য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র/দ্বাদশ পত্র

দ্বাদশ পত্র

গর্মি কাল। আজ অতি সুন্দর সূর্য উঠেছে। এখন দুপর দুটো বেজেছে। আমাদের দেশের শীতকালের দুপর বেলাকার বাতাসের মতো বেশ একটি মিষ্টি বাতাস বইছে, রোদ‍্দুরে চার দিক ঝাঁ ঝাঁ করছে। এমন ভালো লাগছে, আর এমন একটু কেমন উদাস ভাব মনে আসছে যে কী বলব। মনের sentimental অবস্থায় যে-যে লক্ষণ হয়ে থাকে তা আমার সব হয়েছে, যথা— নিশ্বাস পড়ছে, একটু চুপচাপ হয়ে আছি, মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেছে ইত্যাদি। কিন্তু আজকের রোদ্দুরে, গরমে, চার দিকের গাছপালায়, বসন্তের বাতাসে, পাখির ডাকে, যদি আমার এ রকম ভাব হয়ে থাকে তা হলে কি ‘লোকটা দেখছি নিতান্তই কবি হয়ে গিয়েছে’ ব’লে আমার একটা বদনাম হবার সম্ভাবনা আছে? দেশে যদি আমার ‘কান্ত’ থাকত তা হলে আজ হয়তো এই দুরন্ত বসন্তে একান্ত প্রাণান্ত ও ‘অন্ত’-অক্ষর-বিশিষ্ট আরও অসংখ্য ঘটনা ঘটত। এ দেশে ‘বসন্ত’ ব’লে বাস্তবিক একটা পদার্থ আছে। আমাদের দেশে বসন্ত নেই, কেবল বসন্ত বসন্ত বসন্ত করে বিরহীগুলো ভারী গোলমাল করে—বলে, মলয় বাতাসে তাদের গা দগ্ধ হয়! আরে, হবে না কেন? সে চৈত্রি মাসের মলয় বাতাসে সহজ মানুষের গা পুড়ে যায়, তাদের তো তবু অনেক দিনকার একটা বাঁধা দস্তুর আছে! সেই বিরহীগণ একবার এখানে আসুন দেখি— দেখি কেমন করে চন্দন আর পঙ্ক মাখেন, আর নলিনীপত্রের বাতাস খান!

 আমরা এখন Devonshireএর অন্তর্গত টর্কী (Torquay) বলে একটা নগরে আছি। এমন সুন্দর জায়গা আমি কখনও দেখি নি। সমুদ্রের ধারে। চার দিকে পাহাড়। অতি পরিষ্কার দিন। মেঘ নেই, কোয়াশা নেই, অন্ধকার নেই— চারি দিক হাস্যময়। চারি দিকে সবুজ বর্ণ, চারি দিকে গাছপালা, চারি দিকে পাখি ডাকছে, ফুল ফুটছে। যখন Tunbridge Wellsএ ছিলুম তখন ভাবতুম, এখেনে যদি মদন থাকে তবে সে ব্যক্তি তার ফুলশর তৈরি করবার জন্যে এত ফুল পায় কোথা? অনেক বনবাদাড় ঝোপঝাপ কাঁটাগাছ হাৎড়ে দু-চারটে বুনো ফুল নিয়েই কাজ চালাতে হয়। কিন্তু Torquayতে মদন যদি গ্যাট্‌লিঙের কামানের মতো এমন একটা বাণ উদ্ভাবন করে থাকে যার থেকে প্রতি মিনিটে হাজারটা করে তীর ছোঁড়া যায়, আর সেই বাণ দিন রাত যদি কাজে ব্যস্ত থাকে, তবু মদনের ফুলশরের তহবিল এখেনে দেউলে হবার কোনো সম্ভাবনা নেই— এত ফুল! যেখানে সেখানে পথে ঘাটে ফুল। ফুল মাড়িয়ে চলতে হয়। আমরা রোজ পাহাড়ে বেড়াতে যাই। গোরু চরছে, ভেড়া চরছে। এক-এক জায়গায় রাস্তা এত ঢালু যে, উঠতে নাবতে কষ্ট হয়। এক-এক জায়গা খুব সংকীর্ণ পথ, দু ধারে গাছ উঠে আঁধার করে আছে, ওঠবার সুবিধের জন্যে জায়গায় জায়গায় ভাঙা ভাঙা সিঁড়ির মতন আছে, পথের মধ্যেই লতাগুল্ম উঠেছে, ফুল ফুটে রয়েছে। চার দিকে এমন মধুর রোদ‍্দুর (হাসছ কী! রোদ‍্দুর মধুর হতে পারে কিনা এখেনে এসে একবার দেখে যাও দিকি!)