়ালা সারি সারি একঘেয়ে ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে; অত্যন্ত শ্রীহীন দেখতে। দোকানগুলো তেমনি সুসজ্জিত, পরিপাটী, কাঁচের-জানলা-দেওয়া। কাঁচের ভিতর থেকে সাজানো পণ্যদ্রব্য দেখা যাচ্ছে; কসাইয়ের দোকানে কোনো প্রকার কাঁচের আবরণ নেই, চতুষ্পদদের আস্ত আস্ত শ্রীচরণ ঝুলছে— ভেড়া গোরু শুয়োর বাছুরের নানা অঙ্গ নানা প্রকার ভাবে চোখের সামনে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে, হাঁস প্রভৃতি নানা প্রকার বিচিত্র মরা পাখি লম্বা লম্বা গলাগুলো নীচের দিকে ঝুলিয়ে আছে, আর খুব একটা জোয়ান ভুঁড়িওয়ালা ব্যক্তি হাতে একটা প্রকাণ্ড ছুরি নিয়ে কোমরে একটা আঁচলের মতো কাপড় (apron) ঝুলিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বিলেতের ভেড়া গোরুগুলো তাদের মোটাসোটা মাংস-চর্বি-ওয়ালা শরীরের জন্যে ও সুস্বাদের জন্য বিখ্যাত, যদি কোনো মানুষ-খেগো সভ্য জাত থাকত তা হলে বোধ হয় বিলেতের কসাইগুলো তাদের হাটে অত্যন্ত মার্ষি দামে বিকোত। আমি একটা কসাই রোগা দেখি নি, এমন জোয়ান মোটা ভীষণাকার জানোয়ার খুব অল্প আছে। এখানকার কসাইয়ের দোকানগুলো দেখলে আমার গা শিউরে ওঠে, এখানকার সূক্ষ্মস্নায়ুবিশিষ্ট বিবিরা এ দৃশ্য কী করে সহ্য করেন বলতে পারি নে। অনেক বিবি ইচ্ছে করে বাজার করতে আসেন। ফলের দোকানে বা তরকারীর দোকানে শখ করে বাজার করতে পারা যায়; কিন্তু কসাইয়ের দোকানের মতো অমন নিষ্ঠুর জায়গায় ভদ্রলোকদের কোমলহৃদয়া মেয়েরা কী করে সাধ করে আসেন আমি তাই ভাবি— সকলই অভ্যেস। একজন বিবি বলেন যে, কসাইয়ের দোকান দেখলে তাঁর বেশ তৃপ্তি হয়; তাঁর মনে হয় যে, দেশে আহারের অপ্রতুল নেই, দেশের পেট ভরবার মতো খাবার প্রচুর আছে, দুর্ভিক্ষের কোনো সম্ভাবনা নেই। ইংরেজদের খাবার টেবিলে যে রকম আকারে মাংস এনে দেওয়া হয় তাতেও কেমন অহৃদয়তা প্রকাশ পায়। কেটে কুটে মসলা দিয়ে মাংস তৈরি করে এনে দিলে এক রকম ভুলে যাওয়া যায় যে, একটা সত্যিকার জন্তু খেতে বসেছি; কিন্তু মুখ-পা-বিশিষ্ট একটা আস্ত প্রাণীকে অবিকৃত আকারে টেবিলে এনে দিলে একটা জীবন্ত প্রাণীর মৃতদেহ খেতে বসেছি বলে গা কেমন করতে থাকে। কশাইয়ের দোকানের ওপর অনেক কথা বললুম, কেননা বিলেতে এসে অবধি আমার ঐটের ওপর অত্যন্ত ঘৃণা আছে— সেই ঝাল ঝাড়তে গিয়ে কথাটা অত্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ল। নাপিতের দোকানের জানলায় নানা প্রকার কাঠের মাথায় নানা প্রকার কোঁকড়ানো পরচুলো বসানো রয়েছে, দাড়ি গোঁফ ঝুলছে, শত শত মার্কা-মারা শিশিতে টাক-নাশক চুল-উঠে-যাওয়া নিবারক শত প্রকার অব্যর্থ ওষুধ রয়েছে, দীর্ঘকেশী মহিলারা এই দোকানে গেলে সেবকেরা (সেবিকা নয়) তাঁদের মাথা ধুয়ে দেবে, চুল বেঁধে দেবে, চুল কুঁকড়ে দেবে— এবং এই রকম নানা প্রকার বাহার করে দিতে পারে। এখেনে মদের দোকানগুলোই সব চেয়ে জমকালো দেখতে, সন্ধের সময় সেগুলো আলোয়-আলোয়=আলাকীর্ণ হয়ে যায়; বাড়িগুলো প্রায় প্রকাণ্ড হয়; ভিতরটা খুব বড়ো ও সাজানো ও খদ্দেরের ঝাঁক দোকানের বাইরে ও ভিতরে সর্বদাই, বিশেষতঃ সন্ধেবেলায়, লেগে থাকে। দরজীর দোকানও মন্দ নয়। নানা ফেশানের কোট প্যাণ্টলুন কাঁচের জানলার ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে, বড়ো বড়ো কাঠের মূর্তিকে কাপড় পরিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মেয়েদের কাপড়-চোপড় এক দিকে সাজানো; সে-সকল নানা প্রকার সাজসজ্জা টুকরো-টাকরা আমার মতো একজন বিদেশী bachelorএর কাছে ঘোরতর রহস্য, তার মধ্যে দন্তস্ফুট করা আমার সাধ্য নয়— এইখানে যে কত লুব্ধ নেত্র দিন রাত্রি তাকিয়ে আছে তার সংখ্যা নেই, সাজসজ্জার দিকে সকল দেশের মেয়েদেরই সমান টান। এখানকার বিলাসিনীরা, যাদের নতুন ফেশানের দামী কাপড় কেনবার টাকা নেই, তারা দোকানে এসে দামী কাপড়গুলে। ভালো করে দেখে যায়; তার পরে বাড়িতে গিয়ে সস্তায় নিজের হাতে তৈরি করে। এখানকার দোকান-বাজার-গুলো এই রকম লন্ডনের ছাঁচে তৈরি। আমাদের বাড়ির কাছে একটা খোলা পাহাড়ে জায়গা আছে, সেটা common অর্থাৎ সরকারী জায়গা; চার দিক খোলা, বড়ো গাছ খুব অল্প, ছোটো ছোটো গুল্মের ঝোপ ও ঘাসে পূর্ণ, চার দিক সবুজ, বিচিত্র গাছপালা নেই বলে কেমন ধূ ধূ করছে, কেমন বিধবার মতো চেহারা, উঁচু নিচু জমি, কাঁটাগাছের ঝোপঝাপ— জায়গাটা আমার বেশ লাগে। মাঝে মাঝে এই রকম কাঁটাখোঁচা এবড়ো-খেবড়োর মধ্যে এক-এক জায়গায় এক রকম ছোটো ছোটো নীল ফুল ঘেঁষাঘেঁষি ফুটে সবুজের মধ্যে স্তূপাকার নীল রঙ ছড়িয়ে রেখেছে; কোথাও বা ঘাসের মধ্যে সাদা সাদা ডেজি ও হলদে বাটার-কপ এক রাশ ফুটে রয়েছে— চার দিকে এই রকম একটা অনুর্বর সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝোপঝাপের মধ্যে ও গাছের তলায় একএকটা বেঞ্চি রয়েছে, এইটে সাধারণের বেড়াবার জায়গা। কী ভাগ্যি গাছপালা বসিয়ে এটা বাগান করে তোলা হয় নি, ‘আশ্রমবাসিনী’ প্রকৃতিকে সাজিয়ে-গুজিয়ে ‘শুদ্ধান্তযোগ্যা’ করে তোলা হয় নি। এখানে মানুষ এত অল্প ও জায়গা এত বড়ো যে মানুষের ঘেঁসাধেঁসি নেই, লন্ডনের বড়ো বড়ো বেড়াবার বাগানের মতো যে দিকে চাই সেই দিকেই ছাতা-হস্ত টুপি-মস্তক চোক-ধাঁধক ভিড়ের চার দিক থেকে আনাগোনা নেই; দূর-দূর বেঞ্চির মধ্যে নিরালা যুগলমূর্তি রোদ্দুরে ‘এক ছাতার ছায়ায় বসে আছে; কিম্বা হাত ধরাধরি করে নিরিবিলি বেড়াচ্ছে, পাছে পাশের