— এত অগণ্য ফুল যে মনের মধ্যে বসন্ত জেগে ওঠে, মলয় বাতাস বইতে থাকে। এখানকার বাতাস বেশ গরম! ভারতবর্ষ মনে পড়ে। এইটুকু গরমেই লন‍্ডনের প্রাণীদের চেয়ে এখানকার জীবজন্তুদের কত নির্জীব ভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। ঘোড়াগুলো আস্তে আস্তে যাচ্ছে, মানুষগুলোর তেমন ভারী ব্যস্ত ভাব নেই, গড়িমসি করে চলেছে। আমি আজ কাল এমন আলস্যচর্চায় ব্যস্ত আছি যে তোমাদের একটু ভালো করে চিঠি লেখবার সময় পেয়ে উঠি নে। দিনের মধ্যে তিন শো হাই উঠছে, এক-একটা বই খুলছি ও তার ওপরে আধ ঘণ্টা চোখ বুলিয়ে দু ঘণ্টা চোখ বোজবার বন্দোবস্ত করে নিচ্ছি, দোয়াতে কলম ডুবিয়ে কালী তুলে লেখা সমুদ্রমন্থনের মতো একটা ঘোরতর ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে, চোখের পাতা ফেলতে ও নিশ্বাস প্রশ্বাস নিতে পরিশ্রম বোধ হচ্ছে। তুমি এখেনে এলে বড়ো আরামেই থাকো। এখানকার মতো দৃশ্য, নদীর ধার, মাঠ, পড়বার বই, গল্প করবার সময়, গান করবার নির্জনতা, পরনিন্দা করবার অবসর আর যদি কোথাও আছে!

 এখানকার সমুদ্রের ধার আমার বড়ো ভালো লাগে। যখন জোয়ার আসে তখন সমুদ্রতীরের খুব প্রকাণ্ড পাথরগুলো জ্বলে ডুবে যায়, তাদের মাথা বেরিয়ে থাকে। খুব ছোটো ছোটো দ্বীপের মতো দেখায়। জলের ধারেই ছোটো বড়ো কত পাহাড় উঠেছে। ঢেউ লেগে লেগে পাহাড়ের নীচে সব গুহা তৈরি হয়ে গেছে, যখন ভাঁটা পড়ে যায় তখন আমরা এক-এক দিন এই গুহার মধ্যে গিয়ে বসে থাকি। বেশ নির্জন। সুমুখে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র। গুহার মধ্যে জায়গায় জায়গায় অতি পরিষ্কার একটু-একটু জল জমে রয়েছে, ইতস্ততঃ সমুদ্রউদ্ভিদ (seaweeds) পড়ে রয়েছে, সমুদ্রের এক রকম স্বাস্থ্যজনক গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, চার দিকে পাথর ছড়ানো আছে। আমরা সবাই মিলে এক-এক দিন সেই পাথরগুলো ঠেলাঠেলি করে নড়াবার চেষ্টা করি, নানা শামুক ঝিনুক কুঁড়িয়ে নিয়ে আসি। এক-একটা পাহাড় সমুদ্রের জলের ওপর খুব ঝুঁকে পড়েছে, আমরা প্রাণপণ করে এক-এক দিন সেই অতি দুর্গম পাহাড়গুলোর ওপর উঠে বসে নীচে সমুদ্রের ঢেউয়ের উত্থানপতন দেখি। সমুদ্রের একটা হু হু শব্দ উঠছে, জলে এক-একটা ছোটো ছোটো নৌকা পাল তুলে চলে যাচ্ছে, চার দিকে রোদ‍্দুর হাসছে, মাথার ওপর এক-একটা ছাতা খোলা রয়েছে, পাথরের ওপর মাথা দিয়ে আমরা শুয়ে শুয়ে গল্প করছি। আলস্যে কাল কাটাবার এমন জায়গা আর পাবে? তুমি যে Thomsonএর Castle of Indolence পড়েছ— এখানটা তার একটা জীবন্ত ছবি। এক-এক দিন পাহাড়ে যাই আর পাথর-দিয়ে-ঘেরা ঝোপঝাপে-ঢাকা একটি প্রচ্ছন্ন জায়গা দেখলে সেইখানটিতে গিয়ে একটি বই নিয়ে পড়তে বসি। কিন্তু অতি একমনে বই পড়বার জায়গা টর্কী নয়। মনের এমন শিথিল অলস অবস্থায় অত মনোযোগ দেওয়া পোষায় না। তাই যদি পারবে তবে এক দিকে এমন সুনীল সমুদ্র কী করতে, এমন রোদ‍্দুর উঠেছে কেন, এমন অতি পরিষ্কার আকাশ কী জন্যে? দু ছত্র বই পড়বে আর দু দণ্ড সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকবে, চেয়ে থেকে থেকে সাত শো ভাবনা ভাববে, অথচ ভাবছ কি না ভাবছ তা বিশেষ মনোযোগ না দিলে টের পাওয়া যাবে না, হঠাৎ বইয়ের দিকে চোখ পড়বামাত্র আবার পড়া আরম্ভ করবার জন্যে খুব দৃঢ় সংকল্প করবে, কিন্তু দ্বিতীয় ছত্রের একটা কমা পর্যন্ত যেই পৌঁচেছ অমনি মনটা অলক্ষিত ভাবে তোমার হাত ফসকে এমন একটা অদ্ভুত জায়গায় গিয়ে হাজির হবে যে জায়গার বিষয় ইতিপূর্বে তুমি কখনও ভাবও নি। মনটা সমস্ত দিন এই রকম লুকোচুরি খেলে বেড়ায়, একটা বইয়ের দেড় পাতা পড়তে আড়াই দিন লাগে।

 আমি বড়ো বাজে কথা বকে যাচ্ছি, এ কিন্তু টর্কীর বাতাসের গুণে। মনের ভিতর হাজারটা কথা চলাফেরা করে বেড়ায়, কিন্তু কথাগুলো হাত ধরাধরি করে আসে না, পরস্পরের মধ্যে চেনাশুনো নেই, খাপছাড়া দলছাড়া কথাগুলো মনের বড়ো রাস্তা দিয়ে খুব ঘেঁষাঘেঁষি করে চলেছে, কিন্তু পথিকদের মতো কেউ কারও কোনো এলাকা রাখে না। এমন ভাঙাচোরা কথার জোড়াতাড়া চিঠি পড়তে কি তোমাদের ভালো লাগছে?

 তুমি যদি এখানে আসতে, ভাই, তা হলে সমুদ্রের শব্দ শুনতে শুনতে, সমুদ্রের ঢেউ গুনতে গুনতে, ফুলের রাশে মাথা রেখে, ফুলের রেণু গায়ে মেখে, ফুলের মালা গেঁথে গেঁথে, ফুলের মধু খেতে খেতে, সন্ধে বেলায় সাগরবেলায়, দুজনেতে গলায় গলায়, ঘাসের ’পরে গাছের তলায়— গল্প হত, হাসি হত— ঠাণ্ডায় যদি কাশি হত বাড়ি যেতেম, চা খেতেম, হেসে খেলে দিন কাটাতেম। কেমন! লোভ হচ্ছে কি? আমি, ভাই, কবি নই—একটা ঘোরতর কাজের লোক। তবে যে, এ জায়গাটা খুব ভালো লাগছে বলছি তার কারণ হচ্ছে। বরাবর শুনে আসছি ভালো জায়গা দেখলে লোকের ভালো লাগা উচিত। না ভালো লাগলে বড়ো লজ্জার বিষয়। তুমি হচ্ছ কবি মানুষ, ছড়াটড়া লিখে থাক, তুমি এখানে এলে বাস্তবিক তোমার লাগত ভালো।