লোক শুনতে পায় বলে গলা নাবিয়ে কথা কইতে হচ্ছে না কিম্বা প্রাণ খুলে হাসির ব্যাঘাত হচ্ছে না। যাঁরা বলেন গাছ-পালা লতা-পাতা ঘাস-গুল্ম কেবল ছাগল-গোরুদের কাছেই আমোদজনক, আরক্তকপোল আকর্ণচক্ষু আকুঞ্চিতকুন্তলের দিকেই যাদের আন্তরিক টান, তাঁরাও যে এখেনে এসে নিতান্ত নিরাশ হবেন তা নয়; তাই বলছি সব-শুদ্ধ জড়িয়ে common জায়গাটা খুব উপভোগ্য। এখনও গর্মিকাল শেষ হয় নি। এখেনে গর্মিকালে সকাল ও সন্ধে অত্যন্ত সুন্দর। গর্মির পূর্ণযৌবনের সময় রাত দুটো-তিনটের পরে আলো দেখা দিতে আরম্ভ করে, চারটের সময় রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে ও রাত্রি নটা-দশটার আগে দিনের আলো নেভে না। আমি একদিন ৫টার সময় উঠে commonএ বেড়াতে গিয়েছিলুম। উঁচু একটা পাহাড়ের ওপর একটা গাছের তলায় গিয়ে বসলুম, দূরে ছবির মতো শহর দেখা যাচ্ছে, একটি লোকও তখন ওঠে নি, একটুও কোয়াশা নেই, চার-ট্রিক অত্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ঘুমন্ত শহরটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তার নির্জন রাস্তাগুলি, গির্জের উন্নত চূড়া, রৌদ্ররঞ্জিত বাড়িগুলি নীল আকাশের পটে যেন একটি অতি স্পষ্ট ছবির মতো আঁকা। খুব ভালো লাগছে বটে, কিন্তু ভালো লাগার প্রধান কারণ হচ্ছে— একটা শহরের ঘুমন্ত ভাব কল্পনা করা। একটা ঘুমন্ত গ্রামের চেয়ে একটা ঘুমন্ত শহরের গাম্ভীর্য আছে; পরিশ্রম নড়াচড়া ও যুঝাযুঝি ব’লে একটা প্রকাণ্ড দত্য অসহায় শিশুটির মতো ঘুমিয়ে আছে, তার কপাল থেকে ভাবনার ভ্রূকুঞ্চন মিলিয়ে গেছে; মুখের একটা দৃঢ়ভাব চলে গিয়েছে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো শিথিল হয়ে এলিয়ে পড়েছে। দিনের বেলায় আফিসের মূর্তিতে যাকে খারাপ দেখাচ্ছিল এই ঘুমন্ত অবস্থায় তার মুখেই একটু সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে দেখে আমার ভালো লাগে, নইলে আসলে এই শহরটা কিছুই ভালো দেখতে নয়— এখানকার বাড়িগুলো আমি দুচক্ষে দেখতে পারি নে। জানলা-কাটা-কাটা চারটে দেয়াল, একটা ঢালু ছাত ও তার ওপরে ধোঁওয়া বেরোবার কতকগুলো কুশ্রী নল হচ্ছে এখানকার বাড়ির বাহ্য আকার— এ আর কী ভালো দেখাবে বলো। ক্রমে ক্রমে যতই বেলা হতে লাগল শত শত chimney থেকে অমনি ধোঁওয়া বেরোতে লাগল, ধোঁওয়াতে ক্রমে শহরটা অস্পষ্ট হয়ে এল। রাস্তায় ক্রমে মানুষ দেখা দিলে, গাড়ি ঘোড়া বেরোতে আরম্ভ হল, হাতগাড়ি কিম্বা ঘোড়ার গাড়িতে করে দোকানিরা মাংস রুটি তরকারি বাড়িতে বাড়িতে বিতরণ করে বেড়াতে আরম্ভ করলে (এখানে দোকানিরা বাড়িতে বাড়িতে জিনিসপত্র দিয়ে আসে), ক্রমে commonএ লোক জমতে আরম্ভ হল— আমি বাড়ি ফিরে এলেম।