 একটা গল্প বলি শোনো। আমাদের এখেনে দিন কতক Miss Hও Miss N ছিলেন। Miss H একজন চিত্রকরী। তাঁর বড়ো সুন্দর ছবি আঁকা আসে। তিনি প্রায় প্রত্যহ breakfast খেয়েই সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে ছবি আঁকতে বেরোতেন। Miss N ক্রমিক কবিতা ও নভেল পড়েন ও তিনিও নাকি শুনেছি কাগজে খুব ভালো ভালো sonnet মাঝে মাঝে লিখে পাঠান। মাঝে মাঝে আমরা তাঁদের সঙ্গে বেড়াতে যেতেম। কোনোখানে একটা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, কোথাও বা একটা ভাঙাচুরো বেড়া, কোথাও বা খানিকটা বনজঙ্গল ঝোপঝাপ, কখনো বা এক খণ্ড মেঘের বিশেষ একটা রঙ দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতেন ও শতমুখে ব্যাখ্যা করতেন। আমার তো ভ্যাবাচ্যাক। লেগে যেত, আমি তাদের বিশেষ সৌন্দর্য বড়ো একটা বুঝতে পারতেম না; ঝট্ করে একটা মত ব্যক্ত করতে বড়ো ভয় করত। দ্বিরুক্তিমাত্র না করে তাঁদের মতে সায় দিয়ে যেতেম। রোজ রোজই আমি অতি ভালোমানুষটির মতো তাঁদের প্রতি কথায় বিনীত ভাবে সায় দিয়ে যেতেম। শেষকালে আমার বড়ো লজ্জা বোধ হতে লাগল। একদিন বেড়াতে বেরোবার সময় প্রতিজ্ঞা করলেম, ‘আজ আমি নিজে হতে প্রকৃতির একটা কিছু সৌন্দর্য বের করে আগে থাকতে তাঁদের দেখাব, তাঁদের মুখ থেকে বাহবা নিতেই হবে।’ এই পণ করে তো বেরোনো গেল। চার দিকে নজর ক’রে দেখতে দেখতে চলেছি। চার দিকে ফুল আছে, গাছপালা আছে, পাহাড় পর্বত আছে, কিন্তু সে-সব তো পুরোনো— একটা নতুন কিছু বের করতে হবে। খানিক দূর গিয়ে দেখি একজনদের বাড়ির সুমুখে তারা একটি বাগান তৈরি করেছে, গাছগুলোর ডালপালা কেটে নানাবিধ আকারে পরিণত করা হয়েছে। কোনোটা গোল, কোনোটা বা অষ্টকোণ, কোনোটা মন্দিরের চুড়োর মতো। দেখে তো আমার তাক লেগে গেল। পাছে তাঁরা আগে থাকতে কিছু বলে ফেলেন এই ভয়ে তাঁরা মুখ খুলতে না খুলতে তাড়াতাড়ি আমি চেঁচিয়ে উঠেছি, ‘How beautiful!’ Miss Hকে তার একটা ছবি নিতে অনুরোধ করলেম। Miss H ও Miss N তো একেবারে হেসে আকুল; তাঁরা বলে উঠলেন, ‘Oh Mr. T, surely you are joking!’ Mr. T তো কালবিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি হেসে উঠলেন; যেন তিনি ঘোরতর একটা ঠাট্টা করে নিয়েছেন ও তার জন্যে মনে মনে ভারী তৃপ্তি ও গর্বের উদ্রেক হয়েছে। ভালো করে সামলাতে পেরেছি কিনা বলতে পারি নে। কিন্তু বড়ে। লজ্জা হল! ‘যাবৎ কিঞ্চিৎ’ বাক্যব্যয় না করেছিলেম ‘তাবচ্চ’ যথাকথঞ্চিৎ রূপে শোভা পেয়েছিলেম, কিন্তু প্রথম যে দিনই মুখ খুললেম সেই দিনই এই রকম হাস্যভাজন হতে হল! আমি কিন্তু Miss H ও Miss N-এর ভাব আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলেম না; তাঁরা একটা যাচ্ছেতাই বনবাদাড় দেখলে হাঁ করে চেয়ে থাকতেন আর অমন সুন্দর নানা আকৃতিতে ছাঁটা গাছপালা তাঁদের পছন্দসই হল না! সেদিন একটা ভিক্ষুক একটা ছেঁড়া টুপি পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল; হঠাৎ তাঁদের খেয়ালে কেমন লেগে গেল, তৎক্ষণাৎ তাকে আট গণ্ডা পয়সা (এক শিলিং) দিয়ে দাঁড় করিয়ে ছবি নেওয়া হল। আর, রাস্তা দিয়ে কত মহা মহা সুন্দরী চলে যায়, যাদের একদিন দেখলে তিরিশ দিন মলয় সমীরণ ও চাঁদের কিরণে দগ্ধ করতে থাকে, তাদের সম্বন্ধে তাঁরা একটি কথাও কন না। কেন বলো দেখি। যা হোক, অপ্রস্তুত হয়ে বাড়ি গিয়েই একটা বাংলা কবিতা লিখতে বসলেম। Miss N আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি বাড়িতে চিঠি লিখছি? আমি বিনয়সহকারে হাসতে হাসতে বললেম যে, ‘আমি মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে চেষ্টা করে থাকি, তাই দুই-এক ছত্র কবিতা লিখছি।’ শুনে অবধি Miss Nএর আমার প্রতি ভারী ভক্তি হয়েছে। তিনি মনে করলেন, লোকটা খুব ভাবুক হবে। তিনি তাঁর লেখা দুই-একটা sonnet আমাকে শোনাতে আরম্ভ করলেন। কবিতা পড়তে পড়তে যেখানটা ভালো লাগত আমাকে চেঁচিয়ে শোনাতেন। আমার উচ্ছ্বাস দেখে কে! আমার পূর্বকৃত কোনো ত্রুটি তাঁর আর মনে রইল না। ক্রমে ক্রমে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ ভারী পরিপক্ব হয়ে উঠতে লাগল— এত দূর পর্যন্ত যে, একটা ফুস‍্ফাস্ উঠল। ম—সন্দেহ করলেন যে, Miss Nএর নেত্র রূপ ও বাক্যবাণ-বর্ষণের মধ্যে পড়ে আমার বুকটা দু-তিন টুকরো হয়ে গেছে। আমি তাঁকে বোঝাতে গেলেম, ‘মাথা নেই তার মাথাব্যথা। আমি একটা হৃদয়হীন শীতলশোণিত জীব। আমার হৃদয় দগ্ধও হয় না, ভস্মও হয় না, হারায়ও না, ভাঙেও না, চুরেও না। অমন একটা বিষম নট্‌খোটে পদার্থের আমি কোনো সম্পর্কই রাখি নে।’ তিনি তো বিশ্বাসই করলেন না। তিনি বললেন, ‘courtship চালাও।’ আমার মতো চুপচাপ লাজুক মানুষ কি courtship চালাবার উপযুক্ত নাবিক? আমি কি মশায় তার দিকে হাঁ করে চেয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বেস ফেলতে পারি! ডিনার-টেবিলে আমার দিকে একটা লবণ-দানি সরিয়ে দিলে এমনি অতিমাত্র কৃতজ্ঞতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে চলঢল নেত্রে অত্যন্ত কোমল ভারপূর্ণ হাস্যরসে মুখখানা টস্‌টোসে করে হৃদয়ের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা কি আমার কর্ম! বায়রন থেকে বেছে বেছে এমন কবিতা পড়ে শোনানো যাতে আমার মনের ভাব ব্যক্ত হয়, পড়তে পড়তে বিশেষ একটা লাইনে থেমে অতিশয় করুণরসের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলা, সে-সব কি আমার পোষায়! আমি কি হাঁটু গেড়ে বলতে পারি: সুন্দরি, ত্বমসি মম ভূষণং স্বমসি মম জীবনং ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নং! তোমরা কবি মানুষ তোমরা হলে পারতে। কিন্তু এ কথা নিয়ে আর বেশি ঠাট্টা উচিত নয়— বিষয়টি গুরুতর, একটা মনুষ্যমনের সুখশান্তি নিয়ে কথা হচ্ছে। আমার আলাপী অনেক লোকের মুখেই এই রকম একটা গুজব শুনতে