আমার এখানে একটি সাধের বেড়াবার জায়গা আছে, আমি সেখেনে রোজ বিকেলে বেড়াতে যাই। সেটা একটা পাড়াগাঁর রাস্তা, পাথর দিয়ে বাঁধানো কিম্বা খুব সমতল করা নয়, গাড়ির চাকার দাগে এবড়ো-খেবড়ো উঁচুনিচু পাহাড়ে রাস্তা, দুধারে blackberry ও ঘন লতাগুল্মের বেড়া, বড়ো বড়ো গাছে ছায়া করে আছে, রাস্তার আশে পাশে ঘাস উঠেছে ও ঘাসের মধ্যে daisy প্রভৃতি বুনো ফুল ফুটে আছে, পাড়াগাঁয়ের ছোটোলোকেরা ধুলো-কাদা-মাখানো ময়লা কোট প্যাণ্টলুন ও ময়লা মুখ নিয়ে আনাগোনা করছে (বর্ণনার এ অংশটা বড়ো romantic হল না), ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলো তাদের লাল লাল ফুলো ফুলে মুখে বাড়ির দরজার বাইরে কিম্বা রাস্তায় খেলা করছে— এমন মোটাসোটা গোলগাল ছেলে কোনো দেশে দেখি নি। তাদের গাল-দুটোর অযথা প্রাদুর্ভাবে নাক ও চোখ নিতান্ত হীন অবস্থায় উপত্যকার অন্ধকারে পড়ে আছে, হাত-পা-গুলো অত্যন্ত মোটা, গাল দুটো অত্যন্ত লাল—এক-একটা জীবন্ত মাংসের ঢিবি আর-কি। এক-একটা বাড়ির কাছে ছোটো ছোটো পুকুরের মতো আছে, সেখেনে পোষা হাঁসগুলো ভাসছে; মাঠগুলো যদিও পাহাড়ে উঁচুনিচু, কিন্তু চষা জমি- এমন সমতল ও পরিষ্কার যে আমাদের দেশের কোনো সমভূমিতে এমন দেখি নি। ঘাসগুলো অত্যন্ত সবুজ ও তাজা, এখানে রৌদ্র তেমন তীব্র নয় বলে ঘাসের রঙ আমাদের দেশের মতন হেজে যায় না; তাই জন্যে এখানকার মাঠের দিকে চেয়ে থাকতে অত্যন্ত ভালো লাগে, অজস্র সবুজ রঙে চোখ যেন ডুবে যায়, উঁচুনিচু পাহাড় যতদূর দেখা যাচ্ছে ঘাসের সবুজ প্লাবনে প্লাবিত। মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো গাছ ও সাদা সাদা বাড়িগুলো দূর থেকে ছোটো ছোটো দেখাচ্ছে, এই রকম শূন্য মাঠ ছাড়িয়ে অনেক দূরে এসে এক-একটা প্রকাণ্ড পাইন; (pine, কেলু) গাছের অরণ্য পাওয়া যায়, ঘেঁসাথেঁসি pine গাছে অনেক দূর জুড়ে অন্ধকার করে আছে— সে খুব গম্ভীর দেখতে। বাড়িগুলো আমাদের দেশের কুঁড়েঘরের মতো গরিবানা ও গাছপালা ঘাস মাঠের মধ্যে থাকবার উপযুক্ত সুন্দর দেখতে না— সোজা, খাড়া, পরিপাটি দোতালা বাড়ি, বাস করতে খুব আরামের বটে, কিন্তু গাছপালার মধ্যে দেখতে ভালো লাগে না, তবে এক-একটা বাড়ি আপাদমস্তক লতা ও ফুলে ঢেকে গিয়ে খুব ভালো দেখতে হয়েছে।
বর্ণিমা নিয়ে আর বেশি বকাবকি করব না। তুমি হয়তো এতক্ষণ মনে করছ যে, ‘এ ব্যক্তি কোথা থেকে আকাশ-থেকে-পড়া গোটাকতক কথা পেড়ে তাই নিয়ে অনর্গল বকে যেতে লাগল। কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে নি, কেউ জানতে চায় নি, অথচ গায়ে পড়ে ধরে-বেঁধে কতকগুলো লম্বাচৌড়া information দিতে আরম্ভ করলে।’ যা হোক, এখন আমি ছেড়ে দিলুম তুমি কেঁদে বাঁচ।