পাচ্ছি যে, আমি ভালোবাসায় পড়েছি ও সেই জন্যে মনে মনে আমার অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে। সংবাদটা অত্যন্ত ভাবনাজনক এবং শুনে অবধি আমি ভারী চিন্তিত আছি। কী করব বলো দেখি? বিবাহের প্রস্তাব করব কি? অবিশ্যি, লোকের মুখে এক কথা শুনেই আমি তাড়াতাড়ি করে বিয়ে করতে যাচ্ছি নে। আমি প্রথমতঃ তদারক করব যে আমি ভালোবাসায় পড়েছি কি না, তার পরে যদি প্রমাণ হয় তা হলে তোমাদের এবং অন্যান্য আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের পরামর্শ নিয়ে যা হয় স্থির করা যাবে। কী বল? তার পরে গল্পের শেষ দিকটা শোনো। সেই বাংলা কবিতাটা লিখছিলেম। চতুর্থ ছত্রে লাইনের শেষে ডেজি (daisy) কথাটা পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার আর কোনো মিল না পেয়ে সেইখেনেই কবিভাটা বন্ধ থাকে। এ দিকে Miss N রোজই আমাকে পীড়াপীড়ি করেন; বলেন, ‘তোমার কবিতাটা অনুবাদ করে শোনাও।’ আমি তো আজকাল করে রোজই স্থগিত রাখি। পরশু দিন তাঁরা এখান থেকে লন‍্ডনে চলে গিয়েছেনও আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ করে গিয়েছেন, কবিতাটা অনুবাদ-সমেত লিখে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কী করা যায় বল তো। ভারী মুশকিলেই পড়েছি। আমি বলি কী, তুমি, ভাই, আমার হয়ে যত শীঘ্র পারো একটা কবিতা লিখে পাঠাও। বিষয়টা কী জান? টর্কী না দেখে টর্কীর বর্ণনা কি অসম্ভব মনে করছ? কিচ্ছুই না। ভালো জায়গা মাত্রেরই যে রকম বর্ণনা করা হয়, সেই রকম করলেই চুকে যাবে। অর্থাৎ, ফুল ফুটছে, পাখি ডাকছে, বাতাস বয়, জ্যোৎস্না ওঠে। যত প্রকার মিষ্টি জিনিস আছে, কোনো প্রকারে কবিতাটার মধ্যে গুঁজে দেওয়া। গাছপালার বর্ণনা সমাপ্ত করে যদি কোনো রকম করে খানিকটা অশ্রুজল, হৃদয়-ভাঙাভাঙি, নিরাশা, প্রিয়তমা, নিবিড় কুন্তল, সুদীর্ঘ নয়ন বসাতে পারো, তা হলেই জিনিসটা সর্বাঙ্গসুন্দর হবে। দেখো, nightingale, violet, forget-me-not, hyacinth প্রভৃতি কথাগুলো বাংলা কবিতার মধ্যে ভালো শোনাবে না। কিন্তু তার জন্যে বেশি ভেবো না। তুমি তো, কোকিল, পাপিয়া, মালতী, মল্লিকা, চামেলি, চম্পা লিখে দিয়ো; তার পরে অনুবাদ করে দেবার সময় আমি যা হয় একটা উপায় করে দেব।

 সমস্ত গল্পটা কি নিতান্ত আজগুবি মনে হচ্ছে? তবে আসল কথাটা খুলে বলছি। এটা আমার কথা নয়। এক ব্যক্তি তাঁর নিজের ঘটনা চিঠিতে আমাকে লিখেছিলেন, তাঁর চিঠি থেকে আমি উদ্ধৃত করে দিলেম। ব্যক্তিটি কে শুনবে? না— কাজ নেই বাপু, তোমরা আবার দশ জনের কাছে গল্প করে বেড়াবে। তোমাদের পেটে যদি একটি কথা থাকে! ভারী কৌতূহল হচ্ছে? আচ্ছা তাঁর নামের প্রথম অক্ষর লিখছি— শ। বুঝেছ?